টিকটক এখন আর খালি কনটেন্ট বানানোর অ্যাপ না, বরং একটা আলাদা ‘ডিজিটাল সমাজ’। এই সমাজে ‘ফর ইউ’ হইল সোশ্যাল মবিলাইজেশন ও সাকসেসের সিঁড়ি, ‘কপি লিঙ্ক শেয়ার’ হইল সাপোর্ট সিস্টেম, ‘মিলন মেলা’ হইল বন্ধুত্বের প্রমাণ, আর ‘দাদুভাই কালচার’ হইল স্পর্শকাতর ও একান্ত আবেগের জায়গা।
তারিকুর রহমান অনি
টিকটক হইল এখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারের প্ল্যাটফর্ম। সোশ্যাল মিডিয়ার এই ভার্শনটা এমন যে আপনি দুইটা ট্যাপ দিলেই একটা ভিডিও বানায়া আপলোড করতে পারবেন। ক্যামেরা, এডিটিং, মিউজিক, ট্রেন্ডি সাউন্ড সব এক জায়গায়। এই প্ল্যাটফর্মে কিছু ট্রিক এপ্লাই কইরা ভাইরালও হইয়া যাইতে পারবেন দ্রুত। এইজন্য এই অ্যাপে সবচেয়ে বেশি ইউজার এক্টিভ। সহজ ইন্টারফেস আর অ্যাক্সেসিবিলিটির জন্য টিকটক এখন গ্লোবাল ফেনোমেনা তো হইছেই, বাংলাদেশেও একটা আলাদা সোশ্যাল কালচার তৈয়ার কইরা ফেলছে।
আপনি যদি এখনই একটা টিকটক আইডি খোলেন, সেইখানে আপনি ভিডিও আপ করতে পারবেন সাথে সাথে। প্রক্রিয়াটা সহজ। ট্রেন্ডি সাউন্ড সিলেক্ট কইরা, সিঙ্ক কইরা দিতে পারবেন। এইভাবে কোটি কোটি ক্রিয়েটর প্রতিদিন নতুন নতুন ভিডিও বানায়, কেউ লিপসিং কইরা, কেউ ডায়লগ দিয়া এক্টিং কইরা। চাইলে ট্রেন্ডিং সাউন্ড ব্যবহার করতে পারবেন, ফিল্টার দিতে পারবেন, ক্যাপশন লেইখা একটা ‘র’ ভিডিও ছাইড়া দিতে পারবেন। কনটেন্টের বিষয় হইতে পারে যেকোন কিছু, র্যান্ডম কথা, নিজের ট্যালেন্ট, কোন জায়গার ভ্রমণ, ডায়লগ লিপসিং, বা শুধু ‘ভাইব দিয়া’ ক্যামেরার দিকে তাকায়া থাকা।
এইখানে একদিকে যেমন ক্লাস ফাইভে পড়া পোলাপান আছে, তেমনই দেখা যায় অন্যদিকে আছেন দাদা/ চাচা/ মামা/ নানা বয়সের মানুষজন। সোজা কথায় টিনএজার থেইকা ষাটোর্ধ সবাই। এবং তারা সবাই একেকটা সাব-কমিউনিটির অংশ। টিকটকের এই ‘সব বয়সের মিলন’ নিজেই একটা কালচার গইড়া তুলছে। এই মিশ্র বয়সের মানুষজন মিলা এখানে গইড়া উঠতেছে একেকটা সাব-কমিউনিটি।
তবে একটা জিনিস সব ভিডিও ক্রিয়েটররাই চায়, ভিডিওটা যেন ‘ফর ইউ’ অপশনে আসে। টিকটকের ইউজারদের একটা বড় অংশ এই বিষয়টা নিয়া খুব কনসার্নড, ভিডিও ফর ইউতে যাওয়া। ‘ফর ইউ’ অপশনটা হইল টিকটকের মেইন ডিসকভারি ফিড। এখানে এলগরিদম যেই কনটেন্টরে মনে করে অন্যদের পছন্দ হইবে, সেইগুলা সাজেস্ট করে। ফর ইউ-তে আপনার ভিডিও যাওয়া মানে অনেক ইউজার অটোমেটিক আপনার ভিডিও দেখবে। ফর ইউতে ভিডিও গেলে সেটা এমনভাবে এক্সপোজার পায় যেইখানে ইউজার নিজে কিছু না করলেও হাজার হাজার মানুষ দেইখা ফেলে। অনেক সময় ভিডিওর ভিউ এক রাতেই লাখ ছাড়ায়ে যায়। এইটা একটা ছোটখাটো ভাইরাল হওয়ার লটারির মতো। তাই সবার কমন লক্ষ্যই থাকে ‘ফর ইউ’ তে যাওয়া।
এখন এই ফর ইউ’তে যাবার জন্য মানুষজন নানান ট্রিক ফলো করে। সবচেয়ে কমন কয়েকটা উপায় হইল: ভিডিও আপ করার পরপরই কমিউনিটির মানুষজন সেই ভিডিওতে লাইক দেবে, কমেন্ট করবে, ভিডিওটা সেইভ করবে, লিংক কপি করে শেয়ার করবে। এই লিঙ্ক শেয়ার করাকে তারা বলে ‘কপি লিঙ্ক শেয়ার’ বা ‘কপিলিঙ শেয়ার’।
এই ‘কপি লিঙ্ক শেয়ার’ বা তাদের ভাষায় ‘কপিলিঙ শেয়ার’ হইল একটা রিচ ট্রিক। ভিডিওর লিংকটা কেউ কপি কইরা শেয়ার করলে, সেই লিংক থেইকা যদি কেউ টিকটকে ঢোকে, টিকটকের এলগরিদম ধইরা নেয় যে এই ভিডিওটা অন্যদের কাছে ইন্টারেস্টিং, তাই এইটা বড় সংখ্যক অডিয়েন্সের সামনে দেয়া যায়।
যেই ভিডিওতে বেশি শেয়ার, বেশি সেইভ, বেশি কমেন্ট হয় ঐ ভিডিওর ফর ইউতে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি। এই অ্যাকশনগুলা যত বেশি হয়, টিকটকের এলগরিদম ধইরা নেয় এই ভিডিওতে মানুষ আগ্রহী। আর তখনই ভিডিও চইলা যায় ফর ইউতে। ফলে, ফর ইউতে যাওয়া যতটা না কন্টেন্ট কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে, তার চাইতে বেশি নির্ভর করে কমিউনিটির ভূমিকা উপর।
এইখানেই গইড়া উঠছে একেকটা কমিউনিটি। একেকটা কমিউনিটির লোকজন নিজেদের ভিডিও রিচ বাড়ানোর জন্য দলবাইধা কন্ট্রিবিউশন করে। কেউ ভিডিও দিলেই অন্যরা সেটা ফর ইউতে নিয়া যাইতে হেল্প করে। লাইক, কমেন্ট, সেইভ, কপিলিঙ শেয়ার সবকিছু একসাথে করে। যেন একটা টিম ওয়ার্ক। এইখানেই আসে কমিউনিটি কালচারের ব্যাপারটা। টিকটকে আপনি দেখবেন একেকটা গ্রুপ একেক রকম কন্টেন্ট করে, আর তাদের মধ্যে গইড়া উঠে এক ধরনের সম্পর্ক, জড়তা মুক্ত সহজ বন্ধুত্ব। যারা একে অপরের কাছে সাপোর্ট চায়।
এমনই একটা ভাইরাল টিকটক আছে; কথাটা এমন ‘সাপোর্ট করলে সাপোর্ট পাইবা, না করলে কিছুই পাইবা না, জিরো। আর তোমরা যারা কমেন্ট করো, ভাইয়া আমাকে সাপোর্ট করো! তোমাদেরকে বলতে চাই, আমার কয়টা ভিডিওতে তুমি সাপোর্ট করছো? আগে সেটা বলো।’
এই কমিউনিটিগুলার মধ্যে কিছু সাব-কমিউনিটিও আছে, কিশোর গ্যাংও একটা সাব কমিউনিটি। এদের কালচার হইল ডিজে গান, দেশীয় অস্ত্র, বোট পার্টি, ধামার মহড়া এইসব নিয়া ভিডিও বানানো। এদের বয়স প্রায় ১৩ থেইকা ২২ এর ভিতরে। এদের জন্য টিকটক একটা এক্সপ্রেশন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা তাদের গ্যাঙয়ের ব্র্যান্ডিং করে।
‘মিলন মেলা’ এই কালচারের একটা হাইলাইটেড ইভেন্ট। এই মিলনমেলাগুলা সাধারণত আয়োজন করে সেই সব টিকটকার যারা একটু বেশি জনপ্রিয়। লাইক, ফলোয়ার, ভিউ বেশি। তারা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একটা গ্যাদারিং অর্গানাইজ করে, যেইখানে টিকেট কাইটা অংশগ্রহণ করতে হয়। সেই টিকিটে থাকে দুপুরের খাওয়া, বিকালের নাস্তা, মোরগ পোলাওয়ে বাড়তি ঝোল বা ডিম থাকবে কি থাকবে না এইসব অলরেডি টিকেটে ডিটেইলে লেখা থাকে। মেলায় কমিউনিটি/গ্রুপের নাম প্রিন্ট করা গেঞ্জি দেয়া হয়, ছোট বড় টিকটকাররে সম্মান জানাইয়া ক্রেস্ট দেয়া হয়, সবাই কোলাব করে ভিডিও বানায়, একসাথে লাইভে আসে। এইসব মিলন মেলা কমিউনিটির ভিতরে এক ধরণের ইনভলভমেন্ট বাড়ায়, বন্ধুত্ব তৈয়ার করে।
এছাড়া ফর ইউতে যাওয়া ক্রিয়েটরের সাথে কোলাব করার একটা চর্চাও আছে। যে কেউ যদি ফর ইউতে গিয়া ভাইরাল হয়, ছোট ক্রিয়েটররা তারে খুঁইজা বাইর করে, ভিডিও বানায়, বন্ধুত্ব করে। এইভাবে তারা নিজেরাও রিচ বাড়ায়।
আরেকটা সাব কমিউনিটিতে একটা ভিন্ন লেভেলের কালচার তৈয়ার হইছে, ‘দাদুভাই কালচার’।
এই দাদুভাই কালচার এমন এক ইউনিক কালচার, যেইখানে কিছু বয়স্ক ও ইয়াং মানুষ পার্টিসিপেট করে, একে অন্যরে ভালোবাইসা ‘দাদুভাই ’ বইলা ডাকে। আবার অনেকে ‘দাদুভাই’ শব্দটারে ব্যবহার কইরা তাদের মাঝে এক ধরনের সংযোগ তৈয়ার করে।
দেখা যায়, এক বুড়া লোক টাঙ্গাইল থেইকা একটা ভিডিও দিল, সেখানে বরিশালের কোনো ছেলে কমেন্ট করে ‘প্রিয় দাদুভাই আমার’। তখন দাদুভাই কমেন্টে রিপ্লাই দেয়, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই’। দাদুভাই নাম্বার চায়, কোথায় থাকে জিজ্ঞাস করে।
টিকটকে এই দাদুভাই কালচারে যুক্ত মূলত দুই ধরনের মানুষ আছে:
১. যারা বয়সে সত্যিই দাদু টাইপ অর্থাৎ ৫০+
২. যারা ছোট বা ইয়াং, কিন্তু তারা ‘দাদুভাই ’ বইলা অন্য বয়স্কদের ডাকে এবং সেই সম্বন্ধে এক ধরনের আবেগে জড়ায়। যারা ‘দাদুভাই ’ সম্বোধনটা রোমান্টিসাইজ করে।
এখানে মেয়েদের কোনো পার্টিসিপেশন নাই। দাদুভাই কালচার পুরাই বয়েজ ডমিনেটেড, ব্যাটাদের মহল। তবে এইখানে সম্পর্ক, মান-অভিমান, ভালোবাসা, কষ্ট—সবকিছুই আছে, যা এক রকম রিলেশনশিপ স্টাইলেই গইড়া উঠে। এক দাদুভাই আরেক দাদুভাই কে মিস করে। দেখা করার জন্য ঢাকা টু বরিশাল বা কুমিল্লা টু ঢাকা চইলা যায়।
দাদুভাই দের বড় একটা অংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেইকা আসা। তারা সাধারণত স্মার্টফোন-ইন্টারনেট অ্যাক্সেস রাখলেও ডিজিটাল লিটারেসি সীমিত। বাংলাদেশের সোশ্যাল নর্ম অনুযায়ী বয়স্ক পুরুষদের অনলাইন বা পাবলিক স্পেসে থাকা সহজ। একই বয়সী নারীরা সাধারণত পরিবারে সীমাবদ্ধ থাকেন, অনলাইনে প্রকাশ্য হতে দ্বিধা বোধ করেন বা সামাজিক বাধা বেশি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বন্ধুবান্ধব কইমা যায়, পরিবারে গুরুত্ব কমে, আর সমাজেও বয়সভিত্তিক ‘আনসিন’ ফিলিং তৈয়ার হয়। এই লোনলিনেস থেইকাই দাদুভাইরা এমন একটা ভার্চুয়াল জগতে জড়ায় এমন হওয়াও অসম্ভব না, যেখানে তারা ভ্যালিডেশন পায়, রিলেশনশিপ দাঁড় করতে পারে, আবেগ প্রকাশ করতে পারে।
কেবল ‘দাদুভাই ’ কথাটা দ্রুত সম্পূর্ণ অচেনা দুইজন মানুষকে সম্পর্কযুক্ত করে। এক দাদুভাই আরেক দাদুভাইর সাথে দেখা কইরা আন্তরিক কোলাব করে, ছবি তোলে, পোস্ট দেয়। দাদুভাই কালচারে অংশগ্রহণকারীদের আচরণ, একে অপরের সাথে দেখা করার পরের কোলাব ভিডিও, একসাথে স্টেওভার করার ভিডিও—এইসবই যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে যে, তারা সেক্সুয়াল রিলেশনশিপে যুক্ত। দাদুভাইরা একে অপরের প্রতি যেসব ইশারা-ইঙ্গিতপূর্ণ আবদার করে ভিডিও তৈয়ার করে, বড় লম্বা দাড়ি বিশিষ্ট লোক বাচ্চাদের যেইভাবে ইঙ্গিত কইরা ভিডিও বানায়, এইসব কিছু দেখলে এটা ‘কাম’ আহ্বান হিসেবেও অনুমান করা যায়।
এই সম্পর্কগুলা বেশিরভাগ সময়েই মিস্ট্রিয়াস, ইঙ্গিতপূর্ণ, আর সমাজের চোখ ফাঁকি দিয়া গইড়া উঠতেছে। এই প্রবণতা এখন দেশের বাইরেও ছড়াইতেছে, বিদেশে থাকা সেইম মেন্টালিটির লোকজনের সাথেও অনেক ‘দাদুভাই ’ ভার্চুয়াল সম্পর্ক তৈয়ার করতেছে, মাঝে মাঝে দেখা করার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করে। একটা নিরীহ শব্দ দিয়া শুরু হওয়া এই কালচার এখন অনেকাংশেই এক ধরনের সেক্সুয়াল ডিজায়ারের আড়াল হইয়া দাঁড়াইছে– এমন অনুমান খুব একটা ভুল হওয়ার কথা না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমকাম ট্যাবু। ফলে অনেক দিক দিয়া ‘দাদুভাই দের’ জন্য সহজতর এক্টিভিটি। কারণ এইখানে অপজিট জেন্ডারের দুইজন এক ঘরে সময় কাটানোটাকেই মানুষ বেশি স্ট্রিক্টলি প্রশ্নবিদ্ধ করে, কিন্তু এডাল্ট, সেইম জেন্ডারের দুইজনের এক ঘরে সময় কাটানোকে নরমাল হিসেবে নেয়। সব মিলায়া টিকটকে এমন এক সাব-কমিউনিটি গইড়া উঠছে, যারা ‘দাদুভাই ’ নামক এক সেক্সুয়াল রিলেশনশিপ তৈয়ার করতেছে, যেইটা শুধু আবেগ বা বন্ধুত্বের জায়গায় থাইমা নাই।
এই সব কিছু মিলায়া টিকটক এখন আর খালি কনটেন্ট বানানোর অ্যাপ না, বরং একটা আলাদা ‘ডিজিটাল সমাজ’। এই সমাজে ‘ফর ইউ’ হইল সোশ্যাল মবিলাইজেশন ও সাকসেসের সিঁড়ি, ‘কপি লিঙ্ক শেয়ার’ হইল সাপোর্ট সিস্টেম, ‘মিলন মেলা’ হইল বন্ধুত্বের প্রমাণ, আর ‘দাদুভাই কালচার’ হইল স্পর্শকাতর ও একান্ত আবেগের জায়গা।
এখানে মানুষ বাস্তব-জীবনের সামাজিক কাঠামোর বাইরেও নতুন নতুন সম্পর্ক বানায়, নিজের একটা ভার্চুয়াল পরিচিতি নির্মাণ করে। আর এই ব্যাপারটাই টিকটকরে আলাদা কইরা তোলে, কারণ অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় এত তাড়াতাড়ি, এত গভীর, এত বিচিত্র কমিউনিটি তৈয়ার হয় না।
টিকটক হইল এখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারের প্ল্যাটফর্ম। সোশ্যাল মিডিয়ার এই ভার্শনটা এমন যে আপনি দুইটা ট্যাপ দিলেই একটা ভিডিও বানায়া আপলোড করতে পারবেন। ক্যামেরা, এডিটিং, মিউজিক, ট্রেন্ডি সাউন্ড সব এক জায়গায়। এই প্ল্যাটফর্মে কিছু ট্রিক এপ্লাই কইরা ভাইরালও হইয়া যাইতে পারবেন দ্রুত। এইজন্য এই অ্যাপে সবচেয়ে বেশি ইউজার এক্টিভ। সহজ ইন্টারফেস আর অ্যাক্সেসিবিলিটির জন্য টিকটক এখন গ্লোবাল ফেনোমেনা তো হইছেই, বাংলাদেশেও একটা আলাদা সোশ্যাল কালচার তৈয়ার কইরা ফেলছে।
আপনি যদি এখনই একটা টিকটক আইডি খোলেন, সেইখানে আপনি ভিডিও আপ করতে পারবেন সাথে সাথে। প্রক্রিয়াটা সহজ। ট্রেন্ডি সাউন্ড সিলেক্ট কইরা, সিঙ্ক কইরা দিতে পারবেন। এইভাবে কোটি কোটি ক্রিয়েটর প্রতিদিন নতুন নতুন ভিডিও বানায়, কেউ লিপসিং কইরা, কেউ ডায়লগ দিয়া এক্টিং কইরা। চাইলে ট্রেন্ডিং সাউন্ড ব্যবহার করতে পারবেন, ফিল্টার দিতে পারবেন, ক্যাপশন লেইখা একটা ‘র’ ভিডিও ছাইড়া দিতে পারবেন। কনটেন্টের বিষয় হইতে পারে যেকোন কিছু, র্যান্ডম কথা, নিজের ট্যালেন্ট, কোন জায়গার ভ্রমণ, ডায়লগ লিপসিং, বা শুধু ‘ভাইব দিয়া’ ক্যামেরার দিকে তাকায়া থাকা।
এইখানে একদিকে যেমন ক্লাস ফাইভে পড়া পোলাপান আছে, তেমনই দেখা যায় অন্যদিকে আছেন দাদা/ চাচা/ মামা/ নানা বয়সের মানুষজন। সোজা কথায় টিনএজার থেইকা ষাটোর্ধ সবাই। এবং তারা সবাই একেকটা সাব-কমিউনিটির অংশ। টিকটকের এই ‘সব বয়সের মিলন’ নিজেই একটা কালচার গইড়া তুলছে। এই মিশ্র বয়সের মানুষজন মিলা এখানে গইড়া উঠতেছে একেকটা সাব-কমিউনিটি।
তবে একটা জিনিস সব ভিডিও ক্রিয়েটররাই চায়, ভিডিওটা যেন ‘ফর ইউ’ অপশনে আসে। টিকটকের ইউজারদের একটা বড় অংশ এই বিষয়টা নিয়া খুব কনসার্নড, ভিডিও ফর ইউতে যাওয়া। ‘ফর ইউ’ অপশনটা হইল টিকটকের মেইন ডিসকভারি ফিড। এখানে এলগরিদম যেই কনটেন্টরে মনে করে অন্যদের পছন্দ হইবে, সেইগুলা সাজেস্ট করে। ফর ইউ-তে আপনার ভিডিও যাওয়া মানে অনেক ইউজার অটোমেটিক আপনার ভিডিও দেখবে। ফর ইউতে ভিডিও গেলে সেটা এমনভাবে এক্সপোজার পায় যেইখানে ইউজার নিজে কিছু না করলেও হাজার হাজার মানুষ দেইখা ফেলে। অনেক সময় ভিডিওর ভিউ এক রাতেই লাখ ছাড়ায়ে যায়। এইটা একটা ছোটখাটো ভাইরাল হওয়ার লটারির মতো। তাই সবার কমন লক্ষ্যই থাকে ‘ফর ইউ’ তে যাওয়া।
এখন এই ফর ইউ’তে যাবার জন্য মানুষজন নানান ট্রিক ফলো করে। সবচেয়ে কমন কয়েকটা উপায় হইল: ভিডিও আপ করার পরপরই কমিউনিটির মানুষজন সেই ভিডিওতে লাইক দেবে, কমেন্ট করবে, ভিডিওটা সেইভ করবে, লিংক কপি করে শেয়ার করবে। এই লিঙ্ক শেয়ার করাকে তারা বলে ‘কপি লিঙ্ক শেয়ার’ বা ‘কপিলিঙ শেয়ার’।
এই ‘কপি লিঙ্ক শেয়ার’ বা তাদের ভাষায় ‘কপিলিঙ শেয়ার’ হইল একটা রিচ ট্রিক। ভিডিওর লিংকটা কেউ কপি কইরা শেয়ার করলে, সেই লিংক থেইকা যদি কেউ টিকটকে ঢোকে, টিকটকের এলগরিদম ধইরা নেয় যে এই ভিডিওটা অন্যদের কাছে ইন্টারেস্টিং, তাই এইটা বড় সংখ্যক অডিয়েন্সের সামনে দেয়া যায়।
যেই ভিডিওতে বেশি শেয়ার, বেশি সেইভ, বেশি কমেন্ট হয় ঐ ভিডিওর ফর ইউতে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি। এই অ্যাকশনগুলা যত বেশি হয়, টিকটকের এলগরিদম ধইরা নেয় এই ভিডিওতে মানুষ আগ্রহী। আর তখনই ভিডিও চইলা যায় ফর ইউতে। ফলে, ফর ইউতে যাওয়া যতটা না কন্টেন্ট কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে, তার চাইতে বেশি নির্ভর করে কমিউনিটির ভূমিকা উপর।
এইখানেই গইড়া উঠছে একেকটা কমিউনিটি। একেকটা কমিউনিটির লোকজন নিজেদের ভিডিও রিচ বাড়ানোর জন্য দলবাইধা কন্ট্রিবিউশন করে। কেউ ভিডিও দিলেই অন্যরা সেটা ফর ইউতে নিয়া যাইতে হেল্প করে। লাইক, কমেন্ট, সেইভ, কপিলিঙ শেয়ার সবকিছু একসাথে করে। যেন একটা টিম ওয়ার্ক। এইখানেই আসে কমিউনিটি কালচারের ব্যাপারটা। টিকটকে আপনি দেখবেন একেকটা গ্রুপ একেক রকম কন্টেন্ট করে, আর তাদের মধ্যে গইড়া উঠে এক ধরনের সম্পর্ক, জড়তা মুক্ত সহজ বন্ধুত্ব। যারা একে অপরের কাছে সাপোর্ট চায়।
এমনই একটা ভাইরাল টিকটক আছে; কথাটা এমন ‘সাপোর্ট করলে সাপোর্ট পাইবা, না করলে কিছুই পাইবা না, জিরো। আর তোমরা যারা কমেন্ট করো, ভাইয়া আমাকে সাপোর্ট করো! তোমাদেরকে বলতে চাই, আমার কয়টা ভিডিওতে তুমি সাপোর্ট করছো? আগে সেটা বলো।’
এই কমিউনিটিগুলার মধ্যে কিছু সাব-কমিউনিটিও আছে, কিশোর গ্যাংও একটা সাব কমিউনিটি। এদের কালচার হইল ডিজে গান, দেশীয় অস্ত্র, বোট পার্টি, ধামার মহড়া এইসব নিয়া ভিডিও বানানো। এদের বয়স প্রায় ১৩ থেইকা ২২ এর ভিতরে। এদের জন্য টিকটক একটা এক্সপ্রেশন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা তাদের গ্যাঙয়ের ব্র্যান্ডিং করে।
‘মিলন মেলা’ এই কালচারের একটা হাইলাইটেড ইভেন্ট। এই মিলনমেলাগুলা সাধারণত আয়োজন করে সেই সব টিকটকার যারা একটু বেশি জনপ্রিয়। লাইক, ফলোয়ার, ভিউ বেশি। তারা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একটা গ্যাদারিং অর্গানাইজ করে, যেইখানে টিকেট কাইটা অংশগ্রহণ করতে হয়। সেই টিকিটে থাকে দুপুরের খাওয়া, বিকালের নাস্তা, মোরগ পোলাওয়ে বাড়তি ঝোল বা ডিম থাকবে কি থাকবে না এইসব অলরেডি টিকেটে ডিটেইলে লেখা থাকে। মেলায় কমিউনিটি/গ্রুপের নাম প্রিন্ট করা গেঞ্জি দেয়া হয়, ছোট বড় টিকটকাররে সম্মান জানাইয়া ক্রেস্ট দেয়া হয়, সবাই কোলাব করে ভিডিও বানায়, একসাথে লাইভে আসে। এইসব মিলন মেলা কমিউনিটির ভিতরে এক ধরণের ইনভলভমেন্ট বাড়ায়, বন্ধুত্ব তৈয়ার করে।
এছাড়া ফর ইউতে যাওয়া ক্রিয়েটরের সাথে কোলাব করার একটা চর্চাও আছে। যে কেউ যদি ফর ইউতে গিয়া ভাইরাল হয়, ছোট ক্রিয়েটররা তারে খুঁইজা বাইর করে, ভিডিও বানায়, বন্ধুত্ব করে। এইভাবে তারা নিজেরাও রিচ বাড়ায়।
আরেকটা সাব কমিউনিটিতে একটা ভিন্ন লেভেলের কালচার তৈয়ার হইছে, ‘দাদুভাই কালচার’।
এই দাদুভাই কালচার এমন এক ইউনিক কালচার, যেইখানে কিছু বয়স্ক ও ইয়াং মানুষ পার্টিসিপেট করে, একে অন্যরে ভালোবাইসা ‘দাদুভাই ’ বইলা ডাকে। আবার অনেকে ‘দাদুভাই’ শব্দটারে ব্যবহার কইরা তাদের মাঝে এক ধরনের সংযোগ তৈয়ার করে।
দেখা যায়, এক বুড়া লোক টাঙ্গাইল থেইকা একটা ভিডিও দিল, সেখানে বরিশালের কোনো ছেলে কমেন্ট করে ‘প্রিয় দাদুভাই আমার’। তখন দাদুভাই কমেন্টে রিপ্লাই দেয়, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই’। দাদুভাই নাম্বার চায়, কোথায় থাকে জিজ্ঞাস করে।
টিকটকে এই দাদুভাই কালচারে যুক্ত মূলত দুই ধরনের মানুষ আছে:
১. যারা বয়সে সত্যিই দাদু টাইপ অর্থাৎ ৫০+
২. যারা ছোট বা ইয়াং, কিন্তু তারা ‘দাদুভাই ’ বইলা অন্য বয়স্কদের ডাকে এবং সেই সম্বন্ধে এক ধরনের আবেগে জড়ায়। যারা ‘দাদুভাই ’ সম্বোধনটা রোমান্টিসাইজ করে।
এখানে মেয়েদের কোনো পার্টিসিপেশন নাই। দাদুভাই কালচার পুরাই বয়েজ ডমিনেটেড, ব্যাটাদের মহল। তবে এইখানে সম্পর্ক, মান-অভিমান, ভালোবাসা, কষ্ট—সবকিছুই আছে, যা এক রকম রিলেশনশিপ স্টাইলেই গইড়া উঠে। এক দাদুভাই আরেক দাদুভাই কে মিস করে। দেখা করার জন্য ঢাকা টু বরিশাল বা কুমিল্লা টু ঢাকা চইলা যায়।
দাদুভাই দের বড় একটা অংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেইকা আসা। তারা সাধারণত স্মার্টফোন-ইন্টারনেট অ্যাক্সেস রাখলেও ডিজিটাল লিটারেসি সীমিত। বাংলাদেশের সোশ্যাল নর্ম অনুযায়ী বয়স্ক পুরুষদের অনলাইন বা পাবলিক স্পেসে থাকা সহজ। একই বয়সী নারীরা সাধারণত পরিবারে সীমাবদ্ধ থাকেন, অনলাইনে প্রকাশ্য হতে দ্বিধা বোধ করেন বা সামাজিক বাধা বেশি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বন্ধুবান্ধব কইমা যায়, পরিবারে গুরুত্ব কমে, আর সমাজেও বয়সভিত্তিক ‘আনসিন’ ফিলিং তৈয়ার হয়। এই লোনলিনেস থেইকাই দাদুভাইরা এমন একটা ভার্চুয়াল জগতে জড়ায় এমন হওয়াও অসম্ভব না, যেখানে তারা ভ্যালিডেশন পায়, রিলেশনশিপ দাঁড় করতে পারে, আবেগ প্রকাশ করতে পারে।
কেবল ‘দাদুভাই ’ কথাটা দ্রুত সম্পূর্ণ অচেনা দুইজন মানুষকে সম্পর্কযুক্ত করে। এক দাদুভাই আরেক দাদুভাইর সাথে দেখা কইরা আন্তরিক কোলাব করে, ছবি তোলে, পোস্ট দেয়। দাদুভাই কালচারে অংশগ্রহণকারীদের আচরণ, একে অপরের সাথে দেখা করার পরের কোলাব ভিডিও, একসাথে স্টেওভার করার ভিডিও—এইসবই যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে যে, তারা সেক্সুয়াল রিলেশনশিপে যুক্ত। দাদুভাইরা একে অপরের প্রতি যেসব ইশারা-ইঙ্গিতপূর্ণ আবদার করে ভিডিও তৈয়ার করে, বড় লম্বা দাড়ি বিশিষ্ট লোক বাচ্চাদের যেইভাবে ইঙ্গিত কইরা ভিডিও বানায়, এইসব কিছু দেখলে এটা ‘কাম’ আহ্বান হিসেবেও অনুমান করা যায়।
এই সম্পর্কগুলা বেশিরভাগ সময়েই মিস্ট্রিয়াস, ইঙ্গিতপূর্ণ, আর সমাজের চোখ ফাঁকি দিয়া গইড়া উঠতেছে। এই প্রবণতা এখন দেশের বাইরেও ছড়াইতেছে, বিদেশে থাকা সেইম মেন্টালিটির লোকজনের সাথেও অনেক ‘দাদুভাই ’ ভার্চুয়াল সম্পর্ক তৈয়ার করতেছে, মাঝে মাঝে দেখা করার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করে। একটা নিরীহ শব্দ দিয়া শুরু হওয়া এই কালচার এখন অনেকাংশেই এক ধরনের সেক্সুয়াল ডিজায়ারের আড়াল হইয়া দাঁড়াইছে– এমন অনুমান খুব একটা ভুল হওয়ার কথা না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমকাম ট্যাবু। ফলে অনেক দিক দিয়া ‘দাদুভাই দের’ জন্য সহজতর এক্টিভিটি। কারণ এইখানে অপজিট জেন্ডারের দুইজন এক ঘরে সময় কাটানোটাকেই মানুষ বেশি স্ট্রিক্টলি প্রশ্নবিদ্ধ করে, কিন্তু এডাল্ট, সেইম জেন্ডারের দুইজনের এক ঘরে সময় কাটানোকে নরমাল হিসেবে নেয়। সব মিলায়া টিকটকে এমন এক সাব-কমিউনিটি গইড়া উঠছে, যারা ‘দাদুভাই ’ নামক এক সেক্সুয়াল রিলেশনশিপ তৈয়ার করতেছে, যেইটা শুধু আবেগ বা বন্ধুত্বের জায়গায় থাইমা নাই।
এই সব কিছু মিলায়া টিকটক এখন আর খালি কনটেন্ট বানানোর অ্যাপ না, বরং একটা আলাদা ‘ডিজিটাল সমাজ’। এই সমাজে ‘ফর ইউ’ হইল সোশ্যাল মবিলাইজেশন ও সাকসেসের সিঁড়ি, ‘কপি লিঙ্ক শেয়ার’ হইল সাপোর্ট সিস্টেম, ‘মিলন মেলা’ হইল বন্ধুত্বের প্রমাণ, আর ‘দাদুভাই কালচার’ হইল স্পর্শকাতর ও একান্ত আবেগের জায়গা।
এখানে মানুষ বাস্তব-জীবনের সামাজিক কাঠামোর বাইরেও নতুন নতুন সম্পর্ক বানায়, নিজের একটা ভার্চুয়াল পরিচিতি নির্মাণ করে। আর এই ব্যাপারটাই টিকটকরে আলাদা কইরা তোলে, কারণ অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় এত তাড়াতাড়ি, এত গভীর, এত বিচিত্র কমিউনিটি তৈয়ার হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাইকর গ্রাম। ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বিষণ্ন মুখে বসে আছেন বৃদ্ধ ভাদু শেখ। কপালের ভাঁজে ভাঁজে দুশ্চিন্তা—তাঁর মেয়েটি কি সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পারবে? গর্ভপাত হয়ে যাবে না তো?
৬ ঘণ্টা আগেবিশ্বের বিভিন্ন দেশেই দীর্ঘ দিনের স্বৈরশাসন ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পতন ঘটায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে সমাজের রাজনৈতিক কাঠামো, শাসন ব্যবস্থা ও মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দৃষ্টিকোণও বদলে দিয়েছে।
১ দিন আগেফেনীতে নারী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সূচনা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘কোটা পূর্ণবহাল চলবে না’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে অনেকেই প্রথমবার মতামত জানান। সরাসরি অংশ নিতে ইচ্ছুকদের যুক্ত করা হয় একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে। সেখান থেকেই শুরু রাজপথে সক্রিয়তা।
১ দিন আগে২ আগস্ট ঢাকার গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে আগুন লাগে। এতে দেশের সব সংবাদমাধ্যমই খবরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই গুলিস্তান নামটি উল্লেখ করেছে। কিন্তু ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামোয় গুলিস্তান নামে কিছু নেই!
৫ দিন আগে