leadT1ad

ব্রিফ হিস্ট্রি অব পিনিক

পিনিক! তিন বর্ণের ছোট্ট, পাঞ্চি একটা শব্দ। বাংলার ইয়ুথের বুলিতে ব্যাপকভাবে চালু একটা শব্দ। শব্দটার উৎপত্তি কীভাবে ঘটলো? কোত্থেকে ঘটলো? এই লেখা পিনিক শব্দের ব্রিফ হিস্ট্রি।

স্ট্রিম গ্রাফিক

‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ,
ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভিতর বাড়ি, পায়ের ভিতর পা,
বুকের ভিতরে বুক
আর কিছু নয়।’

লাইনগুলা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়’ কবিতার অংশ। এক জুনিয়র এই লাইনগুলা শুনে বলছিলো, ‘কঠিন পিনিকের কবিতা তো!’ ১৯৬৭ সালে রচিত কবিতা ২১ শতকের ৩ নাম্বার দশকে আইসা এই প্রজন্মরে যে ‘কঠিন পিনিক’ দিতে পারে—ভাবলে অবাক লাগে।

আরও অবাক করা বিষয় হইতেছে, এত চালু একটা শব্দের অরিজিনটা বেশ ঝাপসা। পিনিক জিনিসটার বয়স হয়তো মানবজাতির বয়সের সমান কিন্তু বাংলা ভাষায় ‘পিনিক’-এর বয়স কত, সেটা বলাও কঠিন। বাংলায় পিনিক শব্দের বয়স মাপামাপি ও অন্যান্য হদিস আমরা নেব কিন্তু তার আগে জানা দরকার শব্দটার মানে কী?

পিনিকের মানে ও ব্যবহার

বাংলা ভাষায় সুন্দর এক সংযোজন 'পিনিক'। তিন বর্ণের ছোট্ট, পাঞ্চি একটা শব্দ পিনিক। দুইটা স্বরধ্বনির (‘ই’) পরে খটখটে একটা ক ধ্বনিতে আৎকা স্টপ। শব্দটা যেভাবে আৎকা থাইমা যায়, পিনিকের ফিল কিন্তু তার সাথে মেলে না। পিনিকের সাথে সম্পর্ক ফ্লো বা প্রবহমানতার। আরবান ইয়ুথের মধ্যে শব্দটা ব্যাপকমাত্রায় চালু আছে। এমনকি যারা 'পিনিক' করে না তারাও 'পিনিক' কথাটা ব্যবহার করে। এই শ্রেণির শব্দরে বলে ইয়ুথস্পিক। অবশ্য স্ল্যাং মূলত ইয়ুথেরই কারবার।

পিনিক শব্দের ব্যবহার বহুমুখী। এমনকি যেকোনো এক্সাইটিং, ইন্ট্রেস্টিং অবস্থারে পিনিক বইলা চালায়ে দেয় এমন ঘটনাও আমি দেখছি। তবে পিনিক-এর মোটাদাগে তিন ধরনের ব্যবহার আছে।

১. নেশা করে (বা না করে) পাওয়া একস্টেটিক স্টেইট বা তুরীয় অবস্থা। তুর্কচেতে বলে কাফাম গুজাল। ('ডিস্টার্ব দিও না, ম্যান, পিনিকে আছি’।)

২. অকারণ উত্তেজনা ('সবকিছুতে তোর এত পিনিক ক্যান, দোস্ত? হোয়াই?')

৩. (অনেক সময়) ইংলিশ 'হাই’ হওয়ার সমার্থক এবং সেক্ষেত্রে ক্রিয়াপদ। ( মামা, খালি পানি খায়া পিনিক করলে হবে?)

বাংলা শিল্প- সাহিত্যে কি পিনিক আছে?

শক্তির কবিতাতেই তো কঠিন পিনিক আছে! না, পিনিক শব্দের নমুনা বাংলা সাহিত্যে আমি পাই নাই। এখন যে অর্থে পিনিক কথাটা চালু আছে, বাংলা ভাষায় সেইটা আগে ছিল না। পিনিক শব্দটাই ছিল না। পুরান বাংলা সাহিত্যে কাছাকাছি অর্থের একটা শব্দ পাওয়া যায়: মৌতাত।

বঙ্কিমের কমলাকান্তের দপ্তরেই মৌতাত পাইতেছি।

প্রসন্ন তখন কমলাকান্তের প্রতি চাহিয়া বলিল, ‘ঠাকুর! মৌতাতের সময় হয়েছে না?’
কমল। মৌতাতের আবার সময় কি রে বেটী –“অজরামরবৎ প্রাজ্ঞঃ বিদ্যাং নেশ্চাঞ্চ চিন্তয়েৎ।’
প্রসন্ন । অং বং এখন রাখ –এখন মৌতাত করিবে?

বাংলা হিপহপের অন্যতম সেরা অ্যালবাম কাহিনী সিন পাট রিলিজ হয় ২০০৯ সালে। আপটাউন লোকলজ– এর এই অ্যালবামের গান, ‘টান তুই টান’ –এ পিনিক কথাটা আছে। কাহিনী সিন পাট-এই আছে ভীম পিনিক শব্দটাও।

জালালি সেট–এর গান বনবাসের সাধন (২০১৬) -এ পাইতেছি:

টাইনা ধুমা ভিত্রে লইয়া ছাড়ি
পিনিক আর ঝিনিকে ঝিনিক

‘পিনিক পিনিক লাগে’ নামে একটা গান কিছুদিন আগে টিকটকে ভাইরাল হয়। আদর আজাদ ও বুবলি অভিনিত এবং জাহিদ জুয়েল পরিচালিত একটা মুভিও আছে ‘পিনিক’ নামে।

কোত্থেকে এলো পিনিক?

উৎপত্তি প্রক্রিয়া নির্ধারণ কঠিন। এত চালু একটা শব্দ অথচ বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক অভিধানে শব্দটাই নাই। এমনকি ঢাউস সাইজের বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানেও পিনিক কথাটা নাই। মাঝেমধ্যে লাগে যেন একাডেমি নিজেই একটা মূর্তিমান পিনিক।

আমার অনুমান ছিলো, পিনিক শব্দের বয়স খুব বেশি না। ইন্টারনেটে ২০০৯ সালের আগের নমুনা পাই নাই। বাস্তবে আরও আগে থেকে ব্যবহার থাকার কথা।

অনেকে বলতেছেন, 'পিকনিক' থেকে অপভ্রংশ হয়া 'পিনিক' হইছে। পথে অর্থও বদলায়ে গেছে। আর্বান ডিকশোনারিও

এইটাই বলতেছে। কিন্তু এই উৎস ঠিক মনে হয় না। কারণ, সমস্যা হইতেছে, অর্থের দিক দিয়া বাংলা আর আর ইংলিশ পিনিক একই না। ইংলিশে স্ল্যাং হিসাবে পিনিক এখনও ‘পিকনিক’ অর্থেই আছে। তাছাড়া বাংলাদেশে পিকনিক আরবান পপুলার ইয়ুথ কালচারের অংশ না। অন্তত গত ২০ বছরে নাই। যে সাবকালচারে পিকনিক বা চড়ুইভাতি বলে জিনিসটা এখনো চালু আছে, সেই সাবকালচারে পিনিক শব্দটার অরিজিনের কোনো সম্ভাবনা নাই। যেমন— bad buzz ইংলিশ শব্দ। কিন্তু এর অরিজিন ইউরোপ-আম্রিকায় না, বাংলাদেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের (স্কলাস্টিকা, সানবিমস, মাস্টারমাইন্ড ) সাবকালচারে। পরে শব্দটা অন্যান্য আরবান ইয়ুথ সাবকালচারে ছড়ায়ে পড়ছে। ফলে 'ব্যাডবাজ' বাংলা শব্দও। আমার ধারণা ছিল পিনিক শব্দটাও এই সাবকালচারে উৎপন্ন। আমার এই ধারণা ভুল।

শব্দটা এখন মোটামুটি সব ধরনের সাবকালচারে ছড়ায়ে পড়ছে যদিও আরবান মিক্লা আর আপার মিক্লাতে কাটতি বেশি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ফুলবাড়িয়ার স্বল্প সাক্ষর ও নিরক্ষর নেশারুদের মধ্যে এই শব্দের প্রচলন দেখছেন বইলা দাবি করছেন অনেকে। এদের একজন, বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি -এর লেখক ও ভাষা গবেষক মো: শাহাবুদ্দিন সাবু। তিনি ১৯৯০-এর দিকে ফুলবাড়িয়ার নেশারুদের মধ্যে পিনিক শব্দের ব্যবহার দেখছেন।

আমার একটা অনুমান: ecstatic state বা তুরীয় অবস্থার তীব্রতায় প্যানিকের সাথে কিছুটা মিলের কারণে, তীব্র আনন্দ বুঝাইতে পিনিক শব্দ আসতে পারে।

পিনিক চলছে, পিনিক চলবে

ইয়ুথের প্রাত্যহিক বুলিতে পিনিক এখনো খুবই জীবন্ত। ব্যবহার কমার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাইতেছে না। কিছু শব্দের রিপ্লেসমেন্ট সহজে আসে না। পিনিক তেমনই এক শব্দ। মানুষ থাকলে পিনিক থাকবে, পিনিকে থাকবে, পিনিক করবে। আমার মনে হয়, আরও দীর্ঘকাল বাংলা ভাষায় পিনিক শদবটাও চলবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত