leadT1ad

চার মিনিটের ডাকাতি: ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়াম থেকে যেভাবে চুরি হল অমূল্য রত্ন

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
লুভর জাদুঘরের অ্যাপোলো গ্যালারিতে সম্রাজ্ঞী ইউজেনি ডি মন্টিজোর মুকুট প্রদর্শিত হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত লুভর জাদুঘর ‘বিশেষ কারণে’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একদল দুর্বৃত্ত মাত্র চার মিনিটে সেখানে প্রবেশ করে আটটি অমূল্য গয়না চুরি করেছে। ঘটনাটি জাদুঘরজগতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

রবিবার প্যারিসজুড়ে চোরদের ধরতে অভিযান চালানো হয়। পুলিশ জাদুঘরটি ঘিরে ফেলে এবং সশস্ত্র সেনারা বিখ্যাত গ্লাস পিরামিড প্রবেশপথে টহল দিতে থাকে।

সরকার ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানায়, কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী জানালা ভেঙে জাদুঘরের গ্যালারি দ্য অ্যাপোলো অংশে প্রবেশ করে। এটি ফরাসি রাজমুকুটের গয়না সংরক্ষণের স্থান।

তারা আসবাব তোলার লিফট ব্যবহার করে ভবনে ওঠে এবং মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। পথে একটি গয়না ফেলে যায়।

প্রেসিডেন্ট ইম্মানুয়েল ম্যাক্রোঁ একে ‘ফরাসি ঐতিহ্যের ওপর হামলা’ বলে নিন্দা জানান। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’

কী ঘটেছিল

রবিবার সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে পর্যটকে ভরা জাদুঘরের ভেতর চোরেরা নির্দিষ্টভাবে অ্যাপোলোর গ্যালারি টার্গেট করে। এটি রাজা লুই চতুর্দশের আমলে নির্মিত সোনালি অলংকৃত হল।

তারা লিফট ব্যবহার করে জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ‘অমূল্য গয়না’ নিয়ে মোটরবাইকে পালায়।

ঘটনার পর লুভর দ্রুত সব দর্শনার্থীকে সরিয়ে নেয় এবং জানায়, দিনটিতে ‘বিশেষ কারণে’জাদুঘর বন্ধ থাকবে।

পুলিশ জাদুঘরের চারপাশ ও সেন নদীর তীর ঘিরে তদন্ত শুরু করে।

এক মার্কিন পর্যটক বলেন, ‘ঘটনাটা যেন সিনেমার দৃশ্যের মতো!’

কী কী চুরি হয়েছে

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে দুটি নিরাপদ কাচের কেস থেকে আটটি গয়না চুরি গেছে। এর মধ্যে রয়েছে নেপোলিয়ন প্রথমের স্ত্রী মারি-লুইজ ও নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউজেনির ব্যবহৃত কিছু গয়না।

চুরি হওয়া গয়নাগুলো— রানী মেরি-আমেলি ও রানী হর্টেন্সের গয়না সেটের টায়ারা, একই সেটের নীলা পাথরের নেকলেস, নীলা পাথরের একটি কানের দুল, মারি-লুইজের পান্না নেকলেস, মারি-লুইজের পান্না দুলের জোড়া, ‘রেলিকোয়ারি’ নামের ব্রোচ, সম্রাজ্ঞী ইউজেনির টায়ারা, ইউজেনির আরেকটি বড় ব্রোচ।

চোরেরা পালানোর সময় ইউজেনির মুকুট বাইরে ফেলে যায়। এতে ছিল ১ হাজার ৩৫৪টি হীরা ও ৫৬টি পান্না।

ডাকাতির সময় ব্যবহৃত একটি জানালা পরীক্ষা করছেন ফরেনসিক দলের একজন সদস্য। ছবি: রয়টার্স।
ডাকাতির সময় ব্যবহৃত একটি জানালা পরীক্ষা করছেন ফরেনসিক দলের একজন সদস্য। ছবি: রয়টার্স।

লুভরের অ্যাপোলো গ্যালারিতে আরও বহু অমূল্য রত্ন সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি ঐতিহাসিক হীরা— দ্য রিজেন্ট, দ্য স্যানসি, এবং দ্য হরটেনসিয়া। এছাড়া রয়েছে ফ্রান্সের রাজাদের কঠিন পাথরের তৈরি অলঙ্কার সংগ্রহ, যা জাদুঘরের ওয়েবসাইটে ‘অসাধারণ ঐতিহ্যের নিদর্শন’ হিসেবে বর্ণিত।

শিল্পচুরি বিশেষজ্ঞ ও ‘স্টিলিং রেমব্রান্ডটস’ বইয়ের সহলেখক অ্যান্থনি অ্যামোরে আল জাজিরাকে বলেন, এই সংগ্রহের গয়নাগুলো টাকার মানে নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে অমূল্য।

তিনি আরও বলেন, ‘এটি কোনো বিখ্যাত চিত্রকর্ম নয়, যার ছবি সঙ্গে সঙ্গে সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে ধরা পড়বে। এই ধরনের গয়নাগুলো ভেঙে আলাদা করে বিক্রি করা হতে পারে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে চেনা প্রায় অসম্ভব।’

কীভাবে ডাকাতি করা হয়

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চোরেরা স্কুটার ও পাওয়ার টুলস নিয়ে আসে। তারা ডিস্ক কাটার দিয়ে জানালার কাঁচ কেটে ভেতরে প্রবেশ করে।

এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, দুই ব্যক্তি নির্মাণকর্মীর পোশাকে লিফটে উঠে জানালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। পুরো কাজটি শেষ হয় ৩০ সেকেন্ডে।

চোরেরা সেন নদীর পাশের দিক দিয়ে প্রবেশ করে, যেখানে সংস্কারকাজ চলছিল।

সংস্কৃতি মন্ত্রী রাশিদা দাতি জানান, ‘আমরা খবর পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। কিন্তু তার আগেই ডাকাতরা সটকে পড়ে। পুরো ডাকাতিটি চার মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়।’

ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, লিফটটি সেন নদীমুখী দেয়ালে স্থাপন করা ছিল, যা সরাসরি একটি বারান্দার জানালায় গিয়ে মিলেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই জানালাই ছিল চোরদের প্রবেশপথ। পরে রবিবার সেটি সরিয়ে ফেলা হয়।

লুভর জাদুঘরে প্রবেশের জন্য ডাকাতদের ব্যবহৃত একটি আসবাবপত্রের লিফট। ছবি: এএফপি।
লুভর জাদুঘরে প্রবেশের জন্য ডাকাতদের ব্যবহৃত একটি আসবাবপত্রের লিফট। ছবি: এএফপি।

এরপর কী

চোরেরা এখনও ধরা না পড়ায়, ফরেনসিক দল লুভর ও আশপাশের এলাকায় প্রমাণ সংগ্রহ করছে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, গয়নাগুলোর বাজারমূল্যের চেয়ে ঐতিহাসিক মূল্যই বেশি। সংস্কৃতি মন্ত্রী দাতি মনে করেন, এটি পেশাদার অপরাধীচক্রের কাজ।

কর্তৃপক্ষ জানায়, রবিবার সকালে জাদুঘর খোলার সময় যে কর্মীরা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চুরি হওয়া গয়নার বিস্তারিত তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তবে তারা উল্লেখ করে, এসব গয়নার বাজারমূল্যের চেয়ে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত মূল্যই অনেক বেশি।

অতীতের অনুরূপ ঘটনা

লুভরের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত চুরি ঘটে ১৯১১ সালে— মোনালিসা চিত্রটি ফ্রেম থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। দুই বছর পর সেটি উদ্ধার করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে এক দর্শক চিত্রটিতে পাথর নিক্ষেপ করলে সেটি বুলেটপ্রুফ গ্লাসে সংরক্ষণ করা হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাদুঘরটি বাড়তি ভিড় ও কর্মীসংকটে ভুগছে। ২০২৪ সালে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৮৭ লাখ।

কর্মীরা বারবার অভিযোগ করেছেন, ১৫ বছরে প্রায় ২০০টি পদ কমানো হয়েছে।

দিনদুপুরে এমন ঘটনা ঘটায় ফরাসি নাগরিকরা বিস্মিত। একজন শিক্ষক বলেন, ‘এত বিখ্যাত জাদুঘরে এমন নিরাপত্তা দুর্বলতা—অবিশ্বাস্য!’

সূত্র: আল-জাজিরা

Ad 300x250

সম্পর্কিত