leadT1ad

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস

বাংলাদেশের কিংবদন্তি শিক্ষক যাঁরা

শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়, এটা একটি ব্রত—এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাদের কিংবদন্তি শিক্ষকেরা। এমন শিক্ষার পেছনে প্রাচ্য জীবনপদ্ধতি, মূল্যবোধ ও জীবনদর্শন কাজ করেছে। তবে বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব শিক্ষক কিংবদন্তি হয়ে আছেন, তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা যেমন জাতি গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি আমাদের জন্যও হয়ে উঠেছেন বাতিঘর। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ফিরে তাকানো যাক দেশের এমন সাতজন অবিস্মরণীয় শিক্ষকের জীবন ও কর্মে।

বাংলাদেশের কয়েকজন কিংবদন্তি শিক্ষকের ছবি অবলম্বনে। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রাচ্য-প্রতীচ্য পুরাণে ও ইতিহাসে অনেক শিক্ষক বা গুরু কিংবদন্তি হয়ে আছেন তাঁদের জ্ঞান, মনীষা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যকর্মের জন্য। অবশ্য দুই সভ্যতার মূল্যবোধ, জীবনদর্শন ও জীবনপদ্ধতি আলাদা বলে গুরুদেরও প্রকৃতি বা ধরন ভিন্ন ধাঁচের ছিল। তাই ভারতীয় পুরাণের দ্রোণাচার্যের (পঞ্চপাণ্ডবদের গুরু) সঙ্গে যেমন গ্রিক পুরাণের কাইরনকে (অ্যাকিলিস-অ্যাসক্লেপিয়াস-হেরাক্লেস প্রমুখের গুরু) মেলানো যায় না; তেমনি প্রাচীন গ্রিসের অ্যরিস্ততলের (আলেকজান্ডারের শিক্ষক) সঙ্গে প্রাচীন ভারতের চাণক্যের (চন্দ্রগুপ্তের গুরু) তুলনা করা যায় না। যদিও দুই সভ্যতায় পুরাণের বা ইতিহাসের এঁরা সবাই ছিলেন শিক্ষক, ছিলেন জ্ঞান-অন্বেষী; তাঁদের জীবনের ব্রত ছিল বিদ্যাশিক্ষা। আসলে সভ্যতার ধরন অনুযায়ী গুরু বা শিক্ষকদের মানকাঠামো ও কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছিল। দারিদ্র্যক্লিষ্ট দ্রোণাচার্য নিজ সন্তাদের জন্য দুধ কিনতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু শিক্ষকতায় বা দায়িত্বে কসুর করেননি কখনো। প্রিয় ছাত্র অর্জুনকে সর্বশ্রেষ্ঠ করার জন্য তিনি একলব্যের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিলেন ‘গুরু-দক্ষিণা’ হিসেবে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান ঈশ্বচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেয়েদের স্কুল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে নিজের বইয়ের রয়্যালিটি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিক্রিলব্ধ টাকায় বিদ্যালয়টি চালু রেখে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

শুধু শিক্ষাদান নয় শিক্ষার্থীদের প্রতি আপত্য স্নেহে সাদাসিধে জীবন, সরলতা, নম্রতা, দয়া, সততা, নিষ্ঠা, সাহস, পরোপকার প্রভৃতিসহ সামাজিক দায়িত্বপালন প্রাচ্যদেশীয় শিক্ষকদের প্রধান গুণাবলি। বাংলাদেশের শিক্ষকেরাও এই ঐতিহ্যের অধিকারী। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে নতুন দেশ গঠিত হওয়ার পরে বাংলাদেশ অঞ্চলে বড়ো ধরনের দায়িত্ব পড়ে শিক্ষকদের ওপর। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা নিজেদের বিলিয়ে দিতে থাকেন। শিক্ষকদের জ্ঞান ও মনীষায় স্নাত হয়ে নতুন একটি জাতি গঠিত হয় এবং একাত্তর সালে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এদেশের শিক্ষক-সমাজ শিক্ষাদান ছাড়াও সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে যুগপৎ দায়িত্ব পালন করেন; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন অনেকেই। যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও ডিসেম্বর মাসে দেশের জন্য বরণ করেন শহিদি জীবন। বুদ্ধিজীবী হিসেবে ঘাতকেরা হত্যা করে অনেককেই।

শুধু শিক্ষাদান নয় শিক্ষার্থীদের প্রতি আপত্য স্নেহে সাদাসিধে জীবন, সরলতা, নম্রতা, দয়া, সততা, নিষ্ঠা, সাহস, পরোপকার প্রভৃতিসহ সামাজিক দায়িত্বপালন প্রাচ্যদেশীয় শিক্ষকদের প্রধান গুণাবলি। বাংলাদেশের শিক্ষকেরাও এই ঐতিহ্যের অধিকারী। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে নতুন দেশ গঠিত হওয়ার পরে বাংলাদেশ অঞ্চলে বড়ো ধরনের দায়িত্ব পড়ে শিক্ষকদের ওপর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। বাংলাদেশের বুনিয়াদ গঠন করেন মূলত এই বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষকেরা। তাই একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বড় ক্ষেত্র ছিল এটি। বাংলাদেশের কিংবদন্তি শিক্ষকদের বেশির ভাগই এই বিদ্যাপিঠ থেকে তৈরি হয়েছিলেন। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেক বড় মাপের শিক্ষকের কর্মক্ষেত্র ছিল। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি অনেক কলেজও কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষকের কর্মক্ষেত্র ছিল। স্কুল থেকেও আমরা অনেক কৃতী শিক্ষককেও লাভ করেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি শিক্ষকেরা হচ্ছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), কুদরাত এ খুদা (১৯০০-১৯৭৭), মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০২-১৯৮২), গোবিন্দচন্দ্র দেব (১৯০৭-১৯৭১), মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯), আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২), কবীর চৌধুরী (১৯২৩-২০১১), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১), খান সরওয়ার মুরশিদ (১৯২৪-২০১২), আনিসুজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক (১৯২৪-২০২২), আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন (১৯৩০-১৯৯৮), মুহাম্মদ শাসসুজ্জোহা (১৯৩৪-১৯৬৯), বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬-২০২০), সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (১৯৩৬-), আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৯৩৬-১৯৮৯), জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৯৪৩-২০২০) সৈয়দ আকরম হোসেন (১৯৪৪-), অরুণচন্দ্র বসাক (১৯৪১-), হুমায়ুন আজাদ (১৮৪৭-২০০৪), সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮), মহাম্মদ দানীউল হক (১৯৪৭-২০২৩) প্রমুখ।

অন্যদিকে বিভিন্ন কলেজের কিংবদন্তি শিক্ষকেরা হচ্ছেন শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮), আলাউদ্দিন আল-আজাদ (১৯৩২-২০০৯), যতীন সরকার (১৯৩৬-২০২৫), আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (১৯৩৯-), সফিউদ্দিন আহমেদ (১৯৪৩) প্রমুখ। জীবনব্যাপী জ্ঞানতপস্যা, শিক্ষকতা, গবেষণা, লেখালেখি, সমাজকর্ম প্রভৃতি কর্মের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে এঁরা সবাই-ই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সবাই দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন; পেয়েছেন শ্রদ্ধ ও সম্মান। কেউ কেউ পেয়েছেন জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা, কেউ কেউ অপরাপর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মাননা।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯)

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ জ্ঞানতাপস হিসেবে পরিচিতি ছিলেন, ছিলেন বহু ভাষাবিদ ও শিক্ষাব্রতী। চরিত্রে, চলনে, বলনে ছিলেন প্রাচীন ভারতের ঋষিতুল্য। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটি আজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করে গেছেন। যদিও শিক্ষকতা তিনি শুরু করেছিলেন স্কুল থেকে। পোশাক-আশাক ও কথাবার্তায় খাঁটি মুসলমানের জীবনযাপন করলেও শহীদুল্লাহ্ ধর্মান্ধ ছিলেন না; বরং মুসলমানদের মধ্যে যেসব অন্ধ বিশ্বাস ছিল, তিনি তার মূলে আঘাত করেছেন। বাংলা ভাষার ব্যাপারে বাঙালি মুসলমানের যে একটা দূরত্ব ছিল গবেষণা ও বহুল চর্চার মাধ্যমে সেই দূরত্ব ও বিভ্রান্তি ঘুচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলা ভাষা নিয়ে যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল, সেখানে শহীদুল্লাহ্ বাংলার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ইতিহাস প্রণয়ন করে এবং বাংলা লোকসাহিত্য চর্চা ও সংরক্ষণে তাঁর ভূমিকা অনন্য, বিশ্ববিশ্রুত।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। সংগৃহীত ছবি
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। সংগৃহীত ছবি

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন নিবেদিত প্রাণ; ছাত্র-অন্তপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে ও গবেষক তৈরিতে তিনি ছিলেন আদর্শ। বিদ্যাভিমানী তো ছিলেনই না, বরং ছাত্রদের তিনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতেন। ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার একবার বলেছিলেন, ‘দেখো, শহীদুল্লার্হ নিকট ছাত্র বা যে কেউই হোক না কেন কোনো দুঃখ-কষ্টের বা দুঃখ নিবারণের স্কিম নিয়ে এলেই কিছু টাকা নিতে পারে। এভাবে যে সে কতবার ঠকেছে ইয়াত্তা নেই।’ অথচ বিরাট সংসার নিয়ে সারাজীবন তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন এবং অতিসাধারণ জীবন যাপন করেছেন। মানুষকে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং দারিদ্র্যপীড়িত ছাত্রদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। বড় পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও রাস্তার পাশের মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর কথা বলতেন।

ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার একবার বলেছিলেন, ‘দেখো, শহীদুল্লার্হ নিকট ছাত্র বা যে কেউই হোক না কেন কোনো দুঃখ-কষ্টের বা দুঃখ নিবারণের স্কিম নিয়ে এলেই কিছু টাকা নিতে পারে। এভাবে যে সে কতবার ঠকেছে ইয়াত্তা নেই।’ অথচ বিরাট সংসার নিয়ে সারাজীবন তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন এবং অতিসাধারণ জীবন যাপন করেছেন।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র শিক্ষকতার আদর্শ ছিল জ্ঞান-অন্বেষণ ও দেশগঠনে কাজ করে যাওয়া। একটা বক্তৃতায় একবার বলেছিলেন, ‘শিক্ষকেরা চিরদিন জাতিগঠনের কর্তা। কিন্তু আজকার দিন আমাদের ওপর এক অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য-ভার অর্পণ করেছে। সেটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন।...সুনাগরিক গঠন করতে হলে সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো, ছাত্রদের মনে স্বাধীনতার ভাব সৃষ্টি করা। এটা একটা নিষ্ঠুর সত্য যে দেশ আজাদ, কিন্তু অনেকের পক্ষে মন গোলাম। আমি তাকেই স্বাধীন মন বলি, যা সবরকমের কুসংস্কারবর্জিত, যা সকল দীনতা-হীনতা থেকে মুক্ত, যা দেশের মঙ্গলচিন্তায় সদাব্যাপৃত, যা দেশের সেবায় উল্লসিত। এই স্বাধীন মন সৃষ্টি করতে হলে শিক্ষকদের মনকে স্বাধীন করতে হবে।...আজ আমাদের মানুষের চাষ করতে হবে। যত পতিত মানুষ-জমি আমাদের আবাদ করতে হবে। তবেই আমরা ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমকক্ষ হতে পার।’ এই লক্ষ্যে সারাজীবন শিক্ষকতা করে শহীদুল্লাহ্ জাতিগঠনে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছেন; তাঁর ছাত্রছাত্রীরা পদস্থ কর্মকর্তা হয়ে দেশের দায়িত্ব নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহের জন্য তিনি নিজে হাতে অনেক শিক্ষক তৈরি করেছেন। অনেক গবেষকের হাতেখড়ি শহীদুল্লাহ্‌র হাতেই, উত্তরকালে বাংলা সাহিত্যের বড় মাপের অধ্যাপক ও গবেষক সবাই-ই তাঁর ছাত্র ছিলেন। এভাবে সরল জীবনযাপন, অকৃত্রিম দেশপ্রেম ও ছাত্রদের প্রতি পিতৃসুলভ ভালোবাসা তাঁকে কিংবদন্তি শিক্ষকের মর্যাদা দেয়। যারা স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়েও যাননি, তাঁদের কাছেও বাংলাদেশে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একটি আবেগের নাম। শিক্ষকতা পেশাকে তিনি গৌরবান্বিত করে গেছেন। শিক্ষকতা পেশায় তিনি অনুকরণীয় ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব।

কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১)

কাজী মোহাতার হোসেন ঢাকা ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি পদার্থবিদ্যা, গণিত ও পরিসংখ্যান বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অনুপ্রেরণার প্রতীক ও আদর্শস্থানীয়। মোহাতার হোসেন একজন সুসাহিত্যিক ছিলেন; ধার্মিক হয়েও ছিলেন উদার ও কুসংস্কারমুক্ত। শিক্ষা-সংস্কৃতি, সংগীত, দাবাখেলা, সমাজতত্ত্ব, দর্শন প্রভৃতিতে তাঁর আসক্তি ছিল। তাই পদার্থবিদ্যা, গণিত ও পরিসংখ্যানের বাইরে তিনি মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিতেন। মোতাহার হেসেনের কাছে বিজ্ঞান ও সাহিত্য দুই-ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং উপযুক্ত মানুষ হওয়ার জন্য এগুলোর সমন্বয় নিয়ে চিন্তা করেছেন।

কাজী মোতাহার হোসেন। সংগৃহীত ছবি
কাজী মোতাহার হোসেন। সংগৃহীত ছবি

বিশ শতকের বিশের দশক থেকে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের চিন্তাচেতনায় প্রগতিশীলতার বীজ বপনে এবং মানসগঠনে একজন শিক্ষক হিসেবে কাজী মোতাহার হোসেনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তরুণসম্প্রদায়ের উৎকর্ষ সাধনে তিনি কাজ করে গেছেন। তিনি বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও সৃজনশীলা ব্যতিরেকে যে মুসলমান সমাজ এগাতে পারবে না, এটা মনে করে তিনি তাঁর সমুদয় কার্যসাধন করেন।

কাজী মোতাহার হোসেনের বক্তৃতা ছিল প্রাঞ্জল, যুক্তিনিষ্ঠ ও প্রেরণাদায়ী। তিনি ছাত্রদের পছন্দ করতেন, ছাত্ররাও তাঁকে পিতৃসম সম্মান করত। তিনি আড্ডাপ্রিয় ও রসিক ছিলেন এবং আড্ডাচ্ছলে তরুণ শিক্ষকদের প্রাণিত করতেন। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গবেষণায় পরিসংখ্যান ব্যবহারের প্রাথমিক ভিত্তি তার হাতে দিয়েই গড়ে ওঠে। সহৃদয় ও উদার শিক্ষক হিসেবে তিনি দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিকসহযোগ দিতেন। কাছে ডেকে প্রেরণা দিতেন, সাহস দিতেন। অনেক মেধাবী ছাত্র মোতাহার হোসেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে দেশবিদেশে প্রতিষ্ঠালাভ করেন।

বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গবেষণায় পরিসংখ্যান ব্যবহারের প্রাথমিক ভিত্তি তার হাতে দিয়েই গড়ে ওঠে। সহৃদয় ও উদার শিক্ষক হিসেবে তিনি দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিকসহযোগ দিতেন। কাছে ডেকে প্রেরণা দিতেন, সাহস দিতেন। অনেক মেধাবী ছাত্র মোতাহার হোসেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে দেশবিদেশে প্রতিষ্ঠালাভ করেন।

একজন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি পাকিস্তান সরকারের দমননীতির বিরোধিতা করেন। ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রবিরোধিতা সহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। বাংলা বানান ও লিপিসংস্কার কমিটির সদদ্যও তিনি ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সখ্য পান। একজন সরল, ধর্মপ্রাণ, জ্ঞানপিপাসু, সংস্কৃতিবান ও নির্লোভ মানুষ হিসেবে মোতাহার হোসেন একজন আদর্শ ও অনুকরণীয় মানুষ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ও সম্মান পান। শিক্ষক হিসেবে তিনি সকলের হৃদয়ে স্থান করে আছেন।

কুদরাত-এ খুদা (১৯০০-১৯৭৭)

কুদরাত-এ খুদা শিক্ষকতা শুরু করেন অবিভক্ত বাংলার প্রেসিডেন্সি কলেজে; পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজেও চাকরি করেন। রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছাড়াও তিনি একজন শিক্ষবিদ, লেখক ও বিজ্ঞানী ছিলেন। শিক্ষাদান, শিক্ষার মান-উন্নয়ন ও প্রসারে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। দেশভাগের পর তিনি এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিসংক্রান্ত উচ্চতর পদে কাজ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণীত হয়। কিন্তু শিক্ষক হিসেবেই তঁর গ্রহণযোগ্যতা, খ্যাতি ও সমীহ সর্বত্র স্বীকৃত।

কুদরাত-এ খুদা । সংগৃহীত ছবি
কুদরাত-এ খুদা । সংগৃহীত ছবি

মানুষ হিসেবে কুদরাত-এ খুদা একজন বিজ্ঞানমনস্ক, পণ্ডিত, অসাস্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ছিলেন। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের ব্যবহারিক জ্ঞানের সঙ্গেও এই আদর্শও বিলিয়ে দিতেন। একজন অনুকরণীয় শিক্ষক হিসেবে কুদরাত-এ খুদা বিজ্ঞানকে শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে প্রায়োগিক ক্ষেত্র নিয়ে ছাত্রদের বুঝাতেন। তাঁর শিক্ষা ছিল, বিজ্ঞানবিহীন জীবন অন্ধ। তিনি বিশ্বাস করতেন মাতৃভাষায় মাধ্যমেই বিজ্ঞানশিক্ষা ফলবান হয় এবং মাতৃভাষায় বই লিখে ও শ্রেণিকার্যক্রম চালিয়ে তিনি বিজ্ঞানের জ্ঞান বিতরণ করে যশস্বী শিক্ষকে পরিণত হন। শিক্ষক হিসেবে কুদরাত-এ খুদা ছিলেন সহানুভূতিশীল ও আন্তরিক; ক্লাসে ও ক্লসের বাইরে তিনি ছাত্রদের কৌতূহল জাগিয়ে তুলতেন। দুই বাংলায় যুক্তিবাদী তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলতে এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাঁকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার মহীরূহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

কুদরাত-এ খুদা মনে করতেন, শুধু ক্লাসের গণ্ডিই একজন দায়িত্বশীল শিক্ষকের কাজ নয়। দারিদ্র্যদূরীকরণ, সমাজগঠন, মানবিক নানা কর্মকাণ্ডেও শিক্ষকের ভূমিকা রাখা উচিত। এই লক্ষ্যে তিনি সমাজকল্যাণমূলক নানা কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন; দেশের নানামুখী আন্দোলন-সংগ্রামেও নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। সংস্কৃতির বিকাশের তাঁর ভূমিকা অনন্য। তিনি নির্লোভ ও নরোম মনের মানুষ ছিলেন। ছিলেন দয়াশীল ও ছাত্রবান্ধব। বিজ্ঞানী ও উচ্চতর পদে চাকরি করলেও নিজের শিক্ষকসত্তাকে কোনোদিন ভুলেনি তিনি। শিক্ষক হিসেবেই তিনি আমাদের কাছে আদরণীয়। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ পদক ও সম্মান।

আব্দুর রাজ্জাক (১৯২৪-২০২২)

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক জ্ঞানচর্চা ও সাদাসিধে জীবনের জন্য সবার কাছে সমাদৃত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি। ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে আব্দুর রাজ্জাকের দৃষ্টিভঙ্গি তরুণ শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তার পথে অনুপ্রাণিত করত। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দর্শনের অগ্রদূত হিসেবে অনেকে তাঁকে মান্য করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাপর বিভাগের আগ্রহী শিক্ষার্থীরা আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে সময় কাটাতেন। নিজের বাড়িতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্ঞানতাত্ত্বিক আলাপে সময় কাটাতেন ছাত্রদের সঙ্গে। শিক্ষা, গবেষণা, সমাজকাঠামো ও রাজনীতির নির্দেশনা দিতেন। ছাত্রদের তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন, তাদের সঙ্গ দিতেন। নিজে রান্না করে খাওয়াতেন। ঢাকাই ভাষায় কথা বলতেন। ঢাকা শহরের তরুণ সাহিত্যিকরা তাঁর বাড়িকে আশ্রম মনে করতেন। তরুণ শিক্ষার্থীদের অনেকে তাঁকে দ্বিতীয় পিতা ভাবতেন। সরদার ফজলুল করিম, আহমদ ছফা প্রমুখ চিন্তাবিদ-সাহিত্যিকদের তিনি গড়েপিঠে তৈরি করেছেন। বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারাও আব্দুর রাজ্জাকের স্মরণাপন্ন হতে, শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর ভক্ত ছিলেন।

আব্দুর রাজ্জাক। সংগৃহীত ছবি
আব্দুর রাজ্জাক। সংগৃহীত ছবি

আব্দুর রাজ্জাকে উদার মানবতাবাদী মনোভাব, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনা ও অনুকরণযোগ্য সবাইকে আকৃষ্ট করত। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় আপসহীন ছিলেন, ছিলেন প্রতিবাদী ও সাহসী। পাকিস্তান সরকার একসময় তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হেনে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ডও দেয়। তবু তিনি মাথা নত করেননি। নিরংকার, প্রচারবিমুখ, জ্ঞানতাপস চিরকুমার আব্দুর রাজ্জাক আজীবন অকৃতদার থেকে জ্ঞানের তপস্যাই করে গেছেন এবং জ্ঞানে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি মনে করতেন মাতৃভাষা ছাড়া উচ্চশিক্ষা অসম্ভব এবং শিক্ষাই জাতীয় মুক্তি এনে দিতে পারে। এই লক্ষে তিনি শিক্ষকতায় ব্রত ছিলেন।

শ্রেণিকক্ষ আব্দুর রাজ্জাকের প্রিয় জায়গা ছিল, তবে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতার চেয়ে বাসগৃহে ও অফিসকক্ষে আড্ডায় বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে যেভাবে জ্ঞানদান করতেন কিংবা শ্রোতাদর অনুপ্রাণিত করতে তা ছিল বিস্ময়কর । শিক্ষকরাও তাঁর ক্লাস করতেন, তাঁকে শিক্ষকদের শিক্ষক বলা হতো।

আব্দুর রাজ্জাকের জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত বড় ছিল। তিনি যেকোনো বিষয়ে আলাপ জুড়ে দিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারতেন। শ্রেণিকক্ষ আব্দুর রাজ্জাকের প্রিয় জায়গা ছিল, তবে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতার চেয়ে বাসগৃহে ও অফিসকক্ষে আড্ডায় বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে যেভাবে জ্ঞানদান করতেন কিংবা শ্রোতাদর অনুপ্রাণিত করতে তা ছিল বিস্ময়কর । শিক্ষকরাও তাঁর ক্লাস করতেন, তাঁকে শিক্ষকদের শিক্ষক বলা হতো। তবে রাজ্জাক নিজে বই লিখতেন না, তাঁর সঙ্গে আলাপের সূত্র ধরে অনেকে বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন। খ্যাতি বা ক্ষমতার প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। পদোন্নতির জন্য তিনি কখনো আবেদন করতেন না। অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাঁকে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা দেওয়া হয়। অসাধারণ প্রজ্ঞা, আন্তরিকতা, ছাত্রদের প্রতি দরদ, দয়া, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা আব্দুর রাজ্জাককে কিংবদন্তি শিক্ষকে পরিণত করে এবং তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে হন।

মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১)

মুনীর চৌধুরী প্রথমে কলেজে ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের পরে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হন। দুই বিষয়েই তিনি সমান পারদর্শী, দক্ষ ও গুণী শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা ও পাণ্ডিত্য তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দেয়। মুনীর চৌধুরী বাগ্মী হিসেবে বিশেষ খ্যাত ছিলেন। সাবলীল উচ্চারণ ও প্রাঞ্জল ভাষা প্রয়োগ ও যুক্তিনিষ্ঠতা তাঁর বক্তব্যকে বিশেষ আকর্ষণীয় করে তুলত।

ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুনীর চৌধুরী। তাঁর জীবনদর্শন ছিল মানবতাবাদী। তিনি মুক্তবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন, এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্য ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন, ছাত্রদের তিনি ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানতে পারতেন। তাঁর ছত্রছায়ায় অনেক ছাত্র পরবর্তীকালে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হন।

মুনীর চৌধুরী মনে করতেন, শিক্ষক হিসেবে মুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজগঠনে তাঁর দায়িত্ব রয়েছে। তাই দেখা যায় জাতীয় সংকটে তিনি সোচ্চার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একজন লেখক, নাট্যকার, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন।

মুনীর চৌধুরী । সংগৃহীত ছবি
মুনীর চৌধুরী । সংগৃহীত ছবি

বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম যে ছাত্রসভা হয়, তাতে তিনি বক্তৃতা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন, এজন্য তাঁকে জেলজুলুমও পোহাতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্যে জেলে বসে তিনি রচনা করেছিলেন ‘কবর’ নাটকটি। মুনীর চৌধুরী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর লেখাই এর বড় প্রমাণ। দেশভাগের আগে-পরে যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তাতে তিনি খুব বিচলিত হন। দাঙ্গা নিয়ে রচিত তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘মানুষ’। বিভিন্ন ঐতিহাসিক নাটক লিখে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও মানবতাবাদী সমাজগঠনে কাজ করে গেছেন। পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্র-নিষেধাজ্ঞা, রোমান হরফে বাংলা বর্ণমালা সংস্কার প্রভৃতি ঔপনিবেশিক আচরণের বিরুদ্ধেও তাঁর সংগ্রাম ছিল। এসব কারণে তিনি সরকারি খেতাবও ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুনীর চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। একাত্তর সালের চৌদ্দই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাঁকে অপহরণ করে হত্যা করে।

একজন দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক হিসেবে মুনীর চৌধুরী জাতিগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে মানুষের কাছে সম্মাননীয় আসন পেয়েছেন। ছাত্রবান্ধব শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। নির্লোভ ও সাধারণের প্রতিকৃতিও ছিলেন তিনি। জাতীয় জীবনে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ও সম্মান। একজন বিরল শিক্ষক হিসেবে তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন।

শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে আনিসুজ্জামান জাতীয় জীবনে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভাষা-আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতিতে ছিল তাঁর সক্রিয় ভূমিকা।

আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০)

আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন দেশখ্যাত একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক। মনস্বী ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী আনিসুজ্জামান অত্যন্ত ছাত্রবান্ধব ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ ছিল ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রিয় ও অনুপ্রেরণার বিষয়। তিনি ছিলেন মিতভাষী এবং এটাই শিক্ষার্থীদের কাছে আরাধ্য ছিল। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হলেও আনিসুজ্জামানের জ্ঞানের পরিধি ছিল বৃহৎ। ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে ব্যুৎপন্ন আনিসুজ্জামান ক্লাসে পাঠপুস্তকের বাইরে সমকালীন সমাজ, রাজনীতি ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্যসংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করতেন। ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবমুখী জ্ঞানের অধিকারী হতো। ক্লাসে তিনি ছাত্রদের কথা বলার সুযোগ দিতেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী। আনিসুজ্জামান শিক্ষকতা ও গবেষণার মাধ্যমে অসংখ্য ছাত্রদের জীবন গড়ে দিয়েছেন; এঁদের সবাই জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষকতা পেশাকে তিনি আকাশচুম্বী পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। শিক্ষকদের মর্যাদার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।

আনিসুজ্জামান। সংগৃহীত ছবি
আনিসুজ্জামান। সংগৃহীত ছবি

শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে আনিসুজ্জামান জাতীয় জীবনে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভাষা-আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতিতে ছিল তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান রচনায় ও জাতীয় শিক্ষা কমিশনে কাজ করেন। আশির দশকের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, নব্বইয়ের গণতন্ত্রের আন্দোলন এবং সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর যুক্ততা অনবদ্য। জীবনচেতনায় তিনি মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ও সম্মান পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও লেখক হয়েও আনিসুজ্জামান সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (১৯৩৯-)

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাংলাদেশের জীবিত কিংবদন্তি শিক্ষক। শিক্ষাবিদ ও লেখকসত্তার বাইরে তাঁর আরেক পরিচয় একচন সংগঠক হিসেবে। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসেবে চল্লিশ বছর ধরে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সংগৃহীত ছবি
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সংগৃহীত ছবি

মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজের বাংলা বিষয়ের শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করলেও চাকরি-জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটান ঢাকা কলেজে। এখান থেকেই তিনি অবসরে যান। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষকদের একজন। কৌতুকবোধ, বিদগ্ধতা, বাগ্মিতা, হাস্যরস তাঁর চরিত্র্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর ক্লাসে ছেলেদের ঢল পড়ত, তিনি দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লাস নিতে পছন্দ করতেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ক্লাস প্রাণবন্ত, আলোচনামূলক ও প্রশ্ন-উদ্দীপক। সাহিত্যকে তিনি জীবনের উপযোগী করে পাঠযোগ্য করে উপস্থাপন করেন। তিনি শুধু ক্লাসের শিক্ষক নন, জীবনেরও শিক্ষক। তরুণদের জীবনমুখী, মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উদার, যুক্তিশীল ও দায়িত্ববান করে তোলাই তাঁর শিক্ষার মূল মন্ত্র। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতে, শিক্ষক হওয়া মানে ছাত্রদের মনে আলো জ্বালানো। সুতরাং তাঁর জন্ম হয়েছে এই আলো জ্বালানোর জন্য।

একজন শিক্ষকের দায়িত্ব যে কত বড় মহৎ হতে পারে, তার প্রমাণ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সারাদেশে মানুষকে বইপড়ার সুযোগ করে দেওয়া একটি বড় দৃষ্টান্ত। বইপড়া আন্দোলনকে তিনি সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। তরুণদের মানবিক ও বিশ্বমনস্ক করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বিরল। সারাজীবন ছাত্রদের মধ্যে ভালোবাসা, মানবিকতা, সততা ও বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত করে শেষ বয়সে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রকল্প তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি দিয়েছে। ‘সায়ীদ স্যার’ নামে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন।

তরুণদের মানবিক ও বিশ্বমনস্ক করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বিরল। সারাজীবন ছাত্রদের মধ্যে ভালোবাসা, মানবিকতা, সততা ও বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত করে শেষ বয়সে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রকল্প তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি দিয়েছে। ‘সায়ীদ স্যার’ নামে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে পথপ্রদর্শক হয়ে আছেন।

শেষ কথা

শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়, এটা একটি ব্রত---এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাদের কিংবদন্তি শিক্ষকেরা। সন্দেহ নেই, এমন শিক্ষার পেছনে প্রাচ্য জীবনপদ্ধতি, মূল্যবোধ ও জীবনদর্শন কাজ করেছে। ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষার ভিত গড়ে ওঠে; আমলাশাসিত ইংরেজ আমলে শিক্ষকেরা যে খুব সম্মান পেতেন এমন নয়; বেতনও ছিল কম। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁদের পেছনে রাখা হতো, সামাজিক মর্যাদা হয়তো পেতেন। তার পরেও ঔপনিবেশিক আমলে কিংবা পাকিস্তান আমলে পদমর্যাদার দুরবস্থা ও দারিদ্র্য সত্ত্বে শিক্ষকেরা নিজেদের পেশাকে সম্মানীয় ও মর্যাদাপূর্ণ করে তুলেছিলেন মানবিক দায় থেকেই। শিক্ষকতার বাইরেও তাঁরা রেখেছিলেন নানা অবদান ও কৃতিত্ব, বিশেষ করে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শিক্ষকদের জীবনমান যে খুব উন্নত হয়েছে তা নয়; সামরিক শাসন-আমল থেকে আমলাতান্ত্রিক ও পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠলে শিক্ষকদের অবস্থান আরও তলানিতে চলে যায়। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স’ বলি, আর বেতনকাঠামো বলি কিংবা অন্যান্য সুযোগসুবিধা-তাতে শিক্ষকদের অবস্থা গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক নয়। তা সত্ত্বেও অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন একটা মোহ হিসেবে; সেই মোহ কিংবদন্তি শিক্ষকদের তৈরি করা মোহ। বিগত কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন, নেপোটিজম, বৈষম্য প্রভৃতির কারণে যোগ্য শিক্ষকেরা যথাযথ সম্মান পান না; সব জায়গাতে অযোগ্যদের বসিয়ে রাখা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়, এটা দুর্ভাগ্যজন। অন্যদিকে শিক্ষকদের নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা বেশি করা হয়। ফলে তরুণ মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় পিছপা হচ্ছে; ক্লাসের সবচেয়ে কৃতী গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়ে আমলা হতে চায়; এটা যেকোনো জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তবু একদল জ্ঞানপিপাসু মানুষ এ পেশাকে বেছে নেয় মূল্যবোধ্যের ঐতিহ্যকে জিইয়ে রাখতেই; নির্মোহভাবে কাজ করে যান---এটাই ভরসা।

লেখক: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত