leadT1ad

বেনজীরের অর্থপাচার সিন্ডিকেটের ‘হোতা’ মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের অবৈধ অর্থ পাচার-সিন্ডিকেটের ‘মূল হোতা’ ছিলেন সম্প্রতি গ্রেপ্তার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরী ওরফে মাসুদ করিম।

স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ৩৪
জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েত করিম বেনজীরের নামে থাকা প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছেন। স্ট্রিম গ্রাফিক

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের অবৈধ অর্থ পাচার-সিন্ডিকেটের ‘মূল হোতা’ ছিলেন সম্প্রতি গ্রেপ্তার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরী ওরফে মাসুদ করিম। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বেনজীরের নামে থাকা প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র। বেনজীরের নমিনি হিসেবে তিনি দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেন বলেও জানা গেছে। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, বেনজীর র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) থাকার সময়ই এনায়েত করিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। দেশে ছেড়ে পালানোর পর বেনজীর নিজের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ ও এফডিআর ভেঙে টাকা উত্তোলন ও পাচারের দায়িত্ব দেন এনায়েতকে।

গত কয়েক দিন ধরে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ, দুদক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা যায়। তবে এসব কর্মকর্তাদের কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। বেনজীর পরিবারের অর্থপাচার মামলায় গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে এনায়েত করিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুদক। এর আগে দুই দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রিমান্ডে ছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ বুধবার রাত পৌনে ৯টার দিকে স্ট্রিমকে বলেন, ‘পুলিশের বেনজীর আহমেদের সঙ্গে এনায়েত করিম ওরফে মাসুদ করিমের বিভিন্ন নম্বর, হোয়াটসঅ্যাপ ও বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের তথ্য পেয়েছি। তাদের দুজনের টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়ে আমরা সন্দিহান। এনায়েত করিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।’

এনায়েত করিম। ছবি: সংগৃহীত
এনায়েত করিম। ছবি: সংগৃহীত

কে এই এনায়েত করিম

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিন্টো রোড এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। প্রাডো গাড়িতে করে তিনি ‘সন্দেহজনকভাবে’ ঘোরাঘুরি করছিলেন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে রমনা মডেল থানায় মামলা করা হয়।

পুলিশ পরে জানায়, ‘এনায়েত করিম’ ও ‘মাসুদ করিম’- এই দুই নামে তাঁর ভ্রমণ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। তিনি ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ২০০৪ সালে দেশটির পাসপোর্ট পান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করতে অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে ৬ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশে আসেন। দেশে আসার পর তিনি দুদিন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অবস্থান করেন। ওই হোটেল বুকিং ও ভাড়া পরিশোধ করেন জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী অংশের মহাসচিব পরিচয় দেওয়া কাজী মামুনুর রশিদ। গত ২৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার মামুন এখন কারাগারে আছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্ট্রিমকে জানান, এনায়েত নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রধান হিসেবে পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়ে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। মার্কিন নাগরিকত্ব থাকায় তাঁকে নিয়ে তেমন সন্দেহ করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর এজেন্ট।

তাঁরা স্ট্রিমকে আরও জানান, এনায়েতের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। জাতীয় পার্টির নেতা মামুনের পাশাপাশি একজন ডিআইজি এবং আরও চার পুলিশ সদস্যের সংশ্লিষ্টতার তথ্যও পেয়েছে দুদক।

বেনজীর আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
বেনজীর আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

বেনজীরের অর্থ পাচারে এনায়েত

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর সপরিবারে দেশ থেকে পালানোর পর দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে এবং ২৮টি এফডিআর ভেঙে টাকা উত্তোলন করেছেন এনায়েত করিম। বেনজীর তাঁর মনোনীত নমিনি হিসেবে এনায়েত করিমের নাম ব্যবহার করেছেন। এনায়েতের মাধ্যমে বেনজীরের টাকা পাচার হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে বিষয়টি বুঝতেই পারেনি। পরে বিষয়টি সামনে আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বেনজীরের টাকা উত্তোলনকারীকে খুঁজতে থাকে। ব্যাংকের নথিতে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে পরে এনায়েত করিমের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর থেকেই তাঁর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তাঁরা আরও জানান, বেনজীরের নামে থাকা ১১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বিদেশের একাধিক অ্যাকাউন্টে পাচার করা হয়। বেনজীর ও এনায়েত করিমের নামে থাকা এমন বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্টের তথ্য পেয়েছে দুদক। এই টাকার অধিকাংশ পাচার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; কিছু টাকা গেছে কানাডায়।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, বেনজীর র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) থাকার সময়ই এনায়েত করিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। ওই সময় র‌্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্য তৎকালীন ডিজি বেনজীরের সঙ্গে ২০০ কোটি টাকার চুক্তিও করেছিলেন বলে জানিয়েছেন এনায়েত। বেনজীর দেশে ছেড়ে পালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর আশ্রয়ে থাকা শুরু করেন। পরবর্তীকালে বেনজীর তাঁর নামে বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ ও এফডিআর ভেঙে টাকা উত্তোলন ও পাচারের দায়িত্ব দেন এনায়েতকে। এরপর ২৮টি এফডিআর ভেঙে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি তা হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করেন।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা স্ট্রিমকে জানান, প্রাথমিকভাবে এনায়েত করিমকে একজন প্রতারক মনে হয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার বড় কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী সরকারের আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের যুক্তরাষ্ট্রের রয়্যাল ডিনারে অংশগ্রহণ করিয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামিকে বাঁচিয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন বলেও জানা গেছে।

বর্তমান পুলিশের কর্মকর্তাও জড়িত

জাতীয় পার্টির নেতা ছাড়াও পুলিশের একজন ডিআইজি, তাঁর দেহরক্ষী এবং আরও তিন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে এনায়েতের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা।

ডিএমপির একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্ট্রিমকে জানান, এনায়েতকে গ্রেপ্তারের সময় জব্দ করা প্রাডো গাড়িটি সরবরাহ করেছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। এমনকি ওই কর্মকর্তা তাঁর নিজের দেহরক্ষীকে এনায়েত করিমের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া পুলিশের আরও তিন সদস্য এনায়েতের প্রটোকলের দায়িত্বে ছিলেন। তাদের সবাইকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত