leadT1ad

ফিলিস্তিনি জলপাই চাষীদের উপর ইহুদী বসতিস্থাপনকারীদের হামলা

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

মুখোশধারী ইহুদী বসতি স্থাপনকারী উম্মে সালেহ আবু আলিয়াকে লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। ছবি: সংগৃহীত।

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের তুরমুস আয়ার কাছে একদল মুখোশধারী ইহুদি বসতি স্থাপনকারী গত রবিবার ফিলিস্তিনি জলপাই চাষি ও তাঁদের সঙ্গে থাকা কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তারা লাঠি ও পাথর দিয়ে আক্রমণ করে, তিনটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং অন্য গাড়ির জানালা ভাঙচুর করে।

ভিডিওতে দেখা যায়, এক মুখোশধারী একজন ফিলিস্তিনি নারীকে বড় লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলে। এতে তিনি রক্তাক্ত হন।

ঘটনাটি জলপাই চাষের মৌসুমে ইহুদী বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ধারাবাহিকতা। এতে ফিলিস্তিনিদের কৃষিকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং উত্তেজনা বাড়ছে।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ঘটনাটির নিন্দা জানিয়েছে ও তদন্ত শুরু করেছে। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ ধরনের ঘটনায় বিচার হওয়ার হার খুবই কম।

ঘটনাস্থল ও পরিস্থিতি

হামলাটি ঘটেছে রোববার (১৯ অক্টোবর) সকালে, পশ্চিম তীরের তুরমুস আয়ার কাছাকাছি একটি ‘এরিয়া বি’ অঞ্চলে। এই এলাকা দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি কৃষকরা জলপাই চাষে ব্যবহার করে আসছেন।

প্রায় ১৫ থেকে ৪৫ জন মুখোশধারী, হাতে লাঠি ও পাথর নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। তারা ফিলিস্তিনি মুসলিমদের মারধর করে, গাড়ি পুড়িয়ে দেয় ও ভাঙচুর চালায়।

আল-মুঘাইয়ির ও টাইবেহ নামক এলাকাতেও একই দিনে জলপাই চুরি ও যন্ত্রপাতি লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরদিন সোমবারও (২০ অক্টোবর) আরও কিছু সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

ভিডিওতে দেখা গেছে, এক মুখোশধারী হামলাকারী, যার গায়ে এক ধরনের ইহুদি ধর্মীয় পোশাক ছিল, এক নারী জলপাই চাষিকে বড় একটি কাঠের লাঠি দিয়ে বারবার মাথায় আঘাত করছে। এতে ওই নারী অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং রক্তাক্ত হন।

এই সহিংসতার ফলে জলপাই সংগ্রহের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এই ফসল পল্লি ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উৎস। এর আগেও সামরিক নিয়ন্ত্রণ ও জমি প্রস্তুতির সমস্যার কারণে তারা নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন।

প্রায় ১৫ থেকে ৪৫ জন মুখোশধারী, হাতে লাঠি ও পাথর নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রায় ১৫ থেকে ৪৫ জন মুখোশধারী, হাতে লাঠি ও পাথর নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ছবি: সংগৃহীত।

আহত ও ক্ষয়ক্ষতি

আল-মুঘাইয়ির গ্রামের উম সালেহ আবু আলিয়া নামে ৫২–৫৫ বছর বয়সী এক নারী জলপাই তুলছিলেন। এ সময় তাঁর মাথায় দুবার লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। তিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং রক্তপাত শুরু হয়। আগের কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তিনি পালাতে পারেননি। তাঁকে রামাল্লার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রথমে তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়, তবে বর্তমানে তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল।

আহত নারীর ভগ্নিপতি আয়মান আবু ওলিয়াকেও (৪৮) মারধর করা হয়। তাঁর বুক ও হাতে মারধরের ফলে আঙুল ভেঙে যায়। পরে তাঁর গাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়।

জলপাই চাষিদের সহায়তায় থাকা দুজন মানবাধিকার কর্মীকেও আক্রমণ করা হয়। তাঁরা আহত হয়েছেন।

টাইবেহ শহরে আরও কিছু জলপাই চাষির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। তবে তাঁদের আঘাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।

কমপক্ষে তিনটি গাড়িতে আগুন লাগানো হয়। আরও কয়েকটি গাড়ির জানালা ভেঙে দেওয়া হয়। জলপাই সংগ্রহের যন্ত্রপাতি চুরি হয়।

টাইবেহ শহরের বাসিন্দারা জানান, প্রায় পাঁচ ঘণ্টা শহরের প্রবেশপথে তাঁদের আটকে রাখা হয়।

ঘটনাস্থলে থাকা মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক জাসপার নাথানিয়েল বলেন, পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত বিশৃঙ্খল। তাঁর মতে, হামলাটি ছিল পরিকল্পিত এবং হামলাকারীরা গোষ্ঠীগতভাবে টার্গেট করছিল।

তিনি দাবি করেন, ইসরায়েলি সেনারা হামলার আগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল এবং হয়তো ফিলিস্তিনিদের একটি ফাঁদে ফেলে সরে যায়।

ইসরায়েলি সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল, যদিও হামলার সময় তারা সরে যায়। ছবি: সংগৃহীত।
ইসরায়েলি সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল, যদিও হামলার সময় তারা সরে যায়। ছবি: সংগৃহীত।

হামলাকারী ও ঘটনার প্রেক্ষাপট

হামলাকারীদের পরিচয় মুখোশধারী চরমপন্থী ইহুদি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তারা কাছাকাছি অবৈধ বসতি যেমন আদেই আদ, এশ কোদেশ ও গেউলাত সিয়োন থেকে এসেছে। তারা সংগঠিতভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়, মুখে মুখোশ পরে ও হাতে লাঠি নিয়ে আসে।

ঘটনাটি ঘটে জলপাই চাষের মৌসুমে, যা ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হয়। ঐতিহাসিকভাবে এই সময়টিতে বসতি স্থাপনকারীদের হামলা বেড়ে যায়। এসব হামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষকদের ভয় দেখানো এবং জমিতে প্রবেশ ঠেকিয়ে ভূমি দখলের পথ সুগম করা।

সরকারি ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ও পুলিশ ঘটনার পর সেখানে পৌঁছে সংঘর্ষ ছত্রভঙ্গ করে। আইডিএফ এক বিবৃতিতে জানায়, তারা যেকোনো ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানায় এবং সকলের জন্য নিরাপদ চাষের পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

জুডিয়া ও সামারিয়া পুলিশ বিভাগ তদন্ত শুরু করেছে এবং ভিডিও প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। তবে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত কারও গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি।

আল-মুঘাইয়িরের মেয়র আমিন আবু আলিয়া ও হামলায় আহত হামদি আবু আলিয়া (উম সালেহর চাচাতো ভাই) জানান, হামলাটি ছিল সম্পূর্ণ অপ্ররোচিত।

টাইবেহ শহরের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারাও হামলার নিন্দা জানান।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বার্তা সংস্থা ওয়াফা, ২০ অক্টোবরও স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের ওপর হয়রানির ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।

তুরমুস আয়ার ৮০ শতাংশের বেশি ইহুদী বাসিন্দা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও দূতাবাসকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।

‘পিস নাউ’ নামের ইসরায়েলি একটি সংগঠন এই ঘটনাকে ‘বসতিস্থাপন সন্ত্রাস’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, ইসরায়েলি পুলিশ ও সরকার এ ধরনের চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না।

রামাল্লাহর উপকণ্ঠে পশ্চিম তীরের তুরমুস আয়া গ্রামে ফিলিস্তিনিরা জলপাই ফসল কাটছে। ছবি: এএফপি।
রামাল্লাহর উপকণ্ঠে পশ্চিম তীরের তুরমুস আয়া গ্রামে ফিলিস্তিনিরা জলপাই ফসল কাটছে। ছবি: এএফপি।

‘ইয়েশ দিন’ নামের মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জলপাই মৌসুমে বসতিস্থাপনকারী ও সেনাবাহিনীর হয়রানির ১১৩টি ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৫২টিই সম্পত্তি নষ্ট বা চুরির অভিযোগ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীদের ওপর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেছেন। এর ফলে জবাবদিহির প্রক্রিয়া আরও দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এই হামলা ২০২৫ সালের জলপাই মৌসুমে বসতিস্থাপনকারীদের সহিংসতা বৃদ্ধির অংশ।

জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (ওসিএইচএ) জানায়, গত ৭ থেকে ১৩ অক্টোবর-এর মধ্যে পশ্চিম তীরে বসতিস্থাপনকারীদের ৭১টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর অর্ধেকের বেশি জলপাই চাষের সময় হয়েছে, যা ২৭টি গ্রামকে প্রভাবিত করেছে।

চলতি বছর এ পর্যন্ত ৩ হাজার ২০০-র বেশি ফিলিস্তিনি এই ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব হামলার লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে ভূমি দখল করা।

২০০৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বসতিস্থাপনকারী সহিংসতার তদন্তের মাত্র ৩ শতাংশই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।

এর ফলে টানা তৃতীয় বছরের মতো ফিলিস্তিনিদের খারাপ ফলনের আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। জমিতে প্রবেশে বাধা থাকায় ফিলিস্তিনিদের চাষের প্রস্তুতি ও ফসল সংগ্রহ ব্যাহত হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, টাইমস অব ইসরায়েল

Ad 300x250

সম্পর্কিত