leadT1ad

আজ বিশ্ব ডাক দিবস

এখন কেউ আর লেখে না ‘এখন তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো, পত্র দিও’

আজ বিশ্ব ডাক দিবস। একটা সময়ে চিঠি ছিল একধরনের নীরব সংলাপ। একটা চিঠি লেখা হতো ভালোবাসা মিশিয়ে। এখন ভালোবাসা আসে ‘টাইপিং…’ শব্দে, এবং হারিয়ে যায় ‘লাস্ট সিন এট…’-এ। হেলাল হাফিজের মতো গভীর আবেগ নিয়ে কেউ আর লেখে না ‘এখন তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো, পত্র দিও’ বরং লিখে ‘ইউ ওকে?’

আতিয়া সুলতানা
আতিয়া সুলতানা
একজন নিঃসঙ্গ কর্নেল ও আমাদের শূন্য পোস্টবক্স। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রতি শুক্রবার দুপুরে ছোট শহরটির নদীর ঘাটে দেখা মেলে এক বৃদ্ধ কর্নেলের। ধূসর পোশাক, চোখে কালো সানগ্লাস, হাতে পুরোনো ছাতা নিয়ে মেঘলা আকাশের নিচে তাঁর বসে থাকা যেন এক চলমান প্রতীক্ষার প্রতীক। বিকট শব্দে ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ ঘাটে ভিড়লে তিনি নিঃশব্দে এগিয়ে যান চিঠির ঝোলা বয়ে নিয়ে আসা ডাকপিয়নের দিকে। যেন জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়ানো সেই ডাকপিয়নই তাঁর শেষ আশ্রয়।

কাঠের পুরোনো বেঞ্চে বসে তিনি অপেক্ষা করেন, সেই বহু প্রতীক্ষিত চিঠিটির জন্য। সেই চিঠি, যেখানে লেখা থাকবে তাঁর পনেরো বছরের বকেয়া পেনশন মঞ্জুরির খবর। প্রতি সপ্তাহেই একই দৃশ্য, একই সংলাপ। নদীর ওপার থেকে লঞ্চ আসে, ডাকপিয়ন নামে, আর কর্নেল প্রশ্ন করেন, ‘আমার জন্য কিছু আছে?’

প্রতিবারই ডাকপিয়নের সেই নিস্পৃহ উত্তর: ‘কর্নেলকে কেউ লেখে না।’

বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের এই ছোট উপন্যাস ‘নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল’ শুধু কলম্বিয়ার এক গৃহযুদ্ধফেরত নিঃসঙ্গ কর্নেলের গল্প নয়, এটি আসলে অপেক্ষা, উপেক্ষা আর একটি যুগের নীরব বিদায়ের গাঁথা। এক সর্বজনীন বিষাদের প্রতিচ্ছবি, যা আমাদের আজকের দ্রুতগতির ডিজিটাল জীবনে আরও বেশিভাবে অনুভূত হয়। তবে শুধু কর্নেলকে কেউ আর লেখে না, এমন নয়; এখন আর কেউই কাউকে লেখে না। চিঠি লেখে না।

আমরা যাঁরা নব্বইয়ের দশক বা তারও কিছু আগে জন্মেছি, আমরাই সম্ভবত সেই শেষ প্রজন্ম যাঁরা চিঠির স্পর্শ পেয়েছি। একসময় ডাকপিয়ন ছিল আনন্দের বাহক। তাঁর আগমন মানেই হৃদয়ে এক অজানা শিহরণ। হলুদ খামে মোড়া, এক কোনায় আঠা লেগে থাকা একটি চিঠি যেন একটি ছোট্ট গুপ্তধন, যার ভেতরে লুকিয়ে থাকত প্রিয়জনের হৃদয়ের উত্তাপ।

চিঠি লিখতে হতো সময় নিয়ে, কলমের কালি ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য ছিল যত্নে সাজানো, যেন লেখার আগে মনের ভেতর বারবার মহড়া দেওয়া হয়েছে। একটি বানান ভুল হলে বা কাটাকুটি হলে মন খারাপ হতো। কারণ, চাইলেই তো ‘আনডু’ বা পাল্টে ফেলা যেত না।

আমরা যাঁরা নব্বইয়ের দশক বা তারও কিছু আগে জন্মেছি, আমরাই সম্ভবত সেই শেষ প্রজন্ম যাঁরা চিঠির স্পর্শ পেয়েছি। একসময় ডাকপিয়ন ছিল আনন্দের বাহক।

সেই চিঠি কয়েকদিন, এমনকি কয়েক সপ্তাহ পরে যখন প্রাপকের হাতে পৌঁছাত, তখন সেটি শুধু আর একটি কাগজের টুকরো থাকত না; হয়ে উঠত সময়, দূরত্ব আর ভালোবাসার সেতু। চিঠির ভাঁজে থাকত প্রিয়জনের হাতের গন্ধ, কখনো বা একটি শুকনো গোলাপের পাঁপড়ি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেলেও আবেগের গন্ধ হারাত না। চিঠি পড়তে পড়তে ভিজে আসত চোখ, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠত। সেই চিঠি বালিশের নিচে রেখে কত রাত কেটেছে কেঁদে কেঁদে!

চিঠি লুকিয়ে রাখা হতো ডায়েরির ভাঁজে, আলমারির গভীরে বা বিছানার পাশে রাখা ছোট কোনো বাক্সে, যেন এক পবিত্র আমানত। আজকের প্রজন্ম হয়ত বিশ্বাসই করবে না, একটা চিঠির উত্তর না এলে কেউ কেউ রাতের পর রাত ঘুমাতে পারত না। সেই অপেক্ষার ভেতরেই গড়ে উঠত সম্পর্ক, ধীরে ধীরে, গভীরভাবে।

শিশুরা এখন জানেই না, ডাকটিকিট কী, খাম কী, কিংবা ‘চিঠি’ মানে আসলে কী! এ সময়ে তাঁদের কাছে চিঠি মানেই ‘ইমেইল’, ‘ডিএম’ বা ‘ইনবক্স মেসেজ’, যেখানে ভুল বানানে চলে আবেগহীন, ঘ্রাণহীন শব্দের পাল্টাপাল্টি আসা যাওয়া। হাজারো ইন্সট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপের ভীড়ে এ প্রজন্মের সন্তানেরা হয়তো কেবল জানে, চিঠি হলো একধরনের ‘লেগ্যাসি অ্যাপ’, যা এখন আর ব্যবহৃত হয় না।

একটা সময়ে চিঠি ছিল একধরনের নীরব সংলাপ
একটা সময়ে চিঠি ছিল একধরনের নীরব সংলাপ

অথচ একটা চিঠি একসময় পুরো একটা সম্পর্কের প্রতীক ছিল। প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে, মা আর দূরে থাকা সন্তানের মধ্যে কিংবা প্রবাসে থাকা স্বামী আর অপেক্ষমাণ স্ত্রীর মধ্যে চিঠিই ছিল সেতুবন্ধন। চিঠি পড়তে গিয়ে কেউ হয়তো চুপিচুপি কেঁদেছে, কেউ আবার মুখে হাসি লুকিয়েছে।

আজ আমাদের জীবনে কর্নেলের মতো সেই অপেক্ষা আর নেই। চিঠি পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা নেই, অপেক্ষার উত্তেজনা নেই। একটি মেসেজ লিখলাম, আর নিমেষে তা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেল। হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ফেসবুক মেসেঞ্জার, অসংখ্য মাধ্যম। সবই দ্রুত, সবই ইনস্ট্যান্ট। কিন্তু এই বার্তাগুলোর কি আর সেই চিঠির মতো আবেগ আছে? এক ঝলকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া এই টেক্সট বার্তাগুলোর ভেতর কতটুকুই বা থাকে হৃদয়ের স্পন্দন?

এখানে নেই প্রিয়জনের হাতের লেখার বাঁক, নেই কলমের কালির মৃদু ছোপ, নেই ভাঁজ করা কাগজের গন্ধে মিশে থাকা সেই অদ্ভুত উষ্ণতা। কোনো এসএমএস কি আপনি বুকের ডায়েরির পাতায় রেখে দেন? কোনো হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট কি বছরের পর বছর পর আবার খুলে পড়ে চোখ ভিজে আসে? আজ আমরা সেই অনুভূতিগুলো হারিয়ে ফেলেছি।

শিশুরা এখন জানেই না, ডাকটিকিট কী, খাম কী, কিংবা ‘চিঠি’ মানে আসলে কী! এ সময়ে তাঁদের কাছে চিঠি মানেই ‘ইমেইল’, ‘ডিএম’ বা ‘ইনবক্স মেসেজ’, যেখানে ভুল বানানে চলে আবেগহীন, ঘ্রাণহীন শব্দের পাল্টাপাল্টি আসা যাওয়া।

চিঠি পড়তে গিয়ে চোখে জল আসত, এখন মেসেজ ডিলিট করলে একটুখানি আফসোসও হয় না। চিঠি সংরক্ষণ করার জন্য ছিল কাঠের ট্রাংক, কাপড়ের ব্যাগ বা বিছানার পাশে রাখা কোনো ছোট্ট বাক্স।

আজ আমরা ইমোজি সংরক্ষণ করি, স্ক্রিনশট রাখি, তবুও আমাদের কোনো স্মৃতিই আর টেকে না। আমাদের ফাস্ট ফরোয়ার্ড জীবনের গতি, পিক্সেলের আলোর ঝলকানি, বেতার আর বৈদ্যুতিক তরঙ্গের রসায়নে তৈরি হওয়া বার্তাগুলো কেমন যেন অস্থায়ী, তাৎক্ষণিক এবং তাপহীন। একটুখানি অনুভূতি, তারপর এক ক্লিকেই হারিয়ে যায় দূরের অন্ধকারে।

এখন সবার যোগাযোগ হয় বিভিন্ন ধরনের ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপে। সংগৃহীত ছবি
এখন সবার যোগাযোগ হয় বিভিন্ন ধরনের ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপে। সংগৃহীত ছবি

একটা সময়ে চিঠি ছিল একধরনের নীরব সংলাপ। একটা চিঠি লেখা মানে ছিল নিজেকে উন্মোচন করা, ধীরে ধীরে, ভয়ে ভয়ে, ভালোবাসা মিশিয়ে। এখন ভালোবাসা আসে ‘টাইপিং…’ শব্দে, এবং হারিয়ে যায় ‘লাস্ট সিন এট…’-এ। হেলাল হাফিজের মতো গভীর আবেগ নিয়ে কেউ আর লেখে না ‘এখন তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো, পত্র দিও’ বরং লিখে ‘ইউ ওকে?’ আজ আমরা কথা বলি অনেক, কিন্তু বলি কি সত্যিই কিছু?

তখনকার সময়ে চিঠি লেখা এবং পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটিও ছিল একটি অনুষ্ঠান, একটি শিল্প। পোস্ট অফিসে যাওয়া, ডাকটিকিট কেনা, খামের ওপর প্রাপকের ঠিকানা সাবধানে লেখা, প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল ভালোবাসার ছোঁয়া। আজ আমরা সবকিছু পেয়েও যেন এক অদ্ভুত শূন্যতায় ভুগছি। কর্নেলের মতো আমাদেরকে কেউ আর চিঠি লেখে না-এমন না। বরং অজস্র বার্তা আসে, কিন্তু কোনো হৃদয়স্পর্শী বার্তা যেন আর আসে না। আমরা প্রতি মুহূর্তে কানেক্টেড থেকেও আসলে এক গভীর নিঃসঙ্গতার শিকার।

আমরা যেন ভুলেই গেছি, জীবনের কিছু অনুভূতি আছে, যেগুলো কোনো ইনস্ট্যান্ট মেসেজের ঠান্ডা পর্দায় ধরা দেয় না। সেই আবেগের গভীরতা প্রকাশ পায় কেবল কাগজের নিঃশব্দ ভাঁজে, কলমের কাঁপা আঁচড়ে আর হাতের লেখার উষ্ণতায়।

কর্নেলের মতো সেই অপেক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক। হয়তো পেনশনের চিঠির জন্য অপেক্ষা নয়, সেই অপেক্ষা এক গভীর মানবিক সংযোগের জন্য অপেক্ষা। আমরা ভাবি, প্রযুক্তি আমাদের কাছে এনেছে। আসলে তা আমাদের আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমরা এখন একে অপরের অনলাইন স্ট্যাটাস দেখি, কিন্তু হৃদয়ের খবর আর জানতে পারি না।

আমাদের মানবিক সংযোগ যেন ধীরে ধীরে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমরা পাশে বসে থাকি আলো জ্বালানো মুঠোফোন হাতে, শব্দ শুনি—তবু হৃদয় একে অপরের ছোঁয়ায় পৌঁছায় না। কানেক্টেড থেকেও আমরা যেন বিচ্ছিন্ন, যেন প্রত্যেকে নিজের ভেতর এক একটি নীরব দ্বীপ।

আমরা যেন ভুলেই গেছি, জীবনের কিছু অনুভূতি আছে, যেগুলো কোনো ইনস্ট্যান্ট মেসেজের ঠান্ডা পর্দায় ধরা দেয় না। সেই আবেগের গভীরতা প্রকাশ পায় কেবল কাগজের নিঃশব্দ ভাঁজে, কলমের কাঁপা আঁচড়ে আর হাতের লেখার উষ্ণতায়। ভালোবাসার কিছু শব্দ আজও আছে, যেগুলো কেবল কলমই জানে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত