leadT1ad

বালির বাঁধে ভরসা রেখে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসের গল্প

সজল মিত্র রিচার্ড
সজল মিত্র রিচার্ড
ঢাকা
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৩১
ছবি: আফগান ক্রিকেট বোর্ডের এক্স পোস্ট থেকে

আবুধাবির প্রকৃতিতে আলো-ছায়ার খেলা যখন সন্ধ্যার আবরণে ঢেকে যাচ্ছিল, বাংলাদেশের ইনিংসের আলো নিভে গেছে তার অনেক আগেই। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে যা ঘটল, তা নতুন কিছু নয়, বরং পুরনো এক হতাশার প্রতিধ্বনি। একের পর এক দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং, অস্থির সিদ্ধান্ত, আর আত্মবিশ্বাসহীন উপস্থিতি, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ যেন এক ক্লান্ত সত্ত্বা, যে জানে নিজের ব্যর্থতার পরিণতি, তবুও কিছুই বদলাতে পারছে না।

প্রথম ওয়ানডেতে যেমন হয়েছিল, দ্বিতীয় ম্যাচেও তারই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের ব্যাটিং ধসে পড়ল কাগজের প্রাসাদের মতো। তানজিদ তামিম, হৃদয়, শান্ত, জাকের, সোহান সবার মধ্যে যেন এক অজানা আতঙ্ক। কেউ নিজের জায়গা নিয়ে নিশ্চিত নয়, কেউ হয়তো নিজের খেলার আনন্দই হারিয়ে ফেলেছে। যেখানে তার কাজ ছিলো মাঠে আগুন ঝরানো, সেখানে আজ তাদের চোখে কেবল এক ধরনের নিস্তব্ধতা। আর এখানেই বোঝা যাচ্ছে সবচেয়ে গভীর বাস্তবতা আপনি যে কাজটি করবেন, তা যদি আনন্দের সঙ্গে না করেন, সেই কাজের ফলাফলেও তা ফুটে উঠবে। ক্রিকেট তার ব্যতিক্রম নয়। পারফরম্যান্স-ভিত্তিক এই খেলায় মানসিক প্রশান্তি যতটা প্রয়োজন, শারীরিক দক্ষতাও ততটাই। কিন্তু হলফ করে বলা যায়, এই দলটির ড্রেসিং রুমের ভেতরে সেই প্রশান্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। গুমোট এক আবহ, অদৃশ্য এক অস্বস্তি যেন ঢেকে রেখেছে গোটা পরিবেশ।

তাদের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস কারও নেই। কারণ, তারা প্রতিভাবান। কিন্তু সেই প্রতিভা কেবল তখনই আলো ছড়ায়, যখন মন মুক্ত থাকে, যখন খেলা হয়ে ওঠে আনন্দের। আজকের বাংলাদেশ দলে সেই আনন্দের ছোঁয়া নেই। কেউ খেলছে বাধ্যতামূলক দায়িত্বে, কেউ খেলছে আত্মপ্রমাণের চাপে। দল হয়ে তারা যেন দলই নয়, একটা অসুখী পরিবারের মতো, যেখানে সবাই নিজের ঘরে আটকে আছে, কিন্তু কারও সঙ্গে কারও সম্পর্ক নেই।

দীর্ঘদিন ধরেই এই দলের বডি ল্যাংগুয়েজ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মাঠে তাদের হাঁটা, ক্যাচ নেওয়ার পরের প্রতিক্রিয়া, উইকেট পতনে সাড়া, সবকিছুই যেন নিঃশব্দ, উদাসীন। সেখানে দলীয় উৎসাহ, পারস্পরিক উচ্ছ্বাস, সেই পুরোনো। একসাথে লড়বো, মনোভাবটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, দলটা এখনো দল হয়ে উঠতে পারেনি।

এই মানসিক অস্থিরতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ব্যাটিংয়ের ধারাবাহিক ব্যর্থতা। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত ওয়ানডে ব্যাটিং গড় নেমে এসেছে ২৪ এর নিচে। টপ অর্ডার থেকে মিডল অর্ডার পর্যন্ত কারও ইনিংসই আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক নয়। তানজিদ তামিমের ব্যাটে দেখা যায় অস্থিরতা, হৃদয়ের ইনিংস থেমে যায় অর্ধেক পথে, শান্তর ব্যাট থেকে আসে বিচ্ছিন্ন ঝলকানি। কারও মধ্যে নেই স্থিতি বা অভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওয়ানডে ইতিহাস আজ প্রায় চার দশকের। ১৯৮৬ থেকে ২০২৫ এই দীর্ঘ পথচলায় অর্জনের গল্প কম নয়। কিন্তু আজ সেই অর্জনের আলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। কারণ, খেলোয়াড়রা যেন ভুলে গেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেবল প্রতিভার খেলা নয়, এটি মানসিক শক্তির পরীক্ষা।

প্রতিটি ইনিংস এখন যেন একই চিত্রনাট্য অনুসরণ করে। শুরুটা কিছুটা আশাব্যঞ্জক, কিন্তু মাঝপথেই ভেঙে পড়ে আত্মবিশ্বাসের দেয়াল। তারপর আসে সেই চেনা পতন। মিডল অর্ডার কিংবা লোয়ার অর্ডারের ব্যাটাররা তখন কেবল পরিসংখ্যানের ভারসাম্য রাখার প্রয়াসে ব্যস্ত থাকে। ফলাফল! আরেকটি পরাজয়, আর দর্শকের নীরব দীর্ঘশ্বাস।

দর্শকরা এখন আর হতবাক হন না। তারা জানেন, এটি কেবল আরেকটি দিন, আরেকটি ব্যর্থতার অধ্যায়। ম্যাচ শেষে যখন বলা হয়, “উইকেট কঠিন ছিল”, “কিছু ভুল শট খেলেছি”, “শিখছি”, তখন এই অজুহাতগুলোও আর বিশ্বাস জাগায় না। কারণ ৩৯ বছরের শিখনযাত্রা শেষে বাংলাদেশ এখনও একই ভুল করছে, একই অস্থিরতায় ভুগছে।

এই পরিস্থিতির শেকড় খুঁজলে পাওয়া যায় মানসিক দারিদ্র। ব্যাটাররা এখন আর দলীয় সাফল্যের জন্য নয়, নিজের অবস্থান রক্ষার জন্য খেলছে। তারা জানে, পারফরম্যান্সে ব্যর্থ হলেও হয়তো আবারও দলে সুযোগ মিলবে। এই নিশ্চিন্ততাই জন্ম দিয়েছে এক ধরনের উদাসীনতা। ফলাফল, মাঠে যা দেখা যায়, নখহীন টাইগারদের নির্বাক হেঁটে যাওয়া।

অন্যদিকে প্রতিপক্ষ দলগুলো, বিশেষ করে আফগানিস্তান, এখন আরও শৃঙ্খলিত, আত্মবিশ্বাসী। ইব্রাহিম জাদরান কিংবা রহমত শাহরা জানে, ইনিংস কীভাবে গড়তে হয়। তারা জানে, কখন ঝুঁকি নিতে হয়, কখন সংযম দেখাতে হয়। বাংলাদেশের ব্যাটাররা সেই বোধ হারিয়ে ফেলেছে। যেন খেলার মাঝেই খেলা ভুলে গেছে তারা।

কেউ কেউ বলেন, পতন খেলার অংশ। কিন্তু এই পতন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২৫০ রানের ইনিংস এখন বাংলাদেশের কাছে স্বপ্নের মতো। যে দল একসময় বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল, আজ সেই দল ২০০ রান পার করাকেই জয় মনে করছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এই দলটির ভেতরে এখন বিশ্বাসের ঘাটতি। খেলোয়াড়েরা হয়তো একই জার্সি পরে মাঠে নামছে, কিন্তু তাদের চোখে একই লক্ষ্যের প্রতিফলন নেই। কেউ দলের জন্য খেলছে না, খেলছে নিজের মানসিক শান্তি বা আত্মপ্রমাণের জন্য। ক্রিকেট যেমন টেকনিকের খেলা, তেমনি এটি সম্পর্কের খেলাও, যেখানে পারস্পরিক আস্থা আর একাত্মতা ছাড়া জেতা যায় না।

বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে প্রতিটি ব্যাটারকে আবার নতুন করে শিখতে হবে খেলার আনন্দ। খেলাটা ভালো না লাগলে, কোনো অনুশীলনই ফল দেবে না। খেলাটা উপভোগ করতে না পারলে, দেশের জন্য খেলার আত্মা মরে যায়।

আজ যখন শান্ত, হৃদয় বা তানজিদ আউট হয়ে ফিরে যায়, তখন সেটি কেবল একটি উইকেট পতন নয়, এটি একটি জাতির আশা ভাঙার প্রতীক। যখন বোলাররা চেষ্টা চালিয়ে যায়, অথচ ব্যাটাররা দায়িত্বহীনভাবে উইকেট ছুঁড়ে দেয়, তখন মনে হয়, মাঠে লড়াই নয়, বরং এক বিষণ্ন নীরবতা চলছে।

তবুও, সময় এখনো পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়নি। চাই কেবল এক নতুন সূচনা, এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব। যেখানে খেলোয়াড়রা আবারও শিখবে একে অপরের জন্য খেলতে, আবারও বিশ্বাস করবে জার্সির রঙে। কারণ, ক্রিকেট কখনো কেবল বল ও ব্যাটের খেলা নয়, এটি আত্মারও খেলা।

মাঠের আলো যখন নিভে আসে, তখন ড্রেসিং রুমে যে নীরবতা নেমে আসে, তা কেবল হারের নয়, তা এক আত্মশূন্যতার প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন সেই শূন্যতা থেকে পুনর্জন্মের অপেক্ষায়। আর যদি তারা এই পুনর্জন্মে ব্যর্থ হয়, তবে ইতিহাস তাদের স্মরণ করবে এমন এক দল হিসেবে- যারা টাইগার নামে পরিচিত ছিল, কিন্তু মাঠে রেখে গিয়েছিল কেবল নিরবতার প্রতিধ্বনি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত