একাত্তরের বর্ষাকাল। রোদ মরে গেছে। পাকবাহিনী অস্ত্র হাতে কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরছে। বুটের শব্দ হচ্ছে। রাস্তার পাশেই পানি করছে থই থই। সেই পানিতে প্রচুর কচুরিপানা। পাকবাহিনী ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি কচুরিপানার ভেতর থেকে বন্দুকের নল তাঁদের দিক তাক করা হচ্ছে। হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দে বুলেট আঘাত করে তাদের ওপর। তারা পজিশন নেয়। কিন্তু কাকে গুলি করবে বুঝতে পারে না। অদৃশ্য কেউ যেন লড়ছে তাঁদের বিরুদ্ধে। দিশেহারা হয়ে জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে থাকে তারা। আরও বুলেট ছোড়া হয় তাদের দিকে। বেশ কয়েকজন নিহত হয়। সবাই পালানোর পর কচুরিপানা থেকে বের হয়ে হানাদারবাহিনীর পলায়ন ও নিহতদের নিয়ে উদ্যাপন করতে থাকে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা।
শুনতে অবাক লাগলেও এমন ঘটনাই ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। যদিও ইতিহাসের পাতায় কচুরিপানা নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে, কিন্তু কচুরিপানার অবদান অস্বীকার কোনো উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল বারুদ আর রক্তের ইতিহাস নয়। এটি ছিল বাংলার মাটি, জল ও প্রকৃতির এক সম্মিলিত সংগ্রাম।
সাধারণের কাছে যা ছিল ‘আগাছা’, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তা হয়ে ওঠে ‘বন্ধু’। আর এই বন্ধুর নাম ‘কচুরিপানা’। এটিই হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অদৃশ্যঢাল’।
একাত্তরের বর্ষাকালে এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এই জলজ ভূগোলের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো পরিচয় ছিল না। তবে বাঙালির কাছে এটি ছিল জন্মগত চেনা পথ। বর্ষায় অধিকাংশ জলাশয় ঢেকে যেত ঘন সবুজ কচুরিপানায়। পাকিস্তানি সেনাদের কাছে যা ছিল চলাচলের প্রতিবন্ধকতা, বাঙালির কাছে তাই হয়ে ওঠে আত্মগোপনের প্রাকৃতিক উপায়। আধুনিক বাঙ্কার বা ট্রেঞ্চ সব জায়গায় তৈরি করা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে পুকুর বা খালের ওপর ভেসে থাকা কচুরিপানার জঙ্গলই হয়ে উঠেছিল গ্রামবাসীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বাঙ্কার।
যখন হানাদার বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন আধুনিক বাঙ্কার বা ট্রেঞ্চের অভাবে এই কচুরিপানাই হয়ে উঠেছিল গ্রামবাসীর ‘প্রাকৃতিক বাঙ্কার’। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ তখন ছুটে যেত নিকটস্থ জলাশয়ের দিকে। শ্বাস-প্রশ্বাস সচল রাখতে কেবল নাকের ডগাটি পানির ওপরে ভাসিয়ে, বাকি শরীর আর মাথা কচুরিপানার জটলার নিচে লুকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতেন অনেক নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।
একাত্তরে কচুরিপানা উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অদৃশ্যঢাল’। ছবি: সংগৃহীতদূর থেকে দেখলে মনে হতো এটি শুধুই আগাছাপূর্ণ একটি সাধারণ ডোবা, অথচ তার নিচেই হয়তো লুকিয়ে থাকত আস্ত একটি পরিবার। বিশেষ করে নারীদের সম্ভ্রম রক্ষায় এই উদ্ভিদের ভূমিকা ছিল অবর্ণনীয়। পানির নিচের পোকামাকড়, জোঁক কিংবা সাপের ভয়কে তুচ্ছ করে কেবল হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচতে এই কষ্ট সহ্য করতেন তাঁরা।
বর্ষায় নদীর স্রোতে কচুরিপানার ভেসে যাওয়া একটি অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। এই স্বাভাবিকতাকে কাজে লাগিয়েই নৌ-কমান্ডো ও মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অপারেশন পরিচালনা করতেন। মাথায় কচুরিপানার স্তূপ চাপিয়ে, শরীরের বাকি অংশ পানির নিচে রেখে মাইলের পর মাইল সাঁতরে যাওয়ার কৌশলটি ছিল অত্যন্ত কার্যকর। পাকিস্তানি গানবোটের সার্চলাইটের তীব্র আলোতেও অনেক সময় ভাসমান কচুরিপানার নিচের মানুষের উপস্থিতি বোঝা যেত না।
ব্রিজ বা কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিস্ফোরক স্থাপনের সময় এই ছদ্মবেশ মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর চোখের আড়ালে থাকতে সাহায্য করত। এভাবেই প্রকৃতির এই সাধারণ উপাদানটি হয়ে উঠেছিল গেরিলা যুদ্ধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে সহায়তা করেছিল।
অস্ত্র ও গোলাবারুদ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিরাপদে পরিবহনের ক্ষেত্রেও এই আগাছা পালন করেছে এক নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষ করে নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং গ্রামের সাধারণ নারীরা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ বা গ্রেনেড পৌঁছে দিতেন, তখন সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে তাঁরা ঝুড়ির তলায় অস্ত্র রেখে তার ওপরে কচুরিপানা সাজিয়ে নিতেন। চেকপোস্টে পাকিস্তানি সেনারা ভাবত, হয়তো গবাদিপশুর জন্য খাবার বা জ্বালানির জন্য শুকনো কচুরিপানা নেওয়া হচ্ছে। এই সাধারণ আগাছার আড়ালে এভাবেই এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে পৌঁছে যেত স্বাধীনতার বারুদ।
পাশাপাশি, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে লাখো ক্লান্ত শরণার্থীর জন্যও এটি ছিল ভরসার প্রতীক। নৌকার অভাবে খরস্রোতা নদী পার হতে অনেকে কচুরিপানার বড় বড় জটলা বা ভেলার ওপর নির্ভর করতেন। সাঁতার না জানা মানুষ বা ছোট শিশুদের ভাসিয়ে রাখতে এই উদ্ভিদটি ছিল এক ভাসমান ভেলা।
যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে কচুরিপানা হয়তো আবার তার আগের ‘আগাছা’ পরিচয়ে ফিরে গেছে। বিবেচিত হচ্ছে খাল-বিল ভরাট করা এক বিরক্তিকর উদ্ভিদ হিসেবেই। কিন্তু ইতিহাসের আয়নায় তাকালে দেখা যায়, একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে এটি ছিল এক নিঃশব্দ রক্ষাকবচ। এটি কোনো গুলি ছোঁড়েনি, কোনো স্লোগান দেয়নি, কিন্তু নীরবে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাই কচুরিপানা কেবল একটি উদ্ভিদ নয়, বরং এটি একাত্তরের এক নীরব সাক্ষী ও অকৃত্রিম বন্ধু। যা প্রমাণ করে, ন্যায়ের সংগ্রামে প্রকৃতিও শেষ পর্যন্ত শোষিতের পক্ষেই দাঁড়ায়।