leadT1ad

কেন বেগম রোকেয়া আজও বাংলাদেশের নারী মুক্তির অগ্রদূত

মাহিসুন রাশ্তি
মাহিসুন রাশ্তি

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ৪২
স্ট্রিম গ্রাফিক

যদি একজন জেলেকে জিজ্ঞেস করি, ‘পচা মাছের গন্ধ ভালো না খারাপ?’ সে কী বলবে?

সে নতুন কিছু বলবে না। কারণ সে ওই গন্ধে অভ্যস্ত।

ঠিক একইভাবে, আমরাও এত দীর্ঘকাল ধরে অবরোধে আছি যে অবরোধটাই এখন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর ‘অবরোধবাসিনী’ (১৯৩১) বইয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন।

নারীদের এই বন্দীদশা, নীরবতা, আর আপস করে নেওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। এতটাই স্বাভাবিক যে রোকেয়ার মতো মানুষ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর আগে পর্যন্ত আমরা বৈষম্যের এই পচা গন্ধ প্রায় টেরই পাইনি। নারীবাদের ভাষা জানার অনেক আগেই আমি এটা বুঝেছিলাম।

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমি ‘অবরোধবাসিনী’ বইটি পড়ি। ‘নারীবাদ’ কী জিনিস, সেটা না জানলেও ‘অবিচার’ কাকে বলে তা আমি ঠিকই বুঝেছিলাম। আমার লেখাপড়া শেখার সুযোগ ছিল। অন্য অনেক মেয়ের চাইতে তুলনামূলকভাবে আমি ভালো অবস্থায় ছিলাম। সব ধরনের নিরাপত্তাও ছিল। তবুও এমন অজস্র কাজ ছিল যা আমার ‘করা উচিত নয়’, ‘বলা উচিত নয়’ বা ‘স্বপ্ন দেখা উচিত নয়’।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কোন দিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে? আমার জন্মদিনের ঠিক আগের দিনই বেগম রোকেয়া দিবস। এটাও তাঁকে আমার মনে রাখার একটা কারণ হতে পারে! কিন্তু পঞ্জিকার এই সামান্য সমাপতনের চেয়েও এই মানুষটির গুরুত্ব অনেক বেশি।

তিনি বিশ শতকের একজন নারীবাদী ছিলেন, এটাই যে আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে, এমন নয়। আমি মুগ্ধ হই তাঁর নারীবাদ চর্চার ধরণে। তিনি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েননি। তিনি কোন জ্বালাও-পোড়াওয়ের ডাক দেননি। কিন্তু তিনি যা করেছেন, তা অনেক বেশি বিপজ্জনক। তিনি পরিষ্কারভাবে ভেবেছিলেন, চমৎকারভাবে লিখেছিলেন এবং তীব্রভাবে সমালোচনা করেছিলেন।

যে সময়ে প্রত্যাশা করা হতো যেন নারীরা নিজেদের বন্দিদশাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে মেনে নেয়। এমনই এক সময়ে তিনি সাহস করে বলেছিলেন—পর্দা কোনো সুরক্ষা নয়, এটা একটা খাঁচা। আর সেই খাঁচার তালা হিসেবে যা কাজ করছে, তার নাম তিনি দিয়েছিলেন পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষতন্ত্র নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

১৯৩১ সালে প্রকাশিত বইটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল যে কীভাবে প্রথা আর ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা ধর্মীয় নীতিকে কাজে লাগিয়ে নারীদের রাখা হয়েছিল অদৃশ্য আর ক্ষমতাহীন করে। রোকেয়া তাঁর সমালোচনা নিভৃত আড্ডায় ফিসফিস করে বলেননি। সেই সমালোচনা বই প্রকাশ করে স্থায়ী করে দিয়েছিলেন।

এক শতাব্দী আগে, পর্দা নারীদের শারীরিকভাবে ঘরে বন্দি করে রাখত। আজ, নীতি ও সামাজিক প্রত্যাশাগুলো ঠিক একই কাজ করছে। শুধু ভাষাটা পাল্টে গেছে। খাঁচাটিকে নতুন রং করা হয়েছে, কিন্তু এটা আজও একটা খাঁচাই। পুরুষরা এখনও নারীদের শরীর, সময় ও শ্রম নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা না করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রণকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য ধর্মকে আজও টেনে আনা হয়। বন্দিদশাটা কেবল পোশাক বদলেছে।

খাঁচা বদলায়, মুক্তি মেলে না

আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আজ যদি কোনো নারী ‘অবরোধবাসিনী’ বইটি লিখতেন, তবে তাঁর কী হতো? তিনি কি প্রশংসা পেতেন? নাকি তাঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হতো? তিনি কি অনলাইন হয়রানি, ধর্মবিরোধিতার অপবাদ, কিংবা নিরাপত্তাহীনতার হুমকির মুখে পড়তেন? সমাজ কি তাঁর এই সাহস সহ্য করত? নাকি তাঁর সমালোচনার মুখ বন্ধ করার জন্য নতুন কোনো পথ খুঁজে নিত?

এই ভাবনার কারণ আছে। অস্বস্তিকর সত্যিটা হলো, আমরা রোকেয়ার কাল থেকে যতটা দূরে সরে এসেছি বলে মনে করি, আসলে ততটা দূরে আসতে পারিনি।

এই তো কিছুদিন আগে, জামায়াত-এ-ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান ঘোষণা করলেন যে, যদি তাঁর দল ক্ষমতায় আসে, তবে তারা নারীদের কাজের সময় পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে। প্রশ্ন হলো, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি কার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন? নিশ্চয়ই সেই নারীদের সঙ্গে নয়, যাদের জীবন ও জীবিকা এই রকম সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হবে।

এই ঘোষণাটি নারীদেরকেও দ্বিধাবিভক্ত করে দিল। কেউ কেউ এটিকে একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত বলে প্রশংসা করলেন। যুক্তি দিলেন যে নারীদের ঘরে থাকাটাই ধর্মীয় প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আবার অনেকে ভয় পেলেন। কারণ তাঁরা ঠিকই বুঝতে পারলেন—এটা আসলে নারীদের মতামত ছাড়াই তাদের জীবন সম্পর্কে পুরুষদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার একটি কৌশল।

রোকেয়া ঠিক এই ব্যাপারটি নিয়েই আমাদের সতর্ক করেছিলেন। এক শতাব্দী আগে, পর্দা নারীদের শারীরিকভাবে ঘরে বন্দি করে রাখত। আজ, নীতি ও সামাজিক প্রত্যাশাগুলো ঠিক একই কাজ করছে। শুধু ভাষাটা পাল্টে গেছে। খাঁচাটিকে নতুন রং করা হয়েছে, কিন্তু এটা আজও একটা খাঁচাই। পুরুষরা এখনো নারীদের শরীর, সময় ও শ্রম নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা না করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রণকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য ধর্মকে আজও টেনে আনা হয়। বন্দিদশাটা কেবল পোশাক বদলেছে।

নিজের মতো করে ভাবার অধিকার সবারই আছে। ভিন্নমত পোষণ করাও অন্যায় নয়। কিন্তু একটা বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তোলে, আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। আর তা হলো—অনেক নারী আজও বুঝতে পারেন না যে সমাজ কীভাবে তাদের বন্দি করে রাখছে। তারা নিজেরাই তাদের খাঁচার পক্ষ নেন। তারা সেগুলোকে ঐতিহ্য, শালীনতা ও সুরক্ষা বলে ডাকে। পচা মাছের পাশে থাকা জেলের মতো তারাও এই গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে পচা গন্ধটা আর টের পায় না।

নারীর শিক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক স্বাধীনতা, সাহিত্য ও আত্মমর্যাদার মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক আছে। রোকেয়ার প্রতিভা ছিল সেই সম্পর্কটি অনুধাবন করার মধ্যে। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী যিনি এই ক্ষেত্রগুলো কীভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে একজন নারীর ভাগ্য গড়ে তোলে তা দেখতে পেয়েছিলেন। শুধু দেখা নয়, স্পষ্ট করে বলতেও পেরেছিলেন।

প্রথম নন, তবুও তিনি সবচেয়ে দূরদর্শী

রোকেয়া সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ভুল ধারণাগুলোর মধ্যে একটি হলো যে তিনি বাংলায় মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু আসলে তিনি তা করেননি।

কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় (১৮৭৩) এবং কলকাতার অন্যান্য স্কুল তাঁর স্কুলের আগে থেকেই চালু ছিল।

একইভাবে, তিনি বাংলার প্রথম মুসলিম নারী লেখিকাও ছিলেন না। তাঁর আগে আজিজুন্নেসা খাতুন, ফয়জুন্নেসা, তাহেরুন নেসা এবং লতিফুন নেসার মতো লেখিকারা বই প্রকাশ করেছিলেন।

তাহলে কেন রোকেয়াকে আজও অগ্রদূত মনে করা হয়?

কারণ, অগ্রদূত হওয়া মানে শুধু ‘প্রথম’ হওয়া নয়। এর মানে হলো আমূল পরিবর্তন আনা।

নারীর শিক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক স্বাধীনতা, সাহিত্য ও আত্মমর্যাদার মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক আছে। রোকেয়ার প্রতিভা ছিল সেই সম্পর্কটি অনুধাবন করার মধ্যে। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী যিনি এই ক্ষেত্রগুলো কীভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে একজন নারীর ভাগ্য গড়ে তোলে তা দেখতে পেয়েছিলেন। শুধু দেখা নয়, স্পষ্ট করে বলতেও পেরেছিলেন।

তিনি শুধু পরিবর্তনের অংশীদার হননি। তিনি পরিবর্তনকে তত্ত্ব হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। তা লিখেছিলেন, শিখিয়েছিলেন আর এর জন্য লড়াই করেছিলেন।

রোকেয়া একজন অগ্রদূত। নারীর ওপর অনেক অত্যাচারে চাপানো হয়। এর মধ্যে আছে শিক্ষার অভাব, আর্থিক পরাধীনতা, সামাজিক বিধিনিষেধ, ভুল ব্যাখ্যা করা ধর্ম এবং মানসিক আত্মসমর্পণ। তিনি এই সম্পূর্ণ চিত্রটি বুঝতে পেরেছিলেন। এর প্রত্যেকটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। নারীবাদ একটি আলাদা বিষয়ে পরিণত হওয়ার অনেক আগেই তিনি নারীর স্বাধীনতার একটি সুসংহত, আমূল এবং বাস্তবসম্মত তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন।

স্বপ্ন নামের রাজনৈতিক হাতিয়ার

রোকেয়ার সবচেয়ে উজ্জ্বল সৃষ্টিগুলোর মধ্যে একটি হলো 'সুলতানার স্বপ্ন' (‘সুলতানাজ ড্রিম’)। এই বইটিকে প্রথম দেখায় একটি চটুল নারীবাদী ফ্যান্টাসি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই স্বপ্নের ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক রাজনৈতিক হাতিয়ার।

তাঁর বিদ্রোহকে একটি স্বপ্নের আবরণে ঢেকে তিনি বাইরের এবং ভেতরের সেন্সরশিপকেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যে স্বপ্নের জগৎ তৈরি করেছিলেন, সেই ‘নারীস্থান’-এ নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার, শক্তি গবেষণা কেন্দ্র এবং জাতীয় সরকার পরিচালনা করে। পুরুষদেরকে রাখা হয় ‘মর্দানা’-তে। এই মর্দানা বাস্তবের নারীদের ‘জেনানা’ (অবরুদ্ধ স্থান)-এর ঠিক বিপরীত। যুদ্ধকে তিনি সহিংসতা নয়, মেধা দিয়ে পরাজিত করবার পক্ষে। প্রযুক্তি সেখানে পরিবেশবান্ধব, নবায়নযোগ্য এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। সমাজকে সেখানে শক্তি দিয়ে নয়, জ্ঞান দিয়ে সংগঠিত করা হয়।

আজও আমরা পুরুষতন্ত্র নিয়ে বলতে গেলে এটা এড়িয়ে যাই যে নারীরাও এই তন্ত্রের নিয়মগুলোকে নিজের ভেতরে লালন করে। রোকেয়া সেই অস্বস্তিকর সত্যিটা বলার সাহস করেছিলেন। নারীরা যখন বিশ্বাস করে যে অন্যের অনুমতি ছাড়া তারা বাঁচতে পারবে না, তখন তারা নিজেদের কারাবাসের দায় নেন।

এই স্বপ্ন বাস্তব থেকে কোনো পলায়ন নয়। এটি একটি দিকনির্দেশনা।

নারীস্থানের নারীরা শারীরিক শক্তি দিয়ে পুরুষদের পরাজিত করে না। তারা বিজ্ঞান, যুক্তি ও সংগঠনকে ব্যবহার করে। পুরুষরা শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় নেতৃত্ব দিতে জন্মগতভাবে উপযুক্ত, সুলতানার স্বপ্নে রোকেয়া সেই মিথটিকে ধ্বংস করেন। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, একটি সিংহ মানুষের চেয়ে শক্তিশালী, তবুও মানুষই সিংহের উপর রাজত্ব করে। শক্তি ক্ষমতা নয়। জ্ঞানই আসল ক্ষমতা।

তবে তিনি নারীদেরও ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি দেখান যে নারীরা যখন নিজেদের আত্মসমর্পণকে ভাগ্য বলে মেনে নেন, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের বন্দি হওয়ার পেছনে অবদান রাখেন। যে নারীরা মনে করেন তাদের প্রতিরোধ করবার ক্ষমতা নেই তিনি সেই নারীদের সমালোচনা করেন। তিনি অপছন্দ করেন সেই নারীদের যারা নিজের স্বার্থ বোঝে না।

এই ধরনের সততা বিরল। আজও আমরা পুরুষতন্ত্র নিয়ে বলতে গেলে এটা এড়িয়ে যাই যে নারীরাও এই তন্ত্রের নিয়মগুলোকে নিজের ভেতরে লালন করে। রোকেয়া সেই অস্বস্তিকর সত্যিটা বলার সাহস করেছিলেন। নারীরা যখন বিশ্বাস করে যে অন্যের অনুমতি ছাড়া তারা বাঁচতে পারবে না, তখন তারা নিজেদের কারাবাসের দায় নেন।

রোকেয়াকে চিরন্তন করে রেখেছে কেবল তাঁর কথা নয়, তাঁর কাজও। তিনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল’ শুধু একটি স্কুল ছিল না। এটি ছিল নারীর গতিশীলতা, শিক্ষা ও আত্মবিশ্বাসের বাস্তব ভিত্তি। তিনি ধর্ম ও শ্রেণি নির্বিশেষে কাজ করেছিলেন। হিন্দু, মুসলিম, গরিব, ধনী, গ্রামীণ ও শহুরে নারীদের একত্রিত করে একটি সম্মিলিত কণ্ঠস্বর তৈরি করেছিলেন।

‘নারী অধিকার আন্দোলন’ সামাজিকভাবে স্বীকৃত ক্ষেত্র হওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি এমন সংগঠন তৈরি করেছিলেন যেখানে নারীরা সামাজিক সংস্কারে অংশ নিতে পারত।

অগ্রগতির আধুনিক বিভ্রম

এই আধুনিক যুগে আমরা রোকেয়ার সংগ্রামগুলোকে পেছনে ফেলে এসেছি। এমনটা ভাবতে আমাদের ভাল লাগে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা ভর্তি হচ্ছে। নারীরা মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করছে। আমরা জোরেশোরে ক্ষমতায়নের কথা বলছি। কিন্তু এই নতুন আবরণের নিচে সেই পুরনো ব্যবস্থাগুলো এখনও নীরবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।

আইনের চেয়েও সামাজিক বিচার এখনও নারীদের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। গৃহস্থালির কাজ এখনও প্রায় পুরোপুরি নারীদের কাঁধেই থাকে। সম্মান, শালীনতা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নতুন নামে সহিংসতা চলছে। নারীদের গতিশীলতা এখনও নজরদারি বা দর-কষাকষি সাপেক্ষশর্তযুক্ত। আমরা প্রকাশ্যে ক্ষমতাধারী নারীদের প্রশংসা করি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাশা করি তাদের তাদের চুপসে যাওয়া।

রোকেয়া যদি এই অবস্থা দেখতেন, তাহলে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করতেন—আমরা কি সত্যিই বন্দিদশাকে ভেঙে ফেলেছি নাকি শুধু এটিকে কৃত্রিম সাজে সজ্জিত করেছি? সেই একই পশ্চাৎপদতা আধুনিক মোড়কে বজায় রেখেও আমরা এগিয়ে যাওয়ার দাবি করি। রোকেয়া নিশ্চয়ই আমাদের এই বৈপরীত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন।

যখন রাজনৈতিক নেতারা নারীদের সঙ্গে আলোচনা না করেই তাদের কাজের সময় সীমিত করার নীতি ঘোষণা করতে পারেন, যখন অভিসন্ধিমূলক ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে আজও নারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যখন নারীরা নিজেরাই দুটি ভাগে বিভক্ত—একদল যারা বন্দিদশাকে চিনতে পারে এবং আরেকদল যারা একেই সদ্গুণ বলে রক্ষা করে—তখন বুঝতে হবে, আমরা এখনও রোকেয়ার সময়ের জগতেই বাস করছি। তফাত একটাই। আমরা শুধু একে আরও ভালোভাবে সাজাতে শিখেছি।

রোকেয়া যদি এই অবস্থা দেখতেন, তাহলে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করতেন—আমরা কি সত্যিই বন্দিদশাকে ভেঙে ফেলেছি নাকি শুধু এটিকে কৃত্রিম সাজে সজ্জিত করেছি? সেই একই পশ্চাৎপদতা আধুনিক মোড়কে বজায় রেখেও আমরা এগিয়ে যাওয়ার দাবি করি। রোকেয়া নিশ্চয়ই আমাদের এই বৈপরীত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন।

তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিতেন যে শিক্ষা যতক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ স্বাধীনতা, গতিশীলতা, মর্যাদা ও সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ততক্ষণ শিক্ষা মুক্তি দেয় না।

৯ ডিসেম্বর যখন আমরা রোকেয়া দিবস উদযাপন করছি, তখন আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করা উচিত—আমরা কি তাঁর ঐতিহ্যকে সম্মান জানাচ্ছি, নাকি শুধু স্মরণের অভিনয় করছি? আমরা কি তাঁর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি, নাকি তিনি যে বন্দিদশা ভাঙতে সারা জীবন কাটিয়েছেন, সেটাকেই আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তার সঙ্গে সন্ধি করেছি?

যদি স্বপ্ন দেখা নিপীড়িতের জন্য রাজনৈতিক কাজ হয়, তবে রোকেয়াই ছিলেন আমাদের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে একজন নারী যখন মুক্তভাবে স্বপ্ন দেখতে শেখে, তখন সে মুক্তভাবে বাঁচতেও শেখে।

এই বেগম রোকেয়া দিবসে, আসুন আমরা এই নারীবাদী আইকনকে ফুল বা বক্তৃতা দিয়ে নয়, বরং কাজ দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। তিনি যে যুক্তিবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, তা যেন শিকড় গাড়ে। তিনি যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তা যেন আরও তীব্রভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি যে প্রতিটি নারীকে মুক্ত দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারা যেন বুঝতে পারে—খাঁচার দরজা সব সময় খোলা ছিল। আমাদের কেবল সেই দরজা দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসার সাহস দরকার।

রোকেয়ার প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা তাঁকে মনে রাখায় নয়। তাঁর মতো হয়ে ওঠায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত