leadT1ad

হুমায়ূনের আদালত অবমাননা

‘দেখা হবে জেলখানায়’, হুমায়ূনের অদ্ভুত যাত্রা

আফজাল রহমান
আফজাল রহমান
ঢাকা

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ১৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

ইত্তেফাক থেকে বের হয়ে মতিউর রহমান চৌধুরী তখন বাংলাবাজার পত্রিকা করেছেন। সঙ্গে আমরা একঝাঁক তরুণ। গ্রিন রোডের মতি ভাইয়ের পুরাতন দোতলা বাড়িতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন মোস্তফা ফিরোজ, মশিউল আলম, উত্তম সেন, ফজলুল বারী, প্রভাষ আমীন, রাজু আলাউদ্দিন, ব্রাত্য রাইসু, সিরাজুল ইসলাম কাদির, নাসরীন জাহান, আহমদ ফারুক হাসান, জুলফিকার আলী মাণিকসহ অনেকে। ১৯৯২-এর দিকে দেশের বিশিষ্টজনদের গোটা জীবনপর্ব নিয়ে পুর্ণ পৃষ্ঠা সাক্ষাৎকার ‘ব্যক্তিত্ব’ চালু করলাম। কবি শামসুর রাহমান দিয়ে শুরু, গফফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানার ইমাম—সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সবার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। জাহানার ইমামের সাক্ষাৎকার নিতে হলো পুরো সপ্তাহজুড়ে। অতৃপ্ত জননীর পুত্র হয়ে উঠলাম। এর সপ্তাহ দুই পর হুমায়ূন আহমেদের পূর্ণপৃষ্টা সাক্ষাৎকার ছেপে আমরা কঠিন বিপত্তিতে পড়লাম।

হুমায়ূন আহমেদের ‘দরজার ওপাশে’ উপন্যাসে এক জেল-ফেরত আসামির আপত্তিকর সংলাপ ছিল বিচরপতিদের সম্পর্কে। সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গটি ছাপা হওয়ার পরদিনই জুডিসিয়াল কাউন্সিল বৈঠক করে ‘আদালত অবমাননা’র মামলা ঠুকে দেন। হুমায়ূন আহমেদ ১ নম্বর আসামি, মতিউর রহমান চৌধুরী ২, প্রতিবেদক আফজাল রহমান ও মেহজাবীন খান যথাক্রমে ৩ ও ৪ নম্বর আসামি। এই মামলা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের প্রতিক্রিয়া নিতে গেলে তিনি আবারও বেফাঁস কথা বলে বসেন। সেটি পরদিন ছাপা হলে সেই বেফাঁস উক্তি নিয়ে আরও একটি মামলা হয়। মতিউর রহমান চৌধুরী তখন লন্ডনে। তিনি সেখানে বসেই ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার ইশতিয়াক হোসেনকে তাঁর কৌঁসুলি নিয়োগ করেন। আমরা চলে গেলাম ‘আম্মা’র কাছে। আম্মা জাহানারা ইমাম খুব বিচলিত হয়ে উঠলেন আমাদের নিয়ে । পরদিন তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন ড. রফিকুর রহমানের কাছে। তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন চুপ থাকতে এবং কোনো মহলে কোনো প্রতিক্রিয়া না দিতে। রাতে ফোন দিলাম হুমায়ূন ভাইকে। তিনি আইনজীবী হিসেবে ভাষা সৈনিক এডভোকেট গাজীউল হককে নিয়েছেন।

হুমায়ূন আহমেদ। সংগৃহীত ছবি
হুমায়ূন আহমেদ। সংগৃহীত ছবি

মামলার প্রথম হাজিরা দিন উপস্থিত। আমরা সকালে চলে গেলাম আমাদের আইনজীবী ড. রফিকুর রহমানের চেম্বারে। তিনি ওই দিনের তালিকা দেখে বললেন, আজ মামলা উঠেনি। লিস্টে আমাদের মামলা না থাকায় আমরা গ্রিন রোডের পত্রিকা অফিসে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর টিভিতে দেখি হুমায়ূন আহমেদ হাজিরা দিয়ে নেমে আসছেন বহু লোকজন নিয়ে। আমরা স্কুটার (ঢাকার এক্সময়ের বিখ্যাত বেবিট্যাক্সি) নিয়ে দৌড়ে হাইকোটের্র সেই বেঞ্চে পৌছে দেখি গাজীউল হক হুমায়ূন আহমদেকে নিয়ে বেড়িয়ে যাবার পর ড. কামাল ও ব্যারিস্টার ইশতিয়াক এসে অনুপস্থিত মতিউর রহমান চৌধুরীর পক্ষে ম্যুভ করছিলেন, আমাদের দেখে কিছুটা ক্ষেপে গেলেন, ‘আপনারা কি নিজেদের এভব ল মনে করেন, দুজন দাঁড়ান ওখানে।’ হকচকিয়ে আমরা দুজন আসামি হাজিরার কাঠগড়ায় উঠে দাড়ালাম। আমাদের আইনজীবী ড. রফিকুর রহমান টের পাননি। ড. কামাল ও ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আমাদের দুজনের জন্যেও মুভ করলেন। সে দফা বেঁচে গেলাম।

কোর্ট থেকে বেড়িয়ে এসে আমরা দুজন আমাদের ড. রফিকুর রহমানের চেম্বারে গেলাম। তিনি বললেন, তালিকায় না থাকলেও গাজীউল হক সাহেব তাঁর মক্কেল হুমায়ূন আহমেদের জন্য সাপ্লিমেন্টারি ডেট নিয়ে হাজিরা দিয়েছেন—এটা চিন্তা করা যায়নি। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের প্রথম তারিখেই বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন। ড. রফিকুর রহমানের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আমরা এলিফেন্ট রোডে আম্মার বাসায় গেলাম। বিষয়টা শুনে আম্মার মুখ শুকিয়ে গেলো। আম্মা বললেন, ‘হুমায়ূন সাহেব তোদের খুব ভোগাবে। তোরা হুট করে চলে এলি কেন। উনি কি করে তোদের দেখে আসা উচিত ছিল। তাহলে আর এই বিপদ হতো না। আর কামাল সাহেব না থাকলে তো তোদের চরম বিপদ হতো।’

কিছুক্ষণ পর মেহজাবীন খানের বাবা ডেপুটি গর্ভনর মাহবুবুর রহমান খান ফোন দিয়ে জাহানারা ইমামের সঙ্গে কথা বললেন। চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছিল। সবার ধারণা ছিল, প্রথম দিনই সবাইকে আটকে দেবে। রাতে পত্রিকার কাজ শেষ করে সেন্ট্রাল রোডের মোড়ের ফ্লাটে হুমায়ূন ভাইয়ের ওখানে গেলাম। একদল প্রকাশক নিয়ে মেঝের বিছনায় আড্ডা জমিয়েছেন তিনি। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন, ‘আসো সহ-আসামি। শোনো, আজ তো রেডি হয়ে গেছিলাম, দুদিনের হাজতবাসের প্রস্তুতি নিয়ে। ছেড়ে দিল কেন? বলোতো?’ হুমায়ূন ভাইয়ের মতলব দেখে আমার ভেতরে ধক করে উঠল। অনেকক্ষণ কোনো কথা বের হলো না।এক প্রকাশক হুমায়ূন ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, উনি সহ-আসামি কেন? হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘শোন একই ক্লাসে পড়লে হয় সহপাঠী, একবাসে চড়লে হয় সহযাত্রী, এই সাথে চাকরি করলে হয় সহকর্মী। তো এক মামলায় দুই আসামি হলে সহ-আসামি হবে না?’ বলেই হেসে উঠলেন তিনি, পারিষদও হো হো করে হেসে রুমটা ঝাঁকিয়ে দিল। নুতন দুই উপন্যাসের কপি হাতে দিয়ে বললেন, কী খাবা?

বললাম, ঠান্ডা পানি। হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘খুব ঘাবড়ে গেলে বুঝি?’ বললাম, ‘আপনি সাপ্লিমেন্টারি ডেট নিয়া হাজিরা দেবেন, আমাদের জানাবেন না। এটা কি হলো!’

হুমায়ূন আহমেদ যখন আদালত অবমাননার মামলায় সাজা ভোগ করতে মরিয়া, তখন আমরা খুঁজছি পরিত্রাণের পথ। শহীদ জননী আমাদের বাচাঁতে মরিয়া। বিকালে পত্রিকা অফিসে জাহানারা ইমামের ফোন, ‘সন্ধ্যার পর চলে আয়।’ আবুল খায়ের ভাই উনার পেজ মেকআপে আমাকে বেশ অনেকক্ষণ আটকে রাখলেন। এলিফ্যান্ট রোডে পৌঁছাতে দেরি। আম্মা বেশ উদ্বিগ্ন।

‘আমারেই ছাইড়া দিছে, তোমাগর আর কি হইবো। ঠান্ডা পানির সাথে কী খাবা, বলো।’

পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললাম, ‘আর কিছু খাব না। আজ চলি। কাল আসবোনে।’ বলে বের হয়ে এলাম।

রাজু-রাইসু মিলে হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফা ভাইয়ের মধ্যে একটা গোল বাধিয়ে রাখত।

সেদিন বিকালে আজিজ মার্কেটে উত্থানপর্বে গেলাম ছফা ভাইয়ের কাছে। আমাকে দেখে ছফা ভাই বললেন, ‘আফজাল বসো, শোন, তোমরা হুমায়ূন আহমেদকে তো পুরোটা বুঝতে পারবে না। ও কী চায় জানো? দু-চার দিনের হাজতবাস।’

আমি ছফা ভাইয়ের কাছে ঘনিষ্ট হয়ে বসলাম। তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘শোন, হুমায়ূন যদি হাজতে যেতে পারে, তো কী হবে জানো? প্রত্যেক হাজতখানার মেঝের এক কোনে একটা ফুটো নালা থাকে, হাজতিদের হিসু করার জন্য। হুমায়ূন হাজতে গেলে বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা হোমিওপ্যাথির খালি শিশি নিয়ে ঐ ফুটো নালার সামনে অপেক্ষা করবে হুমায়ূনের হিসু শিশিতে ভরে নিয়ে বাজারজাত করার জন্য।’

তখন হুমায়ূন আহমেদ যা লিখছেন, তা-ই ছাপাতে মরিয়া বাংলাবাজার। বিষয়টায় কিঞ্চিৎ মালুম হলো, বেশ বিরক্ত আহমদ ছফা। এটা নিছক রসিকতা নয়, বেশ অনেকটাই খেদ ছিল প্রিয় হুমায়ূনের আহমেদের প্রতি। কিন্তু ছফা ভাইয়ের অমন রসিকতাতেও প্রাণ খুলে হাসতে পারলাম না। কেননা আদালত অবমাননার মামলায় হুমায়ূন আহমেদের পাগলামি আমাদের বারোটা বাজিয়ে দেবে। অমন দুর্ভাবনা উত্থানপর্বে এসে আরও প্রকট হলো। পরদিন অফিস শেষে রাত আটটায় হুমায়ূন আহমেদের বাসায় যেতে মন টানছিল না। গ্রিন রোড থেকে সেন্ট্রাল রোডের মুখে যেতে সময় বেশি লাগে না। ওই সময়টায় বাংলাবাজারের প্রকাশকদের জমায়েত ঘটে হুমায়ূন ভাইয়ের ড্রয়িং রুমে, অনেক সাহিত্য সম্পাদক সেই জমায়েতে দিব্যি জমিয়ে বসে। আমাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কদিন সেখানে সামিল হতে হচ্ছে মামলায় পড়ে। কদিন আগে নির্মূল কমিটির কার্যক্রমের জন্য হুমায়ূন আহমেদ আর্থিক সহায়তা দেবার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তখন কিছুদিন আসা যাওয়ায় এই জনপ্রিয় পাগল কথাশিল্পীর নানা কাণ্ডকীর্তি উপভোগ করেছি। কিন্তু উনার সহ-আসামি হয়ে এখন দায়ে পড়ে তাঁর বাসায় আবার আসা-যাওয়া। আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে তাঁর যে রকমের উচ্ছ্বাস, তাতে তাঁর মতলবটা নজরে রাখতে প্রতিরাতেই হানা দিয়েছি। সেদিন শুধু অনুরোধ করতে গিয়েছিলাম।

হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক
হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

ঢুকে দেখি, বাসা অভিনেতা-কলাকুশলীতে ঠাঁসা। আমি হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে পৌঁছে কানের কাছে আস্তে করে বললাম, এই মামলা নিয়ে প্রেস-মিডিয়ায় আর কোনো বেফাঁস কথা বলবেন না। হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘তোমরা সাংবাদিক এত ভয় পাও কেন? কয়েদ জেল তো মানুষের জন্যই নাকি, গরু-ছাগলের তো জেল খাটতে হয় না। অমন সশব্দে বোমা ফাঠালেন, যে সবাই আমার দিকে চোখ ফেরাল। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বেশ কিছু মুহূর্ত ‘কোথাও কেউ নেই’ সিরিয়ালের প্রস্তুতি পর্ব নীরবে পর্যবেক্ষণ করলাম। তারপর বেরুবার সময় হুমায়ূন ভাই হাতে ধরিয়ে দিলেন ‘পোকা’। সেটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রিকশায় শাহবাগ এলাম। বন্ধুদের সঙ্গে চা খেয়ে বনানীর উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্টের বাসে চাপলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখি আমার জন্মদাত্রী ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁদছেন। আমি এগিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মা ‘পোকা’ উপন্যাসটি সামনে রেখে কান্না আরও বাড়িয়ে দিলেন। কিছুই বুঝতে পারছি না।

বইটা ব্যগ থেকে নামিয়ে খাওয়ার টেবিলে রেখে ঘুমিয়েছিলাম। বইটা হাতে নিয়ে দেখি নুতন ‘পোকা’ উপন্যাসটিতে নীল কলম দিয়ে হুমায়ূন ভাই লিখে দিয়েছেন,

‘সহআসামি আফজাল,
“দেখা হবে জেলখানায়”
সহআসামি হুমায়ূন আহমেদ’

বুঝতে পারলাম, এটা দেখেই আম্মা কান্না জুড়ে দিয়েছেন। হুমায়ূন ভাই অমন পাগলামি করলে জননীকে কী বলে সান্ত্বনা দেব! আমার বড়বোন তখন দেশে নেই, জার্মানীতে একটা প্রশিক্ষণে। আম্মার অসহায়ত্ব সে জন্য আরও বেড়েছে। মেহজাবীন খানকে নিয়ে বিকালে এলিফেন্ট রোডে শহীদ জননীর বাসায় গিয়ে আম্মার উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরলাম। তিনি বললেন, ‘তোদের যদি এই আদালত অবমাননার মামলায় কোনোরকম ছোটখাট পানিশমেন্টও হয়, তো তোরা কোনো দিন সরকারি চাকুরির আবেদন করতে পারবি না। আর হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের মতিগতি আমার ভালো লাগছে না।’ মেহেজাবীন খান বলল, ‘আম্মা, আমাদের ১৪ বিসিএসের রিটেন আগামী মাসে, আফজাল ভাই তো পরীক্ষা দিতে চাইছেন না, পড়াশোনাও করছেন না।’

জাহানারা ইমাম বললেন, ‘ও তোকেও বিপদে ফেলেছে। ঐ রকম পাগল মানুষের সাক্ষাৎকারে তুই না গেলে তো বেঁচে যেতি। আর এখন পরীক্ষাও দিতে চাইছে না, সাংবাদিকতায় কী মজা পেয়েছে, দেখছিস না!’

প্রধান বিচারপতি বিষয়টি মেনে নিয়েছেন আর ৯ মাস পর জুডিশিয়াল কাউন্সিল মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নভঙ্গ। আমি আর দেখা করতে যাইনি। এদিকে ১৬ হাজার টাকার পত্রিকার চাকরি ছেড়ে পৌঁনে পাঁচ হাজার টাকার মফস্বলের সরকারি চাকরিতে যেতে চাইনি আমি।

আমার চোখ ছলছল। অভিামানী জননীকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি আমার ডান হাত টেনে তুলে তাঁর মাথায় চেপে ধরে শপথ করালেন। ‘মন দিয়ে পরীক্ষা দেব। চাকরি হলে সাংবাদিকতা ছেড়ে যাব।’

হুমায়ূন আহমেদ যখন আদালত অবমাননার মামলায় সাজা ভোগ করতে মরিয়া, তখন আমরা খুঁজছি পরিত্রাণের পথ। শহীদ জননী আমাদের বাচাঁতে মরিয়া। বিকালে পত্রিকা অফিসে জাহানারা ইমামের ফোন, ‘সন্ধ্যার পর চলে আয়।’ আবুল খায়ের ভাই উনার পেজ মেকআপে আমাকে বেশ অনেকক্ষণ আটকে রাখলেন। এলিফ্যান্ট রোডে পৌঁছাতে দেরি। আম্মা বেশ উদ্বিগ্ন। বললেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের বাসায় এখন খুব একটা যাবি না। একটা চিন্তা করেছি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সাহেবকে ধরতে হবে। আমি বললাম, ‘আমাদের বাংলাবাজার পত্রিকার চিত্রশিল্পী উত্তম সেন দার সাথে প্রধান বিচরপতির ছোট কন্যা বিভিন্ন কাজ করেন। জাহানারা ইমাম বললেন, ‘ওকে দিয়ে হবে না। গাফফার চৌধুরী ভাই ফোন করেছিলেন, তোদের বিষয়ে একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। তুই চুপচাপ পড়াশোনা করে পরীক্ষাটা দে। আমি দেখছি কী করা যায়।’

কয়েকদিন হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায় যাওয়া হয়নি। অফিসের সময় কমিয়ে নিয়েছি। মধ্যে মেহজাবীনের বাসায় গিয়েও কিছু পড়াশোনা করেছি। একদিন দেখি রাকাকে নিয়ে আবুল খায়ের ভাই রিকশায় এসে অফিসে নামলেন। আমাকে পেয়ে খায়ের ভাই ডাকলেন। রুমে গিয়ে আবুল খায়ের ভাইয়ের মুখে শুনতে পেলাম, জেলজীবন কীভাবে কাটাবেন, তা নিয়ে বিশাল পরিকল্পনা করে ফেলেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সশ্রম কারাদণ্ড হলে ভালো হয়, তাহলে দৈহিক ব্যায়ামটাও হয়ে যাবে—এমন সব ভাবনা ভেবে ঠিক করে রেখেছেন।

পরের সপ্তাহে হাজিরার দিনে হাইকোর্টে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘কি বিষয় সহ-আসামি, দেখা নাই।’ বললাম, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সে জন্য যাওয়া হচ্ছে না।’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘না, শুনতে পেলাম মামলাটাই তোমরা হজম করে ফেলতেছো। কাজটা ভালো হচ্ছে না।’

‘বাংলাবাজার পত্রিকা’ থেকে আমরা চারজন ১৪তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সবাই লিখিত পরীক্ষা পাস দিয়েছি। আদালত অবমাননার মামলা কাঁধে নিয়ে ভাইবা পরীক্ষাও উত্তীর্ণ হয়েছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম একজন বিশিষ্টজনকে দিয়ে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের কানে এই কথাটি তুলে দিয়েছেন যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করে সমাজে বিচারকগণের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।

প্রধান বিচারপতি বিষয়টি মেনে নিয়েছেন আর ৯ মাস পর জুডিশিয়াল কাউন্সিল মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নভঙ্গ। আমি আর দেখা করতে যাইনি। এদিকে ১৬ হাজার টাকার পত্রিকার চাকরি ছেড়ে পৌঁনে পাঁচ হাজার টাকার মফস্বলের সরকারি চাকরিতে যেতে চাইনি আমি। মেহজাবীন খান জাহানারা ইমামের কাছে সে কথা জানিয়ে দিলে তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। বলেন, ‘আমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিস সাংবাদিকতা ছেড়ে যাবি। সরকারি শিক্ষকতায় যা।’ তাঁর কথার অবাধ্য হতে পারলাম না। মেহজাবীন খানকে নিয়ে নেত্রকোণা সরকারি কলেজে চলে গেলাম।

কোথাও কেউ নেই-এর বাকের ভাইকে ফাঁসি না দিতে সারা দেশের দর্শকদের আপত্তির মিছিল চলছে। সেবার বিশ্বকাপ ফুটবল আমেরিকায়। নিউইয়র্কেও মিছিল হয়েছে। আমিও তখন নিউইয়র্কে। হুমায়ূন ভাই আমেরিকায় এসেছেন। নিউজার্সিতে জাফর ভাইয়ের বাসায় আছেন। আমি নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সিতে ফোন দিয়ে কথা বলতে চাইলাম হুমায়ূন ভাই আমার সঙ্গে কথা বললেন না। জীবদ্দশায় আমার ওপর ক্ষেপেই রইলেন এই অদ্ভুত মানুষটি।

লেখক: সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত