সুদানে চলমান সংঘাত শুধু দেশটির সামরিক বাহিনী (এসএএফ) এবং আধাসামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) অভ্যন্তরীণ লড়াই নয়। এটি আসলে আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের সংঘাতেরও একটি ক্ষেত্র। ইসরায়েলের ‘বিভাজন ও দুর্বল’ করার কৌশলের পটভূমিতে, বিশ্লেষকরা বলছেন যে সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে সুদানকে অস্থিতিশীল করে তুলছে, যা তাদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষারই অংশ।
আরব আমিরাত মূলত আরএসএফ নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালোর সোনার ব্যবসা এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের সুবিধা নিচ্ছে। অন্যদিকে এসএএফের পেছনে রয়েছে তুরস্ক, ইরান ও মিশরের মতো দেশগুলোর একটি জোট, যারা মূলত সুদানকে ইসলামপন্থী প্রভাবমুক্ত রাখা ও নিজস্ব আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসএএফকে সমর্থন দিচ্ছে। এর ফলে সুদানের মাটি সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত আরএসএফ বা প্রথম অক্ষ বনাম তুরস্ক, ইরান ও মিশর সমর্থিত এসএএফ বা দ্বিতীয় অক্ষের মধ্যে যুদ্ধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা দেশটিকে গভীর বিভাজন ও দুর্বলতার দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিয়েছে। এই বহুমাত্রিক হস্তক্ষেপ সুদানের মানবিক সংকটকে পূর্ণমাত্রায় ঘনীভূত করছে।
প্রথম অক্ষ: আরএসএফ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সহায়তা।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত সুদানের আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফকে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে, যা তাদের যুদ্ধে টিকে থাকার প্রধান কারণ।
ক. ড্রোন ও উন্নত সামরিক সরঞ্জাম
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আরব আমিরাত আরএসএফকে উন্নতমানের চীনা ড্রোন সরবরাহ করছে। ড্রোনগুলো ২৪ ঘণ্টা উড়তে এবং লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম। এ ছাড়াও তাদের গাইডেড বোমা, ১৫৫ মিলিমিটার হাউইটজার কামান, ভারী মেশিনগান ও সাঁজোয়া যান সরবরাহ করা হয়েছে। এসব অস্ত্র সরাসরি খার্তুমে পৌঁছানো হয় না, বরং একটি জটিল আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়। আরব আমিরাত লিবিয়া, চাদ, উগান্ডা ও সোমালিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর বিচ্ছিন্ন অঞ্চল হয়ে আরএসএফের কাছে সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে অভিযোগের তির কেনিয়ার দিকেও ছোড়া হয়।
খ. কলম্বিয়ান ভাড়াটে বাহিনী
সুদানের ঘটনায় আরব আমিরাতের সম্পৃক্ততার সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি হলো কলম্বিয়ান ভাড়াটে যোদ্ধা নিয়োগ। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী আরব আমিরাতভিত্তিক সংস্থা (গ্লোবাল সিকিউরিটি সার্ভিসেস গ্রুপ) প্রাক্তন কলম্বিয়ান সেনা সদস্যদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রথমে দুবাইয়ে আনে, তারপর সেখান থেকে তাদেরকে লিবিয়া হয়ে সুদানে পাঠানো হয়। এই ভাড়াটে বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনেকে অভিজ্ঞ সৈনিক, তারা আরএসএফের সঙ্গে ড্রোন পরিচালনা, আর্টিলারি এবং সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয় অক্ষ: এসএএফ-এর সহায়তাকারী জোট (তুরস্ক, ইরান, মিশর) ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থানের বিপরীতে এসএএফের নেতা জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান তুরস্ক, ইরান ও মিশরের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক জোটের সামরিক সহায়তা পাচ্ছেন। নিজ নিজ স্বার্থের জায়গা থেকে দেশগুলো অভিন্ন এক প্ল্যাটফর্মে অবস্থান নিয়েছে।
ক. তুরস্কের স্বার্থ
তুরস্ক এসএএফকে বায়রাকতার টিবি২-এর মতো সামরিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সহায়তার মাধ্যমে একাধিক কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে যদি বলি, লোহিত সাগরে নিজেদের সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য থেকেই আঙ্কারা এই সহায়তা করছে। তুরস্কের স্বার্থ:
১. আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা: তুরস্ক মূলত আরব আমিরাতের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য এসএএফকে সমর্থন দিচ্ছে। অপর দিকে আমিরাত আরএসএফকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, যার বিরুদ্ধে এসএএফ যুদ্ধ করছে।
আমিরাতের এই হস্তক্ষেপকে তুরস্ক তাদের আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। কেননা লিবিয়া, ইয়েমেন ও অন্যান্য অঞ্চলে তুরস্ক ও আরব আমিরাত দীর্ঘকাল ধরে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত। সুদানে এসএএফকে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে তুরস্ক এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাচ্ছে।
এভাবে সুদানে আমিরাতের মদদপুষ্ট আরএসএফকে মোকাবিলা করতে গিয়ে তুরস্ক, মিশর ও ইরানের মতো ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গেও এসএএফের সহায়তাকারী জোটের এক বিরল ঐক্য গড়ে তুলেছে।
২. সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি ও প্রভাব বিস্তার: তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি, বিশেষ করে বায়রাকতার টিবি২ আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সফল ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে টিবি২ ড্রোনের কার্যকারিতা প্রদর্শন করে তুরস্ক বিশ্বব্যাপী তাদের সামরিক রপ্তানি বাজারকে আরও বিস্তৃত করতে চাচ্ছে। সুদানের সংঘাত তাদের জন্য ‘বায়কার’ প্রযুক্তির কার্যকর বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করছে।
এসএএফকে এই ড্রোন সরবরাহ করার মাধ্যমে তুরস্ক সুদানের সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করতে চায়।
৩. লোহিত সাগরে কৌশলগত অবস্থান রক্ষা: সুদানের অবস্থান লোহিত সাগর এবং মধ্য আফ্রিকার সংযোগস্থলে, যা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্ক লোহিত সাগরের উপকূলে তার প্রভাব বজায় রাখতে আগ্রহী। তাই শক্তিশালী ও স্থিতিশীল এসএএফ তুরস্ককে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথে নিজেদের কৌশলগত এবং সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে সহায়তা করবে। তাছাড়া এই অঞ্চলে তুরস্কের বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থও রয়েছে, যা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারের মাধ্যমে সুরক্ষিত রাখা সহজ।
খ. ইরানের ভূমিকা
সুদানে ইরানের ভূমিকা কৌশলগত ভূ-রাজনীতি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত। এটি শুধু এসএএফকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের মূল লক্ষ্য লোহিত সাগরে স্থায়ী সামরিক অবস্থান নিশ্চিত করা, যা তাদের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াতে এবং ইয়েমেনের হুতি মিলিশিয়াদের সহায়তা অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে।
ইরানের প্রধান লক্ষ্যগুলো:
১. সামরিক ড্রোন ও কৌশলগত সহায়তা: ইরান এসএএফকে উন্নত মানের ড্রোন, বিশেষ করে মোহাজের-৬ এবং আবাবিল-এর মতো সামরিক ড্রোন সরবরাহ করেছে বলে জানা যায়। এসব ড্রোন এসএএফকে যুদ্ধে আরএসএফের অবস্থান লক্ষ্য করে দূর থেকে নির্ভুল হামলা চালাতে সাহায্য করছে, বিশেষ করে খার্তুম এবং ওমদুরমানের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পুনরুদ্ধারে তা অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আর এভাবেই দীর্ঘ ৭ বছরের বিরতির পর, ২০২৩ সালের অক্টোবরে সুদান ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়।
এর পরপরই এসব অস্ত্র সরবরাহ শুরু হয়, যা ইঙ্গিত দেয় যে সামরিক সহায়তা এই নতুন সম্পর্কের মূল ভিত্তি।
২. লোহিত সাগরে নৌঘাঁটি সুরক্ষিত করা: তেহরানের প্রধান এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য লোহিত সাগরের উপকূলে (বিশেষ করে পোর্ট সুদানে) একটি সামরিক বা লজিস্টিক ঘাঁটি স্থাপন করা। এটি ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ লোহিত সাগর বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ, যা ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে ভারত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। এই উপকূলে ঘাঁটি স্থাপন করলে ইরান সুয়েজ খাল বা ইসরায়েল ও তার মিত্রদের বাণিজ্যিক এবং সামরিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
এর ফলে এই অঞ্চলে ইরানের নৌবাহিনীর ক্ষমতা ও উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা দূরবর্তী অঞ্চলে তাদের শক্তি প্রয়োগের সুযোগ দেবে।
৩. হুতি মিলিশিয়াদের সহায়তা এবং ‘প্রতিরোধ অক্ষ’: সুদানে একটি নৌঘাঁটি ইরানের জন্য ইয়েমেনের হুতি মিলিশিয়াদের কাছে সহজে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে কাজ করতে পারে। হুতিরা লোহিত সাগরের বাব আল-মান্দাব প্রণালীতে আক্রমণ চালিয়ে বস্তুত ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’কে শক্তিশালী করছে। লোহিত সাগরের অবস্থান ইরানকে ইসরায়েলের দক্ষিণ প্রান্তের সামরিক গতিবিধি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে এবং সম্ভাব্যভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে সহায়তা করবে, যা তেহরানের প্রধান ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
৪. আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার ও মিত্রদের একত্রিত করা: এসএএফকে সমর্থন করার মাধ্যমে ইরান বৃহত্তর ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে চায়, একই সঙ্গে তারা আরব আমিরাতের প্রভাব খর্ব করতে বদ্ধ পরিকর। আরএসএফকে আরব আমিরাত সমর্থন দেওয়ায়, এসএএফকে সমর্থন করা ইরানের জন্য আরব আমিরাতের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাধা দেওয়ার একটি সরাসরি উপায়। সুদানে সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা ইরানকে আঞ্চলিকভাবে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে এবং রাশিয়া ও অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে নতুন জোট গড়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে এসএএফ নেতা জেনারেল আল-বুরহান রাশিয়ার সঙ্গেও নৌঘাঁটি নিয়ে আলোচনা করছেন এবং সৌদি আরবের সঙ্গে সুদানের ভালো সম্পর্ক থাকায়, ইরান তাদের প্রস্তাবিত নৌঘাঁটির চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে কিনা, তা এখনও অনিশ্চিত। কিন্তু তেহরানের জন্য এই সামরিক সহায়তা একটি সুস্পষ্ট দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
গ. মিশরের অবস্থান
মিশর ঐতিহ্যগতভাবে খার্তুমের সামরিক নেতৃত্বকে সমর্থন করে এবং এসএএফের সরকারকে সুদানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কায়রো তাদের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসএএফকে সামরিক প্রশিক্ষক এবং ড্রোন সহায়তা দিয়েছে বলে জানা যায়। সুদানের গৃহযুদ্ধে মিশরের অবস্থান এসএএফের প্রতি ঐতিহ্যগত সমর্থন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ দ্বারা পরিচালিত।
সুদান ইস্যুতে মিশরের ভূমিকা:
১. এসএএফকে সমর্থনের মূল কারণ: নীল নদ মিশরের প্রায় ৯০ শতাংশ সুপেয় পানির উৎস এবং দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। তাই নীল নদের পানি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মিশরের অস্তিত্বের জড়িত, মিশর চায় সুদানে একটি স্থিতিশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার ক্ষমতায় থাকুক, যাতে নীল নদের জলপ্রবাহসংক্রান্ত কোনো নীতিতে বাধা না আসে। সুদানে চলমান বিশৃঙ্খলা বা আরএসএফের শক্তিশালী হওয়া নীল নদের উজানে মিশর বিরোধী কোনো জোটকে উৎসাহিত করতে পারে বলে কায়রো মনে করে। এছাড়াও সুদান মিশরের দক্ষিণ সীমান্ত-সংলগ্ন একটি দীর্ঘ দেশ। সুদানে আরএসএফের প্রভাব বাড়লে তা মিশরের সীমান্তে চোরাচালান, অস্ত্র পাচার ও উগ্রবাদী কার্যক্রম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
২। এসএএফকে সামরিক সহায়তা: যদিও মিশর আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএফের পক্ষ থেকে আসা সরাসরি সামরিক সহায়তার অভিযোগ অস্বীকার করে, তবে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সূত্র অনুযায়ী কায়রো এসএএফকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিয়েছে। মিশরীয় সামরিক প্রশিক্ষকরা সুদানি সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সংঘাত শুরুর দিকে, সুদানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিতে আসা মিশরীয় বিমান বাহিনীর কিছু সদস্যকে আরএসএফ আটক করেছিল, যা দুই দেশের সামরিক সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করে। আরএসএফ প্রধান মোহাম্মেদ হামদান দাগালো সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে মিশর এসএএফকে ড্রোন সরবরাহ করেছে এবং বিমান হামলার সাথেও জড়িত ছিল।
৩. কূটনৈতিক অবস্থান: মিশর জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বাধীন এসএএফকে সুদানের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বিপরীতে আরএসএফ প্রধান হামদান দাগালোকে সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থন করছে, যা মিশর ও আমিরাতের আঞ্চলিক নীতির মধ্যে পার্থক্য তৈরি করেছে। তবে মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র সমন্বিত ‘কোয়াড’ মধ্যস্থতাকারী দলের অংশ হিসেবে সংঘাতের সমাধান এবং মানবিক যুদ্ধবিরতি অর্জনের প্রচেষ্টাতেও জড়িত রয়েছে।
সুদানের গৃহযুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হস্তক্ষেপের মূল কারণগুলো বহুমুখী ও কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা চালিত। সংক্ষেপে কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
ক. সুদানের স্বর্ণের নিয়ন্ত্রণ
সংযুক্ত আরব আমিরাত সুদান থেকে আসা স্বর্ণের প্রধান আমদানিকারক। আরএসএফ নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালোর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র দুবাইয়ে অবস্থিত বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, দারফুরের স্বর্ণখনি থেকে উত্তোলিত বিপুল পরিমাণ সোনা তিনি ও তার পরিবার আমিরাতে পাচার করেছেন। এই স্বর্ণের বাণিজ্য তার পরিবারের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং নিজেদের তেল নির্ভর অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে আরব আমিরাত আরএসএফকে সমর্থন করে বলে মনে করা হয়।
খ. লোহিত সাগরের কৌশলগত নিরাপত্তা
সুদানের লোহিত সাগরের দীর্ঘ উপকূলরেখাটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্য রুট, যা সুয়েজ খাল এবং বাব-আল-মান্দেব প্রণালির সঙ্গে যুক্ত। আরব আমিরাত এই অঞ্চলে বন্দর এবং সামুদ্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে চাচ্ছে। সুদানের আবু আমামা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে আমিরাতের আগ্রহ এই কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রমাণ দেয়। এই রুটের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা মিত্রশক্তির মাধ্যমে প্রভাব বজায় রাখা আরব আমিরাতের বাণিজ্য নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ. কৃষি ও খনিজ সম্পদ
সুদান একসময় ‘আফ্রিকার খাদ্যভান্ডার’ হিসেবে পরিচিত ছিল, নীল নদের আশীর্বাদপুষ্ট সুদানে এখনো বিশাল পরিমাণ অব্যবহৃত উর্বর কৃষি জমি রয়েছে। আমিরাত তাদের খাদ্য সরবরাহ সুরক্ষিত করতে এই অনাবাদি জমিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। আরব আমিরাত ভিত্তিক কিছু বৃহৎ কোম্পানি (যেমন ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানি, জেনান ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ) ইতিমধ্যে সুদানে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে পশুখাদ্য ও ফসল উত্পাদন করছে। কিন্তু এসএএফের নেতৃত্বাধীন সরকার অতীতে আমিরাতের কিছু কৃষি চুক্তিকে অন্যায্য বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ তেল-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং স্বর্ণের বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে সুদানের সম্পদ আমিরাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরএসএফের অবৈধভাবে উত্তোলিত বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের প্রধান গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাত। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এসএএফ-নিয়ন্ত্রিত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করার চেয়ে আরএসএফের মাধ্যমে স্বর্ণের লেনদেন করা আমিরাতের জন্য অনেক সহজ। এসব কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাত সুদানের অব্যবহৃত কৃষি জমি ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। সোনা ছাড়াও সুদানে ইউরেনিয়াম, লোহা ও পেট্রোলিয়ামের মতো অন্যান্য খনিজ সম্পদও রয়েছে। আরএসএফকে সমর্থন করে আরব আমিরাত এই সম্পদগুলিতেও ভবিষ্যতে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করতে চাচ্ছে। মোটকথা সংযুক্ত আরব আমিরাত তার অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সুদানের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ চায়।
ঘ. আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার
সুদানের গৃহযুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হস্তক্ষেপ তাদের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের বৃহত্তর কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন। আরব আমিরাত আরএসএফকে সমর্থন করার মাধ্যমে আমিরাত একদিকে যেমন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামপন্থী রাজনৈতিক প্রভাবকে দুর্বল করতে চাইছে, যা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল, তেমনি অন্যদিকে তারা একটি আজ্ঞাবহ মিত্রশক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট।
আরএসএফ নেতা হামদান দাগালোর সঙ্গে থাকা স্বর্ণ ও কৃষিজমির বাণিজ্যিক সম্পর্ক আমিরাতের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সুরক্ষিত করে। অনেক বিশ্লেষক এই সংঘাতকে উপসাগরীয় দেশগুলির মধ্যে, বিশেষত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের একটি ছায়াযুদ্ধ হিসেবে দেখেন। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য সুদানে এমন একটি স্থিতিশীল (কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ) পরিবেশ তৈরি করা, যা আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত স্বার্থকে দীর্ঘমেয়াদে রক্ষা করবে এবং আঞ্চলিক শক্তিকেন্দ্রে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করবে।
ঙ. ইসলামবাদী প্রভাব হ্রাস
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের দীর্ঘ শাসনামলে এসএএফের অভ্যন্তরে ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শে অনুপ্রাণিত গোষ্ঠীর ব্যাপক প্রভাব ছিল। সামরিক বাহিনীকে আল-বশির তার ইসলামপন্থী শাসনকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এখনো এসএএফের উচ্চপদে থাকা বহু কর্মকর্তা ইসলামপন্থী আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল। আমিরাত এই গভীরভাবে প্রোথিত ইসলামপন্থী প্রভাবকে তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হিসেবে দেখে। অপর দিকে আরএসএফের নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো প্রকাশ্যে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার পক্ষে হিসেবে তুলে ধরেছেন। এ জন্য আরএসএফকে সমর্থন করে আরব আমিরাত এসএএফের ক্ষমতা খর্ব করতে এবং সুদানে ইসলামপন্থী প্রভাব কমাতে চাচ্ছে।
বহু বিশ্লেষক মনে করেন সুদানের সংঘাত আঞ্চলিক আরব দেশগুলোর মধ্যেকার গভীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে উন্মোচিত করেছে, যা ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে সহায়ক। ধারণা করা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত সন্তর্পনে ইজরায়েলের ‘বিভাজন ও দুর্বল’ কৌশলকে এগিয়ে নিচ্ছে।
ক. ইসরায়েলের ‘পেরিফেরি ডকট্রিন’
ইসরায়েল ঐতিহাসিকভাবেই তার আশেপাশের প্রতিকূল আরব দেশগুলোর প্রভাব কমাতে আরব-অক্ষ থেকে দূরে থাকা বা আরব দেশের অভ্যন্তরের সামরিক বা জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের নীতি গ্রহণ করেছে।
খ. আব্রাহাম চুক্তি ও সম্পর্ক
সুদান ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার (আব্রাহাম অ্যাকর্ডস) প্রক্রিয়া শুরু করে। ইসরায়েল নিজেও সংঘাত শুরু হওয়ার আগে এসএএফ প্রধান বুরহান এবং আরএসএফ নেতা হামদান দাগালো, উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র দপ্তর বুরহানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিল, অন্যদিকে মোসাদের সঙ্গে হামদান দাগালোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। হামদান দাগালো প্রকাশ্যেই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ার পক্ষে ছিলেন। ইসরায়েল নিজেও এই অঞ্চলে তার সামরিক ও নিরাপত্তা উপস্থিতি জোরদার করতে আগ্রহী।
গ. আরব ঐক্যে ফাটল
সুদান যুদ্ধ ইরান-তুরস্ক-মিশর সমর্থিত এসএএফ এবং ইউএই-সমর্থিত আরএসএফের মধ্যে একটি প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আরব শক্তিগুলো যখন একটি একক ফ্রন্ট হিসেবে না থেকে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত এবং একে অপরের বিপক্ষে অস্ত্র সরবরাহ করছে, তখন বৃহত্তর আরব ঐক্য দুর্বল হচ্ছে। এই পরিস্থিতি আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যা লোহিত সাগর ও ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় পরোক্ষভাবে সুবিধা দিতে পারে।
সত্যি বলতে, সুদানের সংঘাত আরএসএফ এবং এসএএফের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইকে ছাড়িয়ে এক জটিল আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে একদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত তার নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং লোহিত সাগরে কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখতে আরএসএফকে যেমন ড্রোন ও ভাড়াটে বাহিনীর মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছে। এর বিপরীতে তেমনি এসএএফকে সমর্থন জানাচ্ছে তুরস্ক, ইরান ও মিশর; যা আরব বিশ্বের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি স্পষ্ট অক্ষ তৈরি করেছে। এই সামরিক ও আর্থিক বিভাজন প্রকৃতপক্ষে আরব রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত শক্তিকে দুর্বল করছে। লোহিত সাগর কেন্দ্রিক নিরাপত্তা ও সোনার খনির ওপর অধিকারের এই লড়াই পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের ‘বিভাজন ও দুর্বল’ কৌশলের উদ্দেশ্য সাধন করছে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, সুদানের এই যুদ্ধ আরব দেশগুলোর মধ্যেকার পুরোনো ফাটলকে গভীর করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে চরম সংকটে ফেলেছে।