leadT1ad

আজ আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস

কেমন আছে বাংলাদেশের কন্যাশিশুরা

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশে কন্যাশিশুরা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ধর্ষণ, বাল্যবিয়ে, যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন—প্রায়শই এ ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে তাঁরা। কেউ কেউ খুনের শিকারও হচ্ছে। আবার সহিংসতার শিকার হয়ে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।

গবেষক, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কন্যাশিশুদের মানুষ হিসেবে দেখা এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যৌন শিক্ষা (সেক্স এডুকেশন) পরিচিত করা ছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া সামাজিক পরিসরেও লিঙ্গ সমতার আলোচনা বাড়ানো জরুরি।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম ‘নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ১০৪ কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে, আর ৮৩টি শিশু খুন হয়েছে। যেই ৮৩ কন্যাশিশু খুন হয়েছে, এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ১৫ জন। এ ছাড়া যৌতুকের জন্য চারজন, অন্যান্য কারণে পারিবারিক নির্যাতনে ৩১ জন, পূর্বশত্রুতার কারণে ৯ জন ও প্রেমের সম্পর্কের জেরে পাঁচজন খুন হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে কন্যাশিশুর সঙ্গে সহিংসতা রোধে ১১টি সুপারিশ করা হয়। তার মধ্যে একটি সুপারিশে পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট কঠোরভাবে বন্ধ করার কথা বলা হয়। এর কারণ হিসেবে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পর্নোগ্রাফিতে কনসেন্টের (সম্মতি) ধারণা থাকে না, বরং অবাস্তব ফ্যান্টাসি এই ধরনের কন্টেন্টের উপজীব্য।

এ নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সায়মা আক্তার স্ট্রিমকে বলেন, শিশুদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কনসেন্ট’ বোঝানোর জন্যই তাদের কনসেন্ট (সম্মতি) এবং সেক্স এডুকেশন (যৌন শিক্ষা) নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। অথচ শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যতে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ফলত অনেক শিশু কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিপীড়িত হয়।

অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল, কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করা, শিশু সুরক্ষায় একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠন এবং বাধ্যতামূলকভাবে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল তৈরির মতো বিষয়।

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

কেন হচ্ছে শিশু ধর্ষণ

সাইকোকোচ বাংলাদেশের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সায়মা আক্তার স্ট্রিমকে বলেন, ‘ধর্ষক বা নিপীড়ক কেন ধর্ষণ করছে, এটা বুঝতে আগে নিপীড়কের বেড়ে ওঠার সময়টা কেমন সেটা দেখতে হবে। সে কীভাবে একজন নারীকে দেখছে এটা একটা বড় ইস্যু, সে কি বস্তু হিসেবে শিশুকে দেখছে নাকি মানুষ হিসেবে দেখছে। বেড়ে ওঠার সময় সে কী ধরনের ফ্যান্টাসি নিয়ে বড় হচ্ছে, এটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারও অপরাধপ্রবণতা শিশু পর্নোগ্রাফি থেকে আসে, কেউবা আবার ডার্ক সাইটে বিভিন্ন পেজ থেকে এই ধরনের আইডিয়াগুলো পেয়ে থাকে। কখনো এমন কেস পাওয়া যায় যে সে নিজে হয়ত ভুক্তভোগী ছিল, সে আবার অন্যের ক্ষেত্রে নিপীড়ক হয়ে ওঠে। আবার যে ভুক্তভোগী সে দেখা যায় বারবার ভুক্তভোগী হয়। ভুক্তভোগীর যেহেতু অতি সংবেদনশীলতা (হাইপার সেনসিটিভিটি) কাজ করে, সে খুব দ্রুত সতর্ক (হাইপার অ্যালার্ট) হয়ে যায়। অপরাধী শরীরিক ভাষা বুঝে তারপর ভুক্তভোগী নির্বাচন করে। তখন সে রিড করে নেয় ভুক্তভোগীর ওপর সে দমন, নিপীড়ন বা সহিংসতা চালাতে পারবে কি না বা ভুক্তভোগী তার থেকে দুর্বল কি না। নিপীড়করা টার্গেট করে ভিক্টিমের পারিবারিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস কেমন। ভার্নারেবল (বিপন্ন) শিশু, যাদের পারিবারিক সমস্যা থাকে তারা সহজে ভিক্টিম হিসেবে টার্গেটেড হয়।’

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর সহিংসতার শিকার কন্যা শিশুদের ৭২ দশমিক ৬১ শতাংশ শিশু ও ছাত্রী। অনেক ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ভুক্তভোগীর আত্মীয় ও পরিচিত। এই হিসেবে, শিশুরা নিজ পরিবারেও নিরাপদ নয়।

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

নির্যাতনের অন্যতম কারণ লিঙ্গ সমতার অভাব

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সায়মা আক্তার বলছেন, ‘একটা মেয়েকে আমরা যতটা মেয়ে হতে শেখাই, একটা ছেলেকে আমরা ততটা ছেলে হতে শেখাই না। কালচারাল এই শিফটিং যদি আমরা না নিয়ে আসতে পারি তাহলে পাওয়ার ডমিনেশন চলতে থাকবে। কালচারাল শিফটের জন্য কমিউনিটিতে কাজ করতে হলে মূলত কমিউনিটির স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে হবে। গ্রামে আমরা সরকার কর্তৃক আয়োজিত উঠোন বৈঠকের সাফল্য এর আগে দেখেছি। আমাদের দেশে লোকাল লিডাররা জনমত তৈরিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, শিক্ষকরা শুধু যে স্কুল-কলেজে শিক্ষা দেন এমন না, সমাজেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকে। কমিউনিটিকেন্দ্রিক যেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা র‍য়েছেন, তাদের মধ্য দিয়ে সেক্স এডুকেশন (যৌন শিক্ষা) নিয়ে ট্যাবুটা আগে ভাঙতে হবে।’

কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে লিঙ্গ সমতা আসতে পারে–এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজেও পরিবারগুলো গণতান্ত্রিক উপায়ে ফাংশন করলে সেটা সাংঘর্ষিক হয় না। সেখানেও নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান পাওয়ার ডায়নামিক ন্যায্য থাকতে পারে। কিন্তু সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পিতামাতাকে দেওয়া হয় না কোনো জেন্ডার শিক্ষা। এগুলো অ্যাড্রেস করে সামনে না নিয়ে আসলে মানসিক বিকৃতির ব্যাপারটি আড়ালে থেকে যাবে। একইসঙ্গে পাঠ্যবইতে ছেলে-মেয়েদের সমান সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের কথা বললেও কার্যত নেই সেগুলোর প্রয়োগ।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা কন্যা শিশুর প্রতি এই সহিংসতার কারণ হিসেবে বলেন, ‘ক্ষমতা চর্চা, দুর্বলকে দমন ও পীড়ন করার আকাঙ্ক্ষা, যার সঙ্গে ব্যক্তির কাম বা ফ্যান্টাসি যুক্ত থাকতে পারে। কাম শুধু দৈহিক না, সামাজিকভাবে তৈরি হওয়া ধারণার মধ্যে তা নিহিত থাকতে পারে। গান, নাটক, সিনামা, যাত্রা পালাতেও সহিংসতার বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করে, সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, গল্প ইত্যাদিতেও এই প্রসঙ্গগুলো আনতে হবে।’

কীভাবে সহিংসতা ও লিঙ্গ বৈষম্য কমানো যেতে পারে?

গবেষকরা বলছেন, নারী-পুরুষের কাজকে শৈশব থেকে বিভক্ত করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে জেন্ডার ধারণা বারবার ফিরে আসে। জেন্ডার দৃষ্টিকোণ থেকেও বেশি মানবীয় দৃষ্টিকোণ প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সাদা-কালো বাইনারি, ছেলে-মেয়ে বাইনারি ছোটবেলা থেকে গেঁথে দেওয়া হয়, জেন্ডার রোল বেঁধে দেওয়া হয়, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান শুধু মেয়েদের পড়তে হবে, এরকম কিছু বিষয় বাচ্চাদের ভেতর গেঁথে দেওয়া হয়। তাই সেক্স এডুকেশনের যেমন বিকল্প নেই, তেমনই সহনশীল ব্যবহার পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শেখানোটা খুব জরুরি।’

পাশাপাশি মৌলিক প্যারেন্টিংয়ের যে ধারণা (সন্তান লালন-পালন) সেটা যদি গর্ভাবস্থা থেকেই প্রয়োগ করা যায়, তাহলে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে গাইনোকলজিস্টরা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাদের জন্য অতিরিক্ত চাপ হয়ে গেলেও এটা জরুরি, কেননা বাচ্চা কনসিভের সময় থেকে একটি দম্পতি গাইনোকোলজিস্টের সঙ্গে অনেক অংশেই জড়িত থাকে। তাদের যদি মৌলিক প্যারেন্টিংয়ের ধারণা শুরু থেকে দেওয়া যায়, তাহলে একটি বড় জনগোষ্ঠী জেন্ডার সচেতনতার আওতায় চলে আসে।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সব পর্যায়ে যৌনশিক্ষা পৌঁছাতে হবে

প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যৌনশিক্ষা বিষয়ে কিছুটা আলোচনার সুযোগ আছে। তবে সামাজিক পরিসরে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো আলাপ হয় না। কিন্তু শিক্ষাজীবনের বাইরে যারা রয়েছেন তাদের কীভাবে সম্মতি এবং জেন্ডার শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত করানো যায়, সেই বিষয়ে মির্জা তাসলিমা বলছেন, ‘লিঙ্গ সমতা নিয়ে যে স্টেরিওটাইপ নিয়ে বারংবার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, প্রয়োজন হলে ধর্মীয় বইয়ের বরাতেও প্রকাশ্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়া দরকার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন লারনেড ধর্মীয় নেতারা। ধর্মীয় ডিসকোর্সের ভেতর দিয়ে জেন্ডারবিষয়ক আলোচনা সামাজিক পরিসরে নিয়ে আসতে হবে, যাতে জনসাধারণের ট্যাবু ভাঙতে সহজ হয়।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেক্স এডুকেশন যেহেতু বাংলাদেশি আর্থ সামাজিক বাস্তবতায় ‘পশ্চিমা আগ্রাসন’ হিসেবে পরিচিত, এটিকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য গবেষকরা বলছেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক গন্ডিতে পৌঁছানোর উপায় হচ্ছে কমিউনিটি লিডারদের কাছে পৌঁছানো। জেন্ডার নিয়ে কমিউনিটি লিডারদের সঙ্গে কাজ করার সময় জনসাধারণের ভাষা এবং সমস্যাকে আমলে নিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত কমিউনিটির পুরুষ সদস্য এবং নেতাদের পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝানো সম্ভব না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত জেন্ডার ভায়োলেন্সের ধারণাগুলা তারা ধারণ করবে না। পুরুষদের ইমোশনাল ও ভার্নারেবল জায়গাগুলো আইডেন্টিফাই করে তারপর নারীদের দৃষ্টিতে তাদের বোঝাতে হবে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত