আজ সাহিত্যিক আহমদ ছফার জন্মদিন। বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের ওপরে তাঁর রয়েছে গভীর প্রভাব। বিগত দেড়-দুই দশকে এদেশের তরুণেরা বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রকে বুঝতে চেয়েছেন রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। তাঁদের বড় একটি অংশ মুখর হয়েছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ভারতমুখিনতার সমালোচনায়। তরুণদের কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি উৎস ছিল আহমদ ছফার লেখা। কিন্তু কেন?
সুমন সাজ্জাদ
আহমদ ছফা কি খুব বেশি জনপ্রিয় ছিলেন? বোধ হয় না। তাঁর বন্ধুস্থানীয় লেখকদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ যে অর্থে পরিচিতি কিংবা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, সে অর্থে ছফা কোনোদিনই জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু অবাক করা সত্য এই যে সমকালীন তরুণদের কাছে ছফা অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমি এমন পাঠকও দেখেছি, যিনি সাহিত্য, গদ্যপদ্য, লেখালেখি দুচোখে দেখতে পারেন না, পড়েন না, কিন্তু আহমদ ছফাকে পড়েছেন। বুকশেলফে বই বলতে রেখে দিয়েছেন ছফার কয়েক খণ্ডের রচনাবলি।
বিগত দেড় দশকের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছফার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে বলেই মনে হয়। তাঁর লেখালেখির বহুমাত্রিক বিস্তার দেখে এই অনুমান আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। তরুণদের হাতে হাতে ঘুরে ফিরেছে ছফার লেখা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। ‘গাভীবিত্তান্ত’ কিংবা ‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’ পড়ে মুগ্ধ হতে দেখেছি তরুণতর পাঠককে। ছফার এলোমেলো বোহেমিয়ান জীবনও কাউকে কাউকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়েছে। হয়তো আহমদ ছফার মধ্যে এক ‘দিওনুসিয়ান’ আনন্দ খুঁজে পাওয়া গেছে। খ্যাপাটে আর স্বাপ্নিকেরা খুঁজে পেতে শেষ পর্যন্ত ছফাকেই বেছে নিয়েছেন।
আহমদ ছফার সমকালে বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী পাঠকের ভেতর প্রবল প্রতাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। দুজনেরই অবলম্বন ‘চিন্তা’—নতুন কথা। ছফা কথা বলেন বিশ্লেষণের ভাষায়, আজাদ স্থির থাকেন বদ্ধমূল মন্তব্যে। একজন ঘোরতরভাবে রাজনীতিপ্রবণ, অন্যজন চলে যান বিরাজনীতিকরণের দিকে। দুজনই কথা বলেন জোরালো ভাষায়; ঘটনাচক্রে একজন আরেকজনকে তুমুল আক্রমণও করে বসেন। গেল শতকের নব্বই দশকের তরুণ পাঠকেরা ছফা ও আজাদের বাকযুদ্ধের সাক্ষী হয়েছেন। দুজনই আজ প্রয়াত। হুমায়ুন আজাদের চিন্তার দ্যুতিতে আনেকেই আজ আর গভীরভাবে আচ্ছন্ন নন। কিন্তু তরুণদের অনেকেই ছফার কাছে বৌদ্ধিকভাবে সমর্পিত। কিন্তু কেন? এর জবাব নিহিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে।
এই ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার শক্তিবলয়কে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেছে। একাত্তরের আগে যে জাতীয়তাবাদ ছিল প্রাণের সম্পদ, সেই জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার। ইতিহাসের মর্মান্তিক ফয়সালা এই যে আজ সেই জাতীয়তাবাদকে ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তরুণ বুদ্ধিজীবীরাই মূলত এই অভিধা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আমরা এ–ও দেখেছি, রাষ্ট্রিক আদর্শ আকারে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আবশ্যিক উপাদান করে তোলা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সমালোচনার মুখে পড়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ‘বাংলাদেশি বাঙালি’র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভিন্নতাকে ঐতিহাসিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি এদেশের বাঙালিবাদীরা। বর্ণবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি ছাড়া অন্য জাতির কোনো অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। অর্থাৎ উপেক্ষিত হয়েছিল বাংলাদেশের জাতিক ও সাংস্কৃতিক বহুস্বর।
অভিযোগ উঠেছিল, জাতীয়তাবাদের উপাদান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে পূর্ব বাংলার ইসলাম ও মুসলমানের ঐতিহ্য। রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাঙালিত্ব ও জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে। শাসকগোষ্ঠী এ ধরনের বিতর্ককে আমলে নেয়নি। আর তাই অমীমাংসিত থেকে গেছে বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যবিন্দুর আদর্শ ও তার তত্ত্বরূপ। গত দেড় দশকে এ ধরনের বিতর্ক আরও বেড়েছে। এই প্রশ্ন নতুন করে উত্থাপিত হয়েছে যে বাঙালির জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মুসলমানের সাংস্কৃতিক রাজনীতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব পায়নি। জাতীয়তাবাদ–বিষয়ক সন্দেহ সত্ত্বেও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্র মোটামুটিভাবে টিকে গিয়েছিল। কারণ স্বাধীন ও নতুন রাষ্ট্রের আবেগ তখনও ছিল জোরদার। কিন্তু খুব বেশি সে দিন আবেগ কেন্দ্রীভূত থাকেনি। তার প্রমাণ দেখা গিয়েছে আশি-নব্বইয়ের দশকের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আহমদ ছফা ইতিহাস ও রাজনীতির চোরাফাঁদগুলো শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের ‘হয়ে ওঠা’র বৃত্তান্তকে তিনি দেখেছিলেন ইতিহাস ও রাজনীতির আলোয়। তিনি পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটিকে বিশেষভাবে আমলে নিয়েছেন। তাই উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে বুঝতে চেয়েছেন, ‘রেনেসাঁ’র তৎপরতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রদায়-নিরপেক্ষতার সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকে মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করতে চেয়েছেন। `বাঙালি’ নামক যে জনগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় `বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, আহমদ ছফা তার ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। ছফা তাঁর ভাবনার ভূগোলে স্থান দিয়েছেন বাংলাদেশের ভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীকে।
বিগত দেড়-দুই দশকে বাংলাদেশের তরুণেরাও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে বুঝতে চেয়েছেন রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। এইখানেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ছফার সঙ্গে তরুণদের সংযোগের সেতু। কারণ এ কালের অনেক তরুণের মতো ছফাও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দাঁড় করিয়েছিলেন কাঠগড়ায়। জাতীয়তাবাদের প্রতীকসমূহের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন সমালোচনামূলক ভাষ্য। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, মতাদর্শ—সব কিছুকেই তিনি পাঠযোগ্য করে তুলেছেন। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের একক দাবিদার হিসেবে কোনো দলকে বিজয়মুকুট পরাতে তিনি রাজি হননি। বাংলাদেশের একক মালিকানার স্বত্বপত্র কোনো দলের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারেও ছিল তাঁর ঘোরতর আপত্তি।
এই প্রেক্ষাপটেই আহমদ ছফা বাংলাদেশের ভারতমুখিনতার সমালোচনা করেছেন; যদিও তিনি কখনোই ভারতবিদ্বেষী ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশপন্থী। ছফা এমন কথাও লিখেছেন, ‘অন্ধ ভারতবিদ্বেষকে কিছুতেই একটা সুস্থ রাজনীতি বলা যায় না।’ সত্তরের দশকে এই বলে সতর্ক করেছেন, ‘একদল ভারতের উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় চড়তে চাইছেন, আরেক দল ভারতবিরোধিতা করে ক্ষমতা হস্তগত করতে চাইছেন।’ অন্যেরা যখন ভক্তিগদগদ চিত্তে ভারততর্পণে ব্যস্ত, ছফা তখন ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ বইয়ে নকশা কেটে তুলে ধরেছেন ভারত-বাংলাদেশে সম্পর্কের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সংযুক্তি প্রসঙ্গে ছফা বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। তার একটি হলো, “যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা”র পরিণতিস্বরূপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা করতে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হল।’ মূল কথা হিসেবে ছফা জানাচ্ছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসই করতে পারেননি যে তাঁরা সত্যি সত্যি পাকিস্তানি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন।’ ছফার বক্তব্য এটাই নির্দেশ করে যে বাংলাদেশের নেতৃত্ব তখনও যুদ্ধের জন্য কোনো পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সম্পৃক্ততা নিয়তির মতো হাজির হয়েছিল। কিন্তু ভারত কি কেবলই ‘ত্রাতা’র মাহাত্ম্য নিয়ে দেখা দিয়েছিল? নিশ্চয়ই তা নয়। ছফা লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে পাকিস্তানের অবস্থিতিই ভারতের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’ আঞ্চলিক রাজনীতির এই ভাষ্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটি অংশ মুখর হয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ভারতমুখিনতার সমালোচনায়। তরুণদের কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি উৎস ছিল ছফার লেখা। তরুণেরা ভারতকে চিহ্নিত করেছে ক্ষমতাবান প্রতিবেশীর দম্ভ ও আধিপত্য হিসেবে। জাতীয়তাবাদী সরকারকে তাই মনে হয়েছে ভারতের তল্পিবাহক। ছফার উচ্চারণ এবং তরুণদের বাসনা হুবহু এক, তা বলা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতিকে ‘বাংলাদেশমুখী’ করে তোলার ভাবটি ছফা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।
বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক পাঠ প্রস্তুতের ক্ষেত্রেও ছফা হয়ে উঠেছেন গভীর প্রণোদনা। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুসলমানের অংশীদারত্বকে খুব বেশি পরোয়া করেনি। ছফা আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন মুসলমানের ‘স্পিরিট’। আর সেই স্পিরিটের হদিস নিতে গিয়ে তাঁকে বারবার হাতড়ে ফিরতে হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীম উদ্দীন, সুলতানের সৃষ্টিবিশ্বে। ছফার কাছে তরুণেরা পেয়ে গেছেন ইতিহাসের মর্মমূলে প্রবেশের চাবিকাঠি; ওই চাবি দিয়ে প্রবেশ করা যায় অমীমাংসিত ঘোরালো ধাঁধায়, প্রশ্ন তোলা যায় ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিরুদ্ধে। মুসলমানের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতাকে বাদ দিয়ে ‘বাঙালি’ গঠিত নয়—এই সত্যের সীমানায় পাঠককে দাঁড় করাতে পেরেছেন আহমদ ছফা।
ছফার এই চিন্তার বিষয় ও পদ্ধতি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছে; কারণ চিন্তার এই খাতগুলো উপেক্ষা করে গেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ। তাঁদের বেশির ভাগই ‘বাঙালি’ জাতিকে ‘সেক্যুলার’ হিসেবে তৈরি করতে গিয়ে মুসলমান ও ইসলামবাহিত উপাদানসমূহকে উপেক্ষা করেছেন অথবা ওই উপাদানগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। ছফার যাত্রা ঠিক এর বিপরীতে। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ যদি উপেক্ষিত হয় তাহলে সেই দৃষ্টিভঙ্গি, ভাব অথবা মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন জাগবে, এটিই স্বাভাবিক। আর তাই ‘ইসলামপসন্দ’ তরুণ পাঠকদের কাছে ছফার গ্রহণযোগ্যতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যায়।
এর ধারাবাহিকতায় ছফা যখন মাদ্রাসাশিক্ষা নিয়ে গদ্য লেখেন, তখন দুটি ঘটনা ঘটে। এক. সেক্যুলারদের কাছে তিনি ইসলামপন্থী হিসেবে বিবেচিত হন। দুই. মাদ্রাসাসংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁকে সহমর্মী হিসেবে গ্রহণ করেন। বিদ্যমান বাস্তবতায় মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরা তাঁর বই পড়তে চাইবেন, বুঝতে চাইবেন—তাতে বিস্ময়াবিষ্ট হওয়ার কিছু নেই। বিগত কয়েক দশকে ‘মাদ্রাসা’কে ফেলা হয়েছে বাইনারি দশায়; এই ধরনের প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রই ‘জঙ্গি’, ‘অনাধুনিক’, ‘অনগ্রসর’। কিন্তু এ কালের তরুণেরা এই সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া নব্বই-উত্তর তরুণেরা পেয়ে গেছে উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা, নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচিন্তার ধারণা; এসব তত্ত্বদৃষ্টিতে বাইনারির কোনো সুযোগ নেই। বরং বাইনারি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করা হয়।
চিন্তার এই সব পদ্ধতি তরুণদের প্রভাবিত করেছে। তরুণেরা দেখতে থাকেন নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন; বাংলাদেশকে তাঁরা ‘বিনির্মিত’ করতে চান। যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন আহমদ ছফা। তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ বিকল্প রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ও প্রস্তাবকে কুসুমিত করে তোলে। প্রশ্ন জাগে, সমকালীন তরুণরা কি ওইসব চিন্তার পরাগায়ণেই উল্লসিত হয়েছিলেন?
শেষ পর্যন্ত আহমদ ছফা হয়ে ওঠেন চিন্তার এক গভীর আকর; তাঁর বইয়ে ডুব দিয়ে বাংলাদেশের প্রবহমানতাকে বোঝা যায়, ইতিহাস ও রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ডিসকোর্সের বাইরে থাকা ভিন্ন কোনো অবস্থানের সংকেত অনুধাবন করা যায়। তাঁর চিন্তার চিরচেনা ‘গোয়ার্তুমি’ দমকা হাওয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসে। তাতে করে প্রতিষ্ঠিত মতগুলো খানিকটা টাল খেয়ে পড়ে। আর এই পতনদশা কাকে না মুগ্ধ করে! জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের তত্ত্বভূমি নির্মাণে হয়তো অনেক প্রতিভার নাম আমরা খুঁজে পাব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে আহমদ ছফা কাজ করেছেন অন্তঃস্রোতের মতো। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের এক হৃদয়গ্রাহী বুদ্ধিজীবী—বাংলাদেশের জনহৃদয়কে যিনি সত্যিকারভাবেই ধারণ করতে পেরেছিলেন।
আহমদ ছফা কি খুব বেশি জনপ্রিয় ছিলেন? বোধ হয় না। তাঁর বন্ধুস্থানীয় লেখকদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ যে অর্থে পরিচিতি কিংবা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, সে অর্থে ছফা কোনোদিনই জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু অবাক করা সত্য এই যে সমকালীন তরুণদের কাছে ছফা অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমি এমন পাঠকও দেখেছি, যিনি সাহিত্য, গদ্যপদ্য, লেখালেখি দুচোখে দেখতে পারেন না, পড়েন না, কিন্তু আহমদ ছফাকে পড়েছেন। বুকশেলফে বই বলতে রেখে দিয়েছেন ছফার কয়েক খণ্ডের রচনাবলি।
বিগত দেড় দশকের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছফার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে বলেই মনে হয়। তাঁর লেখালেখির বহুমাত্রিক বিস্তার দেখে এই অনুমান আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। তরুণদের হাতে হাতে ঘুরে ফিরেছে ছফার লেখা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। ‘গাভীবিত্তান্ত’ কিংবা ‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’ পড়ে মুগ্ধ হতে দেখেছি তরুণতর পাঠককে। ছফার এলোমেলো বোহেমিয়ান জীবনও কাউকে কাউকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়েছে। হয়তো আহমদ ছফার মধ্যে এক ‘দিওনুসিয়ান’ আনন্দ খুঁজে পাওয়া গেছে। খ্যাপাটে আর স্বাপ্নিকেরা খুঁজে পেতে শেষ পর্যন্ত ছফাকেই বেছে নিয়েছেন।
আহমদ ছফার সমকালে বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী পাঠকের ভেতর প্রবল প্রতাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। দুজনেরই অবলম্বন ‘চিন্তা’—নতুন কথা। ছফা কথা বলেন বিশ্লেষণের ভাষায়, আজাদ স্থির থাকেন বদ্ধমূল মন্তব্যে। একজন ঘোরতরভাবে রাজনীতিপ্রবণ, অন্যজন চলে যান বিরাজনীতিকরণের দিকে। দুজনই কথা বলেন জোরালো ভাষায়; ঘটনাচক্রে একজন আরেকজনকে তুমুল আক্রমণও করে বসেন। গেল শতকের নব্বই দশকের তরুণ পাঠকেরা ছফা ও আজাদের বাকযুদ্ধের সাক্ষী হয়েছেন। দুজনই আজ প্রয়াত। হুমায়ুন আজাদের চিন্তার দ্যুতিতে আনেকেই আজ আর গভীরভাবে আচ্ছন্ন নন। কিন্তু তরুণদের অনেকেই ছফার কাছে বৌদ্ধিকভাবে সমর্পিত। কিন্তু কেন? এর জবাব নিহিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে।
এই ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার শক্তিবলয়কে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেছে। একাত্তরের আগে যে জাতীয়তাবাদ ছিল প্রাণের সম্পদ, সেই জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার। ইতিহাসের মর্মান্তিক ফয়সালা এই যে আজ সেই জাতীয়তাবাদকে ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তরুণ বুদ্ধিজীবীরাই মূলত এই অভিধা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আমরা এ–ও দেখেছি, রাষ্ট্রিক আদর্শ আকারে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আবশ্যিক উপাদান করে তোলা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সমালোচনার মুখে পড়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ‘বাংলাদেশি বাঙালি’র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভিন্নতাকে ঐতিহাসিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি এদেশের বাঙালিবাদীরা। বর্ণবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি ছাড়া অন্য জাতির কোনো অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। অর্থাৎ উপেক্ষিত হয়েছিল বাংলাদেশের জাতিক ও সাংস্কৃতিক বহুস্বর।
অভিযোগ উঠেছিল, জাতীয়তাবাদের উপাদান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে পূর্ব বাংলার ইসলাম ও মুসলমানের ঐতিহ্য। রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাঙালিত্ব ও জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে। শাসকগোষ্ঠী এ ধরনের বিতর্ককে আমলে নেয়নি। আর তাই অমীমাংসিত থেকে গেছে বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যবিন্দুর আদর্শ ও তার তত্ত্বরূপ। গত দেড় দশকে এ ধরনের বিতর্ক আরও বেড়েছে। এই প্রশ্ন নতুন করে উত্থাপিত হয়েছে যে বাঙালির জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মুসলমানের সাংস্কৃতিক রাজনীতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব পায়নি। জাতীয়তাবাদ–বিষয়ক সন্দেহ সত্ত্বেও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্র মোটামুটিভাবে টিকে গিয়েছিল। কারণ স্বাধীন ও নতুন রাষ্ট্রের আবেগ তখনও ছিল জোরদার। কিন্তু খুব বেশি সে দিন আবেগ কেন্দ্রীভূত থাকেনি। তার প্রমাণ দেখা গিয়েছে আশি-নব্বইয়ের দশকের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আহমদ ছফা ইতিহাস ও রাজনীতির চোরাফাঁদগুলো শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের ‘হয়ে ওঠা’র বৃত্তান্তকে তিনি দেখেছিলেন ইতিহাস ও রাজনীতির আলোয়। তিনি পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটিকে বিশেষভাবে আমলে নিয়েছেন। তাই উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে বুঝতে চেয়েছেন, ‘রেনেসাঁ’র তৎপরতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রদায়-নিরপেক্ষতার সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকে মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করতে চেয়েছেন। `বাঙালি’ নামক যে জনগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় `বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, আহমদ ছফা তার ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। ছফা তাঁর ভাবনার ভূগোলে স্থান দিয়েছেন বাংলাদেশের ভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীকে।
বিগত দেড়-দুই দশকে বাংলাদেশের তরুণেরাও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে বুঝতে চেয়েছেন রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। এইখানেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ছফার সঙ্গে তরুণদের সংযোগের সেতু। কারণ এ কালের অনেক তরুণের মতো ছফাও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দাঁড় করিয়েছিলেন কাঠগড়ায়। জাতীয়তাবাদের প্রতীকসমূহের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন সমালোচনামূলক ভাষ্য। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, মতাদর্শ—সব কিছুকেই তিনি পাঠযোগ্য করে তুলেছেন। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের একক দাবিদার হিসেবে কোনো দলকে বিজয়মুকুট পরাতে তিনি রাজি হননি। বাংলাদেশের একক মালিকানার স্বত্বপত্র কোনো দলের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারেও ছিল তাঁর ঘোরতর আপত্তি।
এই প্রেক্ষাপটেই আহমদ ছফা বাংলাদেশের ভারতমুখিনতার সমালোচনা করেছেন; যদিও তিনি কখনোই ভারতবিদ্বেষী ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশপন্থী। ছফা এমন কথাও লিখেছেন, ‘অন্ধ ভারতবিদ্বেষকে কিছুতেই একটা সুস্থ রাজনীতি বলা যায় না।’ সত্তরের দশকে এই বলে সতর্ক করেছেন, ‘একদল ভারতের উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় চড়তে চাইছেন, আরেক দল ভারতবিরোধিতা করে ক্ষমতা হস্তগত করতে চাইছেন।’ অন্যেরা যখন ভক্তিগদগদ চিত্তে ভারততর্পণে ব্যস্ত, ছফা তখন ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ বইয়ে নকশা কেটে তুলে ধরেছেন ভারত-বাংলাদেশে সম্পর্কের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সংযুক্তি প্রসঙ্গে ছফা বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। তার একটি হলো, “যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা”র পরিণতিস্বরূপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা করতে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হল।’ মূল কথা হিসেবে ছফা জানাচ্ছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসই করতে পারেননি যে তাঁরা সত্যি সত্যি পাকিস্তানি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন।’ ছফার বক্তব্য এটাই নির্দেশ করে যে বাংলাদেশের নেতৃত্ব তখনও যুদ্ধের জন্য কোনো পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সম্পৃক্ততা নিয়তির মতো হাজির হয়েছিল। কিন্তু ভারত কি কেবলই ‘ত্রাতা’র মাহাত্ম্য নিয়ে দেখা দিয়েছিল? নিশ্চয়ই তা নয়। ছফা লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে পাকিস্তানের অবস্থিতিই ভারতের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’ আঞ্চলিক রাজনীতির এই ভাষ্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটি অংশ মুখর হয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ভারতমুখিনতার সমালোচনায়। তরুণদের কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি উৎস ছিল ছফার লেখা। তরুণেরা ভারতকে চিহ্নিত করেছে ক্ষমতাবান প্রতিবেশীর দম্ভ ও আধিপত্য হিসেবে। জাতীয়তাবাদী সরকারকে তাই মনে হয়েছে ভারতের তল্পিবাহক। ছফার উচ্চারণ এবং তরুণদের বাসনা হুবহু এক, তা বলা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতিকে ‘বাংলাদেশমুখী’ করে তোলার ভাবটি ছফা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।
বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক পাঠ প্রস্তুতের ক্ষেত্রেও ছফা হয়ে উঠেছেন গভীর প্রণোদনা। বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুসলমানের অংশীদারত্বকে খুব বেশি পরোয়া করেনি। ছফা আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন মুসলমানের ‘স্পিরিট’। আর সেই স্পিরিটের হদিস নিতে গিয়ে তাঁকে বারবার হাতড়ে ফিরতে হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীম উদ্দীন, সুলতানের সৃষ্টিবিশ্বে। ছফার কাছে তরুণেরা পেয়ে গেছেন ইতিহাসের মর্মমূলে প্রবেশের চাবিকাঠি; ওই চাবি দিয়ে প্রবেশ করা যায় অমীমাংসিত ঘোরালো ধাঁধায়, প্রশ্ন তোলা যায় ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিরুদ্ধে। মুসলমানের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতাকে বাদ দিয়ে ‘বাঙালি’ গঠিত নয়—এই সত্যের সীমানায় পাঠককে দাঁড় করাতে পেরেছেন আহমদ ছফা।
ছফার এই চিন্তার বিষয় ও পদ্ধতি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছে; কারণ চিন্তার এই খাতগুলো উপেক্ষা করে গেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ। তাঁদের বেশির ভাগই ‘বাঙালি’ জাতিকে ‘সেক্যুলার’ হিসেবে তৈরি করতে গিয়ে মুসলমান ও ইসলামবাহিত উপাদানসমূহকে উপেক্ষা করেছেন অথবা ওই উপাদানগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। ছফার যাত্রা ঠিক এর বিপরীতে। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ যদি উপেক্ষিত হয় তাহলে সেই দৃষ্টিভঙ্গি, ভাব অথবা মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন জাগবে, এটিই স্বাভাবিক। আর তাই ‘ইসলামপসন্দ’ তরুণ পাঠকদের কাছে ছফার গ্রহণযোগ্যতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যায়।
এর ধারাবাহিকতায় ছফা যখন মাদ্রাসাশিক্ষা নিয়ে গদ্য লেখেন, তখন দুটি ঘটনা ঘটে। এক. সেক্যুলারদের কাছে তিনি ইসলামপন্থী হিসেবে বিবেচিত হন। দুই. মাদ্রাসাসংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁকে সহমর্মী হিসেবে গ্রহণ করেন। বিদ্যমান বাস্তবতায় মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরা তাঁর বই পড়তে চাইবেন, বুঝতে চাইবেন—তাতে বিস্ময়াবিষ্ট হওয়ার কিছু নেই। বিগত কয়েক দশকে ‘মাদ্রাসা’কে ফেলা হয়েছে বাইনারি দশায়; এই ধরনের প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রই ‘জঙ্গি’, ‘অনাধুনিক’, ‘অনগ্রসর’। কিন্তু এ কালের তরুণেরা এই সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া নব্বই-উত্তর তরুণেরা পেয়ে গেছে উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা, নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচিন্তার ধারণা; এসব তত্ত্বদৃষ্টিতে বাইনারির কোনো সুযোগ নেই। বরং বাইনারি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করা হয়।
চিন্তার এই সব পদ্ধতি তরুণদের প্রভাবিত করেছে। তরুণেরা দেখতে থাকেন নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন; বাংলাদেশকে তাঁরা ‘বিনির্মিত’ করতে চান। যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন আহমদ ছফা। তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ বিকল্প রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ও প্রস্তাবকে কুসুমিত করে তোলে। প্রশ্ন জাগে, সমকালীন তরুণরা কি ওইসব চিন্তার পরাগায়ণেই উল্লসিত হয়েছিলেন?
শেষ পর্যন্ত আহমদ ছফা হয়ে ওঠেন চিন্তার এক গভীর আকর; তাঁর বইয়ে ডুব দিয়ে বাংলাদেশের প্রবহমানতাকে বোঝা যায়, ইতিহাস ও রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ডিসকোর্সের বাইরে থাকা ভিন্ন কোনো অবস্থানের সংকেত অনুধাবন করা যায়। তাঁর চিন্তার চিরচেনা ‘গোয়ার্তুমি’ দমকা হাওয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসে। তাতে করে প্রতিষ্ঠিত মতগুলো খানিকটা টাল খেয়ে পড়ে। আর এই পতনদশা কাকে না মুগ্ধ করে! জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের তত্ত্বভূমি নির্মাণে হয়তো অনেক প্রতিভার নাম আমরা খুঁজে পাব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে আহমদ ছফা কাজ করেছেন অন্তঃস্রোতের মতো। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের এক হৃদয়গ্রাহী বুদ্ধিজীবী—বাংলাদেশের জনহৃদয়কে যিনি সত্যিকারভাবেই ধারণ করতে পেরেছিলেন।
সবকিছুরই একটা পটভূমি থাকে। ৯৯৯ নম্বর চালুর পেছনেও ছিল এক করুণ ও জরুরি বাস্তবতা। ১৯৩৫ সালের এক সন্ধ্যায় লন্ডনের উইমপোল স্ট্রিটে ভয়াবহ আগুন লাগে। সেখানে ছিল বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. ফিলিপ ফ্র্যাংকলিনের চেম্বার। আগুন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে ঘটনাস্থলে পুড়ে মারা যান পাঁচজন।
২ ঘণ্টা আগেব্রিটিশদের বিরদ্ধে ওই লড়াইয়ের ফলাফলের চেয়ে ‘লড়াই’ করার হিম্মতই পরে হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষে শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা।
৪ ঘণ্টা আগেইলন মাস্ক এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধনকুবেরদের একজন। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। বিখ্যাত ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘ফোর্বস’–এর তথ্যমতে, বর্তমানে মাস্কের সম্পদের পরিমাণ ৪০৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু কে এই ইলন মাস্ক? কেনইবা এত সম্পদের মালিকানা তাঁর হাতে? কারও মতে, ইলন এক ‘লাগামহীন ঘোড়া’।
১ দিন আগেযেখানেই যেতেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন ক্যামেরাটা। ছাদে দাঁড়িয়ে বিশেষজ্ঞ ফটোগ্রাফারের মতো ছবি তোলার বিষয় আর দৃশ্য নির্বাচন করতেন। কখনো মানুষের মুখ, কখনো রাস্তা, বাড়িঘর, উৎসব বা প্রকৃতি। সবই ধরা পড়ত তাঁর ক্যামেরার ফ্রেমে।
২ দিন আগে