leadT1ad

নির্বাচিত সরকার থাকলেই কি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

স্ট্রিম গ্রাফিক

নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেই কি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকে

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্থির দামের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ, ডিম ও ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের দাম প্রায়শই ওঠানামা করে। সম্প্রতি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত এক বৈঠকের পর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সমস্যায় পড়ছে।

তিনি বলেন, ‘শুধু জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) দিয়ে বাজার তদারকি করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এই সমস্যার টেকসই ও কার্যকর সমাধানের জন্য একটি রাজনৈতিক দলীয় ও নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। কারণ রাজনৈতিক সরকারের যে নৈতিক ক্ষমতা, সাংগঠনিক কাঠামো এবং তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী থাকে, তা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নেই।’

ড. আহমেদ উল্লেখ করেন যে বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেট ও অস্থিরতা—যেমন সাম্প্রতিক চালের দাম বৃদ্ধি—নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজন হয়। তার বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে নির্বাচিত দলের মাঠপর্যায়ের কর্মী ও সাংগঠনিক শক্তি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশি কার্যকর।

এই মন্তব্য আসল এমন সময়ে, যখন চাল, তেল, পেঁয়াজ এবং অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে (আগস্ট ২০২৪ থেকে দায়িত্বে থাকা ড. ইউনুস নেতৃত্বাধীন সরকার) আবার বেড়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ড. আহমেদের বক্তব্য কতটা সঠিক? ইতিহাস কী বলে? দ্রব্যমূল্য কি কেবল নির্বাচিত সরকারের অধীনেই স্থিতিশীল থাকে?

ইতিহাস যা দেখায়

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি, বিভিন্ন সময়ে ওঠানামা করেছে। কারণ হিসেবে ছিল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কা, সরবরাহ ব্যবস্থার ঘাটতি, সিন্ডিকেটের প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ নীতি বিষয়ক সমস্যা। সরকার নির্বাচিত হোক বা অন্তর্বর্তী—এই ওঠানামা সব সময়ই দেখা গেছে।

২০০১-০৬ সময়কালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের অধীনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫-৭ শতাংশ। শুরুর দিকে দাম স্থিতিশীল ছিল, তবে পরে সিন্ডিকেট-প্রভাবিত মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে।

২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার (সামরিক-সমর্থিত) আমলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯-১২ শতাংশে পৌঁছে। বৈশ্বিক খাদ্য-সংকটের সময় চালের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়। যদিও তারা কয়েকজন সিন্ডিকেট নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল, তবুও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে ব্যর্থ হয়।

২০০৯-১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মূল্যস্ফীতি ৬-১০ শতাংশের মধ্যে থাকে। ২০১১ সালে জ্বালানি-দামের সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি ১০.৬ শতাংশে ওঠে। এই সময়ে সিন্ডিকেট কার্যক্রম অব্যাহত ছিল, কিন্তু মধ্যপর্বে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয়।

২০১৫-২১ সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ ছিল। এটি ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কম মূল্যস্ফীতি থাকার সময়। তবে সমালোচকরা অভিযোগ করেন—এ সময় অনেক তথ্য গোপন বা ‘সমন্বয়’ করা হয়েছিল।

২০২২ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্যের দাম ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট এবং আমদানি-নির্ভর বাজারের চাপ সাধারণ মানুষের ওপর বড় অভিঘাত তৈরি করে। পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ২৪০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মজুতদারির অভিযোগ ওঠে।

২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার আমলে মূল্যস্ফীতি ৯-১১ শতাংশ থেকে কমে ৮.৫-৯.৯ শতাংশের মধ্যে নেমে আসে। চাল আমদানির অনুমতি বাজার স্থিতিশীল করে, যদিও খাতভিত্তিক চাঁদাবাজি বাড়ার অভিযোগও ছিল।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচিত সরকারের সময়ই সবসময় দাম নিয়ন্ত্রণ হয়েছে—এমন প্রমাণ নেই। ২০১১ এবং ২০২২-২৪ সালের বড় দামবৃদ্ধি নির্বাচিত সরকারের আমলেই ঘটেছে। আবার সবচেয়ে খারাপ মূল্য-উল্লম্ফন ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেখা গেলেও এর বড় কারণ ছিল বৈশ্বিক খাদ্যসংকট। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও উচ্চ মূল্যস্ফীতি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে এবং তা কিছুটা কমাতে সক্ষমও হয়েছে।

রাজনৈতিক সরকার অনেক সময়ই সিন্ডিকেটকে শক্তিশালী করে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে বলা হয়, রাজনৈতিক সরকারের মাঠপর্যায়ের কর্মীরা বাজার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু বহু বিশেষজ্ঞের মতে, এই নেটওয়ার্কই কখনও কখনও দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও মূল্য নিয়ে কারসাজিকে প্রশ্রয় দেয়।

বিএনপির দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সিন্ডিকেটগুলো ক্ষমতাসীনদের প্রভাব-বলয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ২০০১-০৬ সময়ের বিএনপি আমলে ‘হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের’ বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ তোলে।

নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান সিপিডি দেখিয়েছে, মূল্যস্ফীতির কারণে শহরবাসীর খাদ্যব্যয় ২৭-৩৮ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব অনেক সময় মজুতদার ও দুর্নীতির চক্রকে রক্ষা করে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও বারবার উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের বাজারে শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রয়েছে, যা অনেক সময় সরকারের কর্তৃত্বকে দুর্বল করে।

২০২৫ সালে অনেক প্রতিবেদনেই বলা হয়, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আবার স্থানীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।

অন্যদিকে কিছু বিশেষজ্ঞ আবার বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত না হওয়ায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় সরাসরি চাপ প্রয়োগ বা কঠোর নজরদারি কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন হচ্ছে। ফলে কিছু নিত্যপণ্যের দাম এখনো সাধারণ মানুষদের নাগালের বাইরে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যেমন মনে করেন, চালের সাম্প্রতিক অস্থিরতা প্রশাসনিক উদ্যোগ দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। তার মতে, বাজার-সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাজনৈতিক সরকারের মাঠপর্যায়ের কর্মী প্রয়োজন। এই কর্মীরাই মজুতদারের বিরুদ্ধে অভিযান বা চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

তবে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ. মনসুর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের অভাবে বাজারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। তবে নির্বাচিত সরকারও বহু সময় নিজস্ব গোষ্ঠীগত স্বার্থকে রক্ষা করে, যা ২০২২-২৪ সময়ে স্পষ্ট হয়েছিল।

সিপিডির অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ শুধু মাঠপর্যায়ের কর্মী থাকার ওপর নির্ভর করে না। প্রয়োজন স্বচ্ছ সরকারি ক্রয়, সঠিক রিজার্ভ-ব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি দমন। তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ সালের প্রবণতায় দেখা গেছে, সঠিক নীতির প্রয়োগে অন্তর্বর্তী সরকারও মূল্যস্ফীতি কমাতে সক্ষম হয়েছে।

কেন রাজনৈতিক সরকারকে অনেক সময় কার্যকর মনে হয়

রাজনৈতিক সরকারের একটি বিস্তৃত মাঠপর্যায়ের নেটওয়ার্ক থাকে। দলের নেতাকর্মীরা প্রতিদিন বাজার মনিটর করতে পারে। ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ভয় পায়, যা অনেক সময় প্রশাসনের চেয়ে বেশি কার্যকর। দলীয় যোগাযোগের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত, সাহায্য বা সতর্কতা দেওয়া সম্ভব হয়।

কেন তারা ব্যর্থ হয়?

কিন্তু অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশই আবার সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করে। তারা নিজেরাই বাজারে ‘কাটমানি’ বা চাঁদাবাজির মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। তাই অনেক সময় রাজনৈতিক সরকারও সিন্ডিকেটকে রক্ষা করে। শক্তিশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দলীয় প্রভাব ব্যবহার করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি, ডলারের ঘাটতি, আমদানি-ব্যয় বৃদ্ধি এবং দুর্বল বাজার-ব্যবস্থাপনা, এসব আবার পণ্যমূল্যকে রাজনৈতিক সরকারের ধরণ থেকে বেশি প্রভাবিত করে। বৈশ্বিক সংকট, যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ বা ডলার ঘাটতি রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার শুল্ক কমানো এবং আমদানি বাড়ানোর মাধ্যমে বাজারে চাপ কমানোর চেষ্টা করছে। তবে জনগণের হতাশাও বাড়ছে, কারণ বাজার এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আংশিকভাবে সঠিক। নির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক শক্তি অনেক সময় বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। তবে ইতিহাস বলে, দ্রব্যমূল্য শুধু নির্বাচিত সরকার থাকলেই নিয়ন্ত্রিত থাকে না। নির্বাচিত এবং অন্তর্বর্তী—উভয় সরকারের আমলেই দামে বড় উল্লম্ফন দেখা গেছে। সফল নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করে স্বচ্ছ নীতি, সিন্ডিকেট দমন এবং বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর—সরকারের ধরণ বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর নয়।

অতীতে বহুবার নির্বাচিত সরকারের আমলেই সিন্ডিকেট শক্তিশালী হয়েছে এবং বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। তাই প্রকৃত সমাধান রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর নয়; বরং সিন্ডিকেট ভাঙা, স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশ, বাজার-ব্যবস্থার সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠানগত জবাবদিহির মাধ্যমেই সম্ভব।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে মূল্যস্ফীতি ৮.১৭ শতাংশে নামায় তারা কিছুটা অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে। নির্বাচিত সরকার হয়তো রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে দ্রুত ফল দেখাতে পারে। তবে তা তখনই সম্ভব, যখন তারা নিজেদেরই পৃষ্ঠপোষক সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রস্তুত থাকবে।

বাংলাদেশ যখন ২০২৬ সালের প্রথমদিকে সম্ভাব্য নির্বাচনমুখী হচ্ছে, তখন আসল প্রশ্ন হলো—পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার কি সত্যিই সেই ‘টেকসই সমাধান’ দিতে পারবে, যার আশা ড. সালেহউদ্দিন জানিয়েছেন?

Ad 300x250

সম্পর্কিত