রবীন্দ্র-উত্তর শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে হুমায়ূন আহমেদ বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের মনোজগতে প্রবলভাবে কড়া নাড়েন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে হুমায়ূনের আবির্ভাব ঘটলেও পর্যায়ক্রমে টিভি নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত সর্বোপরি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিবিধ শাখায় অত্যন্ত প্রভাব ও প্রতিপত্তির সঙ্গে তাঁর বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর সম্পর্কে বহুল প্রচলিত বাক্যটি হলো ‘যেখানে তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন।’ প্রচলিত এই কথাটি হুমায়ূন সম্পর্কে কতটা প্রাসঙ্গিক এটার বিচার সময় সাপেক্ষ। তবে হুমায়ূন যে প্রভাববিস্তারী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ চলে না। তবে এও প্রচলিত আছে যে হুমায়ূনের এই প্রভাব মূলত তরুণ পাঠক মহলে। তবে কি হুমায়ূন বোদ্ধা শ্রেণির কাছে সমাদৃত নন? এই তর্কসাপেক্ষ বিষয় বাদ দিয়ে বরং হুমায়ূনের চলচ্চিত্রের খোঁজ করা যাক।
হুমায়ূনের কথা থেকে জানা যায়, চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বন্ধু আনিস সাবেতের সঙ্গে মেলামেশার খাতিরে। সাবেত প্রসঙ্গে হুমায়ূন বলেন, ‘এক জোছনা রাতে রাস্তায় হাঁটছি। তিনি হঠাৎ বললেন, ফিল্মে জোছনা কীভাবে তৈরি করা হয় জানো? আমি মাথা নাড়লাম--জানি না। জানার কোনো প্রয়োজন কখনো মনে করিনি। জোছনার বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর শুরু হল জোনাকির বক্তৃতা।’ এভাবেই জোছনা তৈরির গল্প শোনাতে শোনাতে হুমায়ূনের অচেতন মনে চলচ্চিত্রের আগ্রহ জন্মে।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। সংগৃহীত ছবিআনিস সাবেত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন কিন্তু ক্যান্সার ব্যাধি তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি। এরপর হুমায়ূন চলচ্চিত্রের দিকে ভিড়তে শুরু করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন মরে না। আনিস ভাই মারা গেলেন, তাঁর স্বপ্ন কিন্তু বেঁচে রইল। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সেই স্বপ্ন ঢুকে গেল আমার মধ্যে। এক ভোরবেলায় আমি আমার স্ত্রীকে ডেকে বললাম, গুলতেকিন, আমি একটা ছবি বানাবো। ছবির নাম ‘‘আগুনের পরশমণি’’।’ এই হলো তাঁর চলচ্চিত্র বানানোর আদিকথা।
তারপর একে একে আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যদিও তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ মুক্তির আগেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। প্রশ্ন জাগে, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্রকার হিসেবে কেমন ছিলেন? কিংবা তার চলচ্চিত্রের বিষয়-আশয় কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলা যায়, এফডিসির প্রচলিত সিনেমা বলতে যা বোঝায়, হুমায়ূন তেমন কিছু বানাননি। তাহলে তিনি কোন ঘরানার চলচ্চিত্র বানালেন? এক্ষেত্রে হুমায়ূনের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে।
হুমায়ূনের চলচ্চিত্রগুলোকে বিশ্লেষণ করলে মোটাদাগে দুই ধরনের বিষয়বস্তু পাওয়া যায়:
ক) বাংলাদেশকে রেপ্রিজেন্টেশন করা;
খ) কমেডি ও মেলোডির যোগসূত্রে একটা কাহিনি তৈরি করা ।
চলচ্চিত্রকার কুসুমকে দিলেন চিরকালীন বিচ্ছেদ, আর মতিকে দিলেন সেই বিচ্ছেদের সুর।
এই আলোচনায় বাংলাদেশকে রেপ্রিজেন্টেশন করার ক্ষেত্রে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রটিকে বিশ্লেষণ করা যাক। হুমায়ূনের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির হয়। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’তে তা ভালোভাবে পাওয়া যায়। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র হলো ‘শ্যামলছায়া’। এ দুটি চলচ্চিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিকে সরাসরি উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশকে রেপ্রিজেন্ট করার ক্ষেত্রে এ চলচ্চিত্র দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ঘরানাভুক্ত হয়। এর বাইরে হুমায়ূন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে হাজির করলেন-যা একান্তই তাঁর বাংলা, অর্থাৎ ভাটি বাংলা।
এই ভাটি বাংলা মানে হলো হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণার জলরাশিভরা অঞ্চল। হাওর অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে--যা একান্তই তাঁদের। যার ফলে বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ কিংবা নেত্রকোণা অঞ্চলে বাংলার অসংখ্য লোককবি ও গায়ক জন্মেছেন। হাওর বাংলার এই নিজস্ব সংস্কৃতিকে চলচ্চিত্রে কেমন দেখালেন হুমায়ূন? এবার সে প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক।
চলচ্চিত্রের নামকরণ ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ থেকে অনুধাবন করা যায়, এটি বর্ষাকালকে নির্দেশ করে। আর বর্ষা মানেই তো মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত কাব্য’। হুমায়ূন এই চলচ্চিত্রে কাব্য নয় বরং সংগীত নিয়ে হাজির হন। চলচ্চিত্রের শুরুতেই গান: পুবালী বাতাসে/ আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/ পুবালী বাতাসে/ বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/ আমার নি কেউ আসেরে...। এই সংগীতের মমার্থ বেদনাবিধুর। ভাটি বাংলার অবিবাহিত কোনো নারী যার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে এবং বিয়ে না-হওয়ায় তাঁকে পরিবারে ঘরবন্দী করে দেওয়া হয়েছে, তার মনের কথা এই গান। এই গান দিয়ে হুমায়ূন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ভাটি বাংলার গানের পরিচয় দিয়েছেন।
‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমার একটি দৃশ্য। সংগৃহীত ছবিহাওর অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি লোকসংগীত। তখন প্রশ্ন জাগে, হাওরের মানুষ কেন এত লোকসংগীতচর্চা করে বা ভালোবাসে? বাংলা লোকসংগীতের সঙ্গে হাওর অঞ্চলের যোগসূত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো জল। হাওরবাসীরা বছরে প্রায় ছয়মাস জলবন্দী থাকে আর এই সময়ে তাঁরা সংগীত চর্চার মতো বিষয়ে যুক্ত হয়। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ এমনই একটি চরিত্র হলো মতি। সে বিখ্যাত গায়ক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সংসার জীবনকে না করে। আর এই গায়ক মতির প্রেমে পড়ে কুসুম। কুসুম মতিকে কামনা করে কিন্তু মতি তা থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যায়।
তো হুমায়ূন কি এখানে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শশী ও কুসমকে হাজির করলেন? ব্যাপারটি তেমনই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় কুসুম যেমন শশী ডাক্তারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে কিন্তু শশী সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, এই চলচ্চিত্রের কুসুম ও গায়ক মতির মধ্যে তেমনটি খেয়াল করা যায়। কুসুম তার বিয়ের আগের দিন বাড়ির আঙিনা যখন রঙিন কাগজ দিয়ে সাজাচ্ছিল, তখন কোনো কারণ ছাড়াই মতি সেখানে হাজির হয়। এই যে মতির সেখানে উপস্থিতি এটা তার অচেতন মনে কুসুমের প্রতি যে ভালোবাসা সেটার টান। কিন্তু চেতন মন তা স্বীকার করে না। ফলে বিয়ের আগের রাতে বৌয়ের সাজ নিয়ে মতির ভাঙা ঘরে যখন কুসুম হাজির হয় তখন মতি তাকে বলে: বাড়িত যা কুসুম, কাইল তোর বিবাহ?’
কুসুম মতিকে বলে, ‘আপনি আমারে একটু আদর কইরা দেন।’ এই দৃশ্যে কুসুমের সঙ্গে আলাপে মতি জানায়, সে কুসুমকে অত্যধিক স্নেহ করে। এর বিপরীতে কুসুম বিস্ময় ও অবজ্ঞা ভরে উচ্চারণ করে- ‘স্নেহ!’ মতি আবার বলে, ‘বাড়িত যা কুসুম।’
তারপর কুসম বলে, ‘আপনি কোনোদিন বিবাহ করবেন না?’
মতি: না, আমার ওস্তাদের নিষেধ আছে। ওস্তাদ বলছে, সংসার আর গান একলগে হয় না। হয় সংসার করবা না হয় গান।
কুসুম: আপনার ওস্তাদ কিন্তু বিবাহ করেছিল!
মতি: এইজন্য তার গলায় গান বসে নাই, আমার গলায় বসছে...।
হুমায়ূনের কথা থেকে জানা যায়, চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বন্ধু আনিস সাবেতের সঙ্গে মেলামেশার খাতিরে।
মতির এই সিদ্ধান্ত কী বার্তা দিল? সেক্ষেত্রে বাউল প্রসঙ্গে বলা যায়, বাউলেরা গৃহী ও সন্ন্যাসী উভয় ঘরানার হয়। তো বাংলার হাওর অঞ্চলের বিখ্যাত ও স্বল্পপরিচিত প্রায় সকল গায়কেরা গৃহী। তাই বলা যায়, কুসুমের প্রেম প্রত্যাখ্যান করার জন্য মতির এই ধরনের কথা বলা ছাড়া আর কি-বা উপায় ছিল? আর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় শশী ও কুসুমের বিচ্ছেদই তো ঘটে। হুমায়ূনও সে পথেই হেঁটেছেন। তখন বলা যায়, এই সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বিচ্ছেদ।
মতি ও কুসুমের বিচ্ছেদ, জমিদার পরিবারের ক্ষয়িষ্ণু প্রতিনিধি ইরতাজুদ্দিনের সঙ্গে তার পুত্রের চব্বিশ বছর দেখা না-হওয়া, কুসুমের বাবার দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি না-আসা, সুরুজ আলির বাবা-মা হারানো এতিম অবস্থা প্রভৃতি এই চলচ্চিত্রে বিরহ ও বিচ্ছেদের রুপটিকে সামনে আনে। কালিদাসের বর্ষাকাব্য ‘মেঘদূত’ তো বিরহ ও বিচ্ছেদের কাব্য। আর সেই অর্থে হাওর অঞ্চলের শ্রাবণ মাসকে বিচ্ছেদ ও কষ্টের গাথা বানালেন হুমায়ূন আহমেদ।
যেমন একটি দৃশ্যে মতির মনে কষ্ট পাওয়া প্রসঙ্গে পরাণের স্ত্রী তার উদ্দেশে বলে: ‘গাতক (গায়ক) যত কষ্ট পায়, গলা তার তত খুলে।’ মনে কষ্ট পাওয়া গায়ক মতি তখন গান ধরে-‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়...’। তো এই গানের একটি কথা ‘বিচ্ছেদের বাজারে গিয়া/আমার এ প্রেম বিক্রি দিয়া/করবো না প্রেম আর যদি কেউ কয়...’-দ্বারা বিচ্ছেদের রুপটিকে ধারণ করা হয়েছে। ফলে বলা যায়, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ বিচ্ছেদ আর বিরহের চলচ্চিত্র। তখন প্রশ্ন জাগে হুমায়ূন কি ভাটি বাংলার বিরহ আর বিচ্ছেদের চিত্রকেই প্রাধান্য দিয়েছেন?
তিনি মূলত ভাটি বাংলার বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। যে অঞ্চলে ডাক্তার নাই, হাসপাতাল নাই, বাহন একমাত্র নৌকা। ফলে গর্ভবতীর বাচ্চা প্রসবকালে মৃত্যুমুখে পতিত হলেও তাৎক্ষণিক করার কিছু থাকে না। ভাটি বাংলা কেন এমন? সেখানকার মানুষেরা কি মৌলিক চাহিদা পাওয়ার অধিকার রাখে না? এসব প্রশ্নের বিপরীতে চলচ্চিত্রে হাজির হয় ইরতাজুদ্দিন চৌধুরী চরিত্রটি। পুরোনো জমিদারির তেজ নিয়ে সামন্তপ্রভু সেজে এলাকার মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে সে। চলচ্চিত্রে সামন্ত আর প্রজার প্রেক্ষাপট বোঝানোর জন্য চৌধুরীর হুকুমে বেদে মেয়েদের চুল কেটে দেওয়া, নৌকা পুড়িয়ে দেওয়া, নিমন্ত্রিত অতিথি গায়ক মতিকে সিঁড়িতে খেতে দেওয়া ইত্যাদি দৃশ্য দেখানো হয়।
হুমায়ূন আহমেদ। সংগৃহীত ছবিতো তিন পুরুষের জমিদার ইরতাজুদ্দিন চৌধুরীরা গ্রামবাসীর উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, খবরদারি চালায় ঠিকই কিন্তু কখনোই তাদের মৌলিক অধিকার কিংবা সুখ-দুঃখের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবে না। তবে চলচ্চিত্রকার জমিদার ইরতাজুদ্দিন চৌধুরীর সেই দম্ভ ভেঙে দিয়েছেন। জমিদারের ডাক্তার নাতনি সাহানাকে যখন পরাণের গর্ভবতী স্ত্রীর প্রসবজনিত জটিলতার জন্য মতি ডাকতে যায়, তখন চৌধুরী তার নাতনিকে যেতে দিতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু তার নাতনি ডাক্তার সাহানা রোগী দেখতে যায়। এই দৃশ্যে জমিদার বাড়ির মোটা মোটা পিলারগুলো অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে-যা তাদের ফুরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। আদতে তা ইরতাজুদ্দিন চৌধুরীর অবস্থাকে নির্দেশ করেছে।
এই বাড়িটিকে চলচ্চিত্রে রাজবাড়ি হিসেবে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। কেন এটা রাজবাড়ি? এটা ঔপনিবেশিক শাসনের ফল। যেহেতু ইরতাজুদ্দিন চৌধুরীর দাদাকে ব্রিটিশ সরকার খান বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল তাই তারা নিজেদের রাজা ভাবে। তখন প্রশ্ন জাগে, ব্রিটিশ সরকার এদেশীয়দের মধ্যে কাদের রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর, প্রিন্স ইত্যাদি উপাধি দিয়েছিল? যারা তাঁদের ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোতে সহযোগিতা করেছিল, তাদেরই তো নাকি! তো সেই ব্রিটিশের খেতাবপ্রাপ্ত পূর্বপুরুষের রক্ত বহনকারী ইরতাজুদ্দিন চৌধুরী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের গ্রামে আশ্রয় দেয়। যার ফলাফল হিসেবে অসংখ্য গ্রামবাসীকে হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হতে হয়।
এই বিষয়টির জন্য তার নাতনি সাহানা তাকে গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা বললে, সে অস্বীকৃতি জানায়। চলচ্চিত্রে পাকিস্তানি সেনাদের আশ্রয় দেয়ার মতো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো যুদ্ধ-দৃশ্য নেই, কিন্তু দাদা ও নাতনির এই কথোপকথনের মাধ্যমে পুরো বিষয়টিকে চলচ্চিত্রকার দর্শকের মগজে গেঁথে দেন। কারণ এটা তো শুধু ভাটি বাংলার বিষয় ছিল না, একাত্তরের যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে সারাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে। হুমায়ূন কিন্তু এই ঘটনার জন্য গ্রামবাসীর কাছে ইরতাজুদ্দিন চৌধুরীকে ক্ষমা চাওয়ালেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাস্তবতায় এই দৃশ্য বিরল বটে! এছাড়া ইরতাজুদ্দিন চৌধুরী তার পিতৃপুরুষের বাড়ি ও সকল সম্পত্তি হাসপাতাল করার জন্য দান করে। চৌধুরী কি তার অপরাধ মোচনের জন্য এই কাজ করে? এতে অবশ্য তার নাতনি ডাক্তার সাহানার প্রসঙ্গ আসে-যে ভবিষ্যতে এই গ্রামে এসে হাসপাতালে ডাক্তারি করতে চায়। তখন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র গাওদিয়া গ্রাম, শশী ডাক্তার, হাসপাতাল এ সকল বিষয় উঠে আসে। তবে কি হুমায়ূন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? সেক্ষেত্রে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র কুসুম, মতি, পরাণ, ডাক্তার এই নাম আর চরিত্রগুলো একটু অদল বদল হয়ে ‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’ জায়গা পেয়েছ বলা যায়। সে যাই হোক, আবার শ্রাবণ মেঘের দিনে ফেরা যাক।
তিনি মূলত ভাটি বাংলার বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। যে অঞ্চলে ডাক্তার নাই, হাসপাতাল নাই, বাহন একমাত্র নৌকা। ফলে গর্ভবতীর বাচ্চা প্রসবকালে মৃত্যুমুখে পতিত হলেও তাৎক্ষণিক করার কিছু থাকে না। ভাটি বাংলা কেন এমন?
‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের মূল কাহিনিটা আসলে কী? মতির প্রতি কুসুমের প্রেম, মতির গায়ক হওয়ার বাসনা, ভাটি বাংলার জীবনচিত্র, জমিদারের ডাক্তার নাতনির ইউটোপিয় ভাবনা প্রভৃতি বিষয়ের সমন্বয়ে কোলাজ তৈরি হয়েছে। ফলে একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কাহিনি এখানে নেই। কিন্তু হুমায়ূন যেহেতু বিচ্ছেদ আর বিরহের আবহ দেখাবেন তাই তিনি আরেকটি চরিত্র সুরুজকে হাজির করলেন। যার সঙ্গে কুসুমের বিয়ে ঠিক হলো। তো এই সুরুজও কিন্তু গায়ক। ফলে এখানে সুরুজকে মতির স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে কিন্তু কুসুমের মন তা মানেনি।
কুসুম চেয়েছিল মতির সঙ্গে গানের দল গড়ে দেশ-বিদেশ ঘুরবে। কিন্তু মতি তাতে অনাগ্রহ দেখায় ফলে বিয়ের দিন কুসুম বিষপান করে এবং মারা যায়। কুসুমের মৃত্যু ছাড়া কি কোনো উপায় ছিল না? সেক্ষেত্রে বলা যায়, মতির প্রতি কুসুমের ভালোলাগা হলো লাইফ ড্রাইভ, যা হাসি, আনন্দ, প্রেম, কাম সংক্রান্ত বিষয়কে যুক্ত করে। কুসুম সর্বদা মতিকে এভাবেই চেয়েছে। কিন্তু মতি যখন কুসুমের এই ভালোবাসা বা প্রেমের প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়েছে তখন বিষাদ এসে যুক্ত হয়েছে, যা ডেথ ড্রাইভের বৈশিষ্ট্য। কুসুম তার এই বিষাদ ব্যক্ত করতে পারেনি। কুসুমের মনের এই অব্যক্ত বাসনা বা আকাঙ্ক্ষা তার মনে ব্যথার উর্দ্রেক ঘটিয়েছে যেটা তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। ফলে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজেছে।
কুসুমের মৃত্যু দৃশ্যটি খেয়াল করা দরকার। বিষপানকারী কুসুমকে নৌকায় নিয়ে হাওর পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে মতি ও সুরুজ। নৌকা দুলছে, যেন কুসুমের প্রাণও দুলছে। কুসুমের পায়ের আলতা পানিতে ভেসে যাচ্ছে, কুসুমের প্রাণ পাখি উড়ে গেল। মতির হাত থেকে লগি পড়ে গেল। তারপর সে গান শুরু করল: ‘শোয়া চাঁন পাখি আমার শোয়া চাঁন পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি!’ ভাটি বাংলার নেত্রকোণা অঞ্চলের এই গান ছাড়া মতি-কুসুমের এই বিচ্ছেদ অপরিপূর্ণ থেকে যেত। তাই চলচ্চিত্রকার কুসুমকে দিলেন চিরকালীন বিচ্ছেদ, আর মতিকে দিলেন সেই বিচ্ছেদের সুর।
লেখক :
কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট