leadT1ad

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস

টোল-মক্তবের বেতের বাড়ি থেকে অনলাইন টিচিং

টোল-মক্তব থেকে হালের অনলাইন টিচিং, এই দীর্ঘ যাত্রা সমাজ রূপান্তরের ইতিহাসও বটে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক, নৈতিকতার চর্চা এবং সমাজে জ্ঞানের অবস্থানও এখানে আলোচ্য। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ফিরে তাকানো যাক ইতিহাসের দিকে। দেখা যাবে, প্রতিটি ধাপে শিক্ষক ছিলেন পরিবর্তনের কেন্দ্রে।

প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ৪২
টোল-মক্তবের বেতের বাড়ি থেকে অনলাইন টিচিং। স্ট্রিম গ্রাফিক

আমরা যদি বাংলাদেশি শিক্ষার গড়ন-প্রকৃতি দেখতে চাই, তবে সেই যাত্রাটা শুরু হবে টোল-মক্তব থেকে স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। আর শেষে গিয়ে থামবে অনলাইন টিচিং-এ। এই দীর্ঘ যাত্রা কেবল শিক্ষক, শিক্ষা বা শিখন পদ্ধতির বিবর্তন নয়, বরং সমাজ রূপান্তরের ইতিহাসও বটে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক, নৈতিকতার চর্চা এবং সমাজে জ্ঞানের অবস্থানও এখানে আলোচ্য।

সমাজ যেমন বদলেছে, শিক্ষার চরিত্রও তেমনি বদলেছে। পরিবর্তিত হয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা, শিক্ষার্থীর পরিচয়, এমনকি শেখার অর্থও। শিক্ষার এই দীর্ঘ যাত্রায় শিক্ষকই ছিলেন মূল চরিত্র। টোল-মক্তবের সেই সময়টায় শিক্ষকের হাতে থাকত বেত, শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে। বড় ভুল করলে বেতও চলত। সময়ের সঙ্গে শিক্ষকতা বদলেছে, কিন্তু শিক্ষকের আসল ভূমিকা আজও অপরিবর্তিত। তিনি জ্ঞানের বাহক, শিক্ষার্থীর নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের নির্মাতা।

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ফিরে তাকানো যাক ইতিহাসের দিকে। দেখা যাবে, প্রতিটি ধাপে শিক্ষক ছিলেন পরিবর্তনের কেন্দ্রে। টোলের গুরু, মক্তবের মাওলানা, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া স্কুলমাস্টার—মাধ্যম বদলেছে, কিন্তু শিক্ষকের দায়িত্ব আজও আলো ছড়ানো।

টোল ছিল বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। সংগৃহীত ছবি
টোল ছিল বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। সংগৃহীত ছবি

টোল

টোল ছিল বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা সংস্কৃত, ব্যাকরণ, ন্যায়–দর্শন, মীমাংসা, বেদ‑পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র পড়াতেন। তবে এই ব্যবস্থা বেশিরভাগ সময় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জন্য ছিল।

মন্দির, চণ্ডীমণ্ডপ বা গুরু মহাশয়ের কুটিরে শিক্ষার্থীরা বসে পড়াশোনা করত। পাঠ্যক্রম মূলত মৌখিক ও গুরু-শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। আবার গুরুকুল মডেলেও শিক্ষার্থীরা গুরুর আশ্রমে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করত এবং গুরুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় বড় হত। এই মডেল শিক্ষকদের ব্যক্তিগত নির্দেশনা, শিষ্যের নৈতিক‑নৈতিক গঠন, পরিশ্রম ও সেবা জাগ্রত করতে গুরুত্ব দিত।

টোলের পাঠ্যক্রম মৌখিক ও স্মৃতিনির্ভর ছিল। দীক্ষা গ্রহণের পর ছাত্ররা প্রাথমিক স্তরে ব্যাকরণ ও শব্দকোষ শেখার মাধ্যমে ভাষা ও অর্থ বোঝার ভিত্তি তৈরি করত। এরপর আইন, ন্যায়–দর্শন, কাব্যসাহিত্য, পুরাণ, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি বিষয় শেখানো হতো। এছাড়া টোলগুলোর পাঠ্যক্রমে মনে রাখার কৌশল, উচ্চারণ-নৈপুণ্য, যুক্তিবিদ্যাও শেখানো হতো।

টোলের প্রত্যেক শিক্ষার্থী গুরুর কাছ থেকে সরাসরি নির্দেশনা পেত। আজকের দিনের বড় ক্লাসরুমের মতো নয়, সেখানে এক‑একজন শিক্ষার্থীকে আলাদা সময় দেওয়া হতো। শিক্ষকেরা কর্মমুখী ও জীবন দক্ষতার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে বোঝাপড়া তৈরি করতে সাহায্য করতেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি টোল আশ্রমের কাজ, কৃষিকাজ, রান্না, প্রাত্যহিক সেবা ইত্যাদিতে অংশ নিতেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদেরকে নম্রতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, শ্রদ্ধাবোধ ও পারস্পরিক সহযোগিতা শেখানো হতো।

টোলের শিক্ষা পদ্ধতি মৌখিক হওয়ায় সেখানে প্রথাগত লিখিত পরীক্ষা ছিল না। মূল্যায়ন চলত প্রতিদিনের পাঠ, আলোচনার গভীরতা ও ছাত্রের স্মরণশক্তি দেখে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে কঠিন মৌখিক পরীক্ষা থাকত। প্রথাগত সনদ দেওয়া না হলেও টোলের ছাত্ররা শিক্ষা শেষ করলে উপাধি পেতেন। এই উপাধিগুলি ছিল সম্মানসূচক।

টোলের সামাজিক ভূমিকা ব্যাপক ছিল। গ্রামাঞ্চলে আইন‑শৃঙ্খলা, বিবাহ‑অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচারের বিচার‑বিধানে পণ্ডিতরা পরামর্শ দিতেন। ফলে টোলের পণ্ডিতরা গ্রামীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন।

টোলের সামাজিক ভূমিকা ব্যাপক ছিল। গ্রামাঞ্চলে আইন‑শৃঙ্খলা, বিবাহ‑অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচারের বিচার‑বিধানে পণ্ডিতরা পরামর্শ দিতেন। ফলে টোলের পণ্ডিতরা গ্রামীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। জমিদার ও স্থানীয় প্রশাসকরা তাঁদের ধর্মীয়‑আইনি পরামর্শের জন্য এই পণ্ডিতদের ডাকতেন; বিনিময়ে তাঁরা জমি, খাদ্য বা অর্থ দান করতেন।

তবে ব্রিটিশ শাসন ও তখন শিক্ষার প্রসারের ফলে টোলগুলোর ঐতিহ্যগত গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে আসে। নতুন দিনের শিক্ষার ধরণ বদলে দেয় শিক্ষার মানচিত্র। সেই পরিবর্তনটি বিশেষত ১৮৫৪ সালের উড’স ডিসপ্যাচের পরে ত্বরান্বিত হয়, যখন ব্রিটিশ প্রশাসন স্কুল-কলেজ ব্যবস্থাকে প্রচারে আনে।

তবে টোলের সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষ, অর্থাৎ গুরু-শিষ্য সম্পর্কের গভীরতা, শেখানোর ধরণ এবং মূল্যবোধ—এসব বৈশিষ্ট্য এখনও শিক্ষার নৈতিক স্তম্ভ হিসেবে কাজে লাগানো যায়। গুরু রাগ করলে বেতও চলত। কিন্তু সেই বেতের আঘাত শুধু শারীরিক ছিল না, ছিল এক ধরণের মানসিক অনুশাসনের প্রতীক। গুরু চাইতেন শিষ্য যেন শৃঙ্খলায় বড় হয়, যুক্তিতে পরিপক্ব হয়। আজকের দিনে সেই বেত হারিয়েছে, কিন্তু শিক্ষার নৈতিক দিকনির্দেশনা হারানো উচিত নয়।

মক্তব

বঙ্গের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মক্তব। মক্তব সাধারণত মসজিদের পাশেই বা মসজিদে পরিচালিত হতো। সেখানে মূলত আরবি হরফ শিক্ষা ও বিশুদ্ধ কুরআনের তেলাওয়াত, দোয়া-দুরুদ ইত্যাদি শেখানো হতো। মসজিদের ইমাম বা একজন মাওলানা ভোরে মক্তবে পবিত্র কুরআনের সুরা, কালেমা, দুরুদ, নামাজ ও অজুর নিয়ম শেখাতেন। কেবল ধর্মশিক্ষা নয়, শিশুদের সদাচারের মানসিকতা গড়ে তোলা হতো সেখানে। গ্রামের নানা শ্রেণির ছেলে–মেয়েরা একই মক্তবে একইসঙ্গে বসতেন; এতে সামাজিক শ্রেণি–ভেদের দেয়াল ভেঙে বন্ধুত্ব ও সমাজের সহনশীলতা তৈরি হয়েছিল। আজও দেশের নানা অঞ্চলের মসজিদগুলোতে মক্তব পরিচালিত হয়ে থাকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অনেক মসজিদে মক্তবের পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে সরকারের।

বঙ্গের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মক্তব। সংগৃহীত ছবি
বঙ্গের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মক্তব। সংগৃহীত ছবি

মক্তব মুসলিম সমাজের শুদ্ধতা ও ধর্মভীরুতার জাগরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। দৈনিক কুরআন পাঠ, সালাত, রোজা, হাদিস ও নৈতিক শিক্ষার ফলে শিশুরা ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত হতো। গ্রামবাসীরা মনে করত, মক্তবের মাধ্যমে শিশুদের চরিত্র গঠন না হলে সমাজে অনৈতিকতা ও বিশৃঙ্খলা বাড়বে।

তখন মক্তবে শিক্ষার ধারা ছিল নিয়মতান্ত্রিক। প্রথমে আরবি হরফ শিক্ষা, এরপর কায়দা, আমপারা এবং শেষে কুরআন শরিফ দেখে পড়া ও আংশিক মুখস্ত করানো হয় মক্তবে। পবিত্র কুরআন একবার পড়ে শেষ করা হলে 'খতমে কুরআন' অনুষ্ঠান করা হতো। কোথাও কোথাও পবিত্র কুরআনপাঠ শুরুর অনুষ্ঠানটিকে 'ছবক' শুরু বলে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করা হতো। এসব অনুষ্ঠানে মিষ্টান্ন, মুড়ি, খই, জিলাপি ইত্যাদি বিলিয়ে দেওয়া হতো শিশুদের মাঝে।

মক্তবে কোনো আধুনিক পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল না। মূল্যায়ন হত দৈনিক মুখস্থ ও পাঠদানের মাধ্যমে। শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীর ‘সবক’ বা পাঠ নিয়মিত শুনে মূল্যায়ন করতেন। মক্তবেও শাসন ছিল শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাওলানা বা হুজুরের হাতে থাকত বেতও। শৃঙ্খলা ছিল শেখার প্রথম ধাপ।

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ মক্তব ব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে, ১৮৩৫ সালের ম্যাকাওলে মিনিটস অনুযায়ী যখন ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষাকে ‘উন্নত সভ্যতা’র বাহক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আবার মক্তব–মাদ্রাসা মূলত ওয়াকফ সম্পত্তি ও দান–অনুদানের উপর নির্ভরশীল ছিল। ব্রিটিশ শাসকেরা এসব সম্পত্তি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ায় আর্থিক সংকটে অনেক মক্তব বন্ধ বা দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ প্রশাসন তখন মক্তবকে সম্পূর্ণরূপে বিলোপ না করে তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল।

মক্তব ব্যবস্থাটিকে এক অর্থে ভোরের পাঠশালা বলা যায়। ফজরের নামাজের পরেই মক্তবে পাঠদান শুরু হয় বলে এটিকে 'সাবাহি মক্তব'ও বলা হয়। আরবি 'সাবাহ' শব্দের অর্থই সকাল বা ভোর। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের শহর ও মফস্বলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পাঠদানের সময় সকালে এগিয়ে আসায় ভোরের পাঠশালা অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে গেছে। সকালে স্কুল থাকায় শহরের অনেক মসজিদে এখন বিকেলে বা আসরের নামাজের পরে মক্তবের কার্যক্রম চালু রয়েছে।

তখন মক্তবে শিক্ষার ধারা ছিল নিয়মতান্ত্রিক। প্রথমে আরবি হরফ শিক্ষা, এরপর কায়দা, আমপারা এবং শেষে কুরআন শরিফ দেখে পড়া ও আংশিক মুখস্ত করানো হয় মক্তবে। পবিত্র কুরআন একবার পড়ে শেষ করা হলে ‌‘খতমে কুরআন’ অনুষ্ঠান করা হতো।

ব্রিটিশ প্রশাসন, স্কুল ব্যবস্থা ও ধারাবাহিক রূপান্তর

ব্রিটিশদের আগমনের আগে বাংলার শিক্ষা ছিল মূলত স্থানীয়, ধর্মীয় ও মৌখিক পরম্পরাভিত্তিক। শিক্ষক ছিলেন সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। ব্রিটিশ শাসনের হাত ধরে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা বদলে যায়। তখন শিক্ষাকে দেখা হয় শুধু জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং প্রশাসনিক দক্ষতা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক ইংরেজদের মাধ্যমে বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়। ইংরেজরা বুঝেছিল, ভারত বহু ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ। তাই শুরুতেই ইংরেজি চাপিয়ে না দিয়ে প্রচলিত ফারসি ভাষাকেই রাখা হয়। কিন্তু প্রশাসনিক কাজ চালাতে ইংরেজি ও ফারসি জানা দেশীয় লোকের দরকার ছিল, তাই ‘মুন্সি’ বা দেশীয় কেরানি শ্রেণির উত্থান ঘটে।

উনিশ শতকে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন বেশ কয়েকজন সংস্কারক। তাঁদের উদ্যোগে সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। ১৮৩৫ সালে ম্যাকলের ‘ইংলিশ এডুকেশন অ্যাক্ট’ জারি করা হয়, যেখানে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তিনি বলেছিলেন, ভারতীয়দের মধ্যে এমন এক শ্রেণি তৈরি করতে হবে, যারা রক্তে ভারতীয়, কিন্তু চিন্তায় ইংরেজ।

এরপর আসে ১৮৫৪ সালের ‘উড’স ডিসপ্যাচ’। এতে বলা হয়, শিক্ষা হবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আর তার উদ্দেশ্য হবে নৈতিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিক যোগ্যতা অর্জন। এই নীতির আওতায় ব্রিটিশ সরকার প্রাদেশিক শিক্ষা দপ্তর স্থাপন করে, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয় এবং সরকারি ও বে-সরকারি উদ্যোগে স্কুল-কলেজ স্থাপনকে উৎসাহ দেয়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ১৮৫৪ সালের উড’স ডিসপ্যাচেই প্রথমবার রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়।

এরপর স্থানীয় উদ্যোগে ও সরকারি সহায়তায় বাংলার গড়ে ওঠে হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে এগুলোর অবস্থা ছিল খুব সাধারণ। মাটির ঘর, বেঞ্চ আর কয়েকজন মাত্র শিক্ষক। পাঠ্যপদ্ধতি ছিল মূলত মুখস্থভিত্তিক। আর সেই শিক্ষকই ছিলেন শৃঙ্খলা ও পাঠের সর্বেসর্বা। ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। কমিশনের সুপারিশে স্থানীয় বোর্ডের অধীনে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন শুরু হয়।

অনলাইন টিচিং এখন ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ বা মিশ্র শিক্ষার অংশ হয়ে গেছে। সংগৃহীত ছবি
অনলাইন টিচিং এখন ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ বা মিশ্র শিক্ষার অংশ হয়ে গেছে। সংগৃহীত ছবি

এই সময় থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা কিছুটা সংগঠিত রূপ পেতে শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মূলত জেলা ও মহকুমা শহরগুলোতে। এই স্কুলগুলো থেকে পাশ করলে ছাত্ররা কলেজে ভর্তি হতে পারত। পাশাপাশি ছিল মাদ্রাসা শিক্ষাও।

এই সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলায় জন্ম নেয় এক নতুন শিক্ষিত শ্রেণি। ব্রিটিশরা বাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিল বটে, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশ শাসনকে শক্তিশালী করা। তারা এমন এক মধ্যবর্তী শ্রেণি তৈরি করতে চেয়েছিল, যারা ইংরেজদের অনুগত ও প্রশাসনিকভাবে উপযোগী।

পাকিস্তান আমলেও শিক্ষা কাঠামোতে সেই ঔপনিবেশিক ছাপ দেখা যায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ উন্নয়ন ও পাঠ্যসূচি সংস্কার করে শিক্ষাকে গণমুখী করার উদ্যোগ নেয়।

ডিজিটাল যুগ ও অনলাইন টিচিং

একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রযুক্তি, ইন্টারনেট ও ভার্চুয়াল সংযোগ মিলে শিক্ষাকে নিয়ে গেছে সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তবতায়। বলা যায়, টোল ও মক্তবের মৌখিক পাঠ থেকে শুরু হওয়া যাত্রা আজ এসে দাঁড়িয়েছে স্ক্রিনের সামনে, ডিজিটাল ক্লাসরুমে।

২০১০ সালের দিকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের ব্যবহার শুরু হয়। ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চালু হয় ‘মুক্তপাঠ’ ও ডিজিটাল প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম। এই সময় থেকেই শিক্ষকরা ধীরে ধীরে প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানে অভ্যস্ত হতে থাকেন।

কিন্তু এই পরিবর্তনের প্রকৃত মোড় ঘুরে যায় ২০২০ সালে। হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কোভিড-১৯ মহামারি। মার্চ মাসে সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থী একযোগে শ্রেণিকক্ষের বাইরে চলে যায়। শিক্ষা যেন থেমে না যায়, সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় এক বিশাল অনলাইন অভিযাত্রা।

প্রথমদিকে শিক্ষকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব ও জুম ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুগল ক্লাসরুম, মাইক্রোসফট টিমস ও জুম অ্যাপের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরে সরকার ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামে টেলিভিশনভিত্তিক ক্লাস চালু করে, যা বিটিভি ও সংসদ টিভিতে প্রচারিত হতো। এই উদ্যোগ গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কাছে অনলাইন শিক্ষার প্রথম বাস্তব অভিজ্ঞতা এনে দেয়।

তবে অনলাইন টিচিং শুধু পাঠদানের মাধ্যম বদলায়নি, বদলে দিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের প্রকৃতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষার ধারণাকেও। পাশাপাশি দেখা দেয় নানা চ্যালেঞ্জও।

তবে অনলাইন টিচিং শুধু পাঠদানের মাধ্যম বদলায়নি, বদলে দিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের প্রকৃতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষার ধারণাকেও। পাশাপাশি দেখা দেয় নানা চ্যালেঞ্জও। দেশের অনেক অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল, স্মার্টফোন বা কম্পিউটার নেই। অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে না পারা লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে পাঠ থেকে তখন বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ে। তবে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বিকল্প উদ্যোগ নেয়।

মহামারির পর যখন প্রতিষ্ঠানগুলো আবার খুলে যায়, তখনও অনলাইন টিচিং পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বরং এখন এটি ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ বা মিশ্র শিক্ষার অংশ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন অ্যাসাইনমেন্ট, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে। মাধ্যমিক স্তরে অনলাইন কনটেন্ট এখন রুটিনের অংশ।

এর বাইরে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লব ঘটেছে ই-লার্নিং ও অনলাইন কোর্স প্ল্যাটফর্মগুলো ঘিরে। এখন দেশে অসংখ্য শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষক নিজেদের কোর্স তৈরি করে বিক্রি করছেন অনলাইনেই। প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে ‘টেন মিনিট স্কুল’, ‘শিখো’ ইত্যাদি। এখানে পাওয়া যায় স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সহায়তা থেকে শুরু করে ভাষা শিক্ষা, প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক ডিজাইন, বিজনেস অ্যানালাইসিস কিংবা চাকরির প্রস্তুতিমূলক কোর্স। আবার ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে অনলাইনেও পড়াচ্ছেন। আবার অনেক লেকচার ভিডিও করে আপলোড করছেন ইউটিউবে।

পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ইউটিউবের ভিডিও লেকচার, অনলাইন কোর্স, ডিজিটাল কনটেন্ট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবকিছু মিলে তৈরি করেছে এক বহুমাত্রিক শিক্ষার কাঠামো। অনেকের কাছে অনলাইনে কোর্স করানো তরুণ শিক্ষক এখন একজন ‘ফ্যাসিলিটেটর’, যিনি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীকে নিজের মতো করে শেখার পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করেন।

এক সময়ের টোল বা মক্তবে শিক্ষক ও ছাত্র মুখোমুখি বসে পাঠ করতেন, আজ তাঁরা একই জায়গায় না থেকেও একই জ্ঞানের ভুবনে যুক্ত। শিক্ষার এই দীর্ঘ যাত্রা প্রমাণ করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার শেখার রূপ বদলায়। কিন্তু টোল-মক্তবের যে নৈতিক আলোচনার স্থান, ব্যক্তিগত পথপ্রদর্শনের ঐতিহ্য আর কমিউনিটির জড়িত শিক্ষাকর্ম, সেগুলো অনলাইন ক্লাসে বা এখনকার দিনের শিক্ষকদের অনেকের কাছ থেকে পাওয়া দুষ্কর।

কিন্তু বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের স্মরণ করতে হবে, শিক্ষকের মূল কাজ কেবল পড়ানো নয়, বরং শিক্ষার্থীর মানসিক ও আদর্শগত দিক নির্দেশনা, শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করা এবং সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে শিক্ষাকে সংযুক্ত রাখা। এতে শিক্ষার ভবিষ্যৎই প্রকৃতপক্ষে সমৃদ্ধ হবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত