leadT1ad

সীমা নাকি সীমাবদ্ধতা: নারীদের ৫ ঘণ্টার কর্মদিবসের আসল অর্থ কী

মাহিসুন রাশ্তি
মাহিসুন রাশ্তি

স্ট্রিম গ্রাফিক

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান যখন বললেন, তাঁর দল নির্বাচিত হলে নারীদের কর্মঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করবে, তখন পাল্টা প্রশ্ন হতে পারত, এই সিদ্ধান্তে আসার আগে তিনি কার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন।

নিউইয়র্ক সিটির অ্যাস্টোরিয়া ওয়ার্ল্ড ম্যানরে ‘কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশনস’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

এই বক্তব্য লিঙ্গসমতা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর দল জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

শফিকুর রহমানের বক্তব্যের পর, নারীদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করার পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপিত এই প্রস্তাবের বিষয়ে বিভিন্ন পেশার নারীদের মতামত জানতে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় ছিল বিস্ময়, উদ্বেগ ও সংশয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সম্মান’ প্রদর্শনের নামে কর্মঘণ্টা কমানো কি সত্যিই নারীদের ক্ষমতায়ন করে, নাকি প্রচলিত লৈঙ্গিক ভূমিকাকে (জেন্ডার রোল) আরও শক্তিশালী করে তোলে?

অ্যাক্টিভিটিস তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘নির্বাচনের সময় অনেক রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস দেয়। জামায়াত আমিরের বক্তব্য সেই ধাঁচেই পড়ে। তাঁর প্রস্তাব কোনোভাবেই শ্রম আইন বা নারী অধিকার-সংক্রান্ত নীতির সঙ্গে মেলে না। নারী বিষয়ে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, নারী-পুরুষ উভয়েরই কর্মঘণ্টা ও সুবিধার ক্ষেত্রে সমান বিবেচনার অধিকার রয়েছে। আমরা যা দাবি করতে পারি তা হলো, আইন অনুযায়ী সমস্ত সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করা হোক।’

শফিকুর রহমানের বক্তব্যে কর্মঘণ্টা কমানোকে ‘মায়েদের সম্মান’ জানানোর উপায় হিসেবে তুলে ধরা হলেও, এটি নারীর মূল্যকে প্রাথমিকভাবে মাতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত করে প্রচলিত লৈঙ্গিক ভূমিকাকেই শক্তিশালী করে। সম্মানের নামে পেশাগত কাজকে সীমিত করার এই পরামর্শকে নারীর স্বায়ত্তশাসন সীমাবদ্ধ করা ও তাঁদের শ্রমের ওপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

কর্মঘণ্টা কমানোকে একধরনের ‘সম্মান’ হিসেবে উপস্থাপন করে নারীদের পেশাগত অবদানকে তাঁদের গার্হস্থ্য ভূমিকার চেয়ে গৌণ হিসেবে উপস্থাপনের ঝুঁকি তৈরি করেছে এই বক্তব্য, যা লিঙ্গসমতা ও শ্রম অধিকারের প্রেক্ষাপটে উদ্বেগজনক।

‘ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশন’-এর প্রকল্প সমন্বয়ক মধুরিমা সাহা বলেন, ‘অনেক নারীই কাজ করতে ও নিজের কর্মজীবন উপভোগ করতে চান। তাঁদের বাড়িতে স্বামীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য নিয়েও কথা বলতে পারি। কারণ, নারীরা প্রায়ই পুরুষদের চেয়ে কম বেতন পান। কর্মঘণ্টা কমানোর পরিবর্তে কর্মক্ষেত্রকে মা-বান্ধব করা উচিত, যেখানে ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সুবিধা, ব্রেস্টফিডিং কর্নার এবং দুপুরের খাবারের বিরতির বাইরেও সন্তান পালন ও বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য অতিরিক্ত ৩০-৪০ মিনিটের ছুটি থাকবে।’

গবেষক ঋতু রাবেয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে শ্রম বাণিজ্যিকীকরণের এই যুগে নারীদের সুযোগ ও মজুরি পুরুষদের তুলনায় কম। “সম্মান” দেখানোর অজুহাতে নারীদের কর্মঘণ্টা কমানো প্রকৃত সমতা প্রতিষ্ঠা করে না। সন্তান পালন ও গৃহস্থালির কাজে নারী-পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ডে-কেয়ার সুবিধা এবং মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে কর্মজীবন বজায় রেখে সন্তান লালন-পালন করা সবার জন্য সহজ হয়।’

রংপুরের মহব্বত খান উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে কি নারীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে? কোনো সংলাপ ছাড়াই কর্মঘণ্টা কমানো বিভেদ তৈরি করতে পারে ও লিঙ্গভিত্তিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।’

পিতৃতন্ত্রের ‘উপহার’

‘আদর্শ নারী’র ধারণা জনসমক্ষে এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যা তাকে কোন দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে তা ঠিক করে দেয়। পাশাপাশি যে নারীরা পরিবারের জন্য কর্মজীবন ত্যাগ করেন, তাঁদের আদর্শ হিসেবে দেখা হয় আর যাঁরা দুটোই সামলানোর চেষ্টা করেন, তাঁদের স্বীকৃতি কম দেওয়ার ঐতিহাসিক ধারাকেই দীর্ঘায়িত করে।

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীদের অবস্থান প্রাথমিকভাবে মা ও যত্নকারী হিসেবে। তাঁদের পেশাগত অবদান গৌণ।

এই বিষয়টি গায়েত্রী স্পিভাকের ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক’ রচনার সঙ্গে মিলে যায়। এই প্রেক্ষাপটে, কর্মজীবী নারীরা প্রভাবশালী বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন কিনা, বা নিজেদের স্বকীয়তা তুলে ধরতে পারেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

কর্মঘণ্টা কমানোকে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের ‘উপহার’ বা স্বীকৃতি হিসেবে উপস্থাপন করে জামায়াত আমিরের ওই বক্তব্য নারীদের স্বায়ত্তশাসন, চাহিদা ও কর্মক্ষেত্রের পছন্দ বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব কণ্ঠকে কার্যকরভাবে স্তব্ধ করে দেয়।

এই ব্যাখ্যাটি ‘মিউটেড গ্রুপ থিওরি’র সঙ্গেও মিলে যায়। মিউটেড গ্রুপ থিওরি তুলে ধরে, কীভাবে পুরুষকেন্দ্রিক ভাষার কারণে নারীদের অভিজ্ঞতাকে পদ্ধতিগতভাবে বাদ দেওয়া হয় বা অবমূল্যায়ন করা হয়।

যেমনটা শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা যদি তাঁদের কাজ আট ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টায় কমিয়ে আনি, তবে মায়েরা অনুভব করবেন যে সরকার তাঁদের সম্মান দিয়েছে… তাঁরা ভাববেন, আট ঘণ্টার কাজ মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় শেষ করা তাঁদের দায়িত্ব।’

এই ধরনের শব্দচয়ন মাতৃত্বের আদর্শিক ধারণা তৈরি করে ও একইসঙ্গে নারীদের পেশাগত শ্রম কীভাবে করা উচিত, তাও স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। ফলে নারীদের যাপিত অভিজ্ঞতাকে পুরুষ-নির্ধারিত মানের অধীন করে ফেলে।

ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে, জামায়াত আমিরের বক্তব্য প্রমাণ করে আলাপচারিতা নিরপেক্ষ নয় ও ভাষাই ক্ষমতা কাঠামোকে পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

কর্মঘণ্টা কমানোকে সম্মান হিসেবে তুলে ধরে এই বক্তব্য কেবল বাস্তবতাকে বর্ণনা করে না; তাকে নতুন আকার দেয় এবং লিঙ্গ ভূমিকা নিয়ে জনমত ও প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতিকে প্রভাবিত করে। নারীদের স্বকীয়তা এখানে সংকুচিত, কারণ প্রভাবশালী বয়ানই তাঁদের ‘সম্মান’ ও পেশাগত সক্ষমতা উভয়কেই নির্ধারণ করে।

এই বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান মান্নু বলেন, ‘জামায়াত আমিরের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, তিনি চতুর আধিপত্যবাদী যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। নারীদের সম্পর্কে সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত ধারণাগুলোকে—যেমন তাঁদের দুর্বল, নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল ও একাধিক গার্হস্থ্য কর্তব্যে ভারাক্রান্ত হিসেবে চিত্রিত করে, তিনি এমন এক লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতিকে শক্তিশালী করছেন যা নারীদের প্রচলিত ভূমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। তাঁর উপস্থাপনা এমন ধারণা দেয়, একজন পুরুষ যখন নারীদের মাতৃ দায়িত্ব পালনের জন্য বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করেন, তখন তিনি তাঁদের প্রতি ‘অনুগ্রহ’ করছেন।’

অধ্যাপক মাসউদ ইমরান মান্নু আরও বলেন, ‘আট ঘণ্টা থেকে কর্মঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টায় নামিয়ে আনার উল্লেখ নারীদের আবার গার্হস্থ্য পরিমণ্ডলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করার প্রচেষ্টা, যা কার্যকরভাবে পেশাগত ও জনজীবনে নারীর পরিসরকে সংকুচিত করে। এই ধরনের ধর্মীয় রাজনীতি নতুন কিছু নয়। ভাষাগতভাবে এটি নিজেকে রক্ষাকবচ হিসেবে উপস্থাপন করলেও আসলে নারীদের সমতা ও স্বকীয়তাকে খর্ব করে।’

জামায়াতের নারী নেত্রী যা বলেন

জামায়াতের পাঁচ লক্ষেরও বেশি নারী কর্মী রয়েছে, যার মধ্যে ৫০ হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষিত ‘রুকন’ সদস্য। দলটির নারী কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলেও জনসমক্ষে তাঁদের উপস্থিতি সীমিত। দলের মোট সদস্য সংখ্যা দশ লাখের বেশি, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ পুরুষ ও ৪০ শতাংশ নারী। দলটির নারী শাখা তিনটি স্তরে সংগঠিত: সহযোগী সদস্য, কর্মী ও সর্বোচ্চ পদ ‘রুকন’। রুকনের পাশাপাশি সারাদেশে প্রায় চার লক্ষ কর্মী ও অগণিত সহযোগী সদস্য রয়েছেন।

যদিও ডা. শফিকুর রহমানের নারীদের কর্মঘণ্টা আট থেকে পাঁচ ঘণ্টায় কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, তবে দলটির নারী শাখা বলেছে, আমিরের মন্তব্য নারীদের প্রতি সম্মান ও উদ্বেগের জায়গা থেকে করা হয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো, এই বক্তব্য তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে দেওয়া হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মহিলা শাখার সেক্রেটারি নূরুন নেসা সিদ্দিকা বলেন: ‘আমিরের বক্তব্যের পর গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হয়েছে। তাঁর কথাগুলো নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বলা। আমরা যদি সরকার গঠন করতে পারি, তাহলে নারীদের বিষয়গুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে, যার মধ্যে কর্মঘণ্টা, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, স্তন্যদায়ী শিশুদের জন্য ব্যবস্থা, মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি এবং আর্থিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোও থাকবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, নারীদের ঘরে বন্দী করে রাখা হবে না। তাঁদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো হবে ও তাঁরা জাতির জন্য অর্থবহ অবদান রাখার সুযোগ পাবেন।’

বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগহীন অলঙ্কার

সুরক্ষার চাদরে মোড়া এই অলঙ্কারপূর্ণ কথাবার্তা কর্মজীবী নারীদের, বিশেষ করে পোশাক শিল্পের নারীদের যাপিত বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। গার্মেন্টস কর্মী নাসিমা বলেন, ‘আমার আয়েই পুরো সংসার চলে। আমার স্বামী পাঁচ বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, আর আমাদের দুই সন্তান গ্রামে থাকে। আমার আয় দিয়েই তাঁর ওষুধ ও সন্তানদের খরচ আর বস্তির ভাড়া চলে। কারখানায় যখন অর্ডার আসে, তখন আমাদের কখনো কখনো দিনে ১৫ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়। অতিরিক্ত কাজের টাকা আমরা কখনোই পাই না। আট ঘণ্টার কাজের ধারণাই আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, পাঁচ ঘণ্টা তো দূরের কথা। পাঁচ ঘণ্টার কর্মদিবসের জন্য আমার বেতন কীভাবে হিসাব করা হবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। যদি তারা বিষয়টি স্পষ্ট করে, তবে হয়তো আমি ভেবে দেখতে পারি।’

একইভাবে আরেক গার্মেন্টস কর্মী সোহাগী বলেন, ‘গার্মেন্টস শিল্পে সত্যিকারের আট ঘণ্টার শিফট বলে কিছু নেই। নারী শ্রমিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর যদি আমাদের কর্মঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টায় কমিয়ে আনা হয়, তবে আমাদের মধ্যে কতজন কারখানায় থাকবে? উৎপাদন কীভাবে চলবে? তারা ইতিমধ্যেই আমাদের প্রাপ্য মজুরির চেয়ে কম দেয় এবং কর্মঘণ্টা কমানোর কোনো প্রতিশ্রুতিই সঠিক মজুরিসহ আসবে না। আমরা সারাজীবন এভাবেই প্রতারিত হয়ে এসেছি।’

পোশাক খাতের এই বৈষম্যগুলো স্পষ্ট করে দেয়, ‘ঘণ্টার পরিবর্তন’ কর্মজীবী নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শ্রম পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নেয় না। এই পুরো বিষয়টি আসলে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ ও নারীদের যাপিত অভিজ্ঞতার মধ্যেকার বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরে।

একইভাবে, স্বাস্থ্যসেবা ও সাংবাদিকতার মতো পেশাগুলোতেও প্রস্তাবিত পাঁচ ঘণ্টার কর্মদিবস নারীদের শ্রম বাস্তবতার সঙ্গে সমানভাবে অনুপযুক্ত বলে মনে হয়।

চিকিৎসকরা, বিশেষ করে জরুরি ও প্রসূতি সেবায় কর্মরত নারীরা তাঁদের দায়িত্ব নির্দিষ্ট ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন না। জরুরি পরিস্থিতি ও প্রসব বা গুরুতর রোগীর পরিচর্যার মতো চিকিৎসা দায়িত্বগুলো সময় নির্বিশেষে তাৎক্ষণিক মনোযোগ দাবি করে।

ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নওশাবা নূর ব্যাখ্যা করেছেন, ‘একজন ডাক্তার হিসেবে আমার পেশায় কিছু দায়িত্ব নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখা যায় না, যেমন—নাইট শিফট, কারণ জরুরি অবস্থা দিন বা রাত যেকোনো সময় ঘটতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ঘণ্টার ব্যাপারে আপস করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না… ২০২৫ সালে এসে ঢালাওভাবে পাঁচ ঘণ্টার কর্মদিবস চলে না, বিশেষ করে আমাদের মতো সেবামূলক পেশার জন্য। নারী বা পুরুষ কার এই কাজগুলো করা উচিত, তা নিয়ে বিতর্ক করার চেয়ে বাস্তবসম্মত সুবিধার দিকে মনোযোগ দেওয়া আরও অর্থবহ হবে।’

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস)-এর সাংবাদিক মৌটুসী জুবাইদা রহমান বলেন, ‘প্রশ্ন থেকেই যায় যে, সন্তান পালন কি কেবল মায়ের দায়িত্ব? যদিও আমরা দেখছি কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, তবে অফিসের বাইরেও নারীদের অন্যান্য দায়িত্ব থাকে বলে অনেক কোম্পানি এখনও নারীদের নিয়োগ দিতে দ্বিধা বোধ করে।’

মৌটুসী জুবাইদা রহমান আরও বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, পাঁচ ঘণ্টার কর্মদিবস বাস্তবায়িত হলে নিয়োগ আরও কমে যেতে পারে। তাছাড়া, এই ব্যবস্থায় বেতন বণ্টন কীভাবে পরিচালিত হবে, তা বক্তব্যে স্পষ্ট করা হয়নি। খামখেয়ালিভাবে কর্মঘণ্টা কমানোর পরিবর্তে, কর্মক্ষেত্রকে আরও নারী-বান্ধব করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হতে পারত। আমার মতে, একজন নারীর সক্ষমতাই নির্ধারণ করা উচিত তিনি কীভাবে তাঁর কাজ করবেন, কোনো অনড় সময়সূচি দিয়ে নয়।’

শফিকুর রহমানের বক্তব্যে তাই কিছু গুরুতর প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না: নারীদের কর্মঘণ্টা কমানো হলে তাঁদের পারিশ্রমিক কীভাবে হিসাব করা হবে? তাঁদের কাছ থেকে কি কম সময়ের মধ্যে পুরো দিনের কাজ আদায় করা হবে? এইসব খুঁটিনাটি এড়িয়ে ও ‘আদর্শ মা’-এর চিত্র তুলে ধরে আমির সাহেব এমন এক রাজনীতির জন্য সহানুভূতি তৈরি করছেন, যা কাঠামোগত বৈষম্য ও শ্রম বাস্তবতা উপেক্ষা করে নারীদের গৃহবন্দিত্বকেই জোরালো করে তোলে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত