২০১৯ সাল থেকেই অন্যান্য বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে শেখ হাসিনাকেও উদ্যাপন করা অলিখিত এক রীতিতে পরিণত হয়।
হুমায়ূন শফিক
ক্ষমতায় যাওয়ার পরে অনেক শাসকই ‘লেখক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এমন নজির বাংলাদেশে আছে। সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘কবি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তখন দেশের সরকারি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষভাবে ছাপা হয়েছিল তাঁর কবিতা। সে সময় এ জায়গায় মূলত প্রথিতযশা কবি-লেখকদের লেখা ছাপা হওয়ার রেওয়াজ ছিল।
এরশাদের মতো শেখ হাসিনাও ক্ষমতায় যাওয়ার পর নিজের ‘লেখক পরিচয়’ উপভোগ করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচুত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীও প্রথিতযশা ‘লেখক’ হিসেবে সরকারিভাবে উদ্যাপিতও হয়েছেন।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র দেশের প্রথিতযশা কবি-লেখকদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে তাঁদের বই ও লেখা নিয়ে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ তালিকায় সাধারণত যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন, এমন কবি-লেখকই থাকেন বেশি। যেমন মাইকেল মধুসূধন দত্ত, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন থেকে শুরু করে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রমুখ। তবে ২০১৯ থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ তালিকায় নিয়মিতভাবে জীবিত লেখক ছিলেন একজন। তিনি শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা কয়েকটি বইয়ের রচয়িতা হলেও যে উচ্চতার লেখক-সাহিত্যিকের জন্ম ও মৃত্যুদিবসে তাঁদের নিয়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে, তাঁর লেখক-ক্যারিয়ার তেমন বর্ণাঢ্য নয়, যতটা বর্ণাঢ্য তাঁর রাজনীতিবিদ পরিচয়। এর বাইরেও এ সময় শেখ হাসিনার বই এবং তাঁর ওপরে লেখা বই নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নানা ধরনের আয়োজন করতে থাকে গ্রন্থকেন্দ্র। অনেক সাহিত্যিক তাই বলছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন বলেই তাঁকে নিয়ে এসব আয়োজন হয়েছিল। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছিল। এসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কটা আসলে ক্ষমতার।
আর ‘ক্ষমতা’ ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী শাসক ‘লেখক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, পৃথিবীতে এই দৃষ্টান্ত কম নেই।
রাজধানীর গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের পাশেই অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি বই ও লেখক-কবিদের নিয়ে নানা ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। তারই একটি অংশ ‘সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর বা সংস্থার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষণ ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন’।
প্রতিবছরই জন্ম-মৃত্যু তারিখ ধরে বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিকদের নিয়ে থাকে নানা আয়োজন। লেখক-কবি তথা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েই সাজানো হয় অনুষ্ঠানটি। তাঁদের নিয়ে কথা বলার জন্য ডাকা হয় দেশের প্রখ্যাত সব লেখক, কবি ও গবেষকদের।
২০১৯ সালের বরেণ্য ব্যক্তিদের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের একটি তালিকা স্ট্রিমের হাতে এসেছে। সেখানে আছেন—মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন, শওকত ওসমান, গোবিন্দচন্দ্র দেব, শওকত আলী, আনিসুজ্জামানের মতো প্রথিতযশা লেখক। এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকেই অন্যান্য বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে শেখ হাসিনাকেও উদ্যাপন করা অলিখিত এক রীতিতে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গণ-অভ্যুত্থানের পর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে কাজ করছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্ট্রিমকে বলেন, ‘এ তালিকায় যখন শেখ হাসিনার নাম দেখলাম, খুবই অবাক হয়েছি। কারণ, রাজনীতিবিদদের জন্মদিন উদ্যাপন করলেও না হয় বোঝা যেত, কিন্তু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি কীভাবে আসেন? যেখানে আনিসুজ্জামানের মতো প্রণম্য লেখকদের নাম রয়েছে!’
প্রায় একই রকম কথা বলেছেন অনুবাদে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া অনুবাদক জি এইচ হাবিবও। স্ট্রিমকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বইয়ের দোকানে বা বলা ভালো অনলাইন বিজ্ঞাপনে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে শেখ হাসিনার যে গোটা বিশেক বই দেখতে পাওয়া যায়, তা বিবেচনায় নিলে এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে তিনি লেখক। তবে দেশের শিল্পসংস্কৃতির জগতে সরকারি-বেসরকারি পদস্থ কর্মকর্তা তোষণের যে অপসংস্কৃতি দেখে আমরা অভ্যস্ত, তাতে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিগত সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি না হলে গত ২০১৯ সাল থেকে চার-পাঁচ বছর ধরে গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে লেখক হিসেবে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন হতো কি না, তাতে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে যখন আরও অনেক গুণী ও প্রথিতযশা জীবিত লেখক—যাঁদের কেউ কেউ ক্ষমতাবলয়ের বাইরে রয়েছেন—এ ধরনের অনুষ্ঠানে উদ্যাপিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচিত হন না।’
সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি না হলে গত ২০১৯ সাল থেকে চার-পাঁচ বছর ধরে গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে লেখক হিসেবে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন হতো কি না, তাতে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। -জি এইচ হাবিব, অনুবাদক
শুধু শেখ হাসিনার জন্মদিনেই লেখক হিসেবে তাঁকে উদ্যাপন করা হয়নি, স্ট্রিমের অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে কর্তৃত্ববাদী এই শাসকের বইয়ের ওপর বিশেষ পাঠ কার্যক্রমও করেছিল গ্রন্থকেন্দ্র। ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর পাঠ কার্যক্রমে তাঁর যে দুটি বই পড়ানো হয়, তা হলো ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ ও ‘বেদনায় ভরা দিন’। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সেই সময়কার পরিচালক মিনার মনসুর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ ও ’২৩ সাল থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে অব্যাহতভাবে নানারকম অনুষ্ঠান হাতে নেয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এর মধ্যে একটি ছিল তাঁর বইগুলো নিয়ে প্রতিযোগিতা। এটি হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল ৫৮ শিক্ষার্থী। বিচারক ছিলেন অধ্যাপক মাসুদুজ্জামান, ডা. মোহিত কামাল, ঝর্ণা রহমান ও সুভাষ সিংহ রায়। আর এখানে শেখ হাসিনার বইগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বেরাইদ গণপাঠাগারের সভাপতি এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া ও দনিয়া পাঠাগারের সভাপতি শাহনেওয়াজ।
এই ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘লেখক ও সম্পাদক শেখ হাসিনা’ শিরোনামে আরেকটি বিশেষ গ্রন্থপাঠ কার্যক্রম হাতে নেয় গ্রন্থকেন্দ্র।
এ ছাড়া, ওই বছর শেখ হাসিনাকে নিয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ প্রতিষ্ঠানটি করেছিল আরও বিচিত্র সব আয়োজন।
ঢাকা, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ২৮টি গণ-পাঠাগারের সদস্যরা এতে অংশ নেন। ঢাকা থেকে অংশ নিয়েছিল বেরাইদ গণপাঠাগার, দনিয়া পাঠাগার, সীমান্ত পাঠাগার, গ্রন্থবিতান, বুকল্যান্ড লাইব্রেরি, কামাল স্মৃতি পাঠাগার, উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আওয়াল পাবলিক লাইব্রেরি, অনির্বাণ, মুক্তি গণপাঠাগার, মুকুল ফৌজ পাঠাগার, তাহমিনা ইকবাল পাবলিক লাইব্রেরি, গোলাম আবেদিন মাস্টার ও রেফাতুন্নেছা গ্রন্থাগার ও আলোকবর্তিকা গ্রন্থাগার।
লেখকদের উদ্যাপন করা খুবই ভালো ব্যাপার। কিন্তু সেখানে কেন শেখ হাসিনার নাম আসবে! এর মধ্য দিয়ে আসলে যেমন পদলেহন আর চটুকারিতা করা হয়েছে, তেমনি নিয়মও ভাঙা হয়েছে। আর সাহিত্যে শেখ হাসিনার অবদান কী? জিয়া হাশান, কথাসাহিত্যিক
অন্যদিকে বিভিন্ন জেলা থেকে অংশ নেওয়া পাঠাগারগুলো হলো, গোপালগঞ্জের বর্ণ গ্রন্থাগার; ময়মনসিংহের আলোর ভুবন পাঠাগার, জাগ্রত আছিম গ্রন্থাগার, অন্বেষা পাঠাগার ও স্বপ্নপূরণ লাইব্রেরি; নারায়ণগঞ্জের সুলপিনা আদর্শ পাঠাগার; সিরাজগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ শ মাহবুবুল হক পাঠাগার; জামালপুরের ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মতি মিয়া ফাউন্ডেশন; সিলেটের পদক্ষেপ গণপাঠাগার; লালমনিরহাটের আলোকিত মালিটারি ফুটন্ত অভিযান গ্রন্থাগার; সুনামগঞ্জ থেকে অজিত স্মৃতি পাঠাগার; কুমিল্লার মজুমদার পাবলিক লাইব্রেরি; নেত্রকোনার জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র ও মুন্সীগঞ্জ থেকে রহমান মাস্টার স্মৃতি পাঠাগার।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রন্থকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা স্ট্রিমকে বলেন, ‘তখন এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের নির্দেশে আমরা অনুষ্ঠানগুলো করতে একপ্রকার বাধ্য ছিলাম। আর এসব কার্যক্রমে পাঠাগারগুলোর আসাও অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।’
এসব বিষয়ে কথা বলতে স্ট্রিমের পক্ষ থেকে মিনার মনসুরকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে তাঁর সঙ্গে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। অবশেষে হোয়াটসঅ্যাপে ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কেন শেখ হাসিনাকে লেখক হিসেবে উদ্যাপন করেছিল? তাঁকে কেন লেখক পাঠ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছিল?’ এ রকম দুটি প্রশ্ন লিখে পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো কিছুতেই সাড়া দেননি।
শুধু শেখ হাসিনার লেখা বই নিয়ে নানা আয়োজন করেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র খ্যান্ত হয়নি। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ওপরে লেখা হয়েছে, এমন বই নিয়েও তারা পাঠ কার্যক্রমের আয়োজন করে। ‘১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন’ শিরোনামে প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো সরাফ আহমেদের লেখা বইটি নিয়ে তারা পাঠ কার্যক্রম করেছিল ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট। আর বইটি পড়তে দেওয়া হয়েছিল তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে এবং অনুষ্ঠান শেষে তাদের মতামতও জানতে চাওয়া হয়েছিল।
শেখ হাসিনাকে ঘিরে গ্রন্থকেন্দ্রের এসব কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক জিয়া হাশান বলেন, ‘লেখকদের উদ্যাপন করা খুবই ভালো ব্যাপার। কিন্তু সেখানে কেন শেখ হাসিনার নাম আসবে!’ এ ধরনের কাজের নিন্দা জানিয়ে এই লেখক বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে আসলে যেমন পদলেহন আর চটুকারিতা করা হয়েছে, তেমনি নিয়মও ভাঙা হয়েছে। আর সাহিত্যে শেখ হাসিনার অবদান কী?’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসকেরা স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার পর যেভাবে তাঁদের ‘লেখক পরিচয়’ সামনে নিয়ে এসেছেন, তার সঙ্গে শেখ হাসিনারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর ১৬ বছরের শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শেষ দিকে তিনি নিজের ‘লেখক পরিচয়’ অনেক বেশিভাবে উদ্যাপিত হতে দিয়েছেন। প্রায় একই ব্যাপার ঘটেছে জোসেফ স্তালিন, বেনিতো মুসোলিনি, মুয়াম্মার গাদ্দাফি কি ইদি আমিনের ক্ষেত্রেও।
তরুণ বয়সে কবিতা লিখতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একসময়কার একচ্ছত্র শাসক জোসেফ স্তালিন (১৮৭৮-১৯৫৩)। জর্জিয়ান ভাষায় ছাপাও হয়েছিল তাঁর কবিতা। পরে ক্ষমতায় এসে শিল্পসাহিত্যকে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের অস্ত্র বানান তিনি। তাঁর কবিতার মান নিয়ে সেই সময়কার রুশ সাহিত্য পণ্ডিতেরা প্রশ্ন তুললেও রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় তিনি ‘কবি’ ভাবমূর্তি ঠিকই বজায় রেখেছিলেন। তাঁর শাসনকাল যত দীর্ঘ হয়েছে, ততই তিনি নিজের ‘কবি পরিচয়’ বিস্তৃত করেছেন।
জোসেফ স্তালিনের মতো আরেক স্বৈরশাসক ছিলেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫)। তাঁর একনায়ককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সমালোচনামূলক সাহিত্য বা মুক্তচিন্তা প্রকাশের জায়গা ছিল না। তবে মুসেলিনির লেখা, বক্তৃতা বা তাঁর আদর্শ সম্পর্কিত বইগুলোকে এ সময় সরকারিভাবে ‘জাতীয় সাহিত্য’-এর মর্যাদা দেওয়া শুরু হয়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর লেখা বিদেশী ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়। ফলে মুসোলিনি যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজেকে একধরনের ‘লেখক-দার্শনিক’ হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির (১৯৪২-২০১১) লেখা তিন খণ্ডে প্রকাশিত বই ‘দ্য গ্রিন বুক’ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ওই দেশের কেন্দ্রীয় পাঠ্য বানানো হয়েছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সামরিক ও প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি বাধ্যতামূলক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হতো। গাদ্দাফির শাসনকাল যত বেড়েছে, তাঁর ‘লেখক পরিচয়’ তত উজ্জ্বল করতে মনোযোগ দিয়েছেন তিনি।
উগান্ডার তৃতীয় রাষ্ট্রপ্রধান ইদি আমিন (১৯২৪-২০০৩) লেখেননি কোনো সাহিত্য। কিন্তু তাঁর বক্তৃতা, চিঠি ও ঘোষণা ছাপানো হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। এরপর সরকারিভাবে এগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয় জনসাধারণেরে মধ্যে। এমনকি তাঁর বইপত্র পাঠ্যও করা হয়েছিল।
স্বৈরশাসকদের এমন মানসিকতার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন লেখক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘এরশাদ লেখক বা কবি হতে চেয়েছিলেন—এটা যতটা না সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য, সেই সময় চাটুকাররা তাঁকে কবি বানাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আর বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে এ রকম স্বৈরাচারী যাঁরা ছিলেন, তাঁদের তো লোকেরা তোষণ করেছে। এডলফ হিটলারের মাইন কাম্ফ, এটা তো তিনি লেখক হওয়ার জন্য লেখেননি, লিখেছিলেন রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে। ক্ষমতা-তোষণকারীরা সবসময়ই এমন করেন। আসলে শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারীর কাছে লেখক হওয়া বা না হওয়ায় কি আদৌ কিছু আসে-যায়? সত্যিকারের লেখকেরা সবসময়েই ক্ষমতা ও স্বৈরাচারের বিপক্ষে থাকেন।’
ক্ষমতায় যাওয়ার পরে অনেক শাসকই ‘লেখক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এমন নজির বাংলাদেশে আছে। সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘কবি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তখন দেশের সরকারি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষভাবে ছাপা হয়েছিল তাঁর কবিতা। সে সময় এ জায়গায় মূলত প্রথিতযশা কবি-লেখকদের লেখা ছাপা হওয়ার রেওয়াজ ছিল।
এরশাদের মতো শেখ হাসিনাও ক্ষমতায় যাওয়ার পর নিজের ‘লেখক পরিচয়’ উপভোগ করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচুত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীও প্রথিতযশা ‘লেখক’ হিসেবে সরকারিভাবে উদ্যাপিতও হয়েছেন।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র দেশের প্রথিতযশা কবি-লেখকদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে তাঁদের বই ও লেখা নিয়ে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ তালিকায় সাধারণত যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন, এমন কবি-লেখকই থাকেন বেশি। যেমন মাইকেল মধুসূধন দত্ত, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন থেকে শুরু করে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রমুখ। তবে ২০১৯ থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এ তালিকায় নিয়মিতভাবে জীবিত লেখক ছিলেন একজন। তিনি শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা কয়েকটি বইয়ের রচয়িতা হলেও যে উচ্চতার লেখক-সাহিত্যিকের জন্ম ও মৃত্যুদিবসে তাঁদের নিয়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে, তাঁর লেখক-ক্যারিয়ার তেমন বর্ণাঢ্য নয়, যতটা বর্ণাঢ্য তাঁর রাজনীতিবিদ পরিচয়। এর বাইরেও এ সময় শেখ হাসিনার বই এবং তাঁর ওপরে লেখা বই নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নানা ধরনের আয়োজন করতে থাকে গ্রন্থকেন্দ্র। অনেক সাহিত্যিক তাই বলছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন বলেই তাঁকে নিয়ে এসব আয়োজন হয়েছিল। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছিল। এসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কটা আসলে ক্ষমতার।
আর ‘ক্ষমতা’ ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী শাসক ‘লেখক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, পৃথিবীতে এই দৃষ্টান্ত কম নেই।
রাজধানীর গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের পাশেই অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি বই ও লেখক-কবিদের নিয়ে নানা ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। তারই একটি অংশ ‘সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর বা সংস্থার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষণ ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন’।
প্রতিবছরই জন্ম-মৃত্যু তারিখ ধরে বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিকদের নিয়ে থাকে নানা আয়োজন। লেখক-কবি তথা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েই সাজানো হয় অনুষ্ঠানটি। তাঁদের নিয়ে কথা বলার জন্য ডাকা হয় দেশের প্রখ্যাত সব লেখক, কবি ও গবেষকদের।
২০১৯ সালের বরেণ্য ব্যক্তিদের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের একটি তালিকা স্ট্রিমের হাতে এসেছে। সেখানে আছেন—মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন, শওকত ওসমান, গোবিন্দচন্দ্র দেব, শওকত আলী, আনিসুজ্জামানের মতো প্রথিতযশা লেখক। এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকেই অন্যান্য বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে শেখ হাসিনাকেও উদ্যাপন করা অলিখিত এক রীতিতে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গণ-অভ্যুত্থানের পর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে কাজ করছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্ট্রিমকে বলেন, ‘এ তালিকায় যখন শেখ হাসিনার নাম দেখলাম, খুবই অবাক হয়েছি। কারণ, রাজনীতিবিদদের জন্মদিন উদ্যাপন করলেও না হয় বোঝা যেত, কিন্তু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি কীভাবে আসেন? যেখানে আনিসুজ্জামানের মতো প্রণম্য লেখকদের নাম রয়েছে!’
প্রায় একই রকম কথা বলেছেন অনুবাদে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া অনুবাদক জি এইচ হাবিবও। স্ট্রিমকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বইয়ের দোকানে বা বলা ভালো অনলাইন বিজ্ঞাপনে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে শেখ হাসিনার যে গোটা বিশেক বই দেখতে পাওয়া যায়, তা বিবেচনায় নিলে এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে তিনি লেখক। তবে দেশের শিল্পসংস্কৃতির জগতে সরকারি-বেসরকারি পদস্থ কর্মকর্তা তোষণের যে অপসংস্কৃতি দেখে আমরা অভ্যস্ত, তাতে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিগত সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি না হলে গত ২০১৯ সাল থেকে চার-পাঁচ বছর ধরে গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে লেখক হিসেবে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন হতো কি না, তাতে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে যখন আরও অনেক গুণী ও প্রথিতযশা জীবিত লেখক—যাঁদের কেউ কেউ ক্ষমতাবলয়ের বাইরে রয়েছেন—এ ধরনের অনুষ্ঠানে উদ্যাপিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচিত হন না।’
সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি না হলে গত ২০১৯ সাল থেকে চার-পাঁচ বছর ধরে গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে লেখক হিসেবে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন হতো কি না, তাতে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। -জি এইচ হাবিব, অনুবাদক
শুধু শেখ হাসিনার জন্মদিনেই লেখক হিসেবে তাঁকে উদ্যাপন করা হয়নি, স্ট্রিমের অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে কর্তৃত্ববাদী এই শাসকের বইয়ের ওপর বিশেষ পাঠ কার্যক্রমও করেছিল গ্রন্থকেন্দ্র। ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর পাঠ কার্যক্রমে তাঁর যে দুটি বই পড়ানো হয়, তা হলো ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ ও ‘বেদনায় ভরা দিন’। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সেই সময়কার পরিচালক মিনার মনসুর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ ও ’২৩ সাল থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে অব্যাহতভাবে নানারকম অনুষ্ঠান হাতে নেয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এর মধ্যে একটি ছিল তাঁর বইগুলো নিয়ে প্রতিযোগিতা। এটি হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল ৫৮ শিক্ষার্থী। বিচারক ছিলেন অধ্যাপক মাসুদুজ্জামান, ডা. মোহিত কামাল, ঝর্ণা রহমান ও সুভাষ সিংহ রায়। আর এখানে শেখ হাসিনার বইগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বেরাইদ গণপাঠাগারের সভাপতি এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া ও দনিয়া পাঠাগারের সভাপতি শাহনেওয়াজ।
এই ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘লেখক ও সম্পাদক শেখ হাসিনা’ শিরোনামে আরেকটি বিশেষ গ্রন্থপাঠ কার্যক্রম হাতে নেয় গ্রন্থকেন্দ্র।
এ ছাড়া, ওই বছর শেখ হাসিনাকে নিয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ প্রতিষ্ঠানটি করেছিল আরও বিচিত্র সব আয়োজন।
ঢাকা, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ২৮টি গণ-পাঠাগারের সদস্যরা এতে অংশ নেন। ঢাকা থেকে অংশ নিয়েছিল বেরাইদ গণপাঠাগার, দনিয়া পাঠাগার, সীমান্ত পাঠাগার, গ্রন্থবিতান, বুকল্যান্ড লাইব্রেরি, কামাল স্মৃতি পাঠাগার, উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আওয়াল পাবলিক লাইব্রেরি, অনির্বাণ, মুক্তি গণপাঠাগার, মুকুল ফৌজ পাঠাগার, তাহমিনা ইকবাল পাবলিক লাইব্রেরি, গোলাম আবেদিন মাস্টার ও রেফাতুন্নেছা গ্রন্থাগার ও আলোকবর্তিকা গ্রন্থাগার।
লেখকদের উদ্যাপন করা খুবই ভালো ব্যাপার। কিন্তু সেখানে কেন শেখ হাসিনার নাম আসবে! এর মধ্য দিয়ে আসলে যেমন পদলেহন আর চটুকারিতা করা হয়েছে, তেমনি নিয়মও ভাঙা হয়েছে। আর সাহিত্যে শেখ হাসিনার অবদান কী? জিয়া হাশান, কথাসাহিত্যিক
অন্যদিকে বিভিন্ন জেলা থেকে অংশ নেওয়া পাঠাগারগুলো হলো, গোপালগঞ্জের বর্ণ গ্রন্থাগার; ময়মনসিংহের আলোর ভুবন পাঠাগার, জাগ্রত আছিম গ্রন্থাগার, অন্বেষা পাঠাগার ও স্বপ্নপূরণ লাইব্রেরি; নারায়ণগঞ্জের সুলপিনা আদর্শ পাঠাগার; সিরাজগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ শ মাহবুবুল হক পাঠাগার; জামালপুরের ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মতি মিয়া ফাউন্ডেশন; সিলেটের পদক্ষেপ গণপাঠাগার; লালমনিরহাটের আলোকিত মালিটারি ফুটন্ত অভিযান গ্রন্থাগার; সুনামগঞ্জ থেকে অজিত স্মৃতি পাঠাগার; কুমিল্লার মজুমদার পাবলিক লাইব্রেরি; নেত্রকোনার জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র ও মুন্সীগঞ্জ থেকে রহমান মাস্টার স্মৃতি পাঠাগার।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রন্থকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা স্ট্রিমকে বলেন, ‘তখন এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের নির্দেশে আমরা অনুষ্ঠানগুলো করতে একপ্রকার বাধ্য ছিলাম। আর এসব কার্যক্রমে পাঠাগারগুলোর আসাও অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।’
এসব বিষয়ে কথা বলতে স্ট্রিমের পক্ষ থেকে মিনার মনসুরকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে তাঁর সঙ্গে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। অবশেষে হোয়াটসঅ্যাপে ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কেন শেখ হাসিনাকে লেখক হিসেবে উদ্যাপন করেছিল? তাঁকে কেন লেখক পাঠ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছিল?’ এ রকম দুটি প্রশ্ন লিখে পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো কিছুতেই সাড়া দেননি।
শুধু শেখ হাসিনার লেখা বই নিয়ে নানা আয়োজন করেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র খ্যান্ত হয়নি। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ওপরে লেখা হয়েছে, এমন বই নিয়েও তারা পাঠ কার্যক্রমের আয়োজন করে। ‘১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন’ শিরোনামে প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো সরাফ আহমেদের লেখা বইটি নিয়ে তারা পাঠ কার্যক্রম করেছিল ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট। আর বইটি পড়তে দেওয়া হয়েছিল তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে এবং অনুষ্ঠান শেষে তাদের মতামতও জানতে চাওয়া হয়েছিল।
শেখ হাসিনাকে ঘিরে গ্রন্থকেন্দ্রের এসব কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক জিয়া হাশান বলেন, ‘লেখকদের উদ্যাপন করা খুবই ভালো ব্যাপার। কিন্তু সেখানে কেন শেখ হাসিনার নাম আসবে!’ এ ধরনের কাজের নিন্দা জানিয়ে এই লেখক বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে আসলে যেমন পদলেহন আর চটুকারিতা করা হয়েছে, তেমনি নিয়মও ভাঙা হয়েছে। আর সাহিত্যে শেখ হাসিনার অবদান কী?’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসকেরা স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার পর যেভাবে তাঁদের ‘লেখক পরিচয়’ সামনে নিয়ে এসেছেন, তার সঙ্গে শেখ হাসিনারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর ১৬ বছরের শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শেষ দিকে তিনি নিজের ‘লেখক পরিচয়’ অনেক বেশিভাবে উদ্যাপিত হতে দিয়েছেন। প্রায় একই ব্যাপার ঘটেছে জোসেফ স্তালিন, বেনিতো মুসোলিনি, মুয়াম্মার গাদ্দাফি কি ইদি আমিনের ক্ষেত্রেও।
তরুণ বয়সে কবিতা লিখতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একসময়কার একচ্ছত্র শাসক জোসেফ স্তালিন (১৮৭৮-১৯৫৩)। জর্জিয়ান ভাষায় ছাপাও হয়েছিল তাঁর কবিতা। পরে ক্ষমতায় এসে শিল্পসাহিত্যকে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের অস্ত্র বানান তিনি। তাঁর কবিতার মান নিয়ে সেই সময়কার রুশ সাহিত্য পণ্ডিতেরা প্রশ্ন তুললেও রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় তিনি ‘কবি’ ভাবমূর্তি ঠিকই বজায় রেখেছিলেন। তাঁর শাসনকাল যত দীর্ঘ হয়েছে, ততই তিনি নিজের ‘কবি পরিচয়’ বিস্তৃত করেছেন।
জোসেফ স্তালিনের মতো আরেক স্বৈরশাসক ছিলেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫)। তাঁর একনায়ককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সমালোচনামূলক সাহিত্য বা মুক্তচিন্তা প্রকাশের জায়গা ছিল না। তবে মুসেলিনির লেখা, বক্তৃতা বা তাঁর আদর্শ সম্পর্কিত বইগুলোকে এ সময় সরকারিভাবে ‘জাতীয় সাহিত্য’-এর মর্যাদা দেওয়া শুরু হয়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর লেখা বিদেশী ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়। ফলে মুসোলিনি যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজেকে একধরনের ‘লেখক-দার্শনিক’ হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির (১৯৪২-২০১১) লেখা তিন খণ্ডে প্রকাশিত বই ‘দ্য গ্রিন বুক’ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ওই দেশের কেন্দ্রীয় পাঠ্য বানানো হয়েছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সামরিক ও প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি বাধ্যতামূলক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হতো। গাদ্দাফির শাসনকাল যত বেড়েছে, তাঁর ‘লেখক পরিচয়’ তত উজ্জ্বল করতে মনোযোগ দিয়েছেন তিনি।
উগান্ডার তৃতীয় রাষ্ট্রপ্রধান ইদি আমিন (১৯২৪-২০০৩) লেখেননি কোনো সাহিত্য। কিন্তু তাঁর বক্তৃতা, চিঠি ও ঘোষণা ছাপানো হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। এরপর সরকারিভাবে এগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয় জনসাধারণেরে মধ্যে। এমনকি তাঁর বইপত্র পাঠ্যও করা হয়েছিল।
স্বৈরশাসকদের এমন মানসিকতার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন লেখক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘এরশাদ লেখক বা কবি হতে চেয়েছিলেন—এটা যতটা না সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য, সেই সময় চাটুকাররা তাঁকে কবি বানাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আর বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে এ রকম স্বৈরাচারী যাঁরা ছিলেন, তাঁদের তো লোকেরা তোষণ করেছে। এডলফ হিটলারের মাইন কাম্ফ, এটা তো তিনি লেখক হওয়ার জন্য লেখেননি, লিখেছিলেন রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে। ক্ষমতা-তোষণকারীরা সবসময়ই এমন করেন। আসলে শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারীর কাছে লেখক হওয়া বা না হওয়ায় কি আদৌ কিছু আসে-যায়? সত্যিকারের লেখকেরা সবসময়েই ক্ষমতা ও স্বৈরাচারের বিপক্ষে থাকেন।’
আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছিলেন, মায়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে জমিটির মালিকানা পাওয়ার বিষয়টি শেখ হাসিনা জানতে পারেন ২০০৭ সালে। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। তবে স্ট্রিমের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ১৯৯৪ সালেই এর পূর্ব পাশে প্রায় ১ বিঘা জমি কিনেছিলেন শেখ হাসিনা।
৩ দিন আগেজমি বিক্রেতা ও স্থানীয়রা জানান, এলাকায় কেউ জমি বিক্রির পরিকল্পনা করছে কি না, বৈকুণ্ঠ নাথ সে সবের খোঁজ রাখতেন। বিক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন তিনি। পরের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করে বিক্রেতাকে টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার কাজও করতেন। তবে জমি বেচাকেনার আলোচনার সময় ক্রেতার আসল পরিচয় গোপন রাখা হতো।
৬ দিন আগেসুনামগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত চার উপজেলায় রোগীর সেবার জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নৌ-অ্যাম্বুলেন্স দিলেও চালক নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় তেলের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বিষয়টি একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও গা করেনি তারা। এখন অ্যাম্বুলেন্সগুলো একেবারে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
৭ দিন আগেশেখ হাসিনার ‘শখের বাগানে’ দেখা মেলে সারিবদ্ধ আম গাছের। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এবং গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবি ঘেঁটে দেখা যায়, বাগানটির চারপাশে পাকা প্রাচীর ছিল। ৫ আগস্টের পরে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সাইনবোর্ড ও প্রাচীর দুটোই ভাঙা পড়ে। এ বাগানে বারি-৪ জাতের প্রায় ১৫০টি গাছ রয়েছে।
৯ দিন আগে