leadT1ad

অযথা লাইট, ফ্যান আর ‘এআই’ ব্যবহার করবেন না

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ০০
অযথা লাইট, ফ্যান আর ‘এআই’ ব্যবহার করবেন না। স্ট্রিম গ্রাফিক

‘ঘরে না থাকলে লাইট-ফ্যান বন্ধ রাখুন’—মোটামুটি সকলেই এ বাক্যটির সঙ্গে পরিচিত। বিদ্যুৎ খরচ কমাতে টিভি, রেডিও, পত্রিকা- কোথায় ছিল না এই বিজ্ঞাপন?

কখনো কি কেউ ভেবেছিল, একসময় কৃত্রিম বুদ্ধিমতা (এআই) নামক একটি বস্তুর জন্যেও এ জাতীয় বিজ্ঞাপন দিতে হবে? বলতে হবে, ‘খেজুরে আলাপ ছাড়ুন। সরাসরি কাজের কথায় আসুন। এআইতে আপনাদের অহেতুক সার্চের জন্যও খরচ হচ্ছে বিস্তর পানি। ওদিকে পানির জন্য হাহাকার করে মরছে মানুষ।’

ঘরে না থাকলে লাইট-ফ্যান যেমন চালাবেন না, তেমন দরকার ছাড়া এআইও ব্যবহার করবেন না।

শুধু কি পানির অপচয়, এআইয়ের জন্য বাড়ছে বিদ্যুৎ ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা, এবং ই-বর্জ্য। এসব বর্জ্যের বড় অংশই আবার যাচ্ছে দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোতে।

এই সংকট সমাধানের উপায় একেবারে নেই, তা নয়। গবেষকেরা বলছেন, টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব।

এআই ব্যবহারে এত পানি লাগে কেন?

এ বছর ১৫ জুলাইয়ে প্রকাশিত বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এআই মডেলকে প্রশিক্ষণ দিতে একসঙ্গে চালাতে হয় হাজার হাজার সার্ভার। এগুলো ঠান্ডা রাখতে ব্যবহৃত হয় বিপুল পরিমাণ পানি।

শুধু প্রশিক্ষণ নয়, দিনভর এআইকে নানা প্রশ্ন করা হয়। এ বিপুল পরিমাণ কর্মযজ্ঞ সামলাতে ব্যবহৃত হয় ডেটা সেন্টার। ডেটা সেন্টারকে শীতল রাখতে প্রয়োজন হয় পানির।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রিভারসাইডের অধ্যাপক শাওলে রেন বিবিসির ওই প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন, জিপিটি থ্রি-এর মতো মাঝারি মানের মডেলকে ১০-৫০টি প্রশ্ন করলেই প্রায় আধালিটার পানি খরচ হয়ে যায়। বলে রাখা দরকার, এ পানি হতে হবে একদম পরিষ্কার, নয়তো জীবাণুর ভয় থাকে। তাছাড়া, এই পানিকে পুনর্ব্যবহার করার উপায় সীমিত। কারণ বেশিরভাগ পানিই বাষ্পীভূত হয়ে যায়।

মানুষ নাকি এআই কার পানি বেশি প্রয়োজন?

গত বছরের ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি বলছে, বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষের কাছে বিশুদ্ধ খাবার পানি নেই। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রিভারসাইডের পেংফেই লি এবং তাঁর দল এআইয়ের পানির ব্যবহার নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। সে গবেষণার একটি অনুমান হলো, বিশ্বজুড়ে এআই প্রযুক্তি পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা খুব শিগগিরই ডেনমার্কের মোট পানি ব্যবহারের চেয়েও ছয় গুণ বেশি হতে পারে। আর ডেনমার্কের জনসংখ্যা নেহাত কম নয়, প্রায় ৬০ লাখ।

চলতি বছরের ২১ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ডেটা সেন্টারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫,৪২৬টিতে, স্ট্যাটিস্টার এক পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেটা সেন্টারের দেশ জার্মানি, তবে সেখানে রয়েছে মাত্র ৫২৯টি কেন্দ্র, যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ।

চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালের পর যেসব নতুন ডেটা সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে বা নির্মাণাধীন, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এমন এলাকায়, যেখানে আগে থেকেই তীব্র পানির সংকট রয়েছে।

জলবায়ু নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ভিওলিয়া ওয়াটার টেকনোলজিস জানাচ্ছে, ডেটা সেন্টারগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় পানির একটি অংশ আসে পৌরসভা বা আঞ্চলিক পানি সরবরাহকারী সংস্থাগুলো থেকে। একই পানির উৎসের ওপর আবার সাধারণ নাগরিকেরাও নির্ভরশীল। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, পানির ব্যাপারে এআই মানুষের সরাসরি প্রতিদ্বন্দী।

বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার

চলতি বছরের শুরুতে জেনারেটিভ এআই নিয়ে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) একটি প্রতিবেদনে ছাপায়। সেখানে বলা হচ্ছে, ২০২৬ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ডেটা সেন্টারগুলোর বিদ্যুৎ খরচ ১০৫ কোটি মেগাওয়াট-ঘন্টার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। যদি তা ঘটে, তবে ডেটা সেন্টারগুলো বিদ্যুৎ ব্যবহারে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ভোক্তা হয়ে উঠবে। র‍্যাংকিংয়ে জাপান ও রাশিয়ার মাঝখানে অবস্থান করবে তারা।

বোঝার সুবিধার্থে ওপরের সংখ্যার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদন বলছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছিল প্রায় ৯ কোটি ৬০ লাখ মেগাওয়াট-ঘন্টা। অথচ ২০২৬ সাল নাগাদ শুধু ডেটা সেন্টারগুলোই এর প্রায় ১১ গুণ বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এআইয়ের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি আরও বাড়ছে।

এমআইটির প্রতিবেদনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ নোমান বশির বলেছেন, ‘নতুন ডেটা সেন্টারের চাহিদা সাস্টেনেবল বা টেকসই উপায়ে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেভাবে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দ্রুতগতিতে নতুন ডেটা সেন্টার নির্মাণ করছে, তাতে এসব সেন্টার চালাতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের বড় অংশই নিতে হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে।’

বাড়ছে ই-বর্জ্য: ধনী দেশের তৈরি বর্জ্য ভোগাচ্ছে অনুন্নত দেশগুলোকে

গত বছরের ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত এমআইটি টেকনোলজি রিভিউয়ের একটি প্রতিবেদন বলছে, এআই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচুর অপচয়ের একটি বড় কারণ হলো হার্ডওয়্যার প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি। সাধারণত কম্পিউটার যন্ত্রপাতির আয়ু দুই থেকে পাঁচ বছর। কিন্তু নতুন সংস্করণ এলে সেগুলো দ্রুতই বদলে ফেলা হয়। ফলে আগের যন্ত্রগুলো অল্প সময়েই বাতিল হয়ে যায়। এটি পরিবেশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে এই প্রবণতা বোঝা যেতে পারে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেকইনসাইটস জানিয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের বড় তিন চিপ নির্মাতা—এনভিডিয়া, এএমডি এবং ইন্টেল, মোট ৩৮ লাখ ৫০ হাজার গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট বা জিপিইউ সরবরাহ করেছে ডেটা সেন্টারগুলোতে। অথচ ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ লাখ ৭০ হাজার। এই সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।

ই-বর্জ্য রিসাইকেল সংক্রান্ত ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, ই-বর্জ্য সাধারণত ধনী ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো থেকেই বেশি তৈরি হয়। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। আর এই বর্জ্য পাঠানো হয় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। যেমন চীন, ভারত, ব্রাজিল এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ।

গতবছর জুলাইয়ে প্রকাশিত হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে গুগল তাদের ফিনল্যান্ডের ডেটা সেন্টার ৯৭ শতাংশ কার্বনমুক্ত জ্বালানিতে পরিচালনা করেছে। কিন্তু এশিয়ার ডেটা সেন্টারগুলোতে সেই হার ছিল মাত্র ৪ থেকে ১৮ শতাংশ।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইনইভেস্টোপিডিয়া বলছে, দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি সবচেয়ে বেশি ডেটা সেন্টারও অবস্থিত দেশটিতে। মানে যতভাবে পরিবেশ দূষণ করা যায় আরকি! কিন্তু তাদের এ কর্মকান্ডের ফল ভোগ করতে হচ্ছে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে।

সমাধান কী

ইয়েল স্কুল অব দ্য এনভায়রনমেন্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ইউয়ান ইয়াও বলেন, ‘এআই প্রযুক্তির পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের জন্য দরকার স্বচ্ছ ও মানসম্মত একটি পদ্ধতি। যথাযথ পরিমাণগত তথ্য ছাড়া এই সমস্যা কতটা গুরুতর তা বোঝা যায় না, আর সঠিকভাবে সমাধান করাও সম্ভব হয় না।’

ডেটা বিজ্ঞান বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্সিং অ্যানালিটিকসের মুখ্য এআই কর্মকর্তা গভিতা রেগুনাথ ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলেন, ‘এআই প্রশিক্ষণে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে একটি বাস্তবসম্মত কৌশল হতে পারে ‘‘স্মার্ট এনার্জি ব্যবহারে’’ জোর দেওয়া। যেমন, সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে এআই মডেল প্রশিক্ষণের কাজ কম ব্যস্ত সময়ে চালানো যেতে পারে, যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রাপ্যতা তুলনামূলক বেশি থাকে। এছাড়া, সবসময় বড় মডেল না চালিয়ে ছোট ও কম শক্তি-নির্ভর মডেল ব্যবহার করলেও বিদ্যুৎ খরচ অনেকটা কমে। হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রেও আরও কার্যকর হতে পারে এনার্জি-সাশ্রয়ী চিপ ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো ব্যবহারে জোর দেওয়া।’

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চ্যাটজিপিটি’র মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একটি অনুরোধ করলে গুগল সার্চের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। এই যখন অবস্থা, তখন এআই ব্যবহারের দায়িত্বশীল উপায় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং দূষণকারী রাষ্ট্রগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে বৈকি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত