leadT1ad

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ ‘এখনও অনিশ্চিত’

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪: ৫৩
রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: পিআইডি

‘জুলাই জাতীয় সনদ’ নিয়ে আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের (নোট অব ডিসেন্টসহ) বিষয়ে একমত হলেও সেসব বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো ভিন্নমত রয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে। বাস্তবায়নের জন্য আগের মতোই ‘অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ’ অথবা গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে—গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। আর অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করে আসা বিএনপির অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দলটি এখন বলছে, বিশেষ বা অতিরিক্ত সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া যেতে পারে।

গতকাল রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। বৈঠকের একটি অংশে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই সনদের সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথ নিয়ে এদিনের বৈঠকেও কোনো সমাধান আসেনি।

আলোচনায় নির্বাচনের প্রসঙ্গও উঠে আসে। বৈঠকে বিএনপি জানায়, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন যেকোনোভাবেই করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। জামায়াতে ইসলামীও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পক্ষে, তবে তাঁদের শর্ত—জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হলে সেটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। অপরদিকে, এনসিপির দাবি—সংস্কারকে টেকসই করতে হলে দরকার গণপরিষদ নির্বাচন।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলগুলোর প্রতিনিধিরা। প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘এনসিপি মনে করে, একটি গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং নতুনভাবে ধারাপত্র ও অনুচ্ছেদ সাজিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তবেই এগুলো টেকসই রূপ পাবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি।’

আখতার হোসেন আরও বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করছি। আলোচনা দুটি ক্ষেত্রে ভাগ করা যায়—যেসব প্রস্তাব সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলো অধ্যাদেশ বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, সেগুলো কেবল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেই টেকসইভাবে কার্যকর করা সম্ভব। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনো কিছুটা সংশয় আছে।’

আখতার হোসেনের মতে, ‘বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই হাইকোর্টে একাধিক সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং সেগুলোর অনেকগুলো বাতিলও হয়েছে। তাই আমরা যে মৌলিক পরিবর্তনগুলো আনতে চাইছি, সেগুলো কীভাবে টেকসইভাবে কার্যকর করা যায়, তা নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।’

আখতার হোসেন আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। এজন্য কমিশনের সভাপতি মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আবেদন, কমিশনের মেয়াদ কিছুটা বাড়ানো হোক, যাতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রশ্নাতীতভাবে সম্পন্ন করা যায়।’

অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী মনে করে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন হলে তা হবে ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য’। দলের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দুটি উপায় হতে পারে। একটি হলো প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার—যার নজির অতীতে আছে। অন্যটি গণভোট—এ দেশের ইতিহাসেও তার প্রমাণ আছে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তবে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নেওয়া যেতে পারে।’

হামিদুর রহমান আরও যোগ করেন, ‘সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল—প্রথমত, সংস্কার বাস্তবায়ন। বিগত দিনে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে ধ্বংসস্তূপ, বিচ্যুতি ও অব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা সরিয়ে বাংলাদেশকে নতুন পথে নিয়ে যাওয়া সরকারের অঙ্গীকার। দ্বিতীয়ত, গণহত্যার বিচার সম্পন্ন করা। আর তৃতীয়ত, একটি উৎসবমুখর পরিবেশে দেশের ইতিহাসের সেরা নির্বাচন আয়োজন করা।’

বিএনপির নতুন প্রস্তাব

সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে ছিল বিএনপি। তবে সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এদিন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ৮২৬টি ছোট-বড় সংস্কার প্রস্তাব পেয়েছি। এগুলো দলে আলোচনা করে লিখিত মতামত প্রদান করেছি। এর মধ্যে মাত্র ৫১টি প্রস্তাবে আমাদের দ্বিমত রয়েছে, আর ১১৫টি প্রস্তাবে আমাদের মতামতসহ ভিন্নমত তুলে ধরে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি। এ বিষয়ে প্রায় চূড়ান্ত ঐকমত্য হয়েছে। মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে মোট ৮৪৫টি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি হয়েছে।কোনো বিষয় দুই দিন পরে টিকবে না বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে—এমন কোনো প্রস্তাব আমরা রেখে দিতে চাই না। যেসব বিষয়ে একমত হয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়িত হবে। শুধু প্রক্রিয়াগত কারণে কিছু সময় লাগতে পারে।’

বাকি থাকা ১৯টি সাংবিধানিক বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এর মধ্যে কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ আমরা একমত হয়েছি। আমাদের মতে ৭০ অনুচ্ছেদের চারটি ক্ষেত্রে এমপিদের স্বাধীনতা সীমিত রাখা ভালো হবে। সর্বনিম্ন দুটি বিষয়ে সবাই একমত। নোট অব ডিসেন্টের ভাষা অনুযায়ী সনদ তৈরি হচ্ছে এবং আমরা সেভাবে সই করব। যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবেন, তারা এই নোট অব ডিসেন্ট রক্ষা করে বাস্তবায়ন করবেন। এটি কোনো জটিল বিষয় নয়।এগুলো বাস্তবায়ন খুব সহজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ফোরাম কোনটি? সাংবিধানিক বিষয়গুলো কি পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরামে করা সম্ভব? এ বিষয়ে আইনি পরামর্শ নিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে পারি। এর বাইরে কিছু থাকলে তা জানানো হলে আমরা একমত। আমরা সনদে সইয়ের জন্য প্রস্তুত আছি, আগেও বলেছি।’

সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আইনি ভিত্তি নিয়ে আলোচনা হলে আমরা অংশ নেব। এই আলোচনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এর আগে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। সেখান থেকে প্রণীত অঙ্গীকারনামার খসড়া আমরা লিখিতভাবে যাচাই করেছি। যেসব বিষয় ভবিষ্যতে টিকবে না, সেগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না।কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বা কোনো দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না—এভাবে সংবিধানের ওপর সনদ স্থাপন গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আরও অনেক উপায় থাকতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা এর বৈধতা ও আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে পারি। প্রয়োজনে আপিল বিভাগের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। এটিকে এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অর্ডার বা স্পেশাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার হিসেবে প্রণয়ন করা যায় কি না, তা যাচাই করা হবে। এতে ভবিষ্যতে আদালতে চ্যালেঞ্জ এলে বলা যাবে যে আমরা পরামর্শ নিয়েছি। এখন সেই পরামর্শ দিতে পারে, নাও পারে।’

প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘স্পেশাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) প্রয়োগ করেছেন। আমরা কেউ এতে আপত্তি জানাইনি। ঐকমত্য কমিশন থেকেই আমরা আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, যাতে সনদ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত আপনি নেন। তারপর আপনি তা বাস্তবায়ন করেছেন। তবে যদি কোনো নাগরিক এটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে কোথাও যায়, তা আপনার গ্লোবাল রেপুটেশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। আমরা অনেক আলোচনা করেছি, এবং সেই আলোচনার ভিত্তিতে আপনি মতামত নিতে পারেন। সেই স্বাধীনতা আপনারই আছে।’

সব দলকে জুলাই সনদে সই করার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

তিন ঘণ্টার বৈঠকে প্রায় এক ঘণ্টা উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিন দলের প্রতিনিধিদের বক্তব্যের পর তিনি সবাইকে একমত হয়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি একমাত্র সুযোগ। আমাদের এটি গ্রহণ করতেই হবে। এখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সমঝোতা হোক বা ঐক্য হোক, যাই বলুন না কেন, নির্বাচনে আমরা একমত হয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে আর কোনো দ্বিমত রাখা হবে না।’

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সামনে ইউনূস আরও বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত আবেদন, যখনই আপনারা এই সনদে সই করবেন, সেটা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করুন—‘‘আমরা একমত হয়েছি’’। তখন নির্বাচনসহ সব প্রক্রিয়া সার্থক হবে।’

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন জরুরি, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হতে পারে

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সংস্কার নিজস্ব ধারায় চলবে, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিচারেও নির্দিষ্ট সময়সীমা আরোপ করা যাবে না, তা করলে অবিচার ঘটবে। যে কোনো সরকারই আসুক, বিচার প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।’

সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন,‘বিচার চলা আমাদের কমিটমেন্ট, জাতির কমিটমেন্ট। তবে নির্বাচনকে এর সঙ্গে শর্তযুক্ত করা যাবে না। যদি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশের নির্বাচনের পরিবেশ অনিশ্চিত হয়, তা ফ্যাসিবাদী চেষ্টা হিসেবে দেখা হবে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ফ্যাসিবাদী শক্তি সুযোগ পাবে, যা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য বিপজ্জনক। অনেকে বলছেন, এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। আমি বলছি, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকি হতে পারে। এখানে দুইটি আঞ্চলিক শক্তি এবং একটি বৈশ্বিক শক্তি জড়িত হতে পারে। আমরা চাই না, বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছাক। তাই নির্ধারিত সময়সীমায় নির্বাচন অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে।’

বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও সেখানে বক্তব্য দেন।

বৈঠক শেষে বেরিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আগামী বুধবার আবার বৈঠক হবে, সেদিন বিস্তারিত জানানো হবে। তবে, দলগুলো জুলাই সনদ কবে সই করবে, সে বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে এখনও নতুন কিছু জানানো হয়নি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত