leadT1ad

কেমন ছিল আইয়ুব বাচ্চু-জেমসের সম্পর্ক

আজ ১৮ অক্টোবর, আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুদিন। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর কনসার্টে গান গাওয়ার সময় আইয়ুব বাচ্চুর শোকে প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন জেমস। আদতেই কি তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল? প্রকাশ্যে একজন কি আরেকজনকে প্রশংসা করতেন?

উপল বড়ুয়া
উপল বড়ুয়া
স্ট্রিম গ্রাফিক

‘এক বনে দুই বাঘ’ থাকতেই পারে, যদি প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে সহাবস্থান তৈরি করে নিতে পারে। ঠিক যেমন, একই সময়ে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের দুই আইকন আইয়ুব বাচ্চু ও জেমস সেই সহাবস্থানের ভেতর দিয়েই হয়ে উঠেছেন মায়েস্ত্রো।

আইয়ুব বাচ্চু আর জেমসের বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা আজ কে না জানে! যেখানে আইয়ুব বাচ্চুর নাম আসে, সেখানে অবধারিতভাবে চলে আসে জেমসের নাম। আবার জেমসের প্রসঙ্গ উঠলেই চলে আসে আইয়ুব বাচ্চু নাম। আদতেই কি তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল? প্রকাশ্যে একজন কি আরেকজনকে প্রশংসা করতেন?

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর কনসার্টে গান গাওয়ার সময় আইয়ুব বাচ্চুর শোকে প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন জেমস। সংগৃহীত ছবি
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর কনসার্টে গান গাওয়ার সময় আইয়ুব বাচ্চুর শোকে প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন জেমস। সংগৃহীত ছবি

মোটাদাগে নব্বই দশকে বাংলা রকের যে ‘সিনারিও’, সেখানে ‘এলআরবি’র আইয়ুব বাচ্চু ও ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের জেমস ছাড়াও ছিলেন ‘আর্ক’-এর হাসান। কিন্তু প্রথম দুই জন যেভাবে প্রতিনিয়ত নিজেদের ছাড়িয়ে গেছেন, হাসান সেভাবে পারেননি বিভিন্ন কারণে। তখন তরুণদের মধ্যে আজম খানের ছিল বিশাল প্রভাব। সবকিছুর ভেতর দিয়েই সতীর্থ আর ভক্তদের মাঝে আইয়ুব বাচ্চুর ‘বস’ হয়ে ওঠা আর জেমসের ‘গুরু’ খ্যাতি পাওয়া। জেমসের আগে শুধু আজম খানই জনতার কাছে গুরু হতে পেরেছিলেন।

তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন জেমস আর আইয়ুব বাচ্চুর জার্নি মোটেও সহজ ছিল না। বলতে গেলে, ওই সময় বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে জোয়ার চলছে। ওয়ারফেজের হার্ড রক, মাইলসের পপ—তখন বেশ জনপ্রিয়। এর বাইরে আরও আগে পরের অনেক ব্যান্ডই তো ছিল। প্রত্যেকের নিজস্ব সিগনেচার ছিল নিজেদের মিউজিকে। তবে তার মধ্যেও একেবারে উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রম ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু আর জেমস। কী গানে কী ধ্যানে—দুজনই হয়ে উঠেছিলের বাংলা ব্যান্ডের অন্যতম দুই চরিত্র।

সবকিছুর ভেতর দিয়েই সতীর্থ আর ভক্তদের মাঝে আইয়ুব বাচ্চুর ‘বস’ হয়ে ওঠা আর জেমসের ‘গুরু’ খ্যাতি পাওয়া। জেমসের আগে শুধু আজম খানই জনতার কাছে গুরু হতে পেরেছিলেন।

তবে দুজনেই ছিলেন চলনেবলনে-সংগীতে পুরোপুরি আলাদা। আইয়ুব বাচ্চুর মাস্টার গিটার প্লেয়িং আর জেমসের নিজেকে ভেঙে ইউনিক এক ভয়েস দিয়ে মঞ্চ কাঁপানো। বাংলা ব্যান্ডের শ্রোতারা বুঝেছিল, একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনের কাছে যাওয়া যায় না। শুনতেই হয়।

ভক্ত-সমর্থকেরা না হয় একসঙ্গে দুই জনকেই চেয়েছেন, তবে বাচ্চু-জেমস কি চেয়েছেন? না, তাঁদের মধ্যে হয়তো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসির মতো প্রতিনিয়ত একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। ছিল না শেন ওয়ার্নের ঘূ্র্ণিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো মাথা উঁচু করে শচীন টেন্ডুলকারের ২২ গজে হেঁটে যাওয়া।

আলাদা ব্যান্ডের হলেও দুজনে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি অ্যালবামে কাজ করেছেন। সংগৃহীত ছবি
আলাদা ব্যান্ডের হলেও দুজনে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি অ্যালবামে কাজ করেছেন। সংগৃহীত ছবি

বাচ্চু-জেমসের মধ্যে যেটা ছিল সেটা হচ্ছে, পরস্পরের প্রতি সম্মান। পরস্পরের প্রতিভা জেনে কাজকে সম্মান। যেটা ১০ বছরে সামনাসামনি দেখা না হলেও একইরকম থাকে। এই কারণে টিভি অনুষ্ঠানে এসে আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘জেমসের মতো আর কেউ আসবে না’। আবার একই কারণে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর কনসার্টে গান গাওয়ার সময় আইয়ুব বাচ্চুর শোকে প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন জেমস।

শুধু জেমস নয়, আইয়ুব বাচ্চুর মতোও কেউ আর বাংলা গানে আসবে কিনা সন্দেহ আছে। অমন গিটার প্লেয়িংয়ের সঙ্গে একেকটি তুমুল জনপ্রিয় গান উপহার দেওয়া সম্ভব অন্য কারও পক্ষে? আজও যখন কেউ গিটার হাতে তুলে নেয়, সে স্মরণ করে আইয়ুব বাচ্চুকে। আজও যখন কেউ গলা খুলে গাইতে চায়, জেমসের মতো গলা ছেড়ে দেয়। জেমসও দুর্দান্ত গিটার বাদক। কিন্তু সেটা ছাড়িয়ে তাঁর ভয়েস হয়ে উঠেছে আমাদের সম্পদ।

শুধু জেমস নয়, আইয়ুব বাচ্চুর মতোও কেউ আর বাংলা গানে আসবে কিনা সন্দেহ আছে। অমন গিটার প্লেয়িংয়ের সঙ্গে একেকটি তুমুল জনপ্রিয় গান উপহার দেওয়া সম্ভব অন্য কারও পক্ষে?

আইয়ুব বাচ্চুও দুর্দান্ত গায়ক। কিন্তু সেটা ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘গিটারের ওস্তাদ’। এ যেন বুদ্ধদেব বসুর সেই অমর প্রবন্ধ ‘এক গ্রীষ্মে দুই কবি’। যেখানে তিনি দুই রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কি ও লেভ তলস্তয়ের তুলনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘টলস্টয় যেন বিরাট, প্রাচীন ও রহস্যময় এক বিগ্রহ, যার সামনে দাঁড়ালে ভক্তিতে ও ভয়ে আমাদের মাথা নুয়ে আসে, আর ডস্টয়েভস্কিকে দেখামাত্র আমরা স্বতস্ফূর্তভাবে বলে উঠি—দ্যাখো, এই যে মানুষ।’

সেই মানুষ কে? আইয়ুব বাচ্চু নাকি জেমস? দুজনের তুলনা আসবেই। আলাদা ব্যান্ডের হলেও দুজনে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি অ্যালবামে কাজ করেছেন। দুজনেই হয়তো চেয়েছেন, একজন আরেকজনের চেয়ে ভালো কাজ করার। সেই কারণেই আমরা পেয়েছি অসংখ্য মাস্টারপিস আর স্মৃতি। তারপরও বলতে হয়, দুজনের সম্পর্কে কি ফাটল ধরেছিল?

এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর আগের মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চু আর জেমস নিজেদের মধ্যে কথা বলেননি। দুজনের ভেতরে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব চোখে পড়েছিল। সেটা কি দ্বন্দ্ব নাকি অভিমান? তা জানার উপায় নেই আমাদের। আছে আইয়ুব বাচ্চুর অসংখ্য রেখে যাওয়া গান আর তাঁর সঙ্গে জেমসের স্মৃতি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত