leadT1ad

মাহফুজ আলমের সাক্ষাৎকার

প্রথম থেকেই আমি ‘মাস্টারমাইন্ড’ শব্দটা ডিজ-ওউন করেছি

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থান সারা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষ। ছাত্র-জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয় শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দফা দাবি। কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের পেছনে কোনো সুসংগঠিত পরিকল্পনা ছিল কি? এসব প্রশ্নের উত্তর উঠে এসেছে গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা, বর্তমানে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সাক্ষাৎকারে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত ৫ আগস্ট সাক্ষাৎকারটি প্রচার করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। তাদের আলাপে উঠে এসেছে জুলাই আন্দোলনের জন্ম, বিস্তার, রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং ভবিষ্যতের পথচলার সম্ভাবনার নানা দিক। আজ থাকছে সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ১৩
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ১৫
গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা, বর্তমানে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। স্ট্রিম গ্রাফিক

ফারুক ওয়াসিফ: আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি এখনো। বিজয়ের পরেও ওই অর্থে স্বস্তির জায়গাটা তৈরি হয়নি। কিন্তু ক্রমশ আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, যে এই গণ-অভ্যুত্থান জয়ী থাকছে, টিকে থাকছে। এক বছর আগের ঠিক এই দিনে—তখনো একদিকে প্রচণ্ড ভয়, আরেকদিকে প্রচণ্ড গণ-বিস্ফোরণ; যেটা ৫ আগস্ট আমরা দেখেছি। তখনকার কোন মুহূর্তটা আপনার মনে পড়ে?

মাহফুজ আলম: ২ আগস্ট রাত ১০টা নাগাদ, যদি ভুল না বলি ঢাকা ট্রিবিউনে (বাংলা ট্রিবিউন) একটা রিপোর্ট পাবলিশ করে—আন্দোলনের পেছনে একজন ইন্টেলেকচুয়াল তরুণ আছেন। তাঁর সঙ্গে এই এরকম এরকম ব্যক্তিদের সম্পর্ক রয়েছে। যাঁরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, অভ্যুত্থানে লিডারশিপে ছিলেন; তাদের সবার এক ধরনের ঠিকুজি অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়। ওই রিপোর্টটা বের হওয়ার পরে আমি আসলে ১৯ জুলাই থেকে যে বাসায় ছিলাম, যেখানে একধরনের আত্মগোপনে ছিলাম। আমার সঙ্গে চার জনের একটা গ্রুপ ছিল, বেসিক্যালি জুলাই আন্দোলনের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত এই গ্রুপ থেকে আসতো… সেই জুনের ৫ তারিখ থেকে জুলাইয়ের ১৯ তারিখ পর্যন্ত। আখতার, নাহিদ, আসিফ এবং বাকের—চার জন একই গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯ জুলাইয়ের রাতে যেটা আমরা পরের দিন জানতে পারলাম নাহিদ গুম হলো। এর আগে ১৭ জুলাই গ্রেপ্তার হলো আখতার এবং আসিফ, বাকের। তাদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাচ্ছে না। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, তাদের মোবাইল ট্র্যাকিং করে পাওয়া সব তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার হাতে যাবে বা সরকারের হাতে যাবে। তারা অবশ্যই দেখবে, ওখানে আমার সঙ্গে সংলাপ হচ্ছে বা আমাদের দিক থেকে নির্দেশনা যাচ্ছে, পরামর্শ যাচ্ছে অথবা কো-অর্ডিনেশন হচ্ছে। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই আমাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। কিন্তু আত্মগোপন অবস্থা ওইদিন ব্রেক করি, এরপরে আসলে আত্মগোপনে থাকার আর কোনো মানে নাই। কারণ সরকার এবং সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা মিডিয়া এস্টাবলিশমেন্ট— সবাই মিলে এই বিষয়টা কো-অর্ডিনেটেড ওয়েতে সামনে নিয়ে আসে যে—একজন আছেন পেছনে, একজন কাজ করছেন। সমাজের বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে। পুরাতন ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রশক্তি এই সংগঠনগুলোর লিডারশিপ এখানে জড়িত আছে। ফলে আমার কাছে মনে হয়েছে অলরেডি উই আর এক্সপোজড। আসলে তখন আত্মগোপনে থাকা না থাকা একই। মানে অভ্যুত্থানের পেছনে যারা অংশ নিয়েছিলেন বা যারা ভূমিকা রাখছেন তাদের সবার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে নাহিদ এবং অন্য যারা স্টুডেন্ট লিডার; তাদের। এর ভেতর দিয়ে আসলে আমাকে ওইদিন অধিকাংশ জনই পরামর্শ দিলেন— আজ রাতটা একটু অন্য কোথাও সরে গিয়ে থাকেন। আমি ওটাই করলাম।

ফারুক: বাংলা ট্রিবিউন বা পত্রিকা হঠাৎ করে পেছনের লোক বা অন্তরালের লোক খোঁজা শুরু করল। আপনি একটু আগে বলছিলেন যে মিডিয়া, এস্টাবলিশমেন্ট, গোয়েন্দা সংস্থার কথা। সবাই মিলে আন্দোলনের কোর্টটাকে চিনিয়ে দেওয়া বা তাকে ধাক্কা দেওয়া, তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল, আপনার কি ব্যাপারটা এরকম মনে হয়েছে?

মাহফুজ: আমার কাছে মনে হয়েছে— এটা আন্দোলনে এক ধরনের ‘স্কেপ গোট’ খোঁজার মতো ব্যাপার। আসলে এটা এইভাবে ঘটেছে কিনা, তা আমার সত্যায়নের সুযোগ নেই। কিন্তু পুলিশ বা বিভিন্ন দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা পরে বলছিলেন যে— ওই রাতে (আমাকে) গ্রেপ্তারের কথা হচ্ছিল। ডিবি হারুন এটার নেতৃত্ব দিতো। কিন্তু তাকে পরের দিন সকালে বরখাস্ত করা হয়। এরপর আমরা লোকেশন চেঞ্জ করি। আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিই।…নাহিদ ইসলামকে গ্রেপ্তার করাটা স্বাভাবিক, উনি সামনে আছেন। আরও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করাটা স্বাভাবিক, তারা সামনে আছেন। এখন একটা লোককে আপনি গ্রেপ্তার করবেন, ওর জন্য তো ফ্রেমিংটা করতে হচ্ছে যে—এই লোকটা সবকিছুর খোঁজখবর জানে, সে পেছনে থেকে বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক মেনটেইন করছে। একে ধরলে বলতে পারবে, একজনকে পাওয়া গেছে, যে আসলে তথাকথিত মাস্টারমাইন্ড, সে সবকিছু জানে। ওকে এবার মারো, ওর কাছ থেকে তথ্য উদ্ধার করো।

২ আগস্ট রাত ১০টা নাগাদ, যদি ভুল না বলি ঢাকা ট্রিবিউনে (বাংলা ট্রিবিউন) একটা রিপোর্ট পাবলিশ করে—আন্দোলনের পেছনে একজন ইন্টেলেকচুয়াল তরুণ আছেন। তাঁর সঙ্গে এই এরকম এরকম ব্যক্তিদের সম্পর্ক রয়েছে। যাঁরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, অভ্যুত্থানে লিডারশিপে ছিলেন; তাদের সবার এক ধরনের ঠিকুজি অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়।

ফারুক: তাঁকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে এস্টাবলিশ করা।

মাহফুজ: তখন তাঁকে দিয়ে আসলে রাষ্ট্র বলতে পারে, আমরা সব জেনে গেছি। এটা একটা চেষ্টা ছিল। আমার কাছে এরকমই মনে হইছে। তো আমরা লোকেশন চেঞ্জ করার পরে ওইদিন ২ আগস্টে বিকাল-দুপুরের দিকে চলে গেলাম আমার বন্ধুর বাসায়। দুপুর বা দুপুরের আগে। তারপরে ৩ আগস্ট আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বললেন যে, এখন আর ভেতরে থেকে কোনো লাভ নেই। তুমি পাবলিকলি আসো। তারপরে ৩ আগস্টে নাহিদ আসলো। নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী নাহিদকে তাঁর বাসা থেকে নিয়ে আসছেন, আবার আমার এক বন্ধু আসাদকেও নিয়ে এসেছেন। তো আমরা চারজন একসঙ্গে শহীদ মিনারে গেলাম একটা সিএনজিতে করে। আমি শহীদ মিনারের প্রোগ্রামে একটা বক্তব্য দিলাম।

ফারুক: সেই তো সামনে চলে আসলেন এবং ৩ আগস্টে শহীদ মিনারে…

মাহফুজ: হ্যাঁ, শহীদ মিনার…

ফারুক: এক দফার যে…

মাহফুজ: এক দফার ঘোষণা। আমাদের সঙ্গে তো যোগাযোগ সবই ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের বক্তব্য এবং এগুলো কীভাবে ঠিক করা হবে, অসহযোগ আন্দোলনের আইডিয়াটাও আসলে আমরা আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে তৈরি করেছি। আন্দোলনের একটা পর্যায়ে আপনারা যদি খেয়াল করেন ৩০, ৩১ জুলাই, ১ আগস্ট এই সময়টায় নার্সেরা নেমে গিয়েছিল, মেডিকেল প্র্যাক্টিশনারেরা নেমেছেন, আইনজীবীরাও তো নেমেছেন একটা সময়। তখন আমাদের ইন্টার্নাল যে ডিসকাশন হয়েছে, সেখানে আমরা একটা পর্যালোচনা করলাম— আমরা অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেবো। অসহযোগ মানে, আমি নিজেও ২ আগস্টে আমার ফেসবুকে পোস্টে লিখেছি যে, অসহযোগ আন্দোলন মানে গান্ধীবাদী আন্দোলন না। আমরা বসে পড়লাম, কোনো (কার্যক্রমে) অংশগ্রহণ করলাম না—এমন না। বরং একাত্তরের মার্চ মাসে যে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে, তেমন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইমিনেন্ট যে ক্র্যাকডাউন হবে; এটার বিরুদ্ধে বাঙালি এবং যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে ছিল, তাঁরা যেভাবে অসহযোগ আন্দোলন করেছে, সেভাবে—যাকে বলে নন-কোঅপারেশন। সেখানে আমাদের লক্ষ্য ছিল, আমলা-পুলিশ-সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে যারা তারা সবাই নেমে পড়ুক। আর যারা জুলাই অভ্যুত্থানের বিপক্ষে থাকবে, এটা তখন একেবারে স্পষ্ট ফারাক হয়ে যাবে। মানে আমরা স্পষ্ট চিনতে পারব, কারা আমাদের পক্ষে।

ফারুক: এবং তো সেটাই তো ঘটলো। কিন্তু…

মাহফুজ: সেটা ঘটে নাই।

ফারুক: এই যে এত শ্রেণি-পেশার লোকজন নামলো, এই নামানোর ক্ষেত্রে আপনাদের কি কোন যোগাযোগ বা কোনো…

মাহফুজ: সেটা তো ছিল। সেটা বামপন্থীদের একটা অংশ… তাদের কারো কারো তো রাজনৈতিক লড়াই হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আমাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ১৯ সালের ডাকসু মুভমেন্ট, ডাকসুর পরের মুভমেন্ট, তারপরে ২০ সালে ভারতের সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সীমান্ত হত্যা-বিরোধী আন্দোলন—যেটা নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী সমন্বয় করেন, উনি অংশগ্রহণ করছেন। এই আন্দোলনগুলোতে তো আমরা সব ধরনের লোকেরা ছিলাম। আনু মুহাম্মদ স্যারও আসছেন, তারপর গণসংহতির লিডারেরা আসছেন বা যারা বাংলাদেশের পক্ষে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আছেন বা যারা বামপন্থী না হয়ে সিভিল সোসাইটির অংশ আছেন; তাদের সবার সঙ্গে। আমাদের যোগাযোগটা ওই ১৯-২০ সাল থেকে শুরু হয়েছে। করোনার সময় আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। পরে আবার ২০২২ সালে যখন ফিরে এসেছি, তখন আমাদের অংশগ্রহণ ছিল।

২০১৯ সালে কাশ্মীরের স্পেশাল স্ট্যাটাস বাতিল হলো। আমাদের একটা সিনেমার প্ল্যাটফর্ম ছিল। সেখান থেকে সিনেমা প্রদর্শনীর আয়োজন করলাম কাশ্মীরের লোকদের নিয়ে। সেখানে বামপন্থী সবগুলো ছাত্র সংগঠনকে আমরা দাওয়াত দিয়েছি। ফলে এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা আমাদেরটা আগে থেকেই…।

আমাদের সঙ্গে তো যোগাযোগ সবই ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের বক্তব্য এবং এগুলো কীভাবে ঠিক করা হবে, অসহযোগ আন্দোলনের আইডিয়াটাও আসলে আমরা আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে তৈরি করেছি। আন্দোলনের একটা পর্যায়ে আপনারা যদি খেয়াল করেন ৩০, ৩১ জুলাই, ১ আগস্ট এই সময়টায় নার্সেরা নেমে গিয়েছিল, মেডিকেল প্র্যাক্টিশনারেরা নেমেছেন, আইনজীবীরাও তো নেমেছেন একটা সময়।

ফারুক: আগে থেকেই ছিল…

মাহফুজ: আগে থেকেই ছিল। ফ্যাসিবাদবিরোধী যারা বাম তাদের সঙ্গে। যারা একটু আঁতাত করবে বা যারা একটু বিভিন্ন ইডিওলজির কারণে আওয়ামী লীগরে অন্ধ সাপোর্ট দিয়ে যাবে তাঁদের সঙ্গে না। ওদের সঙ্গে আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু খুবই স্পষ্টত আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম, যাদের একটা ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান আছে, গণতান্ত্রিক অবস্থান আছে; তাদের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক ওই সময় থেকে শুরু হয়েছে। আপনারা জানেন যে, ছাত্র ইউনিয়নের একটা অংশ ভাগ হয়ে গেল। এই প্রশ্নে যে— আসলে আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট দিবে কি দিবে না। তো ওই ছাত্র ইউনিয়নের যে অংশটা ভাগ হয়ে গেল, ওই অংশটার সঙ্গে আমাদের একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ২০২২-২৩ সাল থেকেই ছিল। আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রামও করেছি একসঙ্গে।

ফারুক: এখন ওই জায়গাটায় আসি। এই যে দেখেন, অসহযোগটা সফল হলো, তারপরে…

মাহফুজ: অসহযোগ একটা পর্যায়ে সফল হয়েছে। কিন্তু আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন এবং সিভিল মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি—আমরা পরে যখন ইন্ট্রোস্পেকশন করি, এই চারটা জায়গাতে আমরা কিন্তু বিভাজনটা স্পষ্ট দেখতে…

ফারুক: না, একাত্তর সালের তুলনায় ওই বিভাজনটা তেমন হয়নি। এটা ঠিক। কিন্তু একরকম হয়েছে। সেটা কিন্তু দুটি দিনকে অন্তত পূরণ করেছে যে— এই সময়ের কর্মসূচি এইটা। তারপরে এক দফা এবং ঢাকা মার্চের যে কর্মসূচি। অসহযোগ থেকে একেবারেই চূড়ান্ত কর্মসূচিতে চলে গেলেন, এটা কী হিসাব-নিকাশ করে, যে মোমেন্ট চলে এসেছে?

মাহফুজ: চার তারিখে অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবেই সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল হল এবং জনগণ অংশ নিল। আমরা সরকারকে আহ্বান জানালাম—আর রক্তপাত নয়, আর কিলিং নয়। আমরা চাই সরকার চলে যাক। আমরা নতুন একটা সরকার এবং নতুন একটা বন্দোবস্তের দিকে যাব। এটা তখনো সরকার মানেনি। আমার যতটুকু জানা আছে, চার তারিখ পর্যন্ত নিয়ারলি ওয়ান হানড্রেন্ট অ্যাক্টিভিস্ট অ্যান্ড মুভমেন্টে যারা ছিল, তারা শহীদ হইছে। তখন আমাদের কাছে মনে হইছে, এটা একটা শেষ পরিস্থিতি।

মানে এটা আর ওই জায়গাতে নাই যে কোনো রকম কনসিডারেশন (হবে)। এটা একটা মরণপণ লড়াই। এখানে কোনো অনারেবল এক্সিটের সুযোগ নাই। আমরা গণভবনের দিকে যাওয়ার… প্রথম থেকেই তো আমাদের একটা পরিকল্পনা ছিল, সেই বাংলা ব্লকেড থেকেই। কিন্তু তারপরও, তিন তারিখও মানুষ বলেছে যে, চলেন গণভবনে যাই। কিন্তু আন্দোলনের বিভিন্ন স্তর থাকে, মানুষের চৈতন্যের স্তর থাকে। পাবলিকের কতটুকু আসলে আমাদের প্রতি সাপোর্টে আছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ওই সাপোর্টটাকে কতটুকু আমরা আর্টিকুলেট করতে পারবো— সেটারও স্তর থাকে। আমরা মনে করেছি যে, ঠিক আছে তিন তারিখ। আমরা ঘোষণা দিলাম— দেখি সরকার কনসিডারেট হয় কিনা। কিন্তু কনসিডারেট হওয়ার প্রশ্নই আসে না হাসিনার কাছে।

ওইদিন গুলি চলার পরে বিকালে ঘোষিত হল—সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ শুরু হবে। ওই সময় আমাদের এক বন্ধুর বাসায় আমরা অনেক লিডারেরা ছিলাম। নাহিদ ছিল, আমার বন্ধু আসাদ ছিল, তারপরে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ছিল, আরও কয়েকজন ছিল। আমরা বসে আলোচনা করলাম যে— আমরা ছয় (৬ আগস্ট) তারিখের যে লং মার্চ, এই লং মার্চ আমরা ছয় তারিখে রাখতে পারবো না। তখন আমরা ওই চার তারিখে সন্ধ্যায় মিটিংয়ে ডিসাইড করলাম, লং মার্চ আগায় নিয়ে আসি। সেটা পরশু হবে না পরের দিন হবে। আসিফ এটা ঘোষণা করল। তখন আমরা একটা স্লোগান ঠিক করলাম যে— ঢাকায় আসো জনতা, ছাড়তে হবে ক্ষমতা। কিছুটা হয়তো রিফ্রেশ করে তারা এটা দিলো। তখন আমরা ঠিক করলাম যে, যদি সরকার দায়িত্ব ছেড়ে দেয় তখন আসলে কী রকম সরকার হবে। এটা ড্রাফটিংয়ের কাজ রাত ৪টা…

হ্যাঁ, ছাত্রশিবির তো ছিল। ছাত্রদলের সঙ্গেও প্রথম থেকেই এনগেজমেন্ট ছিল। আসিফের, বিশেষ করে রাকিব ভাই যিনি আছেন ছাত্রদলের, ওনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। রাকিব নাসির ভাইয়ের সঙ্গে ছিল তো। এখানে আসলে একা কেউ কিছু করেনি। আমি আজ স্লোগানটা লিখছি, আগের দিনের স্লোগানটা হয়তো আরেকজন লিখেছে…

ফারুক: চার তারিখ রাতে…?

মাহফুজ: হ্যাঁ, চার তারিখ রাতে আমরা ড্রাফটিংটা করেছি। আমি পার্সোনালি করেছি বা আমার সঙ্গে এই যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল… যেটা এখন বাংলাদেশে কোশ্চেন আসে আর কি! এটা আমি মনে করি, অহেতুক কোশ্চেন করে যে, ক্রেডিট নিয়ে… কে কী করছে না করছে। এটার আসলে বাস্তবতা হচ্ছে— এখানে সবগুলো পক্ষের (ক্রেডিট আছে)। যেমন, ওই দিন রাতে, যদি আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি যে, ছাত্রশিবিরের একটা অংশের সঙ্গে কথা হয়েছে, ফরহাদ মজহারদের সার্কেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারপরে ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতার সুবাদে আনু মুহাম্মদ স্যার থেকে শুরু করে যত ধরনের বামপন্থী সার্কেল আছে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। মুসতাইন জহির থেকে শুরু করে ওনাদের সার্কেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। তো এইটা খুবই… মানে এক ধরনের অস্বাভাবিক এবং আমি মনে করি যে, এক ধরনের বাজে স্বভাব যে, আমরা এটাকে এক জায়গায় কনফাইন করতে চাচ্ছি। ওই দিন রাতে আমি শুধু চারটা গ্রুপের কথা উল্লেখ করেছি, আমি আরও…

ফারুক: এর বাইরেও ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র ফেডারেশন…

মাহফুজ: হ্যাঁ, ছাত্রশিবির তো ছিল। ছাত্রদলের সঙ্গেও প্রথম থেকেই এনগেজমেন্ট ছিল। আসিফের, বিশেষ করে রাকিব ভাই যিনি আছেন ছাত্রদলের, ওনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। রাকিব নাসির ভাইয়ের সঙ্গে ছিল তো। এখানে আসলে একা কেউ কিছু করেনি। আমি আজ স্লোগানটা লিখছি, আগের দিনের স্লোগানটা হয়তো আরেকজন লিখেছে…

ফারুক: কিন্তু তারপরও যখন আপনার ওপর একটা চাপ আসলো… একটা হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউন আপনাকে নিশানা করলো। যেটা হয়তো রাষ্ট্রযন্ত্রের আপনাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। ভাগ্যিস তারা খুঁজে পায়নি। কিন্তু এরপরে আবার মাস্টারমাইন্ড কথাটা আসলো আপনার ওপর। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মাহফুজ: মাস্টারমাইন্ড শব্দটা, আমি তো বলছি— এইটা আসলে এক ধরনের স্কেপ গোট (বলির পাঠা) করা। একটা স্কেপ গোট লাগে, একটা স্কেপ গোট খোঁজার চেষ্টা…

ফারুক: কাউকে বলির পাঠা বানানো…

মাহফুজ: কাউকে বলির পাঠা বানানো দরকার ছিল। কাউকে দেখিয়ে যে— এই দেখেন, সবকিছুর হোতাকে বের করছি। এবার তার মুখ দিয়ে কিছু বের করা। এটা একটু মিডিয়ার সামনে বলে এটাকে ডিরেইল করা। এটাই ছিল সরকারের প্ল্যান। নাহিদ আমাকে খুবই স্পেসিফিকেলি বলেছে— ভাই, আমাকে যখন মারতেছিল, ওরা তখন তারা এই শব্দটা ইউজ করছে। এই শব্দ (মাস্টারমাইন্ড) আমি তো ওউন করার প্রশ্নই আসে না। আই ডিজ-ওউন দিস ওয়ার্ডস ফ্রম ভেরি বিগিনিং। আমি তো এই শব্দ ওউন করি না।

আমাদের অবশ্যই কৌশল ছিল। বাংলাদেশে না শুধু, পুরা দুনিয়ার কোনো গণ-অভ্যুত্থান, গণ-আন্দোলন নাই, যেখানে কোনোরকম পরিকল্পনা থাকে না, কোনোরকম কৌশল থাকে না। অবশ্যই কৌশল ছিল। ছয় তারিখ থেকে পাঁচ তারিখে প্রোগ্রামটা নিয়ে আসাও তো একটা কৌশলের অংশ। এই কৌশল পাঁচ-ছয় জন মানুষ ডিসাইড করলো। এবং পাঁচ-ছয়জন মানুষ ডিসাইড করার ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয়টা সার্কেলের সঙ্গে কথা বলে একটা পরামর্শ-ভিত্তিক একটা ডিসিশন নিল। সেটাকে আপনি একনলেজ করবেন না? অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু একইসঙ্গে জনগণের যে স্বতঃফূর্ত লড়াই, যখন লিডারেরা ছিল না, আমরা আত্মগোপনে ছিলাম। আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা গুম ছিল। কেউ আত্মগোপনে ছিল কেউ গ্রেপ্তার ছিল। এই সময়টাতে যাত্রাবাড়ীতে যে মানুষগুলো নামছে, ওরা তো তাকায় থাকে নাই যে, আমার লিডার কে…?

রাতে ডিসকাশন হলো। আমরা একটা খসড়া রেডি করলাম যে, কী রকম সরকার হইতে পারে। সেখানে আমি বললাম, সবগুলো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এখানে আমরা চেষ্টা করেছি, ইন্টিগ্রেট করার জন্য। ওই সময় অলরেডি কে সরকারে যাবে না যাবে, কারা সরকারের উপদেষ্টা হবে… এসব আলোচনা চলে আসছে। তিন তারিখেই আমাদের একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমরা আনবো।

ফারুক: যাত্রাবাড়ী, মাদ্রাসার ছাত্ররা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়…

মাহফুজ: হ্যাঁ, মাদ্রাসার ছাত্র, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা… মানে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি তো ভাবিই নাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নামবে। এটার কোনো ক্রেডিট নেওয়ার আমার দরকার নাই। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের এনগেজ করা গেছে, যেই এনগেজ করুক না কেন। এটা হইতে পারে শিবির করছে, হইতে পারে সাধারণ ছাত্ররা করছে, হতে পারে বিএনপির লোকেরা করছে… যেই করুক না কেন। এটা তো আমাদের একটা কমন কজে কন্ট্রিবিউট করছে। এটা নিয়ে তো ক্রেডিট…

ফারুক: মানে, তখন ওই আন্দোলনের সময় কেউ ক্রেডিট দাবি করেনি। প্রথম দুই তিন মাসেও আসেনি। কিন্তু একটা জিনিস তো দেখা গেল, ওই সময় যখন কর্মসূচির ডাকটা আসার দরকার, ৫ আগস্ট পর্যন্ত সব ঠিকঠাক মতো হচ্ছিল। এমনকি ৬ তারিখের প্রোগ্রাম যদি একদিন আপনারা না পেছাতেন, ওই রাতে হয়তো অনেক মানুষ মারা যেত।

মাহফুজ: সে তো মারা যাইতো। সেটা মারা যাওয়া শুরু হইছে চার তারিখ সন্ধ্যা থেকে। আমি যদি ভুল না বলি, বাংলামোটরে সংঘর্ষ হইছে। সংঘর্ষ তো বলা যায় না, কিলিং হইছে…

ফারুক: বাংলামোটর থেকে কাওরান বাজার…

মাহফুজ: বাংলামোটর থেকে কাওরান বাজার। এই জায়গাটায় যথেষ্ট পরিমাণ কিলিং হইছে। চার তারিখ সন্ধ্যায় আমাদের একটা প্রাইমারি ডিসিশন ছিল কারফিউ ভেঙে বের হওয়ার। আমাদের যারা শাহবাগে ছিল, তাদের কাছে এই মেসেজটা পাঠাইছি যে, তোমরা একটা প্রতীকী কারফিউ ভেঙে বের হও। সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ শুরু হবে। তোমরা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত স্টে করো ক্যাম্পাসে এবং শাহবাগে। আমরা মনে করেছি, ক্যাম্পাসের ভেতরে গুলি করবে না। ক্যাম্পাসের সাইডটাতে তোমরা থাইকা প্রমাণ দেখাও যে, তোমরা কারফিউটা ভঙ্গ করছো। তাহলে মানুষের কাছে একটা স্পিরিট যাবে। আমাদের পরামর্শ ছিল যে, কারফিউটা ভেঙে বের হও। পরে তোমরা রাতে আসো আমরা আলোচনা করি, কীভাবে কী করা যায়।

রাতে ডিসকাশন হলো। আমরা একটা খসড়া রেডি করলাম যে, কী রকম সরকার হইতে পারে। সেখানে আমি বললাম, সবগুলো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এখানে আমরা চেষ্টা করেছি, ইন্টিগ্রেট করার জন্য। ওই সময় অলরেডি কে সরকারে যাবে না যাবে, কারা সরকারের উপদেষ্টা হবে… এসব আলোচনা চলে আসছে। তিন তারিখেই আমাদের একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমরা আনবো।

তারপর চার তারিখে আলী রীয়াজ স্যারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল একটা গ্রুপের। আরেকটা গ্রুপ ইউনূস স্যারের সঙ্গে কথা বলছিল। আমার কাজ ছিল ড্রাফটিং। আমি তখন সেটা করতেছি। বা সবগুলো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতেছি। তখন বোধহয় আসিফ বা নাহিদ বা কেউ একজন ইউনূস স্যারের সঙ্গে কথা বলছে বা আলী রীয়াজ স্যারের সঙ্গে কথা বলছে। অনেকের সঙ্গে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং চলতেছে— কী হইতে পারে বাংলাদেশের সরকার, কেমন হইতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কারা কারা হইতে পারে।

(বাকি অংশ পড়ুন দ্বিতীয় পর্বে)

Ad 300x250

জুলাই হত্যার বিচারে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’-এর পুনরাবৃত্তি হবে না: প্রেস সচিব

শিবির উপস্থিত থাকায় উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক থেকে ওয়াক আউট বামপন্থীদের একাংশের

এনসিপিসহ নতুন ১৬ দল নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক যাচাইয়ে উত্তীর্ণ

ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ কর্মী, পদে আছেন হত্যা মামলার আসামিও

উৎসবের ছোঁয়া লাগলেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় বাংলাদেশের জন্য এখনো কঠিন

সম্পর্কিত