leadT1ad

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রাম্পবিরোধী ‘নো কিংস’ আন্দোলনে লাখো মানুষের বিক্ষোভ

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
শনিবার ওয়াশিংটনে নো কিংস বিক্ষোভের সময় পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউতে বিক্ষোভকারীরা সমাবেশ করেছেন। ছবি: সংগৃহীত।

শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একাধিক শহরে লাখ লাখ মানুষ ‘নো কিংস’ আন্দোলনে অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, দেশটি ক্রমে স্বৈরতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘কোনো রাজা নেই, থাকবে না’ — এটাই তাদের মূল বার্তা।

এই আন্দোলন জুন মাসের ঐতিহাসিক বিক্ষোভের দ্বিতীয় ধাপ। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভগুলোর একটি।

এই বিক্ষোভগুলো ছয় মাস আগের পরিস্থিতি থেকে একেবারে ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে। তখন ডেমোক্র্যাটরা জাতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পথ খুঁজে পাচ্ছিল না।

ইনডিভিজিবল সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এজরা লেভিন বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটরা এখন কিছুটা সাহস দেখাচ্ছে। এই মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বড় ভুল হবে আত্মসমর্পণ করা।’

রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি থেকে শুরু করে লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক, শিকাগো, আটলান্টা, সান ফ্রান্সিসকোসহ বড় ও ছোট শহরে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামে। অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনা লেখা বিশাল ব্যানারে স্বাক্ষর করেন।

শিকাগোতে প্রায় এক লাখ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। তাদের অনেকের হাতে ছিল ট্রাম্পবিরোধী ব্যানার ও স্লোগান— ‘ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ করো’, এবং ‘শিকাগো থেকে দূরে থাকো’। এই স্লোগানটি শুরু হয় যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শহরে ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর ঘোষণা দেন।

যদিও অনেক পোস্টারে এমন ভাষা ছিল যা সম্প্রচারের উপযোগী নয়। ইলিনয় প্রতিনিধি জনাথন জ্যাকসন মঞ্চে উঠলে জনতা ট্রাম্পবিরোধী অশালীন স্লোগানে ফেটে পড়ে।

মিনেসোটার সেন্ট পলে ‘নো কিংস’ প্রতিবাদের সময় মিনেসোটা স্টেট ক্যাপিটল ভবনের বাইরে বিক্ষোভকারীরা সমাবেশ করছে। ছবি: সংগৃহীত।
মিনেসোটার সেন্ট পলে ‘নো কিংস’ প্রতিবাদের সময় মিনেসোটা স্টেট ক্যাপিটল ভবনের বাইরে বিক্ষোভকারীরা সমাবেশ করছে। ছবি: সংগৃহীত।

শিকাগোর মেয়র ব্র্যান্ডন জনসন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে তারা গৃহযুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়, যে যুদ্ধে ১৯ শতকে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা পরাজিত হয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে এসেছি। আমরা নত হব না, ভীত হব না, আত্মসমর্পণ করব না। আমাদের শহরে আমরা কোনো সৈন্য চাই না।’

লস অ্যাঞ্জেলেসে বিক্ষোভে অংশ নেন ৭২ বছর বয়সী জিনি এস্চব্যাক, যিনি ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পর থেকে ৪২টি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাগান্বিত, কিন্তু সহিংস নই। ট্রাম্প প্রশাসন বাকস্বাধীনতা সংকুচিত করছে, সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।’

ওয়াশিংটন ডিসিতে ২ লাখের বেশি মানুষ কংগ্রেস ভবনের সামনে জড়ো হয়। অনেক শহরে বিক্ষোভকারীরা ব্যাঙ, ইউনিকর্ন বা অন্যান্য প্রাণীর মতো বাতাস দিয়ে ফোলানো পোশাক পরে অংশ নেয়— যা মূলত প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের বিক্ষোভে সেনেটর রাফায়েল ওয়ারনক বলেন, ‘যখন একজন প্রেসিডেন্ট জনগণকে ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ বলে আখ্যা দেন, তখন সব আমেরিকানেরই উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।’

প্রতিবাদকারীরা ট্রাম্পের শহরগুলোতে ফেডারেল সৈন্য পাঠানো, অভিবাসীদের ওপর দমননীতি, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানায়।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ফেডারেল সেনা পাঠানোর চেষ্টা করছেন এবং আরও অভিবাসন কর্মকর্তা নিয়োগ দিচ্ছেন। এছাড়া তিনি তাঁর বিরোধিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে চান এবং বামপন্থী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন, যাদের তিনি সন্ত্রাসবাদ বা রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত বলে দাবি করেন।

নিউ ইয়র্কে ‘নো কিংস’ প্রতিবাদের সময় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী টাইমস স্কয়ারে অবস্থান নেয়। ছবি: সংগৃহীত।
নিউ ইয়র্কে ‘নো কিংস’ প্রতিবাদের সময় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী টাইমস স্কয়ারে অবস্থান নেয়। ছবি: সংগৃহীত।

বেশিরভাগ শহর এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, যাতে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন ঠেকানো যায়। নাগরিকরাও রাস্তায় নেমে তাদের শহরের সামরিকীকরণের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠরা ‘নো কিংস’ আন্দোলনকে দেশবিরোধী ও অ্যান্টিফা-নেতৃত্বাধীন বলে প্রচার করছে। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট জানিয়েছেন, তিনি অস্টিনে বিক্ষোভের আগে রাজ্যের ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করবেন।

ডেমোক্রেট সিনেটর চাক শুমার, ক্রিস মারফি ও বার্নি স্যান্ডার্স বিক্ষোভে অংশ নিয়ে বলেন, এই আন্দোলন আমেরিকাকে ভালোবাসার প্রকাশ। স্যান্ডার্স বলেন, ‘আমরা এসেছি আমাদের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, যাদের ত্যাগে এই দেশ গঠিত হয়েছে।’

বিক্ষোভ সংগঠকরা জানান, ‘নো কিংস’ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র রক্ষার প্রচেষ্টা। তাদের মূল বার্তা— ‘আমরা কোনো রাজাকে মানি না, এবং স্বৈরাচারের কাছে নতি স্বীকার করব না।’

বিক্ষোভের অন্যতম আয়োজক সংগঠন পাবলিক সিটিজেন-এর সহ-সভাপতি লিসা গিলবার্ট বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হলো— প্রেসিডেন্ট আমাদের ভয় দেখাতে চান, কিন্তু আমরা ভয় বা নীরবতার মাধ্যমে দমন হব না।’

শনিবার ওয়াশিংটন, ডিসিতে ‘নো কিংস’ প্রতিবাদে পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউতে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করছে। ছবি: সংগৃহীত।
শনিবার ওয়াশিংটন, ডিসিতে ‘নো কিংস’ প্রতিবাদে পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউতে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করছে। ছবি: সংগৃহীত।

বিক্ষোভের মূল বার্তা ছিল— ‘যুক্তরাষ্ট্রে কোনো রাজা নেই’। এটি ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়।

তবে ট্রাম্প ফক্স নিউজকে বলেন, ‘তারা আমাকে রাজা বলে উল্লেখ করছে, কিন্তু আমি কোনো রাজা নই।’

রিপাবলিকান নেতারা, বিশেষ করে হাউস স্পিকার মাইক জনসন, এই আন্দোলনকে ‘আমেরিকাবিরোধী সমাবেশ’ বলে আখ্যা দেন।

ওয়াশিংটন ডিসিতে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এই মন্তব্যের জবাবে বলেন, ‘তিনি সম্পূর্ণ ভুল বলছেন। লাখো আমেরিকান আজ রাস্তায় নেমেছে আমেরিকাকে ঘৃণা করার জন্য নয়, বরং আমেরিকাকে ভালোবাসার জন্য। আমরা এসেছি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষায় অতীতের ত্যাগকে সম্মান জানাতে।’

আয়োজকদের মতে, ট্রাম্প জনগণের করের অর্থ ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা বাড়াচ্ছেন এবং ফেডারেল বাহিনী পাঠিয়ে শহরগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছেন। তিনি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন এবং ইতিমধ্যে রাজাধিরাজের মতো আচরণ করছেন। ট্রাম্প প্রশাসন আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে, সরকারি সেবা কমিয়ে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই মানুষকে দেশছাড়া করে তার নীতি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।

এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভগুলোর একটি। ছবি: সংগৃহীত।
এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভগুলোর একটি। ছবি: সংগৃহীত।

বামপন্থী দলগুলো স্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বাস্তব দাবির আহ্বান জানিয়েছে। সোশ্যালিস্ট ইক্যুয়ালিটি পার্টি ১৫ অক্টোবরের এক বিবৃতিতে জানায়, ‘নো কিংস’ স্লোগানটি গণমানুষের স্বৈরাচারবিরোধী অনুভূতি প্রকাশ করে। তবে তারা সতর্ক করে দিয়ে বলে, ‘শুধু ক্ষোভ ও প্রতিবাদ স্বৈরতন্ত্র ঠেকাতে যথেষ্ট নয়।’

প্রগতিশীল সংগঠন পাবলিক সিটিজেন জানায়, এই বিক্ষোভের উদ্দেশ্য ‘আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেআইনি প্রশাসনের’ বিরোধিতা করা। তাদের মতে, ‘লাখো মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে একত্রিত হয়েছে, রাজতন্ত্র বা স্বৈরশাসনের কাছে নতি স্বীকার না করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।’

গত জুনে অনুষ্ঠিত প্রথম ‘নো কিংস’ বিক্ষোভে ২ হাজারটিরও বেশি স্থানে ২০ লাখ থেকে প্রায় ৪৮ লাখ মানুষ অংশ নেয়। হার্ভার্ডের ক্রাউড কাউন্টিং কনসোর্টিয়ামের হিসাবে এটি ছিল ২০১৭ সালের নারী মার্চের পর যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম একদিনের গণবিক্ষোভ।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Ad 300x250

সম্পর্কিত