leadT1ad

কুমারী পূজা: কীভাবে নারীত্বে মিশে গেছে দেবীত্বের উদযাপন

দুর্গাপূজার মহাষ্টমী তিথিতেই মূলত কুমারী পূজা হয়ে থাকে। এ বছর মহাষ্টমী তিথির তারিখটি হলো আজ ৩০ সেপ্টেম্বর, যা বাংলাদেশের জাতীয় কন্যা শিশু দিবস। কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য বিলোপ ও দেবীরূপে কন্যা শিশুর পূজার এই দুই ভিন্ন অনুষ্ঠানের সমাপতন তাৎপর্যপূর্ণ।

বাঁধন দেব
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার বিভিন্ন অঙ্গ ও অনুষঙ্গের মধ্যে কুমারী পূজা অন্যতম। এ পূজায় সাধারণত অরজঃস্বলা কুমারী কন্যাকে সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশাপাশি চিন্ময়ী কুমারীর মধ্যে দেবীর দর্শন এই পূজার একটি উল্লেখযোগ্য দিক।

কুমারী পূজার ইতিহাস সুপ্রাচীন। শাক্ত পরম্পরার প্রধান গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র ‘নারায়ণীস্তুতি’ নামক একাদশ অধ্যায়ে দেবতারা দেবী দুর্গার স্তব বা মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। এর এক পর্যায়ে তাঁরা বলেন, ‘হে দেবী, বেদাদি অষ্টাদশবিদ্যা আপনারই অংশ। চতুঃষষ্টি কলাযুক্তা এবং পাতিব্রাত্য, সৌন্দর্য ও তারুণ্যাদি গুণযুক্তা সকল নারীই আপনার বিগ্রহ।’ (১১/৬)। চণ্ডী কথিত নারীমাত্রেই ভগবতী দর্শনের এই বিষয়টিকেই উনিশ শতকের মাতৃসাধক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আরও বিস্তৃত করেন। তিনি বলেন, ‘সকল স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ।’ (‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’, পৃষ্ঠা ৪৬৭)। আর ভগবতীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভের প্রচেষ্টা থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন।

অমরনাথ যাত্রার পথে সেবার স্বামী বিবেকানন্দ এক মুসলমান মাঝির নৌকায় ছিলেন। সেই মাঝির মেয়েটি নৌকায় থেকেই বাবাকে রান্নাসহ নানা কাজে সহায়তা করত। সেই মুসলমান কন্যাটিকেই স্বামী বিবেকানন্দ সাক্ষাৎ ভগবতী জ্ঞানে পূজা করেন।

শাস্ত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী রজঃদর্শন হয়নি এরূপ কন্যাকে কুমারী বলা হয়েছে। বয়সভেদে এদের প্রত্যেকের পৃথক পৃথক নাম রয়েছে। প্রথম বর্ষীয়া কুমারীকে বলা হয় সন্ধ্যা। এভাবে দুই বছরের কুমারীর নাম সরস্বতী, তিন বছরে ত্রিধামূর্তি, চার বছরে কালিকা, পাঁচ বছরে সুভগা, ছয় বছরে উমা, সাত বছরে মালিনী, আট বছরে কুব্জিকা, নয় বছরে অপরাজিতা, দশ বছরে কালসন্দর্ভা, এগার বছরে রুদ্রাণী, বারো বছরে ভৈরবী, তের বছরে মহালক্ষ্মী, চৌদ্দ বছরে পীঠনায়িকা, পনের বছরে ক্ষেত্রজ্ঞা এবং সর্বশেষ ষোলো বছরের কুমারীকে অম্বিকা নামে অভিহিত করা হয়।

কেন কুমারী পূজা করা হয়

কুমারী পূজার সূচনার নেপথ্যে বিভিন্ন কাহিনি শোনা যায়। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। পুরাণ অনুসারে, সেই সময় ছিল শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ, দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বলেন বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে।

দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে একটি তপ্তকাঞ্চনবর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন সেই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। এরপরই বোধন-স্তবে তাঁকে জাগরিত করেন ব্রহ্মা। দেবী জাগরিত হয়ে বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধারণ করেন।

আরেকটি কাহিনি অনুসারে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় বানাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে। রাজা ভরত বানপ্রস্থে যাওয়ার আগে তাঁর আট পুত্র এবং একমাত্র কন্যা দেবী কুমারীকে তার রাজত্ব ভাগ করে দেন। কন্যাকুমারীর ভাগে পড়ে বর্তমান ভারতের দক্ষিণ অংশ কন্যাকুমারী অঞ্চল। দেবী কুমারী অনেক তপস্যা করেছিলেন যে শিব ছাড়া কাউকে পতি হিসেবে বরণ করবেন না। যথাসময়ে কৈলাস থেকে রওনা হয়েছেন শিব। ভোর হওয়ার আগেই তাঁকে পৌঁছতে হবে তিন সাগরের সঙ্গমে। ভোররাতের ব্রাহ্মমুহূর্তের লগ্ন স্থির হয়েছে তাঁদের বিয়ের জন্য। সেই লগ্ন পেরিয়ে গেলে লগ্নভ্রষ্টা হবেন দেবী।

দেবী কুমারী বানাসুরকে পরাস্ত ও বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। কারও কারও মতে আবার প্রাচীনকালে মুনিঋষিরা কুমারীপূজার মাধ্যমে প্রকৃতিকে পূজা করতেন। প্রকৃতি মানে নারী।

দেখতে দেখতে মহেশ্বর এসে পৌঁছলেন শুচীন্দ্রম গ্রামে। তখন শেষরাত। এদিকে দেবর্ষি নারদও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছেন সেখানে। দূর থেকে মহেশ্বরকে দেখতে পেয়েই তিনি মোরগের ডাক ডেকে উঠলেন। শুনে চমকে উঠলেন মহেশ্বর। তবে তো ভোর হয়ে গেছে। আর ভোর যখন হয়েই গেছে তখন তো বিয়ের লগ্নও গেছে পেরিয়ে। এমন অবস্থায় তিন সাগরের সঙ্গমে গিয়ে আর কীই-বা হবে?

অতএব বিষণ্ণ মহেশ্বর শুচীন্দ্রমেই থেমে গেলেন। ত্রিভুবনের হর্তা-কর্তা-বিধাতা মহেশ্বর তাঁর দিব্যদৃষ্টির প্রভাব খাটালেই উপলব্ধি করতেন ঘটনার স্বরূপ। কিন্তু তিনি তা না করে সম্ভবত জগতের মঙ্গলের জন্যই নারদের কূটনীতিকে স্বেচ্ছায় জয়যুক্ত হতে দিলেন।

ওদিকে মহেশ্বরের আশায় ভোররাত থেকেই সেখানে মালা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন কন্যাকুমারী দেবী। নতুন সূর্যের আলোকমালার ছোঁয়ার ভেতর তিনি অনুভব করলেন লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার যন্ত্রণা।

ইতিমধ্যে বানাসুর এসে পৌঁছলেন সেখানে। সৌন্দর্য্যের প্রতিমূর্তি দেবী কুমারীকে দেখে তাঁর বুকে জেগে উঠল কামনা। অতএব তৎক্ষণাৎ দেবী কুমারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তিনি। সেই মুহূর্তে এমন প্রস্তাব শুনে শিব-অন্তপ্রাণা দেবী সংযতভাবে বানাসুরকে বললেন যে বিয়েতে তিনি তখনই সম্মত হবেন যদি বানাসুর তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেন।

সেই মুহূর্তে বানাসুর সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন ব্রহ্মার বর। কিংবা তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি যখন সকল দেবদেবীরই অবধ্য, তখন এই সামান্য নারী কীভাবে তাঁকে পরাস্ত করবেন? আসলে এই সামান্য নারীর রূপে যে চিরন্তনী পরাশক্তিই তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তা কীভাবেই বা বুঝবেন বানাসুর? আর তাই সানন্দে তিনি দেবীর প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। আর তারপরই শুরু হল দেবী কুমারীর সঙ্গে বানাসুরের যুদ্ধ।

দেবী কুমারী বানাসুরকে পরাস্ত ও বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। কারও কারও মতে আবার প্রাচীনকালে মুনিঋষিরা কুমারীপূজার মাধ্যমে প্রকৃতিকে পূজা করতেন। প্রকৃতি মানে নারী। সেই প্রকৃতিরই আর এক রূপ কুমারীদের মধ্যে দেখতে পেতেন তাঁরা।

যেভাবে দেবী কুমারীর পূজা হয়

দেবী কুমারীর একটি ধ্যানমন্ত্রে এভাবে তাঁর রূপ বর্ণনা করা হয়েছে, দেবী কুমারী পদ্মফুলের আসনে উপবিষ্ট, তাঁর তিনটি চোখ ও কপালে বাঁকা চাঁদ, তপ্ত স্বর্ণের মতো তাঁর গায়ের রঙ, দেবী নানা অলঙ্কারে সজ্জিতা, লাল পোশাক ও লাল ফুলের মালা তাঁর পরিধানে, বামহাতে অভয়মুদ্রা ও ডানহাতে বরমুদ্রাধারী সেই দেবীকে ধ্যান করি।

বাংলাদেশে কুমারী পূজার প্রচলন মূলত রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনকেন্দ্রিক। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রখ্যাত শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এই মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

পূজার দিন সকালে দেবীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় ও নানা অলঙ্কারে সজ্জিত করে মণ্ডপে আনা হয়। তাঁর পায়ে পরানো হয় আলতা, কপালে সিঁদুরের টিপ আর হাতে থাকে মনোরম পদ্মফুল। সুসজ্জিত আসনে দেবীকে বসিয়ে তাঁর পায়ের কাছে রাখা হয় ফুল, বেলপাতা, জল, নৈবেদ্যসহ পূজার নানা উপাচার। পূজারি আসনে বসে একে একে দেবীকে নানা উপচার তুলে দেন। ঢাকের বাদ্য, উলুধ্বনি, মন্ত্রোচ্চারণ ও আরতিতে সাধারণ কুমারী হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ভগবতী।

বাংলায় কুমারী পূজা শুরু হলো কীভাবে

বাংলাদেশে কুমারী পূজার প্রচলন হয়েছে মূলত রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনকেন্দ্রিক। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রখ্যাত শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এই মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, বাগেরহাট, হবিগঞ্জসহ সারা দেশে মঠ ও মিশনের দশের অধিক কেন্দ্রে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

মঠের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর জীবদ্দশায় অন্তত চারবার কুমারী পূজা করেছিলেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৮৯৮ সালের আগস্ট মাসে কাশ্মীরের বারামুল্লায়। অমরনাথ যাত্রার পথে সেবার স্বামী বিবেকানন্দ এক মুসলমান মাঝির নৌকায় ছিলেন। সেই মাঝির মেয়েটি নৌকায় থেকেই বাবাকে রান্নাসহ নানা কাজে সহায়তা করত। সেই মুসলমান কন্যাটিকেই স্বামী বিবেকানন্দ সাক্ষাৎ ভগবতী জ্ঞানে পূজা করেন।

জাতি-বর্ণ-ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডী পেরিয়ে সকল নারীই যে সেই এক ভগবতীর শুদ্ধ প্রকাশ, সেই বার্তা ঘোষণা করতে একটি মুসলমান কন্যার পূজা বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত বৈপ্লবিক, সন্দেহ নেই।

নারীত্বে দেবীত্বের উদ্‌যাপন

দুর্গাপূজার মহাষ্টমী তিথিতেই মূলত কুমারী পূজা হয়ে থাকে। এ বছর মহাষ্টমী তিথির তারিখটি হলো ৩০ সেপ্টেম্বর, যা বাংলাদেশের জাতীয় কন্যা শিশু দিবস। কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য বিলোপ ও দেবীরূপে কন্যা শিশুর পূজার এই দুই ভিন্ন অনুষ্ঠানের সমাপতন তাৎপর্যপূর্ণ।

বিশ্বের সৃষ্টি, অর্থাৎ জন্মের মূলে রয়েছে যে নারী, কুমারী পূজা সেই নারীত্বেরই উদযাপন। আর তাই মনুসংহিতায় ঘোষিত হয়েছে সেই অমোঘ বাণী ‘যত্র নার্য্যন্তু পূজ্যতে রমন্তে তত্র দেবতাঃ’, অর্থাৎ যেখানে নারীর পূজা হয়, সকল দেবতা সেই স্থানে সানন্দচিত্তে অবস্থান করেন। নারীর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার এই শাশ্বত ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি প্রাণে, প্রত্যেক নারীই পাক দেবীত্বের সম্মান–এটাই কুমারীপূজার শিক্ষা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত