leadT1ad

ঢাকার অসহনীয় তাপ: সারা দেশের চেয়ে ৬৫ শতাংশ দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে রাজধানী

' শুধু ২০২৪ সালেই তীব্র গরমের কারণে প্রায় আড়াই কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। আর্থিক মূল্যে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১.৩৩ থেকে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ০.৩ থেকে ০.৪ শতাংশের সমান।'

সানীউজ্জামান পাভেল
ঢাকা
ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

তীব্র তাপমাত্রার ঝুঁকির তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সারাদেশের গড় তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে, ঢাকার তাপমাত্রা তার চেয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর মূল কারণ হিসেবে দ্রুত নগরায়ন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত উন্নয়নকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে রাজধানীর সবুজ এলাকাগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকার মোট আয়তন ১৯ শতাংশ বাড়লেও এর জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ।

ঢাকায় হিট ইনডেক্স বা অনুভূত তাপমাত্রাও অনেক দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ৯ বছরে অনুভূত তাপমাত্রা বাড়ার হার ছিল গড়ে ০ দশমিক ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আগের গড় হারের চেয়ে চার গুণেরও বেশি। হিট ইনডেক্স মূলত বাতাসের আর্দ্রতার হিসাব করে, যা সাধারণ কথায় ‘কেমন গরম অনুভূত হচ্ছে’কে বোঝায়।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘টেকসই জীবন: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে গরমের প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের প্রশাসন ও পরিকল্পনা, সবই এসব সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছে।’পরিবেশ উপদেষ্টা কার্যকরী নগর পরিকল্পনা, সবুজায়ন ও দেশের উন্নয়ন নীতিগুলো নতুন করে পর্যালোচনার ওপর জোর দেন। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ঢাকা আসলে কত মানুষের ভার নিতে পারে? এটাই এখন মূল প্রশ্ন।’

ঢাকায় হিট ইনডেক্স বা অনুভূত তাপমাত্রাও অনেক দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ৯ বছরে অনুভূত তাপমাত্রা বাড়ার হার ছিল গড়ে ০ দশমিক ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আগের গড় হারের চেয়ে চার গুণেরও বেশি। হিট ইনডেক্স মূলত বাতাসের আর্দ্রতার হিসাব করে, যা সাধারণ কথায় ‘কেমন গরম অনুভূত হচ্ছে’কে বোঝায়।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ৯ বছর ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ সময়। এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুধু নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরই প্রভাব ফেলছে না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও মারাত্মক ক্ষতি করছে। শুধু ২০২৪ সালেই তীব্র গরমের কারণে প্রায় আড়াই কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। আর্থিক মূল্যে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১.৩৩ থেকে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ০.৩ থেকে ০.৪ শতাংশের সমান।

গবেষকরা শহর ও গ্রামের ৭,২৬৭টি পরিবারের ৩১,২১৭ জন সদস্যের ওপর দুই ধাপে জরিপ চালিয়েছেন। শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উত্তরদাতারা দীর্ঘস্থায়ী কাশিকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শীতে যেখানে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন, গরমে সেই সংখ্যা বেড়ে ৬ শতাংশ হয়ে যায়। গরমে হিট-স্ট্রোক আরেকটি বড় সমস্যা। প্রায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ গ্রীষ্মকালে এর শিকার হন, যাদের মধ্যে ৩৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাপমাত্রা যখন ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে, তখন হিট-স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ গরমকালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন, অথচ শীতে এর হার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং নারীরা ডায়রিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির বেশি হলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

গরমের প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও পড়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শীতে বিষণ্ণতার হার ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা গ্রীষ্মে বেড়ে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে। একইভাবে, শীতে উদ্বেগের হার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ থাকলেও গরমে তা বেড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছায়। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে যায়।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটান বিভাগের পরিচালক জ্যাঁ পেসমে বলেন, ‘তীব্র গরম কেবল একটি ঋতুকালীন অসুবিধা নয়। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আমরা বাংলাদেশে দেখছি যে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা আমাদের স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা এবং দেশের সমৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’

জ্যাঁ পেসমে আরও বলেন, ‘জলবায়ু অভিযোজনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবং সব খাতকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ এই সংকট মোকাবিলা করতে পারে। ভালো খবর হলো, সিঙ্গাপুর এবং অন্যান্য দেশের মতো এটি করা সম্ভব হয়েছে। চেষ্টা করলে এখানেও তা সম্ভব।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ডা. মো. সাইদুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে যারা দায়ী, তাদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।

সামগ্রিকভাবে, এই গবেষণায় ক্রমবর্ধমান গরম মোকাবিলার জন্য একটি বহু-ক্ষেত্রীয় পদ্ধতি গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, তীব্র গরমের কারণে প্রাণহানি রোধে স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কার্যকর সিদ্ধান্তের জন্য উন্নত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সবশেষে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব কমাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও তহবিল নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত