বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, এখানে একক শক্তিতে পথচলা প্রায় অসম্ভব। ক্ষমতার মঞ্চে টিকে থাকতে হলে কিংবা নির্বাচনে জিততে হলে, এমনকি রাজপথেও সঙ্গী প্রয়োজন। এই সঙ্গী খোঁজার প্রক্রিয়া হলো জোটের রাজনীতি। আদর্শের মিল, ক্ষমতার লোভ, কখনও অস্তিত্বের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের হাত ধরে। ভোটের আগে আসন ভাগাভাগি, ক্ষমতায় গেলে অংশীদারিত্ব, বাইরে থাকলে যুগপৎ আন্দোলন– তিন সূত্রে বাঁধা বাংলাদেশের জোটের রাজনীতি।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিটি বাঁকে জোটবদ্ধতার খেলা চলেছে। কখনও তা এনে দিয়েছে অভাবনীয় সাফল্য, কখনও জন্ম দিয়েছে তিক্ততা। কিন্তু কেন, কবে থেকে জোটের রাজনীতি বাংলাদেশে এত অপরিহার্য হয়ে উঠল? এর পেছনের মনস্তত্ত্বই বা কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের তাকাতে হবে দেশের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক ইতিহাসে।
শেকড়ের সন্ধান: স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের গর্ভে জন্ম
জোটের রাজনীতির আনুষ্ঠানিক ও সবচেয়ে সফল অধ্যায়ের সূচনা স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের আকাঙ্ক্ষা থেকে। স্বাধীনতার পরপরই দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা হোঁচট খায়। বিশেষ করে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ‘বাকশাল’ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকারের রক্তাক্ত পতনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা ও অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার কেন্দ্রে হাজির হন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
প্রয়াত রাজনীতিক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর ‘চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমান একদলীয় ‘বাকশাল’ শাসনব্যবস্থা বাতিল করে দেশে পুনরায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে এনেছিলেন। তার সমর্থকদের কাছে এটি ছিল গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান তাঁর ‘বাংলাদেশ পলিটিক্স প্রবলেম অ্যান্ড ইস্যুজ’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘এটি ছিল মূলত সামরিক শাসনের বেসামরিকীকরণের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, সামরিক ছত্রছায়ায় থেকেই জিয়াউর রহমান গণভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের শাসনকে গণতান্ত্রিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই কারণেই অনেক সমালোচক তাঁর শাসনকে ‘গণতন্ত্রের মোড়কে সামরিক শাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।’
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর চরিত্র বদলে যায় জোটবদ্ধ রাজনীতির। জোটের মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যাওয়া। এই পর্বে হাজির হয় আদর্শের সঙ্গে সুবিধাবাদের জটিল সংমিশ্রণ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।
জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর, গণতন্ত্রের সেই পরীক্ষামূলক যাত্রা আবারও বাধাগ্রস্ত হয়। এবার কোনো রাখঢাক ছাড়াই সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এই স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রথমবারের মতো নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে একমঞ্চে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
আশির দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি পৃথক জোট করে রাজপথে নামে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে আটটি এবং বিএনপির সঙ্গে ছিল সাতটি দল। বামপন্থিরাও পাঁচ-দলীয় জোট করে। আদর্শিকভাবে ভিন্ন মেরুতে থাকলেও, সবার অভিন্ন লক্ষ্য ছিল; স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার।
তিন জোটের সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। এটিই ছিল জোটবদ্ধ রাজনীতির প্রথম ও গৌরবোজ্জ্বল সফলতা। এই আন্দোলনের ফসল তিন জোটের রূপরেখা; পরে সে অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরে বাংলাদেশ।
আদর্শের বিসর্জন ও সুবিধাবাদের উত্থান
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর চরিত্র বদলে যায় জোটবদ্ধ রাজনীতির। জোটের মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যাওয়া। এই পর্বে হাজির হয় আদর্শের সঙ্গে সুবিধাবাদের জটিল সংমিশ্রণ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। এর প্রতিক্রিয়া ও পরের নির্বাচন লক্ষ্যবস্তু করে আন্দোলনের জন্য আওয়ামী লীগ জোট করে বামপন্থিদের সঙ্গে। পরে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আন্দোলনে শামিল হয় জামায়াত, এমনকি জাতীয় পার্টিও।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি বিতর্কিত নির্বাচন করলেও বিরোধীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ওই সংসদ শুধুমাত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সংসদে পাস করেছিল। এরপর তাদের অধীনে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
তবে জোটের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বাঁকটি আসে ১৯৯৯ সালে। আওয়ামী লীগকে হটাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি (এরশাদের একটি অংশ) ও ইসলামী ঐক্যজোট মিলে গঠন করে চার-দলীয় জোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে এই জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।
পরে আওয়ামী লীগও নিজেদের জোটকে প্রসারিত করে। বামপন্থি দল, জাতীয় পার্টি (এরশাদের অন্য অংশ), জাসদ ও অন্যান্য সমমনাদের নিয়ে গঠন করে ১৪-দলীয় মহাজোট। এই জোট গঠনেও ছিল ক্ষমতার একই সমীকরণ।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি এবং আরও কয়েকটি ছোট দল মিলে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ২০১৮ রাতের ভোটের নির্বাচনের কারণে এই জোট নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি ও নির্বাচনের পরেই এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
একচ্ছত্র আধিপত্য ও জোটের অপ্রাসঙ্গিকতা
২০০৮ সালের নির্বাচনে ১৪-দলীয় মহাজোট বিজয়ী হয়। তবে এবার জোটের রাজনীতি ভিন্ন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কার্যকারিতা হারাতে শুরু করে জোটের রাজনীতি। মহাজোট কাগজে-কলমে টিকে থাকলেও, সরকারের নীতি নির্ধারণে তাদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। বামপন্থি দলগুলো সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও, ক্ষমতার বলয় থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি।
অন্যদিকে, ক্ষমতার বাইরে থাকা চার-দলীয় জোটও ধীরে ধীরে দুর্বল ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। চার-দলীয় জোটের অবলুপ্তি হলেও পরে ২০-দলীয় জোট হয় বিএনপির নেতৃত্বে। টানা দুটি সংসদে এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলে পরিণত হয়।
এই সময়ে জোটের রাজনীতির আরেকটি ভিন্ন রূপ দেখা যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি এবং আরও কয়েকটি ছোট দল মিলে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ২০১৮ রাতের ভোটের নির্বাচনের কারণে এই জোট নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি ও নির্বাচনের পরেই এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।
নতুন সমীকরণের হাতছানি
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে আমূল বদলে দিয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ও দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা– এই দুই বাস্তবতার মাঝে জোটের রাজনীতি অভূতপূর্ব এবং জটিল সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো শত্রু-মিত্রের হিসাব-নিকাশ এখন অনেকটাই অচল। দেশের মানুষ এখন আর কেবল দুটি প্রধান জোটের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার বৃত্তে আটকে থাকতে চাইছেন না। এই পরিস্থিতিতে জোটের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কয়েকটি সম্ভাব্য ধারায় প্রবাহিত হতে পারে, যার প্রতিটিই দেশের জন্য এক নতুন সমীকরণের হাতছানি দিচ্ছে।
এই জোট গঠনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থিরা হয়ত বুঝতে পারছে, বড় দলগুলোর ছায়ায় থেকে তাদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হয়েছে। এখন নিজেদের স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তারা।
আলোচিত সম্ভাবনা হলো তৃতীয় ধারার উত্থান, যার কেন্দ্রে রয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা প্রচলিত রাজনীতির বাইরে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছে। এনসিপির মূল শক্তি, জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের জনপ্রিয় করে তুলেছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এনসিপি সুসংহত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বা জোট করতে পারে, তবে তা দেশের প্রচলিত দ্বি-দলীয় রাজনীতির জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, বিএনপিকেন্দ্রিক জোটের পুনর্গঠন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় বিএনপির সামনে সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি সহজেই বিজয়ী হবে। তবে নিরঙ্কুশ বিজয় পেতে বেগ পেতে হবে। ফলে বিএনপিকে সরকার গঠনের জন্য ভোটের জোটে এগোতে হবে। তারা এরই মধ্যে ইসলামপন্থি ও বাম ঘরানার দল নিয়ে নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে নিজেদের ভাবমূর্তিকে আরও গ্রহণযোগ্য করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের বড় অংশ নিজেদের ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করবে।
তৃতীয় সম্ভাবনা হলো– জুলাইয়ের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জামায়াত নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনীতি নিয়ে হাজির হচ্ছে। তারা সমমনা ‘আট দল’ নামে ইসলামপন্থিদের নিয়ে পিআর, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দাবিতে আন্দোলন করেছে। এখন তাদের লক্ষ্য ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আসন সমঝোতা। জামায়াতের সঙ্গে এই জোটে রয়েছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।
এই জোট গঠনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থিরা হয়ত বুঝতে পারছে, বড় দলগুলোর ছায়ায় থেকে তাদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হয়েছে। এখন নিজেদের স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তারা।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এবং শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ প্রমাণ করে, জনগণ এখন সত্যিকারের পরিবর্তন চায়। ভবিষ্যতের জোটের রাজনীতিকে সফল হতে হলে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট, জনকল্যাণমুখী ও গণতান্ত্রিক সংস্কার কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে হবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, মওদুদ আহমদের ‘চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা’ ও রওনক জাহানের ‘বাংলাদেশ পলিটিক্স প্রবলেম অ্যান্ড ইস্যুজ’।