আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন আস্থার প্রতীক। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-এর (বিসিবি) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এই সাবেক ক্রিকেটার নতুন করে আলোচনায় এসেছেন বিসিবির আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে। ফিরে দেখা যাক তাঁর জীবনে।
সৈকত আমীন
সত্তর দশকের শেষ ভাগ। ঢাকার ব্যস্ত অলিগলিতে সদ্য স্বাধীন দেশের ভাঙাচোরা রাস্তায়, মাঠে ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে এক কিশোর। কেউ ভাবেনি এই ছেলেটি একদিন হয়ে উঠবেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান। হয়ে উঠবেন প্রজন্মের নায়ক আর মাঠের বাইরেও ছড়িয়ে দেবেন ক্রিকেটের উন্মাদনা। ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেবেন আফগানিস্তান থেকে চীন পর্যন্ত। বলছি মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের কথা। আপনি যদি এতক্ষণেও তাঁকে না চিনে থাকেন তবে বলি তাঁর ডাকনাম বুলবুল। আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-এর (বিসিবি) এই সভাপতি নতুন করে আলোচনায় এসেছেন বিসিবির আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে।
বুলবুলের এ ঘোষণায় অনেকের চোখেই এখন ভেসে উঠছে তাঁর উত্থান-পতনে ভরা ক্যারিয়ার। কেমন ছিল সে জীবনের গল্প?
১৯৬৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জন্ম বুলবুলের। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি টান ছিল তাঁর। কিন্তু তখন ক্রিকেট নয়, ফুটবলই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম।
স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছেন গেন্ডারিয়া ফেমাস ক্লাবের হয়ে। পায়োনিয়ার লিগে একবার হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। পরে প্রথম বিভাগে খেলেছেন ইস্ট এন্ড ক্লাব ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়। তখন আলো ঝলমলে স্টেডিয়ামে গোল করার আনন্দই ছিল ছেলেটির জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
তবে নায়কদের জীবন যেমনটা হয় আরকি—বলা-কওয়া ছাড়াই ট্রাজেডি এসে যায়!
১৯৮৭ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে ফুটবল খেলতে গিয়ে হাঁটুতে গুরুতর ইনজুরির শিকার হন আমিনুল। যেন হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় স্বপ্নের দরজা। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর পক্ষে ফুটবল খেলা আর সম্ভব নয়।
ভাগ্যের নতুন বাঁক ক্রিকেটে
ইনজুরির হতাশা কাটতে না কাটতেই ভাগ্য বুলবুলের জন্য খুলে দিল নতুন এক দরজা, যে দরজা দিয়ে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে ফাঁকফোঁকর বুঝে চার-ছয় মারা যায়। ১৯৮৮ সালে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) অ্যাসোসিয়েটস ইয়ং ক্রিকেটার্স দলে ডাক পান বুলবুল। তারপর যুব বিশ্বকাপে খেলতে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। অফ-স্পিনে উইকেট নিলেন ছয়টি। এর মধ্যে ছিল ভবিষ্যতের কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার উইকেটও।
এই অর্জন তাঁকে বুঝিয়ে দিল, ফুটবলের স্বপ্ন ভেঙে গেলেও ক্রিকেটে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে নতুন পথ। সে বছরই ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপে ঘটল তাঁর ওয়ানডে অভিষেক। ব্যাট হাতে ২৭ রানের ছোট্ট ইনিংস খেললেও সেটাই ছিল নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তবে ক্রিকেটে তাঁর এই অভিষেক-পর্বটিও কুসুমাস্তৃর্ণ ছিল না।
‘ক্রিকেটে ফুটবল খেলছে’
অভিষেকের পর কঠিন পরীক্ষা শুরু হলো বুলবুলের। ফুটবলারকে ক্রিকেটার হিসেবে কেউ কি মানতে চায়! তা ছাড়া বাংলাদেশ তখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটি দুর্বল দল। সীমিত অবকাঠামো আর আন্তর্জাতিক ম্যাচের সুযোগও কম। অপেক্ষা আর আক্ষেপই তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিয়মমিত সঙ্গী।
এদিকে, আইসিসি ট্রফি ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালে খুব একটা ভালো করতে পারেননি বুলবুল। স্বভাবতই সমালোচনার ঢল নেমে এল তাঁর দিকে। এ সময় ‘ক্রিকেটে ফুটবল খেলছে’—এমন ঠাট্টাও শুনতে হয়েছে তাঁকে।
তবে এ কঠিন সময়ই তাঁকে শিখিয়েছে ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের মূল মন্ত্র। হাল ছাড়লেন না তিনি। নিজের ভেতরের খেলোয়াড় সত্তা গড়ে তুলতে থাকলেন ধীরে ধীরে।
এ সময়ই তিনি পরামর্শদাতা হিসেবে পেলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু ও আকরাম খানকে। তাঁদের কাছ থেকে পেলেন ক্রিকেটের অনেক কৌশলগত শিক্ষা।
আর ১৯৮৮ সলে অস্ট্রেলিয়ায় খেলার অভিজ্ঞতা বুলবুলকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, শুধু প্রতিভা দিয়ে কিছু হয় না, পরিশ্রম, পরিকল্পনা আর ধৈর্য ছাড়া সাফল্য আসে না। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়ে সেই শিক্ষাগুলো কাজে লাগালেন তিনি।
জাতীয় গৌরবের পথে
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ১৯৯৭ সাল এক মাইলফলক। আইসিসি ট্রফি জিতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেল। এই জয়ের অন্যতম নায়ক
বুলবুল। সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে বুলবুল ম্যাচজয়ী ৫৭ রানের ইনিংস খেলেন। ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে করেন ৩৭ রান। তাঁর ব্যাটিংই বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে আনে।
এরপর ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব পেলেন বুলবুল। দলের শক্তি সীমিত হলেও লড়াই করলেন সাহস নিয়ে।
স্কটল্যান্ডকে হারাল বাংলাদেশ। আর সবচেয়ে বড় চমক, পাকিস্তানের মতো বিশ্বশক্তিকে হারাল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লাল-সবুজ এই প্রথম হারালো চাঁদ-তারাকে। এই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা।
স্কোর বলছে, বিশ্বকাপে বুলবুল নিজে ওয়ানডেতে তিনটি হাফসেঞ্চুরি করেন, ভারতের বিপক্ষে করেন সর্বোচ্চ ৭০ রান।
২০০০ সালের মহাকাব্য: প্রথম টেস্ট, প্রথম সেঞ্চুরি
১০ নভেম্বর ২০০০, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকা। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট। সারা জাতির চোখ সেই ম্যাচে।
প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে নামলেন বুলবুল। খেললেন ৯ ঘণ্টারও বেশি। বলের পর বল ঠেকালেন, ঘাম ঝরালেন, ধৈর্যের পর ধৈর্য নিয়ে গড়লেন ইনিংস। ১৪৫ রানের অনন্য এক সেঞ্চুরি—বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম।
ম্যাচে বাংলাদেশ হারলেও বুলবুলের সেই ইনিংস জয় করে নিয়েছিল কোটি মানুষের হৃদয়। বুলবুল হয়ে উঠলেন জাতীয় নায়ক।
নায়কের বেসেই ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট খেলাকে বিদায় জানান বুলবুল। তবে খেলাধুলা থেকে বিদায় নিলেও ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর ছিন্ন হলো না।
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অর্জন করলেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার লেভেল-৩ কোচিং সার্টিফিকেট। শুরু হলো কোচিং ক্যারিয়ার।
‘চীনা ক্রিকেটের নীল আর্মস্ট্রং’
২০০৫ সালে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে যোগ দেন বুলবুল। এরপর একে একে ক্রিকেটে পিছিয়ে থাকা আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, ইউএইসহ বিভিন্ন দেশে পরিচালনা করেন কোচিং ক্যাম্প।
২০০৭ সালে দায়িত্ব নেন চীনের ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে। ক্রিকইনফোর এক প্রতিবেদন বলছে, বুলবুল চীনে ক্রিকেটের প্রসারে এত পরিশ্রম করেছেন যে চীনারা তাঁকে উপাধি দিয়েছিল ‘চীনা ক্রিকেটের নীল আর্মস্ট্রং’ নামে। সেখানে শূন্য থেকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ক্রিকেট-কাঠামো। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শুরু করেছিলেন ক্রিকেটের শিক্ষা।
চীনে পরিশ্রম আর উদ্যোগের ফল হিসবে ২০১৬ সালে আইসিসি এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হলেন তিনি। তখন তাঁর হাত ধরে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়ল থাইল্যান্ড, হংকং আর মিয়ানমারেও।
বিসিবি সভাপতির নতুন অধ্যায়
২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হলেন বুলবুল।
সভাপতি হয়েই তিনি ঘোষণা দিলেন, বিসিবিকে করবেন স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমুখী। আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা এবার কাজে লাগাবেন দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে।
সাম্প্রতিক খবর হলো, অক্টোবর ২০২৫-এ বিসিবির আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আগে নির্বাচন না করার কথা জানালেও এবার নির্বাচনে পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা নিজেই জানিয়েছেন তিনি। শুরু করা কাজগুলো এগিয়ে নিতেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত, বুলবুলের ভাষ্য এমন।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) সরাসরি মনোনয়নে বিসিবির কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন বুলবুল। এরপর তিনি বোর্ড সভাপতি নির্বাচিত হন। বিসিবির দায়িত্ব নেওয়ার পরই বুলবুল জানিয়েছিলেন তিনি টি-টোয়েন্টি ইনিংস খেলার জন্য এসেছেন।
ক্রিকেটার-জীবনে কখনো টি-টোয়েন্টি খোলার সুযোগ ঘটেনি বুলবুলের। এবার বিসিবি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বুলবুল জানালেন, তিনি কেবল টি-টোয়েন্টি নয়, ওয়ানডে ইনিংসই খেলতে চান। এ নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘টেস্ট বা টি-টোয়েন্টি খেলা, আমি বলেছিলাম কুইক ইনিংস খেলার। সেটা এখনও শেষ হয়নি। কুইক ইনিংসটা শেষ হোক। আর যদি কন্টিনিউ করতে হয় টি-টোয়েন্টি থেকে ফিফটিতে যাব।’
নির্বাচন করা প্রসঙ্গে এনএসসির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি জানিয়ে বিসিবি প্রধান বলেন, ‘আমার সঙ্গে এনএসসির এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। আমি শুধু এটা প্রকাশ করেছি যে সম্ভব হলে আমি নির্বাচন করব।’
আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নাম শুধু একটি সেঞ্চুরি দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি এমন একজন, যিনি ফুটবলার থেকে ক্রিকেটার হয়েছেন। আর ক্রিকেটার থেকে হয়েছেন বিশ্বব্যাপী ক্রিটেজ উন্নয়নকর্মী। এখন বিসিবি সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশকে দিয়েছেন জাতীয় গর্ব, আর বিশ্বকে দিয়েছেন ক্রিকেটের আলো। আফগানিস্তানকে তিনি দিয়েছেন এগোনোর আশা, চীনকে দেখিয়েছেন ক্রিকেটের স্বপ্ন।
ঢাকার গেন্ডারিয়ার সেই কিশোর আজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে স্থায়ী আসন নিয়েছেন। তাঁর জীবনের গল্পজুড়ে ছিল ট্রাজেডি, সংগ্রাম ও বিজয় নিয়ে বারবার ফিরে আসা। বিসিবিতে টি-টোয়েন্টি খেলতে এসে এখন যে তিনি ওয়ান ডে ইনিংস খেলতে চান, এই চাওয়া দেশসেরা এ ক্রিকেটারকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোথায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
সত্তর দশকের শেষ ভাগ। ঢাকার ব্যস্ত অলিগলিতে সদ্য স্বাধীন দেশের ভাঙাচোরা রাস্তায়, মাঠে ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে এক কিশোর। কেউ ভাবেনি এই ছেলেটি একদিন হয়ে উঠবেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান। হয়ে উঠবেন প্রজন্মের নায়ক আর মাঠের বাইরেও ছড়িয়ে দেবেন ক্রিকেটের উন্মাদনা। ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেবেন আফগানিস্তান থেকে চীন পর্যন্ত। বলছি মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের কথা। আপনি যদি এতক্ষণেও তাঁকে না চিনে থাকেন তবে বলি তাঁর ডাকনাম বুলবুল। আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-এর (বিসিবি) এই সভাপতি নতুন করে আলোচনায় এসেছেন বিসিবির আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে।
বুলবুলের এ ঘোষণায় অনেকের চোখেই এখন ভেসে উঠছে তাঁর উত্থান-পতনে ভরা ক্যারিয়ার। কেমন ছিল সে জীবনের গল্প?
১৯৬৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জন্ম বুলবুলের। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি টান ছিল তাঁর। কিন্তু তখন ক্রিকেট নয়, ফুটবলই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম।
স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছেন গেন্ডারিয়া ফেমাস ক্লাবের হয়ে। পায়োনিয়ার লিগে একবার হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। পরে প্রথম বিভাগে খেলেছেন ইস্ট এন্ড ক্লাব ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়। তখন আলো ঝলমলে স্টেডিয়ামে গোল করার আনন্দই ছিল ছেলেটির জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
তবে নায়কদের জীবন যেমনটা হয় আরকি—বলা-কওয়া ছাড়াই ট্রাজেডি এসে যায়!
১৯৮৭ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে ফুটবল খেলতে গিয়ে হাঁটুতে গুরুতর ইনজুরির শিকার হন আমিনুল। যেন হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় স্বপ্নের দরজা। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর পক্ষে ফুটবল খেলা আর সম্ভব নয়।
ভাগ্যের নতুন বাঁক ক্রিকেটে
ইনজুরির হতাশা কাটতে না কাটতেই ভাগ্য বুলবুলের জন্য খুলে দিল নতুন এক দরজা, যে দরজা দিয়ে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে ফাঁকফোঁকর বুঝে চার-ছয় মারা যায়। ১৯৮৮ সালে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) অ্যাসোসিয়েটস ইয়ং ক্রিকেটার্স দলে ডাক পান বুলবুল। তারপর যুব বিশ্বকাপে খেলতে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। অফ-স্পিনে উইকেট নিলেন ছয়টি। এর মধ্যে ছিল ভবিষ্যতের কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার উইকেটও।
এই অর্জন তাঁকে বুঝিয়ে দিল, ফুটবলের স্বপ্ন ভেঙে গেলেও ক্রিকেটে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে নতুন পথ। সে বছরই ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপে ঘটল তাঁর ওয়ানডে অভিষেক। ব্যাট হাতে ২৭ রানের ছোট্ট ইনিংস খেললেও সেটাই ছিল নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তবে ক্রিকেটে তাঁর এই অভিষেক-পর্বটিও কুসুমাস্তৃর্ণ ছিল না।
‘ক্রিকেটে ফুটবল খেলছে’
অভিষেকের পর কঠিন পরীক্ষা শুরু হলো বুলবুলের। ফুটবলারকে ক্রিকেটার হিসেবে কেউ কি মানতে চায়! তা ছাড়া বাংলাদেশ তখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটি দুর্বল দল। সীমিত অবকাঠামো আর আন্তর্জাতিক ম্যাচের সুযোগও কম। অপেক্ষা আর আক্ষেপই তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিয়মমিত সঙ্গী।
এদিকে, আইসিসি ট্রফি ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালে খুব একটা ভালো করতে পারেননি বুলবুল। স্বভাবতই সমালোচনার ঢল নেমে এল তাঁর দিকে। এ সময় ‘ক্রিকেটে ফুটবল খেলছে’—এমন ঠাট্টাও শুনতে হয়েছে তাঁকে।
তবে এ কঠিন সময়ই তাঁকে শিখিয়েছে ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের মূল মন্ত্র। হাল ছাড়লেন না তিনি। নিজের ভেতরের খেলোয়াড় সত্তা গড়ে তুলতে থাকলেন ধীরে ধীরে।
এ সময়ই তিনি পরামর্শদাতা হিসেবে পেলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু ও আকরাম খানকে। তাঁদের কাছ থেকে পেলেন ক্রিকেটের অনেক কৌশলগত শিক্ষা।
আর ১৯৮৮ সলে অস্ট্রেলিয়ায় খেলার অভিজ্ঞতা বুলবুলকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, শুধু প্রতিভা দিয়ে কিছু হয় না, পরিশ্রম, পরিকল্পনা আর ধৈর্য ছাড়া সাফল্য আসে না। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়ে সেই শিক্ষাগুলো কাজে লাগালেন তিনি।
জাতীয় গৌরবের পথে
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ১৯৯৭ সাল এক মাইলফলক। আইসিসি ট্রফি জিতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেল। এই জয়ের অন্যতম নায়ক
বুলবুল। সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে বুলবুল ম্যাচজয়ী ৫৭ রানের ইনিংস খেলেন। ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে করেন ৩৭ রান। তাঁর ব্যাটিংই বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে আনে।
এরপর ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব পেলেন বুলবুল। দলের শক্তি সীমিত হলেও লড়াই করলেন সাহস নিয়ে।
স্কটল্যান্ডকে হারাল বাংলাদেশ। আর সবচেয়ে বড় চমক, পাকিস্তানের মতো বিশ্বশক্তিকে হারাল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লাল-সবুজ এই প্রথম হারালো চাঁদ-তারাকে। এই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা।
স্কোর বলছে, বিশ্বকাপে বুলবুল নিজে ওয়ানডেতে তিনটি হাফসেঞ্চুরি করেন, ভারতের বিপক্ষে করেন সর্বোচ্চ ৭০ রান।
২০০০ সালের মহাকাব্য: প্রথম টেস্ট, প্রথম সেঞ্চুরি
১০ নভেম্বর ২০০০, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকা। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট। সারা জাতির চোখ সেই ম্যাচে।
প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে নামলেন বুলবুল। খেললেন ৯ ঘণ্টারও বেশি। বলের পর বল ঠেকালেন, ঘাম ঝরালেন, ধৈর্যের পর ধৈর্য নিয়ে গড়লেন ইনিংস। ১৪৫ রানের অনন্য এক সেঞ্চুরি—বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম।
ম্যাচে বাংলাদেশ হারলেও বুলবুলের সেই ইনিংস জয় করে নিয়েছিল কোটি মানুষের হৃদয়। বুলবুল হয়ে উঠলেন জাতীয় নায়ক।
নায়কের বেসেই ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট খেলাকে বিদায় জানান বুলবুল। তবে খেলাধুলা থেকে বিদায় নিলেও ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর ছিন্ন হলো না।
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অর্জন করলেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার লেভেল-৩ কোচিং সার্টিফিকেট। শুরু হলো কোচিং ক্যারিয়ার।
‘চীনা ক্রিকেটের নীল আর্মস্ট্রং’
২০০৫ সালে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে যোগ দেন বুলবুল। এরপর একে একে ক্রিকেটে পিছিয়ে থাকা আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, ইউএইসহ বিভিন্ন দেশে পরিচালনা করেন কোচিং ক্যাম্প।
২০০৭ সালে দায়িত্ব নেন চীনের ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে। ক্রিকইনফোর এক প্রতিবেদন বলছে, বুলবুল চীনে ক্রিকেটের প্রসারে এত পরিশ্রম করেছেন যে চীনারা তাঁকে উপাধি দিয়েছিল ‘চীনা ক্রিকেটের নীল আর্মস্ট্রং’ নামে। সেখানে শূন্য থেকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ক্রিকেট-কাঠামো। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শুরু করেছিলেন ক্রিকেটের শিক্ষা।
চীনে পরিশ্রম আর উদ্যোগের ফল হিসবে ২০১৬ সালে আইসিসি এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হলেন তিনি। তখন তাঁর হাত ধরে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়ল থাইল্যান্ড, হংকং আর মিয়ানমারেও।
বিসিবি সভাপতির নতুন অধ্যায়
২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হলেন বুলবুল।
সভাপতি হয়েই তিনি ঘোষণা দিলেন, বিসিবিকে করবেন স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমুখী। আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা এবার কাজে লাগাবেন দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে।
সাম্প্রতিক খবর হলো, অক্টোবর ২০২৫-এ বিসিবির আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আগে নির্বাচন না করার কথা জানালেও এবার নির্বাচনে পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা নিজেই জানিয়েছেন তিনি। শুরু করা কাজগুলো এগিয়ে নিতেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত, বুলবুলের ভাষ্য এমন।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) সরাসরি মনোনয়নে বিসিবির কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন বুলবুল। এরপর তিনি বোর্ড সভাপতি নির্বাচিত হন। বিসিবির দায়িত্ব নেওয়ার পরই বুলবুল জানিয়েছিলেন তিনি টি-টোয়েন্টি ইনিংস খেলার জন্য এসেছেন।
ক্রিকেটার-জীবনে কখনো টি-টোয়েন্টি খোলার সুযোগ ঘটেনি বুলবুলের। এবার বিসিবি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বুলবুল জানালেন, তিনি কেবল টি-টোয়েন্টি নয়, ওয়ানডে ইনিংসই খেলতে চান। এ নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘টেস্ট বা টি-টোয়েন্টি খেলা, আমি বলেছিলাম কুইক ইনিংস খেলার। সেটা এখনও শেষ হয়নি। কুইক ইনিংসটা শেষ হোক। আর যদি কন্টিনিউ করতে হয় টি-টোয়েন্টি থেকে ফিফটিতে যাব।’
নির্বাচন করা প্রসঙ্গে এনএসসির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি জানিয়ে বিসিবি প্রধান বলেন, ‘আমার সঙ্গে এনএসসির এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। আমি শুধু এটা প্রকাশ করেছি যে সম্ভব হলে আমি নির্বাচন করব।’
আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নাম শুধু একটি সেঞ্চুরি দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি এমন একজন, যিনি ফুটবলার থেকে ক্রিকেটার হয়েছেন। আর ক্রিকেটার থেকে হয়েছেন বিশ্বব্যাপী ক্রিটেজ উন্নয়নকর্মী। এখন বিসিবি সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশকে দিয়েছেন জাতীয় গর্ব, আর বিশ্বকে দিয়েছেন ক্রিকেটের আলো। আফগানিস্তানকে তিনি দিয়েছেন এগোনোর আশা, চীনকে দেখিয়েছেন ক্রিকেটের স্বপ্ন।
ঢাকার গেন্ডারিয়ার সেই কিশোর আজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে স্থায়ী আসন নিয়েছেন। তাঁর জীবনের গল্পজুড়ে ছিল ট্রাজেডি, সংগ্রাম ও বিজয় নিয়ে বারবার ফিরে আসা। বিসিবিতে টি-টোয়েন্টি খেলতে এসে এখন যে তিনি ওয়ান ডে ইনিংস খেলতে চান, এই চাওয়া দেশসেরা এ ক্রিকেটারকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোথায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
আজ ৪ সেপ্টেম্বর। ‘গানের পাখি’ সাবিনা ইয়াসমিনের জন্মদিন। তাঁর আসল নাম কিন্তু সাবিনা ইয়াসমিন নয়! দিলশাদ ইয়াসমিন থেকে কেন তিনি সাবিনা ইয়াসমিন হলেন? আর কীভাবে শুরু হয়েছিল তাঁর গান-যাত্রা? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে এ লেখায়।
১৪ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের বাস্তবতায় গুজব যেন এক অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বিশ্বকোষে জায়গা না পেলেও রিকশার হ্যান্ডেলে, বাসের সিটে, সেলুনের আয়নায় এবং অবশ্যই ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে গুজবের অবাধ বিচরণ। মনস্তত্ত্ববিদেরা মনে করেন, গুজবের জন্ম অনিশ্চয়তা থেকে।
৩ দিন আগেআফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এই ভূমিকম্পে ইতিমধ্যেই ৮০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ২০২৩ সালের ভূমিকম্পে দেশটিতে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বড় ভূমিকম্প হলে, দেশ-বিদেশে আলোচনায় উঠে আসে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
৩ দিন আগেকোনো সমাজে গুজব কেন ছড়ানো হয়? গুজব আর গালগল্প কেন মানুষের এত প্রিয়? চলুন, ভ্রমণ করা যাক গুজবমুখর এক ব্যাঙ্গের দুনিয়ায়…
৪ দিন আগে