স্মৃতিতে শাফিন আহমেদ
গতকাল ২৪ জুলাই ছিল কিংবদন্তি ব্যান্ডতারকা শাফিন আহমেদের প্রথম মৃত্যুদিন। এ প্রজন্মের ব্যান্ড ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর লিড ভোকালিস্ট, কবি প্রবর রিপনের সঙ্গে তাঁর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। প্রিয় তারকার মৃত্যুদিনে স্মৃতির খাতা মেলে ধরেছেন তরুণদের প্রিয় শিল্পী প্রবর রিপন।
প্রবর রিপন
আমার আগের প্রজন্মের, আগের বলতে আমাদের কৈশোর বা অতি তারুণ্যের সময় যাঁরা কিংবদন্তি মিউজিশিয়ান, তাঁদের মধ্যে চারজনের খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। শাফিন আহমেদ ভাই, কমল ভাই (ওয়ারফেজ), নিলয়দা (নিলয় দাশ) আর কফিল আহমদে ভাই।
শাফিন আহমেদ—শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় খুব কাকতালীয়ভাবে। আমি একদিন এক ঘরোয়া পরিবেশে গান গাচ্ছিলাম। হঠাৎ শাফিন ভাই সেখানে এসে হাজির হন। ঘরোয়া পরিবেশে সাধারণত যে রকম গান গাওয়া হয়, সে গানগুলোই গাইছিলাম—রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক বাংলা গান, লালনগীতি, এসব। শাফিন ভাইকে দেখে আমি গেয়ে উঠি পিংক ফ্লয়েড আর আমার নিজের তথাকথিত মন খারাপ করা লিরিকের গান। সেদিন আমি অনেক সময় ধরে বিচিত্র সব গান গেয়েছিলাম।
গান শেষে হলে শাফিন ভাই এসে আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যান। জিজ্ঞাসা করেন, আমি এত বিচিত্র ধরনের গান গাওয়া কোথা থেকে শিখেছি?
স্পষ্ট মনে পড়ে, বলেছিলাম, ‘রাস্তা থেকে শিখেছি। রাস্তায় তো সব ধরনের গান ভেসে বেড়ায়।’ আমার এই উত্তর তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। তখনও ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ শুরু করিনি। আর আমাদের ‘মনোসরণি’ ব্যান্ডও ততদিনে ভেঙে গেছে।
শাফিন ভাই আমাকে বলেছিলেন, 'তোমাকে মানুষ চেনে না কেন? অ্যালবাম বের হয়েছে কি না?’ আমি বলেছিলাম, ‘মনোসরণি’র একটা অ্যালবাম বেরিয়েছে। কিন্তু অ্যালবামের রেকর্ডিং আর সাউন্ড আমার একদম পছন্দ না। সেদিন শাফিন ভাই আমার ফোন নম্বর নিয়ে বলেছিলেন, 'আমি চাই, মানুষ তোমাকে গায়ক হিসেবে চিনুক।'
ঘরোয়া আড্ডায় আমাদের আরও অনেকবার দেখা হয়েছিল। এমনকি একসঙ্গে দুজন গানও গেয়েছিলাম। প্রায়ই ফোনে যোগাযোগ হতো আমাদের।
শাফিন ভাই একদিন আমি ও আমার প্রেমিকাকে ‘মাইলস’-এর প্র্যাক্টিসেও নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘মাইলস’-এর প্র্যাকটিস করার ধরন দেখে আমি সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। একটানা তিন ঘণ্টায় ২৫টির বেশি গান তারা প্র্যাকটিস করল। তা-ও কোনো বিরতি ছাড়াই! ভাবছিলাম, এটা কীভাবে সম্ভব! আমরা মোটামুটি দুটো গান প্র্যাকটিস করার পর সিগারেট খাওয়ার বিরতির জন্য অস্থির হয়ে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম, ৩০–৪০ বছর ধরে কীভাবে তারা মিউজিকসিন কাঁপিয়ে যাচ্ছে। আরও বুঝেছিলাম, ‘মাইলস’ তখনো কেন লাইভ কনসার্টে যেকোনো তরুণ ব্যান্ডের চেয়ে দুর্দান্ত।
সেদিন ‘মাইলস’-এর প্র্যাক্টিস দেখে মিউজিকে পরিশ্রম ও পেশাদারত্ব সম্পর্কে আমার দারুণ একটা শিক্ষা হয়েছিল। যে শিক্ষা আমি এখন আমার নিজের ব্যান্ড ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর ক্ষেত্রেও মেনে চলি। না মেনে কী উপায় আছে? যে ব্যান্ডে পান্ডু ভাইয়ের (শ্বেত পান্ডুরাঙ্গা ব্লুমবার্গ) মতো এত নিষ্ঠাবান, কঠোর পরিশ্রমী আর নিয়মানুবর্তী একজন মিউজিশিয়ান আছেন।
আমি সেদিন এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। তাঁদের প্র্যাকটিস শেষে আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। এটা শুনে কিছুটা শীতল হয়ে যাই আমি। কারণ, গ্রামে থাকতে হামিন ভাই, শাফিন ভাই, মানাম ভাইদের গান উন্মাদের মতো শুনতাম। আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম ক্যাসেটের কাভারের দিকে। বিশেষত, ‘প্রত্যাশা’ অ্যালবামের সেই রানওয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কাভারের দিকে। ভাবতাম, এরা কি কোনো এলিয়েন! এত সুন্দর করে বাজায় কীভাবে! এরা কি মানুষ নাকি অন্যকিছু? আর তাঁদের সামনে গান গাইব! এই ভয়টা একটু পরেই কেটে যায়। কারণ, গান গাওয়া বিষয়ে আমি ভয়ানক নির্লজ্জ। কারও সঙ্গে কথা বলতে আড়ষ্ট হলেও গান গাইতে বিব্রত হই না।
তখন হামিন ভাইয়ের গিটার নিয়ে আমার ‘এপিটাফ’ আর ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’গান দুটি গেয়ে শোনাই। আমি গান গাচ্ছি আর ছোটবেলার আইকনরা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! চোখ বন্ধ করে গেয়ে ফেলি। গান শেষ হলে সবাই খুব প্রশংসা করেছিলেন। সে সেময় আমি খুব বিব্রত হয়েছিলাম। এখনো মনে আছে, শাফিন ভাই সেদিন মানাম ভাই আর হামিন ভাইকে বলেছিলেন, ‘দেখেছো, ছেলেটার কিন্তু দারুণ রক। আমি চিনতে ভুল করিনি।’
আজীবন এই কথা আমার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
এসব অনুপ্রেরণার খুব অভাব এখানে। কিন্তু শাফিন ভাই আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। ২০২০ সালে যখন আমাদের প্রথম অ্যালবাম ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ বের হয়, সবার আগে শাফিন ভাই অ্যালবামের প্রশংসা করেছিলেন। অ্যালবাম বের করার পর এবং সেটি মানুষের ভালো লাগার পরেও কেউ কনসার্টে ডাকত না আমাদের। তখন শাফিন ভাই-ই প্রথম কোনো বড় কনসার্টে আমাদের ডেকেছিলেন। যদিও কনসার্টটি পরে আর হয়নি। এরপর নিয়মিত আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।
শাফিন ভাই আর কমল ভাই আমাকে সব সময় বলতেন, যেন হতাশ না হই। বলতেন, ‘দেখো কেউ তোমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, যদি না তোমরা হাল ছেড়ে দাও।’
‘সোনার বাংলা সার্কাস’ নিয়ে শাফিন ভাইয়ের খুব উচ্চ ধারণা ছিল। আমাকে সব সরাসরি না বললেও তাঁর শেষ যে ব্যান্ড ছিল, সেই ব্যান্ডের অনেকের কাছেই আমাদের ব্যান্ড নিয়ে খুব ভালো ভালো কথা বলতেন। আমি তাঁর ব্যান্ডমেটদের কাছেই তা শুনেছি।
আপনার হয়তো শাফিন ভাইয়ের বাইরেরটা দেখে ভাবতেন, তিনি খুবই রাশভারী মানুষ। বিশ্বাস করুন, খুব কাছ থেকে দেখলে বুঝতেন, তিনি খুবই শিশুর মতো। আর ‘ভেতরে’শিশুর এমন সারল্য আর পারঙ্গমতা না থাকলে এত সব কঠিন কঠিন বেজলাইন বাজিয়ে এত সুন্দরভাবে গান গাওয়া কি যায়? যায় না।
আমাকে শাফিন ভাই প্রায়ই বলতেন, একজন রক মিউজিশিয়ানকে চির তরুণ থাকতে হবে। শারীরিকভাবে দারুণ ফিট থাকতে হবে, যেন বার্ধক্য না আসে। অথচ বলা যায় সেই শরীরই তাঁকে অকালে নিয়ে চলে গেল।
চিকিৎসকের বারণ থাকা সত্ত্বেও মিউজিকের প্রেমে বিমানভ্রমণ করলেন, কনসার্টে-কনসার্টে গান গেয়ে বেড়ালেন। আর গান শেষেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন! শাফিন ভাইয়ের শেষ ব্যান্ড ‘ভয়েস অফ্ মাইলস’-এর ড্রামার সামিউলের কাছে শুনেছি, তিনি একবার স্টেজে গান গাওয়ার সময় মাইনর হার্ট অ্যাটাক করেন। অথচ এর চেয়ে তিনি বেশি বিব্রত ছিলেন, গানের যে লাইনটা গাওয়ার সময় তাঁর অ্যাটাক হয়, সেই লাইনের সুর ছুটে গেছে বলে। সত্যিই যিনি মন থেকে নিজের কাজকে ভালোবাসেন, তিনি অনেক সময় নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ওই কাজটিকেই ভালোবাসে ফেলেন। শাফিন ভাই ছিলেন সেই গোত্রের মানুষ।
‘সোনার বাংলা সার্কাস’ ডাবল অ্যালবাম বের করছে, এটা জেনে শাফিন ভাই খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কবে আসবে? আমি শুনব।’
আসলে এটা আমাকে আজীবন পোড়াবে যে তিনি আমাদের অ্যালবামটা শুনে যেতে পারলেন না। তার আগেই মৃত্যু এসে তাঁকে নিয়ে গেল সব গানের ওপারে। শাফিন ভাই ‘রিদম অফ লাইফ’নামে একটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটকের টাইটেল গানটা আমি সুর করেছিলাম। আর তিনি গেয়েছিলেন। আমার কী দারুণ সৌভাগ্য!
গত বছর শাফিন ভাই যখন আমেরিকাতে মারা গেলেন, তখন দেশে কী দমবন্ধ অবস্থা! অজস্র মৃত্যুর ভেতর তাঁর মৃত্যুও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। সমাধিস্থ হওয়ার সময় তাঁকে যখন শেষ দেখতে গেলাম , তখনও সে কী চাপা ভয় পথে পথে।
শাফিন ভাই আমার রক্তের কেউ নন, তবু সমাধিতে নামানোর সময় মনে হলো, রক্তের সেই প্রাচীন ধারার সঙ্গে সম্পর্কিত যেন কোন সহোদরের শব নামানো হলো সমাধিতে। আর তাঁর ভেতরে মৃত্যু হলো আমারও। কিন্তু শাফিন ভাই আমার ভেতরে যেমন, আমার মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার মৃত্যু হবে না।
ভালোবাসা নেবেন স্বচক্ষে দেখা এক কিংবদন্তি, শাফিন ভাই। আমাকে নিয়ে আপনার উচ্চাশা যেন ভুল প্রমাণিত না হয়, তার চেষ্টা করে যাব রক্তের শেষবিন্দু নিথর হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত। আমার ভেতরে যে আপনার মৃত্যু নেই কখনো!
লেখক: ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট; কবি।
আমার আগের প্রজন্মের, আগের বলতে আমাদের কৈশোর বা অতি তারুণ্যের সময় যাঁরা কিংবদন্তি মিউজিশিয়ান, তাঁদের মধ্যে চারজনের খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। শাফিন আহমেদ ভাই, কমল ভাই (ওয়ারফেজ), নিলয়দা (নিলয় দাশ) আর কফিল আহমদে ভাই।
শাফিন আহমেদ—শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় খুব কাকতালীয়ভাবে। আমি একদিন এক ঘরোয়া পরিবেশে গান গাচ্ছিলাম। হঠাৎ শাফিন ভাই সেখানে এসে হাজির হন। ঘরোয়া পরিবেশে সাধারণত যে রকম গান গাওয়া হয়, সে গানগুলোই গাইছিলাম—রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক বাংলা গান, লালনগীতি, এসব। শাফিন ভাইকে দেখে আমি গেয়ে উঠি পিংক ফ্লয়েড আর আমার নিজের তথাকথিত মন খারাপ করা লিরিকের গান। সেদিন আমি অনেক সময় ধরে বিচিত্র সব গান গেয়েছিলাম।
গান শেষে হলে শাফিন ভাই এসে আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যান। জিজ্ঞাসা করেন, আমি এত বিচিত্র ধরনের গান গাওয়া কোথা থেকে শিখেছি?
স্পষ্ট মনে পড়ে, বলেছিলাম, ‘রাস্তা থেকে শিখেছি। রাস্তায় তো সব ধরনের গান ভেসে বেড়ায়।’ আমার এই উত্তর তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। তখনও ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ শুরু করিনি। আর আমাদের ‘মনোসরণি’ ব্যান্ডও ততদিনে ভেঙে গেছে।
শাফিন ভাই আমাকে বলেছিলেন, 'তোমাকে মানুষ চেনে না কেন? অ্যালবাম বের হয়েছে কি না?’ আমি বলেছিলাম, ‘মনোসরণি’র একটা অ্যালবাম বেরিয়েছে। কিন্তু অ্যালবামের রেকর্ডিং আর সাউন্ড আমার একদম পছন্দ না। সেদিন শাফিন ভাই আমার ফোন নম্বর নিয়ে বলেছিলেন, 'আমি চাই, মানুষ তোমাকে গায়ক হিসেবে চিনুক।'
ঘরোয়া আড্ডায় আমাদের আরও অনেকবার দেখা হয়েছিল। এমনকি একসঙ্গে দুজন গানও গেয়েছিলাম। প্রায়ই ফোনে যোগাযোগ হতো আমাদের।
শাফিন ভাই একদিন আমি ও আমার প্রেমিকাকে ‘মাইলস’-এর প্র্যাক্টিসেও নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘মাইলস’-এর প্র্যাকটিস করার ধরন দেখে আমি সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। একটানা তিন ঘণ্টায় ২৫টির বেশি গান তারা প্র্যাকটিস করল। তা-ও কোনো বিরতি ছাড়াই! ভাবছিলাম, এটা কীভাবে সম্ভব! আমরা মোটামুটি দুটো গান প্র্যাকটিস করার পর সিগারেট খাওয়ার বিরতির জন্য অস্থির হয়ে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম, ৩০–৪০ বছর ধরে কীভাবে তারা মিউজিকসিন কাঁপিয়ে যাচ্ছে। আরও বুঝেছিলাম, ‘মাইলস’ তখনো কেন লাইভ কনসার্টে যেকোনো তরুণ ব্যান্ডের চেয়ে দুর্দান্ত।
সেদিন ‘মাইলস’-এর প্র্যাক্টিস দেখে মিউজিকে পরিশ্রম ও পেশাদারত্ব সম্পর্কে আমার দারুণ একটা শিক্ষা হয়েছিল। যে শিক্ষা আমি এখন আমার নিজের ব্যান্ড ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর ক্ষেত্রেও মেনে চলি। না মেনে কী উপায় আছে? যে ব্যান্ডে পান্ডু ভাইয়ের (শ্বেত পান্ডুরাঙ্গা ব্লুমবার্গ) মতো এত নিষ্ঠাবান, কঠোর পরিশ্রমী আর নিয়মানুবর্তী একজন মিউজিশিয়ান আছেন।
আমি সেদিন এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। তাঁদের প্র্যাকটিস শেষে আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। এটা শুনে কিছুটা শীতল হয়ে যাই আমি। কারণ, গ্রামে থাকতে হামিন ভাই, শাফিন ভাই, মানাম ভাইদের গান উন্মাদের মতো শুনতাম। আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম ক্যাসেটের কাভারের দিকে। বিশেষত, ‘প্রত্যাশা’ অ্যালবামের সেই রানওয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কাভারের দিকে। ভাবতাম, এরা কি কোনো এলিয়েন! এত সুন্দর করে বাজায় কীভাবে! এরা কি মানুষ নাকি অন্যকিছু? আর তাঁদের সামনে গান গাইব! এই ভয়টা একটু পরেই কেটে যায়। কারণ, গান গাওয়া বিষয়ে আমি ভয়ানক নির্লজ্জ। কারও সঙ্গে কথা বলতে আড়ষ্ট হলেও গান গাইতে বিব্রত হই না।
তখন হামিন ভাইয়ের গিটার নিয়ে আমার ‘এপিটাফ’ আর ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’গান দুটি গেয়ে শোনাই। আমি গান গাচ্ছি আর ছোটবেলার আইকনরা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! চোখ বন্ধ করে গেয়ে ফেলি। গান শেষ হলে সবাই খুব প্রশংসা করেছিলেন। সে সেময় আমি খুব বিব্রত হয়েছিলাম। এখনো মনে আছে, শাফিন ভাই সেদিন মানাম ভাই আর হামিন ভাইকে বলেছিলেন, ‘দেখেছো, ছেলেটার কিন্তু দারুণ রক। আমি চিনতে ভুল করিনি।’
আজীবন এই কথা আমার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
এসব অনুপ্রেরণার খুব অভাব এখানে। কিন্তু শাফিন ভাই আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। ২০২০ সালে যখন আমাদের প্রথম অ্যালবাম ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ বের হয়, সবার আগে শাফিন ভাই অ্যালবামের প্রশংসা করেছিলেন। অ্যালবাম বের করার পর এবং সেটি মানুষের ভালো লাগার পরেও কেউ কনসার্টে ডাকত না আমাদের। তখন শাফিন ভাই-ই প্রথম কোনো বড় কনসার্টে আমাদের ডেকেছিলেন। যদিও কনসার্টটি পরে আর হয়নি। এরপর নিয়মিত আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।
শাফিন ভাই আর কমল ভাই আমাকে সব সময় বলতেন, যেন হতাশ না হই। বলতেন, ‘দেখো কেউ তোমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, যদি না তোমরা হাল ছেড়ে দাও।’
‘সোনার বাংলা সার্কাস’ নিয়ে শাফিন ভাইয়ের খুব উচ্চ ধারণা ছিল। আমাকে সব সরাসরি না বললেও তাঁর শেষ যে ব্যান্ড ছিল, সেই ব্যান্ডের অনেকের কাছেই আমাদের ব্যান্ড নিয়ে খুব ভালো ভালো কথা বলতেন। আমি তাঁর ব্যান্ডমেটদের কাছেই তা শুনেছি।
আপনার হয়তো শাফিন ভাইয়ের বাইরেরটা দেখে ভাবতেন, তিনি খুবই রাশভারী মানুষ। বিশ্বাস করুন, খুব কাছ থেকে দেখলে বুঝতেন, তিনি খুবই শিশুর মতো। আর ‘ভেতরে’শিশুর এমন সারল্য আর পারঙ্গমতা না থাকলে এত সব কঠিন কঠিন বেজলাইন বাজিয়ে এত সুন্দরভাবে গান গাওয়া কি যায়? যায় না।
আমাকে শাফিন ভাই প্রায়ই বলতেন, একজন রক মিউজিশিয়ানকে চির তরুণ থাকতে হবে। শারীরিকভাবে দারুণ ফিট থাকতে হবে, যেন বার্ধক্য না আসে। অথচ বলা যায় সেই শরীরই তাঁকে অকালে নিয়ে চলে গেল।
চিকিৎসকের বারণ থাকা সত্ত্বেও মিউজিকের প্রেমে বিমানভ্রমণ করলেন, কনসার্টে-কনসার্টে গান গেয়ে বেড়ালেন। আর গান শেষেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন! শাফিন ভাইয়ের শেষ ব্যান্ড ‘ভয়েস অফ্ মাইলস’-এর ড্রামার সামিউলের কাছে শুনেছি, তিনি একবার স্টেজে গান গাওয়ার সময় মাইনর হার্ট অ্যাটাক করেন। অথচ এর চেয়ে তিনি বেশি বিব্রত ছিলেন, গানের যে লাইনটা গাওয়ার সময় তাঁর অ্যাটাক হয়, সেই লাইনের সুর ছুটে গেছে বলে। সত্যিই যিনি মন থেকে নিজের কাজকে ভালোবাসেন, তিনি অনেক সময় নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ওই কাজটিকেই ভালোবাসে ফেলেন। শাফিন ভাই ছিলেন সেই গোত্রের মানুষ।
‘সোনার বাংলা সার্কাস’ ডাবল অ্যালবাম বের করছে, এটা জেনে শাফিন ভাই খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কবে আসবে? আমি শুনব।’
আসলে এটা আমাকে আজীবন পোড়াবে যে তিনি আমাদের অ্যালবামটা শুনে যেতে পারলেন না। তার আগেই মৃত্যু এসে তাঁকে নিয়ে গেল সব গানের ওপারে। শাফিন ভাই ‘রিদম অফ লাইফ’নামে একটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটকের টাইটেল গানটা আমি সুর করেছিলাম। আর তিনি গেয়েছিলেন। আমার কী দারুণ সৌভাগ্য!
গত বছর শাফিন ভাই যখন আমেরিকাতে মারা গেলেন, তখন দেশে কী দমবন্ধ অবস্থা! অজস্র মৃত্যুর ভেতর তাঁর মৃত্যুও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। সমাধিস্থ হওয়ার সময় তাঁকে যখন শেষ দেখতে গেলাম , তখনও সে কী চাপা ভয় পথে পথে।
শাফিন ভাই আমার রক্তের কেউ নন, তবু সমাধিতে নামানোর সময় মনে হলো, রক্তের সেই প্রাচীন ধারার সঙ্গে সম্পর্কিত যেন কোন সহোদরের শব নামানো হলো সমাধিতে। আর তাঁর ভেতরে মৃত্যু হলো আমারও। কিন্তু শাফিন ভাই আমার ভেতরে যেমন, আমার মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার মৃত্যু হবে না।
ভালোবাসা নেবেন স্বচক্ষে দেখা এক কিংবদন্তি, শাফিন ভাই। আমাকে নিয়ে আপনার উচ্চাশা যেন ভুল প্রমাণিত না হয়, তার চেষ্টা করে যাব রক্তের শেষবিন্দু নিথর হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত। আমার ভেতরে যে আপনার মৃত্যু নেই কখনো!
লেখক: ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট; কবি।
‘তুমি যে আমার’, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশ’, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’, ‘বাবুজি ধীরে চল না’—এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গায়িকা গীতা দত্ত ছিলেন ভারতের নারী ‘সিংগিং-সুপারস্টার’। তবে অনেকেই জানেন না, এই কালজয়ী শিল্পী জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে।
২১ ঘণ্টা আগেশিশু-কিশোর বলতে আমরা শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সীদের বুঝে থাকি। এ সময়ে তারা যা দেখে, শোনে ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে, সেটিই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২ দিন আগেযুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়া মানেই প্রাণহানি, হাহাকার ফলাফল হয় শোকাবহ। তবে এতসব হাহাকারের বাইরেও আছে এক ‘অলৌকিক’ গল্প। ২০০৯ সালের এক শীতের বিকেল। নিউইয়র্কের আকাশে হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে একটি যাত্রীবাহী বিমান—ইউএস এয়ারওয়েস ফ্লাইট ১৫৪৯।
২ দিন আগেওজি অসবোর্ন। যাঁকে আমরা চিনি হেভি মেটাল মিউজিকের ‘গডফাদার’ হিসেবে। কিন্তু ওজির শুরুটা ছিল অনেক সাধারণ, অনেক কষ্টের। আসল নাম জন মাইকেল অসবোর্ন। জন্ম ১৯৪৮ সালের ৩ ডিসেম্বর, ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের অ্যাস্টনে।
৩ দিন আগে