leadT1ad

জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস

স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ছি, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে বিশ্বকে পাশে চাই

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না।

স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৯
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না। ভাষণে গত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হওয়া শত শত কোটি ডলার উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

আজ শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট, গাজায় চলমান সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন। তরুণদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’—শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য বেকারত্বের একটি রূপকল্প বিশ্বনেতাদের সামনে উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টা।

সংস্কারের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পথ বন্ধের চেষ্টা

ভাষণের শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘গত বছর, আপনাদের এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের শোনানোর জন্য। আজ আমি এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি তা বলব।’

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, তা গত পাঁচ দশকে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তরুণদের নেতৃত্বে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ স্বৈরাচারকে পরাভূত করে বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অভিযাত্রা নতুনভাবে শুরু করার সুযোগ করে দিয়েছে।

পাচার হওয়া সম্পদ ফেরাতে সহায়তা চান

দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা একে একে আবিষ্কার করি দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরি কী ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। দেশের পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমানে অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার।’

মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ‘গত ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আমরা নিরলসভাবে এই সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এ পাচারকৃত সম্পদ গচ্ছিত রাখবার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এই অপরাধের শরিক না হয়— এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিককে অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের নিকট ফিরিয়ে দিন।’ একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব করেন।

রোহিঙ্গা সংকট: মানবিক বিপর্যয় আসন্ন

আট বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। বাংলাদেশ শুধু মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে।

তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানবিক বিপর্যয় আসন্ন বলে সতর্ক করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে মারাত্মক তহবিল ঘাটতির বিষয়ে ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে। অবিলম্বে নতুন তহবিল না এলে, মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে এনে মাথাপিছু মাত্র ৬ মার্কিন ডলারে নামতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের অনাহার ও অপুষ্টিতে নিমজ্জিত করবে।’ এই পরিস্থিতি এড়াতে তিনি দাতাদের সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানান।

গাজায় গণহত্যা চলছে

গাজায় চলমান সংঘাতকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্র আখ্যা দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘শিশুরা না খেয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সঙ্গে আমরাও একমত যে আমাদের চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে।’ তিনি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সংকটের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি জানান।

তরুণদের নিয়ে ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’র স্বপ্ন

তরুণদের সামাজিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো—প্রত্যেক তরুণকে শুধু চাকরিপ্রার্থীর পরিবর্তে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা।’ তিনি তাঁর ‘সামাজিক ব্যবসা’র ধারণা তুলে ধরে বলেন, এর মাধ্যমে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব।

ভাষণের শেষে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমাদেরকে তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তরুণরা তিন শূন্য বাস্তবায়নের সৈনিক হয়ে বড় হবে। তাদের সামনে থাকবে শূন্য কার্বন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, এবং শূন্য বেকারত্ব— এর ভিত্তিতে তারা গড়ে তুলবে তাদের পৃথিবী।’

এছাড়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি পূরণ, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবদান, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত