এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বিচ্ছিন্নতার পর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের মাধ্যমে বড় পরিসরে রাজনীতিতে ফেরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই সমাবেশ শুধু সাংগঠনিক শক্তির প্রদর্শনী নয়, বরং এটি ছিল একটি নতুন রাজনৈতিক কৌশল, আদর্শিক বার্তা ও নতুন বলয়ের সূচনার মঞ্চ। সাত দফা দাবি, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এবং পিআর ভোট ব্যবস্থার প্রস্তাব—সব মিলিয়ে জামায়াত একটি নতুন রাজনৈতিক ভূমিকায় আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন অনেকে।
মো. ইসতিয়াক
এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বিচারিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে থাকা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অবশেষে রাজনীতিতে ফিরেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশের মাধ্যমে। এই ফিরে আসা আসাকে মনে করা হচ্ছে জামায়াতের নতুনভাবে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা এবং নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের ইঙ্গিত। সমাবেশটি ছিল জামায়াতের ‘পুনর্জন্ম’—যেখানে তারা একদিকে সাত দফার মাধ্যমে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রূপরেখা দেয়, অন্যদিকে দুর্নীতিবিরোধী রাজনীতির অঙ্গীকার করে নিজেদের ‘আদর্শিক ইসলামি গণদল’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়।
সমাবেশে শুধু দলের সাংগঠনিক শক্তি দেখানো হয়নি—প্রথমবারের মতো একাধিক বিরোধী দলকে এক মঞ্চে এনে জামায়াত ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা চায় একটি নতুন ‘সংস্কারবাদী বিরোধী বলয়’ গঠন করতে। তবে সমাবেশে বিএনপির অনুপস্থিতি এবং আমন্ত্রণ ঘিরে সৃষ্টি হওয়া বিভ্রান্তি দেখিয়েছে, জামায়াত আর বিএনপি আগের মতো এক ছাতার নিচে নেই।
জামায়াতে ইসলামীর ঘোষিত সাত দফা মূলত নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের কাঠামোতে পরিবর্তন আনার আহ্বান। দলটির যুগ্ম মহাসচিব এ টি এম আজহারুল ইসলাম একে বলেছেন ‘রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা’।
প্রথম দাবিতে তারা ৫ আগস্টসহ বিগত সময়ে হতাহতের নানা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চেয়েছে—বিশেষ করে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শাল্লা ও পল্লবীর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দাবিতে বলা হয়েছে, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনে নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে হবে। তৃতীয় দফায় তারা ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জাতীয় নাগরিক চার্টার’ বাস্তবায়নের কথা বলেছে।
চতুর্থ দফায় জামায়াত চায় ২০২৪-২৫ সালের আন্দোলনে যারা নিহত বা আহত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন। পঞ্চম দাবিতে তারা প্রচলিত একক আসনের নির্বাচন বাতিল করে দলভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক (পিআর) ভোটব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে। ষষ্ঠ দফায় প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবি এসেছে, যাতে তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। সপ্তম দফায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, এই সাত দফা দাবির মাধ্যমে জামায়াত তাদের ধর্মীয় চিন্তাধারাকে ঠিক রেখে, একধরনের আধুনিক ও সংস্কারমূলক রাজনীতির বার্তা দিয়েছে। বিশেষ করে পিআর ভোটব্যবস্থার প্রস্তাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন আলোচনার সূচনা করেছে।
আগের লড়াইটা ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, এবার শুরু হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ। ডা. শফিকুর রহমান, আমির, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আগের লড়াইটা ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এবার শুরু হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, জামায়াত এখন পুরনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বাইরেও এগিয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চায়।
সাব্বির আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শফিকুর রহমানের ‘‘নেতৃত্বের বিলাসিতা থাকবে না, থাকবে দায়িত্ব’’ কথাগুলো তাদের নতুন রাজনৈতিক ভাবনার মূলে প্রস্তাবনা হিসেবে ধরা যেতে পারে। এতে বোঝা যায়, তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, জামায়াতের নেতৃত্ব কোনো বিলাসবহুল সুবিধা গ্রহণ করবে না—যেমন প্লট, শুল্কমুক্ত গাড়ি ইত্যাদি। বরং তারা জনগণের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করবে এবং রাজনীতিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিজ্ঞা করবে।’
সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, ‘এই বক্তব্যকে রাজনীতির নতুন ব্র্যান্ডিং হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে জামায়াত নিজেদেরকে একটি নীতিনিষ্ঠ, আদর্শভিত্তিক ইসলামি গণদল হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। বিশেষত বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্ম, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যেসব অনীহা ও অবিশ্বাস রয়েছে, সেই মনোভাব কাটিয়ে উঠতে জামায়াত এই বার্তাকে কেন্দ্র করে নিজেদের জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহর মতে, ডা. শফিকুর রহমানের এই বক্তব্য একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক চিন্তার প্রতীক, যেখানে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে অতীতের পুরোনো ও তিক্ত রাজনীতি থেকে। এতে নেতৃত্বের জবাবদিহিতা, সততা ও দায়িত্ববোধের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে একটি প্রলোভন হিসেবে কাজ করতে পারে।’
সার্বিকভাবে, এই দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধে জামায়াতের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা রাজনীতিকে সুস্থ ও স্বচ্ছ করে তুলতে চায়, যেখানে নেতৃত্ব দেবে তরুণ প্রজন্ম এবং দেশজুড়ে গড়ে উঠবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিরোধ। এই নতুন কৌশল জামায়াতকে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নেওয়া একটি ধাপ বলে মনে করা হচ্ছে।
সমাবেশ ঘিরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল, বিএনপি কি আমন্ত্রণ পেয়েছিল? জামায়াতের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আমরা বিএনপি ও অন্যান্য দলকে আমন্ত্রণ জানাই। ব্যক্তিগতভাবেও আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছি।’
কিন্তু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা কোনো আমন্ত্রণ পাইনি। আর জামায়াতের ‘পিআর পদ্ধতির’ প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত নই। আমরা চাই অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন।’
বিএনপির এই অবস্থান এবং সমাবেশে তাদের অনুপস্থিতি দেখায়, দুই দলের মধ্যে কৌশলগত দূরত্ব গভীর হয়েছে। জামায়াত যেখানে সংস্কার, প্রোপোরশনাল ভোট (পিআর) ও নতুন বলয়ে আগ্রহী; সেখানে বিএনপি আগের কাঠামোতেই ফিরে যেতে আগ্রহী।
তবে রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সমাবেশ শেষে হাসপাতালে অসুস্থ জামায়াত আমিরকে দেখতে যান। সাব্বির আহমেদের মতে, এই সাক্ষাৎকে এক ধরনের ‘সাময়িক সৌজন্য’ যা একদিকে সম্পর্কের সেতু না ভাঙার বার্তা দেয়, অন্যদিকে জামায়াতের রাজনৈতিক পুনরুত্থানে অস্বস্তির ইঙ্গিতও দেয়। এই সাক্ষাৎকে কি জামায়াতের প্রতি বিএনপির ‘নরম বার্তা’? নাকি এটি কেবলই কূটনৈতিক ভদ্রতা? এই প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয়।
জামায়াতের ডাকে সাড়া দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন ইসলামি দল ও সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান গাজী, এনসিপির আহ্বায়ক আখতার হোসেন, হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি, খেলাফত আন্দোলন এবং ইসলামী ঐক্যজোটসহ অন্তত ১২টি ছোট-বড় দল ও সংগঠনের প্রতিনিধি।
আখতার হোসেন বলেন, ‘এককেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনীতি আর চলবে না। আমাদের দরকার বিকেন্দ্রীকরণ এবং অংশগ্রহণ বাড়ানো।’ অন্যদিকে আতাউর রহমান গাজী বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি ছাড়া সঠিক গণতন্ত্র সম্ভব নয়। আমরা জামায়াতের এই প্রস্তাবকে সমর্থন করি।’
রাজনীতি বিশ্লেষক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে জামায়াত একটি নতুন ধর্মভিত্তিক ও সংস্কারমুখী নির্বাচনী বলয় গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তন জাতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন ধরনের ঐক্য ও দলীয় সমন্বয়ের পথ খুলে দিতে পারে।
এবি পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং গণসংহতি আন্দোলনের মতো বাম দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে পিআর পদ্ধতির সমর্থক। তারা বিশ্বাস করে, এই পদ্ধতিতে সব দলের ভালো প্রতিনিধিত্ব হয়। কিন্তু জামায়াতের গতকালের সমাবেশে এই দলগুলোকে আমন্ত্রণ দেওয়া হয়নি।
এবি পার্টির মুখপাত্র মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা কোনো আমন্ত্রণ পাইনি, যদিও আমরা আগেই পিআর পদ্ধতির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছি।’
এই নেতা আরও বলেন, ‘বাম দলগুলো মনে করছে, জামায়াত তাদের এড়িয়ে গিয়ে শুধু ইসলামি দলগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং ‘‘ইসলামি বলয়’’ গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। এর ফলে বাম ও অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা করছে।’
অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছে, জামায়াত সেখানে আদর্শিক ও সংগঠিত বিকল্প হয়ে উঠছে। তারা দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব এবং তরুণবান্ধব বার্তার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।’
সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, ‘যদি জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি এক প্ল্যাটফর্মে আসে, তাহলে এটি হবে দক্ষিণপন্থী সংস্কারবাদীদের একটি বড় রাজনৈতিক বলয়। এতে বিএনপি অনেকটাই একঘরে হয়ে যেতে পারে।’
সোহরাওয়ার্দীতে জামায়াতের সমাবেশ ছিল একাধিক মাত্রার রাজনৈতিক বার্তা বহনকারী। তারা দেখিয়েছে সাংগঠনিক শক্তি, তুলেছে বিকল্প নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাব, আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের নৈতিক অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করেছে। বিএনপির অনুপস্থিতি, ইসলামী দলগুলোর ঘনিষ্ঠতা এবং প্রশাসনের সহনশীলতা—সব মিলিয়ে এ সমাবেশ একটি নতুন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সূচনা হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন সাব্বির আহমেদ।
আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে এটি কি সত্যিই একটি নতুন মেরুকরণের পথ? নাকি পুরোনো কৌশলের নতুন মোড়ক? সময়ই বলবে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বিচারিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে থাকা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অবশেষে রাজনীতিতে ফিরেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশের মাধ্যমে। এই ফিরে আসা আসাকে মনে করা হচ্ছে জামায়াতের নতুনভাবে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা এবং নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের ইঙ্গিত। সমাবেশটি ছিল জামায়াতের ‘পুনর্জন্ম’—যেখানে তারা একদিকে সাত দফার মাধ্যমে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রূপরেখা দেয়, অন্যদিকে দুর্নীতিবিরোধী রাজনীতির অঙ্গীকার করে নিজেদের ‘আদর্শিক ইসলামি গণদল’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়।
সমাবেশে শুধু দলের সাংগঠনিক শক্তি দেখানো হয়নি—প্রথমবারের মতো একাধিক বিরোধী দলকে এক মঞ্চে এনে জামায়াত ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা চায় একটি নতুন ‘সংস্কারবাদী বিরোধী বলয়’ গঠন করতে। তবে সমাবেশে বিএনপির অনুপস্থিতি এবং আমন্ত্রণ ঘিরে সৃষ্টি হওয়া বিভ্রান্তি দেখিয়েছে, জামায়াত আর বিএনপি আগের মতো এক ছাতার নিচে নেই।
জামায়াতে ইসলামীর ঘোষিত সাত দফা মূলত নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের কাঠামোতে পরিবর্তন আনার আহ্বান। দলটির যুগ্ম মহাসচিব এ টি এম আজহারুল ইসলাম একে বলেছেন ‘রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা’।
প্রথম দাবিতে তারা ৫ আগস্টসহ বিগত সময়ে হতাহতের নানা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চেয়েছে—বিশেষ করে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শাল্লা ও পল্লবীর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দাবিতে বলা হয়েছে, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনে নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে হবে। তৃতীয় দফায় তারা ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জাতীয় নাগরিক চার্টার’ বাস্তবায়নের কথা বলেছে।
চতুর্থ দফায় জামায়াত চায় ২০২৪-২৫ সালের আন্দোলনে যারা নিহত বা আহত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন। পঞ্চম দাবিতে তারা প্রচলিত একক আসনের নির্বাচন বাতিল করে দলভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক (পিআর) ভোটব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে। ষষ্ঠ দফায় প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবি এসেছে, যাতে তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। সপ্তম দফায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, এই সাত দফা দাবির মাধ্যমে জামায়াত তাদের ধর্মীয় চিন্তাধারাকে ঠিক রেখে, একধরনের আধুনিক ও সংস্কারমূলক রাজনীতির বার্তা দিয়েছে। বিশেষ করে পিআর ভোটব্যবস্থার প্রস্তাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন আলোচনার সূচনা করেছে।
আগের লড়াইটা ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, এবার শুরু হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ। ডা. শফিকুর রহমান, আমির, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আগের লড়াইটা ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এবার শুরু হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, জামায়াত এখন পুরনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বাইরেও এগিয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চায়।
সাব্বির আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শফিকুর রহমানের ‘‘নেতৃত্বের বিলাসিতা থাকবে না, থাকবে দায়িত্ব’’ কথাগুলো তাদের নতুন রাজনৈতিক ভাবনার মূলে প্রস্তাবনা হিসেবে ধরা যেতে পারে। এতে বোঝা যায়, তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, জামায়াতের নেতৃত্ব কোনো বিলাসবহুল সুবিধা গ্রহণ করবে না—যেমন প্লট, শুল্কমুক্ত গাড়ি ইত্যাদি। বরং তারা জনগণের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করবে এবং রাজনীতিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিজ্ঞা করবে।’
সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, ‘এই বক্তব্যকে রাজনীতির নতুন ব্র্যান্ডিং হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে জামায়াত নিজেদেরকে একটি নীতিনিষ্ঠ, আদর্শভিত্তিক ইসলামি গণদল হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। বিশেষত বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্ম, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যেসব অনীহা ও অবিশ্বাস রয়েছে, সেই মনোভাব কাটিয়ে উঠতে জামায়াত এই বার্তাকে কেন্দ্র করে নিজেদের জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহর মতে, ডা. শফিকুর রহমানের এই বক্তব্য একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক চিন্তার প্রতীক, যেখানে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে অতীতের পুরোনো ও তিক্ত রাজনীতি থেকে। এতে নেতৃত্বের জবাবদিহিতা, সততা ও দায়িত্ববোধের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে একটি প্রলোভন হিসেবে কাজ করতে পারে।’
সার্বিকভাবে, এই দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধে জামায়াতের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা রাজনীতিকে সুস্থ ও স্বচ্ছ করে তুলতে চায়, যেখানে নেতৃত্ব দেবে তরুণ প্রজন্ম এবং দেশজুড়ে গড়ে উঠবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিরোধ। এই নতুন কৌশল জামায়াতকে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নেওয়া একটি ধাপ বলে মনে করা হচ্ছে।
সমাবেশ ঘিরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল, বিএনপি কি আমন্ত্রণ পেয়েছিল? জামায়াতের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আমরা বিএনপি ও অন্যান্য দলকে আমন্ত্রণ জানাই। ব্যক্তিগতভাবেও আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছি।’
কিন্তু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা কোনো আমন্ত্রণ পাইনি। আর জামায়াতের ‘পিআর পদ্ধতির’ প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত নই। আমরা চাই অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন।’
বিএনপির এই অবস্থান এবং সমাবেশে তাদের অনুপস্থিতি দেখায়, দুই দলের মধ্যে কৌশলগত দূরত্ব গভীর হয়েছে। জামায়াত যেখানে সংস্কার, প্রোপোরশনাল ভোট (পিআর) ও নতুন বলয়ে আগ্রহী; সেখানে বিএনপি আগের কাঠামোতেই ফিরে যেতে আগ্রহী।
তবে রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সমাবেশ শেষে হাসপাতালে অসুস্থ জামায়াত আমিরকে দেখতে যান। সাব্বির আহমেদের মতে, এই সাক্ষাৎকে এক ধরনের ‘সাময়িক সৌজন্য’ যা একদিকে সম্পর্কের সেতু না ভাঙার বার্তা দেয়, অন্যদিকে জামায়াতের রাজনৈতিক পুনরুত্থানে অস্বস্তির ইঙ্গিতও দেয়। এই সাক্ষাৎকে কি জামায়াতের প্রতি বিএনপির ‘নরম বার্তা’? নাকি এটি কেবলই কূটনৈতিক ভদ্রতা? এই প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয়।
জামায়াতের ডাকে সাড়া দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন ইসলামি দল ও সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান গাজী, এনসিপির আহ্বায়ক আখতার হোসেন, হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি, খেলাফত আন্দোলন এবং ইসলামী ঐক্যজোটসহ অন্তত ১২টি ছোট-বড় দল ও সংগঠনের প্রতিনিধি।
আখতার হোসেন বলেন, ‘এককেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনীতি আর চলবে না। আমাদের দরকার বিকেন্দ্রীকরণ এবং অংশগ্রহণ বাড়ানো।’ অন্যদিকে আতাউর রহমান গাজী বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি ছাড়া সঠিক গণতন্ত্র সম্ভব নয়। আমরা জামায়াতের এই প্রস্তাবকে সমর্থন করি।’
রাজনীতি বিশ্লেষক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে জামায়াত একটি নতুন ধর্মভিত্তিক ও সংস্কারমুখী নির্বাচনী বলয় গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তন জাতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন ধরনের ঐক্য ও দলীয় সমন্বয়ের পথ খুলে দিতে পারে।
এবি পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং গণসংহতি আন্দোলনের মতো বাম দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে পিআর পদ্ধতির সমর্থক। তারা বিশ্বাস করে, এই পদ্ধতিতে সব দলের ভালো প্রতিনিধিত্ব হয়। কিন্তু জামায়াতের গতকালের সমাবেশে এই দলগুলোকে আমন্ত্রণ দেওয়া হয়নি।
এবি পার্টির মুখপাত্র মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা কোনো আমন্ত্রণ পাইনি, যদিও আমরা আগেই পিআর পদ্ধতির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছি।’
এই নেতা আরও বলেন, ‘বাম দলগুলো মনে করছে, জামায়াত তাদের এড়িয়ে গিয়ে শুধু ইসলামি দলগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং ‘‘ইসলামি বলয়’’ গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। এর ফলে বাম ও অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা করছে।’
অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছে, জামায়াত সেখানে আদর্শিক ও সংগঠিত বিকল্প হয়ে উঠছে। তারা দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব এবং তরুণবান্ধব বার্তার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।’
সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, ‘যদি জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি এক প্ল্যাটফর্মে আসে, তাহলে এটি হবে দক্ষিণপন্থী সংস্কারবাদীদের একটি বড় রাজনৈতিক বলয়। এতে বিএনপি অনেকটাই একঘরে হয়ে যেতে পারে।’
সোহরাওয়ার্দীতে জামায়াতের সমাবেশ ছিল একাধিক মাত্রার রাজনৈতিক বার্তা বহনকারী। তারা দেখিয়েছে সাংগঠনিক শক্তি, তুলেছে বিকল্প নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাব, আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের নৈতিক অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করেছে। বিএনপির অনুপস্থিতি, ইসলামী দলগুলোর ঘনিষ্ঠতা এবং প্রশাসনের সহনশীলতা—সব মিলিয়ে এ সমাবেশ একটি নতুন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সূচনা হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন সাব্বির আহমেদ।
আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে এটি কি সত্যিই একটি নতুন মেরুকরণের পথ? নাকি পুরোনো কৌশলের নতুন মোড়ক? সময়ই বলবে।
সারাদেশের নেতাকর্মীরা যাতে নির্বিঘ্নে রাজধানীতে আসতে পারেন এ জন্য ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম থেকে চার জোড়া বিশেষ ট্রেন ভাড়া করেছে দলটি। এই ৪ ট্রেন ভাড়া করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা। এছাড়াও ১০ হাজারের বেশি যাত্রীবাহী বাস বুকিং করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
১ দিন আগেসমাবেশে বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ পরস্পর ঐক্য গড়ার গুরুত্ব তুলে ধরবেন। যেসব ইসলামপন্থী দল কখনো জামায়াতের সঙ্গে একছাতার নিচে আসেনি তারাও সমাবেশে আমন্ত্রণ পেয়েছে।
২ দিন আগেজাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে। তবে সংসদের উচ্চকক্ষের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য বেশি। নারী আসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার মতো কয়েকটি বিষয় সংস্কারেও দলগুলো একমত।
৩ দিন আগে১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস। এই দিবসকে বিশ্বব্যাপী আইন ও মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশে ন্যায়বিচার কতটা দৃশ্যমান? ওয়ালিদের মতো শিশুহত্যায় বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা—আমাদের ন্যায়বিচারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবিয়ে তোলে।
৩ দিন আগে