শুরুতে পৃথিবী নামক এই গ্রহে কোনো মাটি ছিল না। প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি বছর আগে মাটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই মাটিই প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সাহায্য করেছে (টপসয়েল অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, ১৯৫৫)। মানবতার উদ্ভব ঘটেছে বাস্তুতন্ত্রের সেবা বা ইকোসিস্টেম সার্ভিস চালু হওয়ার পর। মাটি থেকেই খাদ্যের সূচনা। আমাদের প্রতিদিনের ক্যালোরির ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ জোগান এখনো ভূমি থেকেই আসে। স্বাস্থ্যকর মাটি ও অনুকূল জলবায়ু সভ্যতার উত্থানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে।
মাটিই মানুষকে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ও স্থায়ী বাড়িঘর নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে। নব্য প্রস্তর যুগে (১২ হাজার বছর আগে) বসতি স্থাপনের কারণে মানুষ একই জমি বারবার ব্যবহার শুরু করে। ফলে ভূমির অবক্ষয় ঘটে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সভ্যতা বিকাশের আগ পর্যন্ত যুগ যুগ ধরে মাটির পরিমাণ এবং এর ওপর নির্ভরশীল উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এমন অনেক দক্ষতা অর্জন করেছে যা তার খাদ্যের উৎস ভূমির অবক্ষয়ের গতি বাড়িয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে ভূমির অপব্যবহার, নীতিমালার অভাব, যুদ্ধ ও উপনিবেশবাদ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, নৈতিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য, দুর্বল নেতৃত্ব ভূমির অবক্ষয়ের জন্য দায়ী। এই মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি, খাদ্যশস্য ও বনজ পণ্যের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা অতিমাত্রায় আহরণ ও বাণিজ্যের কারণে অনেক প্রাচীন সভ্যতা, যেমন—ভূমধ্যসাগরীয়, উত্তর আফ্রিকান সভ্যতা ধ্বংস ও বিলীন হয়ে গেছে (টপসয়েল অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, ১৯৫৫)। সভ্য মানুষ দীর্ঘকাল ধরে যেসব জমিতে বসবাস করেছে, তার অধিকাংশকেই সে ধ্বংস করেছে।
বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইকোসিস্টেম পণ্য, সেবার চাহিদা বাড়ছে ও বৈচিত্র্যময় হচ্ছে। ফলে সীমিত ভূমি সম্পদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ১৯৬০-এর দশকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লব’ শুরু হয়। পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল (এইচওয়াইভি) শস্য ও বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক উপকরণ ভূমির অবক্ষয় আরও বাড়িয়ে দেয়। বর্তমান কৃষি পদ্ধতির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মাটি যতটুকু পুনর্গঠিত হয়, তার চেয়ে ১০০ গুণ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ৯০ শতাংশ ভূমিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিশ্বব্যাপী মাটির অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১৩ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ ঘোষণা করে। ২০১৪ সালে এটি জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হয়। তখন থেকে প্রতি বছর মাটির স্বাস্থ্যের গুরুত্ব তুলে ধরতে ও মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার পক্ষে কথা বলার জন্য দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মাটির অবক্ষয়ের জাতীয় ও স্থানীয় সমস্যাগুলো মোকাবিলার সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতেও এই দিবস পালন গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘স্বাস্থ্যকর শহরের জন্য স্বাস্থ্যকর মাটি’ (হেলদি সয়েলস ফর হেলদি সিটিজ)।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বজুড়ে নগরায়ন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমি সম্পদ থেকে বৈচিত্র্যময় খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। আমরা কি আঠার কোটিও বেশি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য মাটির বিকল্প কিছু ভাবতে পারি? হাইড্রোপনিক্স বা কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ কিংবা সমুদ্রের তলদেশে চাষাবাদ?
স্বাস্থ্যকর মাটিতে সাধারণত বিভিন্ন ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান থাকে এবং উদ্ভিদ তার প্রয়োজন অনুযায়ী মাটি থেকে সেসব উপাদান গ্রহণ করে স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদন করে। হাইড্রোপনিক্সের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানীরা ঠিক জানেন না যে স্বাস্থ্যকর খাদ্য ফলাতে দ্রবণে ঠিক কোন উপাদানগুলো কী অনুপাতে প্রয়োজন।
মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তার পরিপাকতন্ত্র ও বিপাকক্রিয়া কৃত্রিম ঘনবস্তু (সিন্থেটিক কনসেনট্রেট) বা রাসায়নিক দ্রবণের জন্য তৈরি নয় (টপসয়েল অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, ১৯৫৫)। এর পাশাপাশি, খরচ ও শ্রমের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করলে এদের কোনটিই মাটি সংরক্ষণের উপযুক্ত বিকল্প নয়। প্রায়ই যে মাটিতে খাদ্য জন্মে, সেই মাটির গুণাগুণ দিয়ে মানবদেহ প্রভাবিত হয়। তাই, স্বাস্থ্যকর শহর গড়তে হলে আমাদের মাটির অবক্ষয় এড়াতে হবে ও ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি পুনরুদ্ধার করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী ভূমি অবক্ষয়ের ভয়াবহতা, খরা মোকাবিলা ও সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে, ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (এসডিজি লক্ষ্য ১৫.৩.১) ও জাতিসংঘের কনভেনশন (ইউএনসিসিডি) ২০৩০ সালের মধ্যে ভূমি অবক্ষয় নিরপেক্ষতা (এলডিএন) অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্যহলো (১) ইকোসিস্টেম সেবার টেকসই সরবরাহ বজায় রাখা বা উন্নত করা, (২) বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে ভূমির উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা বা উন্নত করা, (৩) ভূমি ও এর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সহনশীলতা বৃদ্ধি করা, (৪) অন্যান্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা, (৫) দায়িত্বশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভূমি শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও প্রচার করা। বাংলাদেশও এই এলডিএন প্রক্রিয়ার অংশ।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও এসআরডিআই-এর ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ ভূমি অবক্ষয়ের শিকার। পাশাপাশি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০০৭ সালের প্রতিবেদন মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু ফসলি জমির পরিমাণ কমে প্রায় শূন্য দশমিক শূন্য ৪৪ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। যার অর্থ হলো মাথাপিছু খাদ্য উৎপাদনশীল জমি হ্রাস পাচ্ছে।
এসআরডিআইর প্রতিবেদন মতে, ২০১৩ সালে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি হারাচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দিতে বাংলাদেশ বছরে কয়েকবার উচ্চ ফলনশীল শস্য চাষ ও প্রচুর রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে অল্প জমিতে বেশি খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষিকাজকে (নিবিড় কৃষি) আরও জোরদার করেছে। ফলে মাটির উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কৃষি-জীববৈচিত্র্য সংকোচন, কৃষি-রাসায়নিকের অপব্যবহার, ভিনদেশি প্রজাতির চাষ, নিম্নমানের প্রযুক্তির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তন—সবই মাটির উর্বরতা হ্রাসে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের প্রায় সব মাটিতেই নাইট্রোজেনের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়াও, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিংক ও বোরনের তীব্র বা অতি তীব্র ঘাটতির কথা বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে। দেশে প্রায় ৭৫ শতাংশ মাটিতে পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ও এসআরডিআইর ২০২০ সালের প্রতিবেদন মতে, দেশের ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ এলাকায় মাটির জৈব পদার্থ (এসওএম) নিঃশেষ হয়ে গেছে। ফলে কৃষি-বাস্তুতন্ত্রের ভঙ্গুরতা বেড়েছে ও প্রতিনিয়ত কৃষি-রাসায়নিকের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাসায়নিক উপকরণের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে মাটির খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ও শেষ পর্যন্ত মাটিতে বিষাক্ততা তৈরি করতে পারে। নিবিড় কৃষিতে কৃষি-রাসায়নিকের অত্যধিক ব্যবহার মাটিতে প্রচুর উচ্ছিষ্ট জমা করে, যা মাটির স্বাস্থ্য, শস্যের গুণমান ও মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য ও বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে চাপের মুখে রয়েছে বাংলাদেশের ক্ষয়প্রাপ্ত মৃত্তিকা সম্পদ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সমৃদ্ধি আজ ঝুঁকির মুখে। অযাচিত শোষণ ও ধ্বংসের এই প্রক্রিয়া রোধ করতে আমাদের একটি জাতীয় সংরক্ষণ নীতিমালা প্রয়োজন (যা অবক্ষয় এড়ানো, কমানো এবং পুনরুদ্ধার করবে)। পাশাপাশি এই নীতিমালা অবশ্যই আমাদের জীবনযাত্রার অংশ হতে হবে। গবেষণা ও উন্নয়ন, আইপিএম এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির অনুশীলন, একই মাটিতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন শস্য চাষ বা ক্রপ রোটেশন, রাসায়নিক উপকরণের পরিপূরক ব্যবহার অবশ্যই প্রয়োজনভিত্তিক হতে হবে।
এ ছাড়া ফসলের স্যানিটেশন, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কৃষকদের জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করা—এগুলো স্বাস্থ্যকর শহর গড়ার হাতিয়ার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনশক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
ড. মু. সোহরাব আলী: সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর