বাংলাদেশের রাজনীতি বহু নেতা–নেত্রীর উত্থান-পতনের সাক্ষী। সময়ের স্রোতে অনেকেই বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয়তা-ক্ষমতা পেয়েছেন। আবার তাঁদের অধিকাংশই দ্রুত বিস্মৃত-ও হয়ে গেছেন। দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, আস্থা ও ভালবাসা অর্জন করতে পেরেছেন, এমন নেতার সংখ্যা খুব কম। এই গণমানুষের হৃদয়স্পর্শী ও গ্রহণযোগ্য নেতাদের তালিকা করলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাম নিঃসন্দেহে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে উঠে আসে। গণতন্ত্রের পথে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম, অবিচল মনোভাব, আপসহীন নেতৃত্ব এবং জনগণের প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা তাঁকে একজন পার্টি লিডার থেকে ‘ন্যাশনাল লিডার’ বা জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত করেছে। তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার এক কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি সংকটের মুহূর্তে রাজনীতিকে নতুন পথ দেখিয়েছেন। অসংখ্য বিপর্যয়ের মধ্যেও নিজেকে দেশের জন্য নিবেদন করতে মুহূর্তের জন্য তিনি পিছপা হননি। আপসহীন এই নেত্রী আশঙ্কাজনকভাবে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী। তাঁর সুস্থতার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সবাই দোয়া করছে। বেগম খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি এখন খুবই প্রয়োজন। কেননা, আজকের জটিল, বিভক্ত ও আস্থাহীনতার রাজনীতিতে তিনিই যেন এক ঐক্যের মূর্ত প্রতীক। তাঁর উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেবে তাতে সন্দেহ নেই।
রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার আগমনটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাৎবরণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করে। এসময় দেশ ও দলের নেতৃত্ব জটিল অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। সেইসময় শীর্ষ নেতাদের অনুরোধেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগ দেন। এটিই ছিল তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দলে নিজস্ব সক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুণাবলির পরিচয় দিতে সমর্থ হন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলের সর্বোচ্চ দায়িত্ব অর্থাৎ চেয়ারপারসনের পদ গ্রহণ করেন। তারপর থেকেই তিনি দলকে সুনিপুণভাবে পরিচালনা করছেন। তার সুসংহত নেতৃত্বে দলটি তিনবার জাতীয় নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করেছেন। পাশাপাশি বিএনপির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও ছাত্ররাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করতে সমর্থ হয়েছে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্ন স্বাধীনতার মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে দুঃস্বপ্ন হিসেবে দেখা দেয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল কায়েমের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়। এরপর একটানা দীর্ঘ দেড় দশকের সামরিক শাসন। সবমিলিয়ে জনগণ যেন গণতন্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম। ১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে যখন স্বৈরশাসন কায়েম হয়, তখনই বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের পতাকাবাহী হয়ে ওঠেন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি অসামান্য দৃঢ়তা ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। তাঁর এই আপসহীন ভূমিকার কারণে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাঁকে সাতবার আটক করা হয়। কারাজীবন, গৃহবন্দিত্ব, রাজনৈতিক দমন কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। বরং প্রতিটি বাধা তাঁকে আরও শক্ত ও দৃঢ় করে আন্দোলনের সামনের কাতারে ঠেলে দিয়েছে। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল হয়। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় তাঁর নেতৃত্ব দেশের রাজনীতিকে কাঙ্ক্ষিত বহুমাত্রিকতা দিয়েছে। বিভিন্ন চাপ, প্রতিবন্ধকতা ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তনের মধ্যেও তিনি গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ছিলেন আপসহীন। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে তাঁর অবদানই তাঁকে দেশের জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে, যে উপাধিটি আজও তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের অন্যতম শক্ত ভিত্তি হয়ে রয়েছে।
বেগম জিয়া হলেন বাংলাদেশের লড়াই-সংগ্রাম ও আপসহীনতার প্রতিচ্ছবি। রাজনীতির প্রতিটি স্তরে তাঁকে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কখনো তাঁকে বাড়িতে অবরুদ্ধ রাখা হয়েছে, কখনো কারাবন্দি করা হয়েছে। আবার কখনো রাজনীতিতে তাঁর অংশগ্রহণ সীমিত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজের অবস্থান থেকে সরে যাননি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক স্পেস সংকুচিত হতে শুরু করে এবং বিরোধী রাজনীতির ওপর চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। গণতন্ত্রের আন্দোলন শক্তিশালী করে তুলতে বেগম জিয়া যখন রাস্তায় নেমে আসেন, তখন তাঁকে দুইবার গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু এসব বাধা তাকে দমাতে পারেনি, বরং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারকে আরও সুদৃঢ় করেছে। তাই তো বারবার কারাবরণ, স্বাস্থ্যগত অবনতি, চিকিৎসার প্রয়োজন সবকিছু সত্ত্বেও তিনি দেশের মাটি ছাড়েননি।
হাজারো হুমকি, অগণিত চাপ এবং বিদেশে থাকার অসংখ্য প্রলোভন কোনো কিছুই বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য কিংবা স্বস্তিকর জীবনের প্রতিশ্রুতি নয়; তিনি বেছে নিয়েছেন দেশকে, জনতাকে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে। দুঃসময়ের রাজনীতিতে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেন, কিন্তু তিনি কখনো দেশত্যাগকে বিকল্প ভাবেননি। তাঁর অবস্থান ছিল পরিষ্কার, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার এবং আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষার দায়িত্ব তিনি দেশেই থেকে পালন করবেন। এই দৃঢ়তা, এই সৎ প্রতিশ্রুতি এবং জনগণের প্রতি তাঁর অটুট বিশ্বাসই তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। কর্মগুণে, সততায়, ত্যাগে এবং লড়াইয়ে তিনি এমন একটি জায়গা দখল করেছেন, যা রাজনৈতিক পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন; তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে এক চিরস্থায়ী অধ্যায়। তাই তো তাঁকে শ্রদ্ধা করার ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ের দেয়ালও বারবার ভেঙে যায়। তাঁর নেতৃত্ব আজও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে একটি আশার প্রতীক হয়ে আছে।
বলতে গেলে বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিক মেরুকরণ, আস্থাহীনতা, দলীয় বিভাজন ও গণতন্ত্রের সংকটে চরমভাবে আক্রান্ত। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আস্থার ঘাটতি স্পষ্ট। মতানৈক্য যেন ক্রমেই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়ার অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও ঐতিহাসিক ভূমিকা তাঁকে নতুন করে সময়োপযোগী করে তুলেছে। আজ তিনি স্বাস্থ্যগতভাবে দুর্বল হলেও তাঁর নামে দেশজুড়ে এখনও এক অদৃশ্য ঐক্যের ছায়া আছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সংকট মোকাবিলার দক্ষতা এবং গণতন্ত্র রক্ষার ইতিহাস তাঁকে এমন এক নেতায় পরিণত করেছে যিনি বিভাজিত সমাজকে নতুন করে সংযুক্ত করতে পারেন বলে সকলের বিশ্বাস। তাঁর উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও একটি ভারসাম্যের প্রতীক। বলা বাহুল্য, ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বড় অংশ তাঁর সঙ্গে জড়িত। তাই সংকটময় সময়ে তাঁর ভূমিকা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অসুস্থ, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব আজ আগের চেয়ে আরও বেশি জরুরি। দেশের মানুষ এখনও তাঁর প্রতি অবিচল আস্থা রাখে।
বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী। তাঁর অসুস্থতায় গোটা জাতি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাঁর দ্রুত সুস্থতার কামনায় শুধু বিএনপি নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগেও দেশজুড়ে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজধানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় মসজিদে মসজিদে রোগমুক্তি কামনায় দোয়া মাহফিল অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সুস্থতার জন্য এভাবে সারা দেশে দোয়ার আয়োজন বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। আল্লাহ তায়ালা সবার দোয়া কবুল করবেন বলে আমরা আস্থা রাখি। বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে আবারও জনগণের সামনে ফিরবেন, এ বিশ্বাস দেশের মানুষ এখনো বুকে লালন করে। তিনি ফিরে এসে বিভক্ত সমাজকে নতুন করে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবেন এবং বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার পথ দেখাবেন এটা আপামর জনতার বিশ্বাস। এই বিশ্বাস কেবল রাজনৈতিক অনুভূতি নয়; এটি জাতির আস্থার ওপর দাঁড়ানো এক গভীর প্রত্যাশা।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন