leadT1ad

পশ্চিম তীরে এখনও যুদ্ধ কেন

ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি হলেও পশ্চিম তীরে প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি কৃষক ও তাদের জমির ওপর হামলা হচ্ছে। লিখেছেন অধিকৃত পশ্চিম তীরের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং লেখক মোহাম্মদ আলকিক

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ০৭
এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২১২ জন শিশু। ছবি: সংগৃহীত।

গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এসেছে এক সপ্তাহ আগে। খবরটি যখন পশ্চিম তীরে আমরা শুনলাম, আনন্দে উল্লাস করেছিলাম। মনে হয়েছিল—অবশেষে গণহত্যা শেষ হচ্ছে। কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারলাম, আমাদের জন্য কোনো যুদ্ধবিরতি নেই।

দশকের পর দশক ধরে চলা প্রতিদিনের সহিংসতা ও দমননীতি এখনও বন্ধ হয়নি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে দখলদার শক্তির নৃশংসতা আরও বেড়েছে। আজ পশ্চিম তীরে জীবন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

সহিংসতা, বঞ্চনা ও অচল জীবন

যুদ্ধবিরতির খবর শুনে এক বন্ধুর ছোট মেয়ে খুশিতে বলল, সে দাদা-দাদীর সঙ্গে জলপাই তুলতে যাবে। কিন্তু বাবা জানালেন, তা সম্ভব নয়। মেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? যুদ্ধ তো শেষ হয়েছে, তাই না?’

এক শিশুকে কীভাবে বোঝানো যায় যে, গাজায় যুদ্ধবিরতি মানেই পশ্চিম তীরে শান্তি নয়? এখানকার মানুষ এখনও নিজেদের জমিতে যেতে পারে না। ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলার ভয় অথবা সেনা চৌকির বাধা তাদের পথ রোধ করে।

প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি কৃষক ও তাদের জমির ওপর হামলা হচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইহুদী বসতি স্থাপনকারীরা ৭ হাজার ১৫৪টি হামলা চালিয়েছে, যার কিছু মারাত্মক প্রাণঘাতী।

এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২১২ জন শিশু। বাড়িঘর হারিয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত। ইহুদী বসতি স্থাপনকারীরা ও সৈন্যরা ৩৭ হাজার ২৩৭টি জলপাই গাছ ধ্বংস করেছে।

এমনকি শহুরে জীবনও এখন সহ্যসীমার বাইরে।

আমি রামাল্লাহর উত্তরে অবস্থিত রাওয়াবি শহরের বাসিন্দা। প্রতিদিনই দখলের শ্বাসরোধ অনুভব করি। একটি সাধারণ কাজের জন্য শহরের বাইরে যেতে হলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেকপোস্টে আটকে থাকতে হয়।

রাওয়াবি ও রামাল্লাহর মধ্যে মাত্র দশ মিনিটের পথ, কিন্তু চারটি লোহার গেট, একটি সামরিক টাওয়ার ও একটি দেয়াল এই যাত্রাকে অন্তহীন করে তোলে। পুরো পশ্চিম তীরে বর্তমানে ৯১৬টি ইসরায়েলি চৌকি ও লোহার গেট রয়েছে। এর মধ্যে ২৪৩টি নতুন করে তৈরি হয়েছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর।

এই চৌকিগুলো ইসরায়েলি সেনাদের ইচ্ছামতো খোলা বা বন্ধ হয়, ফলে কেউ ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকতে পারে। এতে পারিবারিক দেখা-সাক্ষাৎ, চিকিৎসা, শিক্ষা ও পণ্য পরিবহন—সব কিছুই ব্যাহত হচ্ছে।

ইহুদী বসতি স্থাপনকারীরা ও সৈন্যরা ৩৭ হাজার ২৩৭টি জলপাই গাছ ধ্বংস করেছে। ছবি: রয়টার্স।
ইহুদী বসতি স্থাপনকারীরা ও সৈন্যরা ৩৭ হাজার ২৩৭টি জলপাই গাছ ধ্বংস করেছে। ছবি: রয়টার্স।

আমরা জেরুজালেমে প্রবেশের অধিকার থেকেও বঞ্চিত।

ফলে আল-আকসা মসজিদ বা চার্চ অব দ্য হোলি সেপালকারে প্রার্থনার সুযোগ নেই। অল্প কয়েকজন ফিলিস্তিনিকেই বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়। আমরা শেষবার জেরুজালেমে গিয়েছিলাম ২০ বছরেরও বেশি আগে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের তরুণরা শহরটিকে কেবল গল্প ও ছবিতেই চেনে।

রাতেও শান্তি নেই। যে কোনো ফিলিস্তিনি বাড়িতে ইসরায়েলি সেনারা অভিযান চালাতে পারে। তারা দরজা ভেঙে ঢোকে, পরিবারকে ভয় দেখায় এবং বিনা অভিযোগে আটক করে। এসময় চোখে পানি আনা গ্যাস নিক্ষেপ করে আশপাশের বাসিন্দাদেরও আতঙ্কিত করা হয়।

আমরা জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চনার শিকার। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা আজ স্বাভাবিক জীবনের সব অধিকার হারিয়েছে—নামাজ পড়ার স্বাধীনতা, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, অবাধ চলাচল, চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার—

সবকিছুই এখন দখলদার শক্তির নিয়ন্ত্রণে বন্দি।

অধিগ্রহণের আতঙ্ক

১৯৬৭ সালের দখলদারিত্বের পর থেকে ইসরায়েল ধীরে ধীরে পশ্চিম তীরের প্রায় অর্ধেক ভূমি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এটি করেছে বসতি স্থাপন ও ফিলিস্তিনি জমি দখলের মাধ্যমে, যেগুলোকে ‘রাষ্ট্রীয় ভূমি’ বা ‘সামরিক এলাকা’ ঘোষণা করা হয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে এই ভূমি দখল আরও বেড়েছে—মাত্র দুই বছরে প্রায় ১২ হাজার ৩০০ একর জমি দখল করা হয়েছে। দখল করা জমি সাধারণত নতুন বসতি স্থাপন বা পুরনো বসতি সম্প্রসারণে ব্যবহার করা হয়।

এই বসতি স্থাপন এলোমেলো নয়; বরং ইসরায়েল এমনভাবে জমি বেছে নেয় যাতে ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা যায়। ফলে ফিলিস্তিনি অঞ্চলের ভৌগোলিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ভেঙে যায়।

এই অবৈধ বসতিগুলো টিকিয়ে রাখতে, ইসরায়েল পশ্চিম তীরের প্রাকৃতিক সম্পদেও দখল নিয়েছে। তারা প্রায় সব পানি সম্পদ দখল করেছে, যার ফলে বসতি সম্প্রসারণের জন্য বৃহৎ পানির ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এখন তারা সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলি পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেকোরোট’-এর ওপর নির্ভরশীল। এই প্রতিষ্ঠান ফিলিস্তিনিদের জনসংখ্যা অনুযায়ী অতি অল্প পানি বরাদ্দ করে, অথচ বসতি স্থাপনকারীরা কয়েকগুণ বেশি পানি পায়।

রাতেও শান্তি নেই। যে কোনো ফিলিস্তিনি বাড়িতে ইসরায়েলি সেনারা অভিযান চালাতে পারে। ছবি: সংগৃহীত।
রাতেও শান্তি নেই। যে কোনো ফিলিস্তিনি বাড়িতে ইসরায়েলি সেনারা অভিযান চালাতে পারে। ছবি: সংগৃহীত।

প্রতি গ্রীষ্মে যখন খরা দেখা দেয়, ফিলিস্তিনিদের উচ্চমূল্যে অতিরিক্ত পানি কিনতে হয়। অন্যদিকে, তাদের কূপ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ট্যাংক প্রায়ই ধ্বংস করা হয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল অধিগ্রহণ পরিকল্পনা আরও ত্বরান্বিত করেছে।

এখন মনে হচ্ছে, অসলো চুক্তিতে নির্ধারিত ‘এরিয়া সি’ অঞ্চল—যেখানে ইসরায়েলের পূর্ণ প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ আছে— তা শিগগিরই সম্পূর্ণ দখলে নেওয়া হবে।

এর মানে হবে, ফিলিস্তিনি গ্রাম ও বসতি উচ্ছেদ করে মানুষদের ‘এরিয়া এ’-তে ঠেলে দেওয়া, যা পশ্চিম তীরের মাত্র ১৮ শতাংশ। পরে ‘এরিয়া বি’-তেও একই প্রক্রিয়া চালু হবে।

বেদুইন সম্প্রদায়ের ওপর ইতিমধ্যেই এই জোরপূর্বক উচ্ছেদ শুরু হয়েছে। এটাই আজ পশ্চিম তীরের বাস্তবতা।

যখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শান্তি সম্মেলন ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, আমরা এখানে প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় হয়রানি, দমন, উচ্ছেদ ও হত্যার শিকার হচ্ছি।

দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল রাজনৈতিক সমাধানকে উপেক্ষা করে ভূমি, মানুষ ও সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

তাদের বোমাবর্ষণ বন্ধ হলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি—এটি শুধু রূপ বদলেছে।

সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হলো—ইসরায়েলি দখলদারত্বের অপরাধকে স্বীকার করা এবং তার অবসান ঘটানো।

Ad 300x250

সম্পর্কিত