leadT1ad

আন্তর্জাতিক যুব দিবস আজ

দেশে অনার্স পাস বেকার বেশি, সরকারি নীতিকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা

আইএলও’র সংজ্ঞা অনুসারে ২৪ লাখ বেকারের সঙ্গে ‘ছদ্মবেকার’ যুক্ত হলে দেশের ১ কোটি ৭ লাখ মানুষকে বেকার বলা যায়।

ফারুক হোসাইনঢাকা
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ১২: ১৪
আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ০৪
দেশে অনার্স পাস বেকার বেশি, সরকারি নীতিকে দুষছেন বিশেষজ্ঞেরা। স্ট্রিম গ্রাফিক

দেশে বেকারদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন। তুলনামূলক কম শিক্ষিতদের বেকার থাকার প্রবণতা কম। অন্তত সরকারি হিসাব এমনটাই বলছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালুর পাশাপাশি খালি থাকা সরকারি পদে নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকেও দুষছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। যাঁদের মধ্যে ৯ লাখ ৫ হাজার জন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। সংশ্লিষ্টেরা অবশ্য বলছেন, বেকার থাকা ব্যক্তিদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চাইতে আরও বেশি।

বিবিএসের সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়েছে, বেকারদের ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশই স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেছেন। ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশের উচ্চ মাধ্যমিক সনদ আছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেছেন ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। বেকারদের ৬৯ শতাংশ গ্রামে ও প্রায় ৩১ শতাংশ শহরে বাস করেন।

২০২৩ সালের এ জরিপের প্রতিবেদন গেলো বছরের নভেম্বরে প্রকাশ করা হয়। জরিপে উঠে এসেছে, আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই—দেশে এমন বেকারের সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার। ৩ লাখ ২৫ হাজার বেকার প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়েছেন।

অন্যদিকে, ৬ লাখ ৭০ হাজার বেকার মাধ্যমিক ও ৪ লাখ ৬ হাজার উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেছেন। ৯ লাখ ৫ হাজার স্নাতক পাশ বেকারের পাশাপাশি আরও ২২ হাজার জন অন্য কোনো মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।

শিক্ষিত বেকার বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকার কথা বলছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. এস এম জুলফিকার আলী।

তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা ব্যক্তিরা যে কোনো কাজে ঢুকে পড়ছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে একজন শিক্ষার্থী তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি খোঁজেন। তবে দেশে এ সুযোগ এখনো সীমিত।’

শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা ব্যক্তিরা যে কোন কাজে ঢুকে পড়ছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে একজন শিক্ষার্থী তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি খোঁজেন। তবে দেশে এ সুযোগ এখনো সীমিত। ড. এস এম জুলফিকার আলী, রিসার্চ ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)

কর্মে নেই তরুণেরা

দেশে প্রাক্কলিত কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬২ লাখ। কর্মক্ষম বলতে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী নারী-পুরুষকে বোঝানো হয়েছে। বিবিএসের জরিপ বলছে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকার বেশি তরুণেরা।

১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮.২৪ শতাংশ; সংখ্যায় ১২ লাখ ৪০ হাজার জন। ২৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক বেকারের সংখ্যা ১২ লাখ ২০ হাজার। নারীদের চেয়ে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেশি বলেও উঠে এসেছে বিবিএসের প্রতিবেদনে।

বেকারের প্রকৃতসংখ্যা আরও বেশি

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, এক মাস ধরে কাজ খুঁজছেন এবং সর্বশেষ এক সপ্তাহে কেউ যদি এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পান, তাঁদের বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পেলে তিনি বেকার নন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইএলও’র সংজ্ঞার ভিত্তিতে বেকারের প্রকৃত সংখ্যা বের করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিআইডিএসের রিসার্চ ডিরেক্টর এস এম জুলফিকার আলী।

বিআইডিএসের রিসার্চ ডিরেক্টর এস এম জুলফিকার আলী। সংগৃহীত ছবি
বিআইডিএসের রিসার্চ ডিরেক্টর এস এম জুলফিকার আলী। সংগৃহীত ছবি

তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে জীবনধারণ অসম্ভব। বিবিএস আইএলও’র সংজ্ঞা অনুযায়ী বেকারের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরও বেশি।

নিষ্ক্রিয় তরুণ ৮২ লাখ

বেকারের পাশাপাশি বাংলাদেশে তরুণদের বড় একটি অংশ নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ, তাঁদের কোনো কাজ নেই, শিক্ষা গ্রহণ করছেন না কিংবা প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না।

১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ৮২ লাখের বেশি। এমন নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ‘ছদ্মবেকার’। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এমন নিষ্ক্রিয় তরুণ-তরুণী পাওয়া গিয়েছিল ৯৬ লাখ ৪০ হাজার।

সংজ্ঞা অনুসারে ২৪ লাখ বেকারের সঙ্গে ছদ্মবেকার যুক্ত হলে দেশের ১ কোটি ৭ লাখ মানুষকে বেকার বলা যায়।

সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে পদ খালি। এরপরেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে অগ্রাধিকার নেই। স্কুল, কলেজের পাশাপাশি পাটকলের মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হতে পারতো। সরকার পাটশিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি তাঁদের অগ্রাধিকারে নেই। আবার জনস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়াও এমন পরিস্থিতির অন্যতম কারণ। আনু মুহাম্মদ, সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সরকারি নীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার দায়

তরুণদের বেকার থাকার পেছনে শিক্ষাব্যবস্থার দায় দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি নীতিকেও দুষছেন তাঁরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ স্ট্রিমকে বলেন, বর্তমানে সরকারি নীতি কর্মসংস্থান তৈরির মতো না। মূলত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যথাযথ না। দেখা যায়, অনেকে পড়াশোনা শেষ করে কোচিং সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান খুঁজছে। যথাযথ শিক্ষাব্যবস্থা হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দিতে পারতো। বেকার জনগোষ্ঠীও মূলধারার কর্মসংস্থানে আসতে পারতো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সংগৃহীত ছবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সংগৃহীত ছবি

তিনি বলেন, সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে পদ খালি। এরপরেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে অগ্রাধিকার নেই। স্কুল, কলেজের পাশাপাশি পাটকলের মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হতে পারতো। সরকার পাটশিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি তাঁদের অগ্রাধিকারে নেই। আবার জনস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়াও এমন পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।

শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করে শিক্ষা কারিকুলাম তৈরির কথা বলছেন বিআইডিএসের রিসার্চ ডিরেক্টর এস এম জুলফিকার আলী।

তিনি বলেন, দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। তবে পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরে তাঁদের জন্য উপযুক্ত কর্মসৃজন হচ্ছে না। গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করা যাচ্ছে না। তারা পাস করে বের হলেও কর্মক্ষেত্রের জন্য দক্ষ হয়ে উঠছে না। দেখা যাচ্ছে, টেক্সটাইল কিংবা গার্মেন্টস সেক্টরে বিদেশিদের আনা হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানগুলো জনশক্তি খুঁজছে, কিন্তু দেশে উপযুক্ত কাউকে পাচ্ছে না।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানে সমন্বয় দরকার বলে মন্তব্য করেন জুলফিকার আলী।

Ad 300x250

সম্পর্কিত