leadT1ad

আজ আন্তর্জাতিক কফি দিবস

আরব দরবেশ আর বাবা বুদান যেভাবে কফি ছড়িয়ে দিলেন সারা দুনিয়ায়

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ৪১
স্ট্রিম গ্রাফিক

কফি আবিষ্কার নিয়ে যে গল্পটি এখন বলা হবে, সেটি একজন সুফি সাধকের। বলা হয়ে থাকে, গোতুল আকবর নুরুদ্দিন আবু আল হাসান আল শাদিলি নামের এক সুফি–দরবেশ এতটাই নিষ্কলঙ্ক ছিলেন যে, তাঁর প্রার্থনার কারণে কেউ কেউ আরোগ্য লাভ করতেন।

গোতুল আকবরের এই বিশেষ গুণের কারণে ইয়েমেনে তাঁর বিশেষ প্রভাব তৈরি হলে তখনকার শাসক তাঁকে দেশান্তরে বাধ্য করেন। গোতুল আকবর লোহিত সাগরের অন্যপারে আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) চলে যান।

ইথিওপিয়ার বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে এই ইয়েমেনি দরবেশ পাখিদের একটি ছোট ফল খেয়ে বেশ প্রফুল্ল হতে দেখেন। পাখিদের আনন্দিত দেখে দরবেশ নিজেও সেই ফলটি খেয়ে এর অপূর্ব স্বাদে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ক্যাফেইনের নিদ্রাহরী ও ক্ষুধাহরী প্রভাব তাঁকে প্রার্থনায় নিমগ্ন হতে দারুণ সাহায্য করলে তিনি এটিকে উপাদেয় করে তুলতে সচেষ্ট হন। কফির বীজকে পানিতে জ্বাল দিয়ে নির্যাস পান করার পথ আবিষ্কার করতে সমর্থন হন। তাঁর এই পানীয়ের কথা ইয়েমেনেও ছড়িয়ে পড়লে আবারও তিনি স্বদেশে ফিরে যান। একই ঘটনা গোতুল আকবরের শিষ্য ওমরের বরাতে কফির ইতিহাসে বিবৃত হয়ে আসছে।

সেই থেকে ইয়েমেন হয়ে ওঠে কফির উর্বর ভূমি। আধুনিক বিশ্বে আল–মুখা নামে যে উৎকৃষ্ট কফিটি পাওয়া যায় তা মূলত ইয়েমেনের একটি বন্দরের নাম। ইয়েমেনের আল–মুখা বন্দর থেকেই লোহিত সাগর হয়ে কফি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজুড়ে। ইয়েমেনিরা তাই তাদের একটি কফির নামই আল–মুখা নামে পরিচিত করে তুলেছে।

কফি আবিষ্কারের আরও গল্প

কফির উৎসভূমি যে আরব অঞ্চল তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে ঠিক কে, কবে আর কোথায় প্রথম কফির আবিষ্কার করেন তা নিয়ে আছে নানা রকম শ্রুতি আর আখ্যান। এই শ্রুতিগুলো বেশ মজাদার এবং এর সত্যতার সম্ভাবনাও রয়েছে।

লোহিত সাগরের দক্ষিণের দুটি দেশ ইথিওপিয়া ও ইয়েমেন থেকেই মূলত কফির ছড়িয়ে পড়া। কফি আবিষ্কারের দ্বিতীয় গল্পটিও তাই একজন ইথিওপিয়ান বুদ্ধিমান রাখালের। কালদি নামের সেই রাখাল একদিন লক্ষ্য করেন তাঁর ছাগলেরা অদ্ভুত আচরণ করছে। ঘুমাচ্ছে না, তিড়িংবিড়িং করে নাচানাচি করছে। আগে কখনো এমন না ঘটায় কালদির কাছে এটি অস্বাভাবিক ঠেকে। অনুসন্ধান চালিয়ে এক পর্যায়ে তিনি আবিষ্কার করেন ছাগলগুলো এক ধরনের লাল–সবুজ বীজ খাওয়ার পরই শুধু এমনটা করে।

মিশরে গোতুল আকবর নুরুদ্দিন আবু আল হাসান আল শাদিলির (১১৯৬-১২৫৮) মাজার প্রাঙ্গণ। ছবি: উইকিপিডিয়া
মিশরে গোতুল আকবর নুরুদ্দিন আবু আল হাসান আল শাদিলির (১১৯৬-১২৫৮) মাজার প্রাঙ্গণ। ছবি: উইকিপিডিয়া

কৌতুহলবশত ছাগলের খাওয়া সেই বীজ তিনি নিজেও খান। অদ্ভুত স্বাদের কারণে সেই বীজ নিয়ে তিনি ছুটেন স্থানীয় ইমামের কাছে। ইমাম খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বীজগুলো ছুড়ে ফেলে দেন। পোক্ত সেই বীজ গিয়ে পড়ে আগুনের ওপর। বেরিয়ে আসে অপূর্ব সুবাস। আগুনে পোড়া কফির মোহনীয় ঘ্রাণের কারণে তাকে সেদ্ধ করার চিন্তা আসে মাথায়। এরপরই জলের সঙ্গে কফি বীজের পরিচয়।

সেদ্ধকরা কফির নির্যাস পান করে রাখাল ও ইমাম চমকে ওঠেন। আশেপাশের মানুষের সঙ্গে এই স্বাদ ভাগাভাগির মাধ্যমেই ইথিওপিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে অন্যরকম এক ঘ্রাণ আর স্বাদ। এক সময়কার হাবশিদের দেশ আবিসিনিয়া হয়ে উঠে আজকের ইথিওপিয়া বা ‘কিংডম অব এরাবিকা’।

কফিকে বলা হয়, সুফি–সাধকদের পানীয়। কফি আবিষ্কারের গল্পের শুরুতে আরব দরবেশ আর ইমামের নাম জড়িয়ে আছে বলেই শুধু নয়, কফি একদিকে ‘নিদ্রাহরী’, ক্ষুধা দূরে ঠেলে রাখে, হৃদয়-মন করে রাখে চাঙা, ফলে দীর্ঘ সময় ইবাদত আর তপস্যায় কাটিয়ে দেওয়া যায়।

কাহওয়া থেকে কফি ও ক্যাফে

কফিকে আরবরা নাম দেয় ‘আল–কাহওয়া’, কাহওয়া শব্দের অর্থ পানীয়—ক্ষুদাহরণকারী পানীয়। যেহেতু সুফিরা স্বল্পাহারী এবং অল্পনিদ্রার মানুষ তাই তাদের পানীয়ের এই নাম। কফি পান করে দীর্ঘসময় ক্ষুধাহীন থেকে প্রার্থনা করা যেত। রাত জেগে আরাধনা করার জন্য সুফিরা কফিকে তাই বিশেষ পছন্দ করতেন। ‘আল–কাহওয়া’ থেকে ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে তুর্কি ভাষায় পানীয়টি হয়ে গেল ‘কহওয়ে’। সেখান থেকে কফি হাউজগুলো নাম পেলো ‘কহওয়ে খানে’। তুর্কি ‘কহওয়ে’ ওলন্দাজদের ভাষায় হয়ে গেল ‘কোফি’। ইংরেজরা আরেকটু বদলে নাম দিলো কফি। ফরাসিরা একে করে দিলো ক্যাফে!

কালদি নামের ইথিওপিয়ান এক রাখাল একদিন লক্ষ্য করেন তার ছাগলেরা অদ্ভুত আচরণ করছে। ঘুমাচ্ছে না, তিড়িংভিড়িং নাচানাচি করছে। ছবি: সংগৃহীত
কালদি নামের ইথিওপিয়ান এক রাখাল একদিন লক্ষ্য করেন তার ছাগলেরা অদ্ভুত আচরণ করছে। ঘুমাচ্ছে না, তিড়িংভিড়িং নাচানাচি করছে। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বে প্রায় দুই শতাধিক প্রজাতির কফি পাওয়া যায়। এর মাঝে মাত্র দুই থেকে তিনটি প্রজাতির কফি পানীয় হিসেবে মানুষ গ্রহণ করছে। বাকিগুলো জংলি প্রজাতির। সেগুলো পানীয় হিসেবে গ্রহণ করা যায় না বটে, কিন্তু যে দুই থেকে তিন প্রজাতির কফি আমরা গ্রহণ করছি তা টিকিয়ে রাখার জন্য এইসব জংলি প্রজাতির কফির অবদান অসামান্য।

এইসব প্রজাতির মধ্যে ‘কফি এরাবিকা’ নামে পরিচিত কফিই সারাবিশ্বের প্রায় সত্তুর ভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। কফি এরাবিকাকে বলা হয় কফি জগতের আদি মাতা–পিতা বা এডাম অ্যান্ড ইভ। কফির আবিষ্কারও আরবদের হাতে। আরবরাই তাদের আবিষ্কৃত কফির ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের কোণায় কোণায়।

আরবের ওয়াইন

আরব অঞ্চলজুড়ে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ থাকায় তেজবর্ধক ও সুস্বাদু পানীয়ের প্রয়োজন ছিল। ‘নাবিজু তামার’ বা খেজুর ভিজিয়ে রাখা পানি খাওয়া ধর্মে সিদ্ধ কী না তা নিয়েও বিতর্ক থাকায় বাহ্যত একমাত্র চা আর ফলের শরবত ছাড়া তাদের পান করার মতো বিশেষ কোনো পানীয় ছিল না। ইয়েমেনে কফি আবিষ্কারের পর তাই খুব দ্রুত তা জাজিরাতুল আরবে (আরব উপদ্বীপে) জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক সময় অ্যালকোহলে ডুবে থাকা আরবে কফিই হয়ে ওঠে প্রধান পানীয়।

ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে আনুমানিক ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেন থেকে প্রথমে মক্কায় আসে কফি। তারপর হজযাত্রী ও অন্যদের মাধ্যমে আরবের অন্য অঞ্চলে সীমিত আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতকের প্রারম্ভে ইয়েমেনের আল–মুখা বন্দর হয়ে কফি পৌঁছে যায় মিশর পর্যন্ত।

শিল্পীর তুলিতে আঁকা কফির জন্য বিখ্যাত ইয়েমেনের আল–মুখা বন্দরের দৃশ্য। ছবি: উইকিপিডিয়া
শিল্পীর তুলিতে আঁকা কফির জন্য বিখ্যাত ইয়েমেনের আল–মুখা বন্দরের দৃশ্য। ছবি: উইকিপিডিয়া

কায়রোর সুফি ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কফি তখন দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিখ্যাত আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে কয়েকটি কফিশপ জমজমাট হয়ে ওঠে। কায়রো থেকে কফি যাত্রা করে সিরিয়ার হালব শহরে। এরপর সেখান থেকে আনুমানিক ১৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সালতানাতের রাজধানী কন্সটান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুলে) জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আরবের কফি।

কফি যেভাবে নিষিদ্ধ পানীয়

পনের শতকের শুরুর দিকেই আরবজুড়ে কফিশপগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণত মসজিদের আশাপাশে তখন কফিশপ তৈরি হতো। মুসলমানরা নামাজ পড়ে বা নামাজ পড়ার আগে কফিশপগুলোতে ভিড় করত। সেখানে কফি পান করতে আসা ব্যক্তিদের আলাপ ধর্ম, সমাজ থেকে শুরু করে শিল্প–সাহিত্য ও রাজনীতি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকত।

১৫১১ সালে মক্কার তুর্কি গভর্নর কর্তৃক কফি নিষিদ্ধ হওয়ার পর ১৫৩২ সালে কায়রোতেও কফি নিষিদ্ধ করা হয়।‌ ছবিতে তুর্কি স্যান্ড কফি বানানোর দৃশ্য। ছবি: উইকিপিডিয়া
১৫১১ সালে মক্কার তুর্কি গভর্নর কর্তৃক কফি নিষিদ্ধ হওয়ার পর ১৫৩২ সালে কায়রোতেও কফি নিষিদ্ধ করা হয়।‌ ছবিতে তুর্কি স্যান্ড কফি বানানোর দৃশ্য। ছবি: উইকিপিডিয়া

মক্কা নগরীর তুর্কি গভর্নর খায়ের বেগ বুঝতে পারেন, এই কফিশপগুলো সামাজিক জনসমাগমস্থলে পরিণত হচ্ছে। এখান থেকে যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হচ্ছে তা ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে ওঠতে পারে। খায়ের বেগ কৌশলে ফতোয়া জারি করে কফি নিষিদ্ধ করে দিলেন। এতে মানুষের আড্ডাস্থল ভেঙে গেল। কিন্তু তৈরি হলো জন-অসন্তুষ্টি।

মক্কার মতো কায়রো ও কন্সটান্টিনোপলেও কফি নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো। রাজনীতিবিদরা পেছনে থেকে আলেমদের মাঝে বিতর্ক সৃষ্টি করে দিলেন। আলেমরা বিতর্ক জুড়লেন, কফিও অ্যালকোহলের মতোই নেশাদায়ী। কারো মতে, কফিশপগুলোতে ঠিক শারাবের মতোই কফি পরিবেশন করা হয়—এইসব ছিল বাহ্যিক যুক্তি। আদতে কফিশপগুলো ছিল তখনকার সমাজে একেকটি নতুন প্রতিষ্ঠান। সেখানে তথ্য আদানপ্রদান থেকে নিয়ে শায়েরি, সঙ্গীত ও বৈঠকি খেলাধুলা (ইনডোর গেমস) করতো মানুষ। রাজনীতিবিদরা এটিকে মসজিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধর্মীয় পণ্ডিতদের সামনে উপস্থাপন করলেন। আর তারা চালাকিটা না ধরতে পেরে জড়িয়ে পড়লেন বিতর্কে।

কফিকে বলা হয় সুফি–সাধকদের পানীয়। ছবি: উইকিপিডিয়া
কফিকে বলা হয় সুফি–সাধকদের পানীয়। ছবি: উইকিপিডিয়া

কফিপানের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড

রাজনীতিবিদদের আশকারায় ফতোয়া জারি হলো, কফি মদের চেয়েও খারাপ! রাষ্ট্রের কর্তারাও এবার তাদের শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন। তারা বললেন, কফি খাওয়া একই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতাও। কারণ কফিশপগুলোতে বসেই রাষ্ট্রবিরোধী যতসব ষড়যন্ত্র করা হয়।

১৫১১ সালে মক্কার তুর্কি গভর্নর কর্তৃক কফি নিষিদ্ধ হওয়ার পর ১৫৩২ সালে কায়রোতেও এটি নিষিদ্ধ করা হলো। নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হলো সব কফিশপ গুড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু এর মাঝে উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম রাষ্ট্র কর্তৃক ফতোয়া জারি করে কফি খাওয়া আবারও চালু করে দিলেন। খায়ের বেগকে তার অন্যায় হুকুমদারীর জন্য উপযুক্ত শাস্তিরও মুখোমুখি করলেন।

কিন্তু এরপর আবারও কফি বিতর্ক ফিরে আসে। উসমানীয় সুলতান চতুর্থ মুরাদের সময় (১৬২৩–৪০ খ্রিষ্টাব্দ) কফিপানের শাস্তি ধার্য্য করা হয় মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু মানুষের কফিপানের অভ্যাস তবুও ছাড়ানো যায়নি। ধীরে ধীরে এক সময় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাও বুঝতে পারেন কফি একটি নির্দোষ পানীয়।

ইউরোপে আরবের কফি

ইউরোপে আরব মুসলমানদের আবিষ্কৃত এই কফি পৌঁছে মূলত দুইভাবে। ইয়েমেন থেকে আল–মুখা বন্দর দিয়ে আর উসমানীয় সালতানাত তথা তুর্কিদের মাধ্যমে। ১৭ শতকের শুরুতে বৃটিশ ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমবারের মতো বড় আকারে আল–মুখা বন্দর দিয়ে কফি ক্রয় করা শুরু করে।

আরবরা তাদের আবিষ্কৃত কফি ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের কোণায় কোণায়। ছবি: উইকিপিডিয়া
আরবরা তাদের আবিষ্কৃত কফি ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের কোণায় কোণায়। ছবি: উইকিপিডিয়া

অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর দিয়েও কফি ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। তুর্কিরা ইউরোপে যায় কফি নিয়ে। ইউরোপেও কফিশপে গল্পস্বল্প, কবিতা–গান আর আড্ডা চলতো। এখানেও আলোচনার বিষয়বস্তুর একটি ছিল রাজনীতি।

খ্রিষ্টজগতে নিষিদ্ধ কফি

প্রাচ্যের মতো ইউরোপেও শাসকরা কফিশপগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করলেন। ব্রিটেনের বাদশাহ চার্লস দ্বিতীয় ১৬৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ্যে এর তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, ভবঘুরের দল ওখানে যায়, মিলেমিশে ফন্দি আঁটে, বাদশাহ ও তার মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দ্রোহ ছড়ায়।

এর বাইরে ইউরোপ আরও একটি অভিযোগ হাজির করে, ‘কফি একটি মুসলমানি পানীয়’। এর সূত্র ধরে ইউরোপের খ্রিষ্টধর্মীয় গুরুরা কফির বিরুদ্ধে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখেন। কিন্তু আনুমানিক ১৬ শতকের দিকে পোপ ক্লেমেন্ট অষ্টম বলেন, কফিকে শয়তানের পেয়ালা সাব্যস্থ করার আগে একবার এর স্বাদ নেয়া যাক। এই বলে তিনি কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে অপূর্ব স্বাদের স্বাক্ষী হয়ে ওঠেন। অসামান্য স্বাদ আর ঘ্রাণের স্পর্শে এসে তিনি বলেন, কফি শুধু মুসলমানদের নয়; খ্রিষ্টানদেরও পানীয়। সেই থেকে কফি বৈধতা পায়।

১৬ শতকে পোপ ক্লেমেন্ট অষ্টম কফির অপূর্ব স্বাদের স্বাক্ষী হন। ইউরোপের খ্রিষ্টানদের মাঝে কফিকে জনপ্রিয় করে তুলতে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। ছবি: উইকিপিডিয়া
১৬ শতকে পোপ ক্লেমেন্ট অষ্টম কফির অপূর্ব স্বাদের স্বাক্ষী হন। ইউরোপের খ্রিষ্টানদের মাঝে কফিকে জনপ্রিয় করে তুলতে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। ছবি: উইকিপিডিয়া

কফি হাউজ থেকে পেনি বিশ্ববিদ্যালয়

একসময় দেখা গেল, কফি হাউজে যাওয়া এক আভিজাত্যের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পানশালাতে যাওয়া মানুষেরা মাতাল হয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু কফিশপে গমনকারীরা হয় নিপাট ভদ্রলোক। তারা কবিতা পড়ে, গান গায়, চুমুক দিতে দিতে বই পড়ে, জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে বিতর্ক জুড়ে, জ্ঞানবৃদ্ধি হয়, মন ও শরীর–স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। পয়সা গেলে যাক, কফিতে চুমুক দিয়ে যদি এতসব উপকারীতা পাওয়া যায় তাহলে কফিশপগুলো তো বিশ্ববিদ্যালয়ই! ইউরোপ আদর করে এগুলোর নাম দিলো ‘পেনি ইউনিভার্সিটি’।

১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কন্সটান্টিনোপলে ‘কিভা হান’ নামে প্রথম একটি কফিশপ স্থাপিত হয়। ছবি: উইকিপিডিয়া
১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কন্সটান্টিনোপলে ‘কিভা হান’ নামে প্রথম একটি কফিশপ স্থাপিত হয়। ছবি: উইকিপিডিয়া

বাবা বুদানের হাত ধরে আরবের কফি ভারতে

কফি আবিষ্কারের মতো ভারতবর্ষে এর আগমন নিয়েও আছে লোককথা। আখ্যানমতে, দক্ষিণ ভারতের একজন দরবেশ হজ শেষ করে ফেরার পথে ইয়েমেন থেকে প্রথম কয়েকটি কফি বীজ নিয়ে আসেন। সূত্রমতে, এই সুফিসাধকের নাম বাবা বুদান। দক্ষিণ কর্ণাটকের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার একটি গ্রামে বাবা বুদান এখন শায়িত আছেন। ইয়েমেন থেকে তিনি কফি এরাবিকার যে বীজ এনেছিলেন তা তাঁর আবাস পশ্চিমঘাটের পর্বতমালার চন্দ্রগিরিতেই বপন করেছিলেন। বীজ থেকে কফি হওয়ার পর বুদান তাঁর সঙ্গী সুফি–দরবেশদের নিয়েই এটি পান করতেন। চিকমগলুর জেলার যে অঞ্চলটিতে তিনি কফি চাষ করেছিলেন সেই চন্দ্রগিরিপ্রণালির বর্তমান নাম বাবা বুদান গিরিপ্রণালি।

বাবা বুদানের প্রভাববলয়ে থাকা এই অঞ্চল থেকেই এখানকার কফির ইতিহাসের শুরু। দরবেশদের হাত ধরে যে কফির আবাদের শুরু হয়েছিল ইংরেজরা তার বাণিজ্যিকমূল্য বুঝতে পেরে ১৯ শতক থেকে এর উৎপাদন শুরু করে। আমরা যে কফির সঙ্গে পরিচিত তা বাবা বুদানের নিয়ে আসা কফি এরাবিকা গোত্রেরই কফি।

কফিখোরদের মতে, আজও আরব দেশে খেজুর দিয়ে যে গাওয়া কফিটি খাওয়া হয় সেটিই এখনও সেরা কফি। তবে কোনো আরবের বাড়িতে অতিথি হয়ে গেলে, দ্রুত কফি পরিবেশন করা হলে ধরে নিতে হবে আরব বন্ধুটি ব্যস্ত আছেন। কফি পান করে খোশালাপের সুযোগ নেই।

Ad 300x250

সম্পর্কিত