শোকাঞ্জলি
বদরুদ্দীন উমরের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী ওমর তারেক চৌধুরী। তিনি খুব কাছে থেকে বদরুদ্দীন উমরের চিন্তা, দর্শন ও লেখালেখির জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখেছেন উমরের শেষ দিনগুলোও।
ওমর তারেক চৌধুরী
অধ্যাপক উমরের সাথে আমার দীর্ঘদিনের সখ্যতা। তাঁর শেষ দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অসম্ভব রসবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। বাইরে থেকে তাঁকে কিছুটা কাঠখোট্টা মনে হলেও, তাঁর ভেতরের সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল অসাধারণ। প্রায়ই তিনি মজা করে বলতেন, ‘আমি তো ইয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি, আজরাইল আমার জন্য তো দরজা খুলছে না।’ অর্থাৎ, তাঁর বয়স হয়েছে, যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু ডাক আসছে না।
গত জুলাই মাসের ২১ তারিখ রাতে তাঁর জ্বর আসে। দিনটি ছিল ২০ বা ২১ তারিখের রাত। জ্বরটা বেশ উদ্বেগজনক হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, তাঁর ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে, নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পর, যখন তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়, তখন তাঁকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হয়।
বাসায় ফিরে তিনি অসুস্থতার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিলেন। আগস্টের ১ তারিখে আমি একবার দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তাঁর বেশ কাশি ছিল এবং করোনার ভয়ও ছিল। তাঁর বয়স এবং নিউমোনিয়ার কারণে কিছুটা বিধিনিষেধ মেনে চলতে হচ্ছিল। আমি দূরে দূরেই ছিলাম। খুব একটা কথা বলিনি। ঘণ্টাখানেক পর চলে আসার সময়, আমি দূর থেকে হাত নাড়তেই তিনি আমাকে জোরে ডেকে বললেন, ‘তারেক’। আমি ফিরে যাই। তিনি বলেন, ‘ভালো থেকো, আবার এসো।’ তাঁর এই ডেকে কথা বলাটা আমাকে ভীষণ আপ্লুত করেছিল। আমি তাঁর পায়ে হাত বুলিয়ে বিদায় নিয়ে আসি।
এরপর আগস্টের ২২ তারিখে আমি এবং আমার বন্ধু চৌধুরী মুফাদ আহমদ আবার তাঁকে দেখতে যাই। তখন তিনি প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আমরা যখন যাই, তখন তাঁকে জোর করে বিকেলের নাস্তা খাওয়ানো হচ্ছিল। তাঁর মেয়ে সারা বানু খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি আমাদের দেখে আক্ষেপ করে বলেন, ‘কিছু তো করতে পারছি না।’ কথাগুলো বলার সময় তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। এরপর তিনি শুয়ে পড়লেন। তাঁর ছেলে সোহেল আবদুল্লাহ বললেন, ‘আব্বা, তারেক ভাই এসছে, মুফাদ ভাই এসেছে।’
তিনি বলছেন, ‘ওদেরকে ডাকো এ ঘরে।’ আমরা দূরে বসলে, তিনি বলেন, ‘আমাকে ঘুরিয়ে দাও।’ আমাদের দিকে মুখ করে বিছানা ঘোরানো হলো, কিন্তু ততক্ষণে তিনি আবার ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, দম ফুরিয়ে আসছিল। আমরাও আর দেরি না করে চলে আসি। সোহেলের কাছে শুনেছিলাম, এই সময়ে তিনি নিজের সম্পর্কে এক গভীর হতাশার মধ্যে ছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘এইভাবে আর কতদিন থাকতে হবে আমাকে?’ এই প্রশ্নটি তাঁর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার আকুতি প্রকাশ করত। তিনি সবসময় চিন্তায় ও লেখায় সক্রিয় থাকতে চেয়েছিলেন, আর শারীরিক অক্ষমতা তাঁর কাছে জীবনের অর্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। শেষ দিকে তিনি আক্ষরিক অর্থেই শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন।
একটি বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সোহেল আমাকে বলেছিল, হাসপাতাল থেকে আসার পর হঠাৎ একদিন উমর তাঁর ছেলে সোহেলকে ডেকে বলেন, ‘তারেক কোথায়? তারেক কোথায়? তারেকের খোঁজ নাও।’ সোহেল জিজ্ঞেস করে, ‘কেন?’ তিনি বলেন, ‘ও একটা বিপদের মধ্যে আছে, ওর খোঁজ নাও।’ সোহেল কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়। সে ভেবেছিল, আব্বার সাথে যোগাযোগ নেই তারেক ভাইয়ের। আব্বা কোত্থেকে এটা জানছে? তখন বোঝা যায়, তিনি কোনো ঘোরের মধ্যে বা স্মৃতিভ্রংশের কারণে আমার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিলেন।
এরপর আমার আর যাওয়া হয়নি। ফোনে খোঁজখবর নিতাম। গত পরশুদিন রাতে তাঁর আবার বেশ জ্বর আসে। মাঝে তিনি স্পেশালাইজড হাসপাতালে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। টেস্ট, ডায়েট ইত্যাদি করে আবার বাসায় পাঠানো হয়েছিল। গতকাল সন্ধ্যায় সোহেলের সাথে কথা বললে সে জানায়, জ্বর কমে এলেও, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আজ সকালে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ততক্ষণে তিনি তাঁর জীবনের শেষ যাত্রা শুরু করেছেন।
আমার মনে হয়, বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তাঁর কথাগুলো ঠিকমতোই রেখে গেছেন। তিনি তাঁর জীবনের চাওয়া, একটি সাধারণ, সম্মানজনক এবং কর্মময় জীবনের কথা বলতেন। তাঁর এই কথাগুলো তাঁর জীবনবোধের প্রতিফলন।
তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যবোধের প্রতি অবিচল ছিলেন। এই বছর যখন তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তিনি খুশি হয়েছিলেন, সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কখনো পুরস্কার নেইনি এবং আমি কখনো কোনো পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। আমি আমার নিজের জন্য কাজ করেছি। আপনারা পুরস্কার দিয়েছেন ধন্যবাদ, কিন্তু এটা আমার পক্ষে অন্যান্য পুরস্কারের মতো নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ এটি ছিল তাঁর কমিটমেন্ট ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তাঁর এক ধরনের সৌভাগ্য বলতে হবে, তিনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে এই জাতীয় ঘটনার সাক্ষী হতে পারতেন না। তিনি ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এই বিশাল ঘটনার ইতিহাস থাকা দরকার এবং সেই লক্ষ্যে তিনি ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইটি রচনা করেন, যা ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানের রাজনীতিকে নতুনভাবে হাজির করেছে। তাঁর পদ্ধতি ছিল অতুলনীয়, যেখানে তিনি প্রত্যক্ষদর্শী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়ে সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করতেন। এই ঐতিহাসিক কাজটি ছিল তাঁর প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠার পরিচায়ক। তিনি এই বইটি বাংলাদেশের জনগণকে উৎসর্গ করেছিলেন। কারণ তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক কোনো ব্যক্তি বিশেষ নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণ।
তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করতে পারলেন। তিনি এটিকে বাংলাদেশের অন্য যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক এবং আক্রমণাত্মক বলে মনে করতেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই অভ্যুত্থানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর মারমুখী প্রকৃতি। তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়েও মন্তব্য করেছিলেন।
তাঁর পর্যবেক্ষণগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জাতীয়তাবাদের বিবর্তন নিয়ে তাঁর উদ্বেগ। অভ্যুত্থানের পরপরই তিনি ছাত্রদের সাথে দেখা করে তাদের চেষ্টা ও পড়াশোনার প্রশংসা করেন। তবে, সময়ের সাথে সাথে তিনি লক্ষ করেন যে, এই ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে একটি দক্ষিণপন্থী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিনি মনে করতেন, এই ধর্মভিত্তিক ঝোঁকটি জাতীয়তাবাদের মূল আদর্শের পরিপন্থী এবং এই বিষয়টি নিয়ে তিনি বিরক্ত ছিলেন। তিনি সরকারের এই দক্ষিণপন্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করতেন।
বদরুদ্দীন উমর বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, যখন ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং ব্যয়বহুল ইফতার পার্টির আয়োজন করে, তখন তাদের মধ্যে শ্রমিক-কৃষকের কোনো আওয়াজ ছিল না। যখন তারা নিজেদেরকে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে ঘোষণা করে, তখন তিনি বলেন, ‘মধ্যপন্থী বলে তো কিছু হয় না।’ তাঁর এই মন্তব্যটি তাঁর স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান এবং আদর্শের প্রতি তাঁর অবিচল প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। বদরুদ্দীন উমরের এই পর্যবেক্ষণগুলো ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’ নামের একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক: বদরুদ্দীর উমরের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী ও সুহৃদ
অধ্যাপক উমরের সাথে আমার দীর্ঘদিনের সখ্যতা। তাঁর শেষ দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অসম্ভব রসবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। বাইরে থেকে তাঁকে কিছুটা কাঠখোট্টা মনে হলেও, তাঁর ভেতরের সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল অসাধারণ। প্রায়ই তিনি মজা করে বলতেন, ‘আমি তো ইয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি, আজরাইল আমার জন্য তো দরজা খুলছে না।’ অর্থাৎ, তাঁর বয়স হয়েছে, যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু ডাক আসছে না।
গত জুলাই মাসের ২১ তারিখ রাতে তাঁর জ্বর আসে। দিনটি ছিল ২০ বা ২১ তারিখের রাত। জ্বরটা বেশ উদ্বেগজনক হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, তাঁর ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে, নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পর, যখন তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়, তখন তাঁকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হয়।
বাসায় ফিরে তিনি অসুস্থতার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিলেন। আগস্টের ১ তারিখে আমি একবার দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তাঁর বেশ কাশি ছিল এবং করোনার ভয়ও ছিল। তাঁর বয়স এবং নিউমোনিয়ার কারণে কিছুটা বিধিনিষেধ মেনে চলতে হচ্ছিল। আমি দূরে দূরেই ছিলাম। খুব একটা কথা বলিনি। ঘণ্টাখানেক পর চলে আসার সময়, আমি দূর থেকে হাত নাড়তেই তিনি আমাকে জোরে ডেকে বললেন, ‘তারেক’। আমি ফিরে যাই। তিনি বলেন, ‘ভালো থেকো, আবার এসো।’ তাঁর এই ডেকে কথা বলাটা আমাকে ভীষণ আপ্লুত করেছিল। আমি তাঁর পায়ে হাত বুলিয়ে বিদায় নিয়ে আসি।
এরপর আগস্টের ২২ তারিখে আমি এবং আমার বন্ধু চৌধুরী মুফাদ আহমদ আবার তাঁকে দেখতে যাই। তখন তিনি প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আমরা যখন যাই, তখন তাঁকে জোর করে বিকেলের নাস্তা খাওয়ানো হচ্ছিল। তাঁর মেয়ে সারা বানু খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি আমাদের দেখে আক্ষেপ করে বলেন, ‘কিছু তো করতে পারছি না।’ কথাগুলো বলার সময় তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। এরপর তিনি শুয়ে পড়লেন। তাঁর ছেলে সোহেল আবদুল্লাহ বললেন, ‘আব্বা, তারেক ভাই এসছে, মুফাদ ভাই এসেছে।’
তিনি বলছেন, ‘ওদেরকে ডাকো এ ঘরে।’ আমরা দূরে বসলে, তিনি বলেন, ‘আমাকে ঘুরিয়ে দাও।’ আমাদের দিকে মুখ করে বিছানা ঘোরানো হলো, কিন্তু ততক্ষণে তিনি আবার ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, দম ফুরিয়ে আসছিল। আমরাও আর দেরি না করে চলে আসি। সোহেলের কাছে শুনেছিলাম, এই সময়ে তিনি নিজের সম্পর্কে এক গভীর হতাশার মধ্যে ছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘এইভাবে আর কতদিন থাকতে হবে আমাকে?’ এই প্রশ্নটি তাঁর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার আকুতি প্রকাশ করত। তিনি সবসময় চিন্তায় ও লেখায় সক্রিয় থাকতে চেয়েছিলেন, আর শারীরিক অক্ষমতা তাঁর কাছে জীবনের অর্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। শেষ দিকে তিনি আক্ষরিক অর্থেই শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন।
একটি বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সোহেল আমাকে বলেছিল, হাসপাতাল থেকে আসার পর হঠাৎ একদিন উমর তাঁর ছেলে সোহেলকে ডেকে বলেন, ‘তারেক কোথায়? তারেক কোথায়? তারেকের খোঁজ নাও।’ সোহেল জিজ্ঞেস করে, ‘কেন?’ তিনি বলেন, ‘ও একটা বিপদের মধ্যে আছে, ওর খোঁজ নাও।’ সোহেল কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়। সে ভেবেছিল, আব্বার সাথে যোগাযোগ নেই তারেক ভাইয়ের। আব্বা কোত্থেকে এটা জানছে? তখন বোঝা যায়, তিনি কোনো ঘোরের মধ্যে বা স্মৃতিভ্রংশের কারণে আমার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিলেন।
এরপর আমার আর যাওয়া হয়নি। ফোনে খোঁজখবর নিতাম। গত পরশুদিন রাতে তাঁর আবার বেশ জ্বর আসে। মাঝে তিনি স্পেশালাইজড হাসপাতালে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। টেস্ট, ডায়েট ইত্যাদি করে আবার বাসায় পাঠানো হয়েছিল। গতকাল সন্ধ্যায় সোহেলের সাথে কথা বললে সে জানায়, জ্বর কমে এলেও, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আজ সকালে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ততক্ষণে তিনি তাঁর জীবনের শেষ যাত্রা শুরু করেছেন।
আমার মনে হয়, বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তাঁর কথাগুলো ঠিকমতোই রেখে গেছেন। তিনি তাঁর জীবনের চাওয়া, একটি সাধারণ, সম্মানজনক এবং কর্মময় জীবনের কথা বলতেন। তাঁর এই কথাগুলো তাঁর জীবনবোধের প্রতিফলন।
তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যবোধের প্রতি অবিচল ছিলেন। এই বছর যখন তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তিনি খুশি হয়েছিলেন, সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কখনো পুরস্কার নেইনি এবং আমি কখনো কোনো পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। আমি আমার নিজের জন্য কাজ করেছি। আপনারা পুরস্কার দিয়েছেন ধন্যবাদ, কিন্তু এটা আমার পক্ষে অন্যান্য পুরস্কারের মতো নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ এটি ছিল তাঁর কমিটমেন্ট ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তাঁর এক ধরনের সৌভাগ্য বলতে হবে, তিনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে এই জাতীয় ঘটনার সাক্ষী হতে পারতেন না। তিনি ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এই বিশাল ঘটনার ইতিহাস থাকা দরকার এবং সেই লক্ষ্যে তিনি ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইটি রচনা করেন, যা ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানের রাজনীতিকে নতুনভাবে হাজির করেছে। তাঁর পদ্ধতি ছিল অতুলনীয়, যেখানে তিনি প্রত্যক্ষদর্শী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়ে সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করতেন। এই ঐতিহাসিক কাজটি ছিল তাঁর প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠার পরিচায়ক। তিনি এই বইটি বাংলাদেশের জনগণকে উৎসর্গ করেছিলেন। কারণ তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক কোনো ব্যক্তি বিশেষ নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণ।
তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করতে পারলেন। তিনি এটিকে বাংলাদেশের অন্য যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক এবং আক্রমণাত্মক বলে মনে করতেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই অভ্যুত্থানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর মারমুখী প্রকৃতি। তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়েও মন্তব্য করেছিলেন।
তাঁর পর্যবেক্ষণগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জাতীয়তাবাদের বিবর্তন নিয়ে তাঁর উদ্বেগ। অভ্যুত্থানের পরপরই তিনি ছাত্রদের সাথে দেখা করে তাদের চেষ্টা ও পড়াশোনার প্রশংসা করেন। তবে, সময়ের সাথে সাথে তিনি লক্ষ করেন যে, এই ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে একটি দক্ষিণপন্থী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিনি মনে করতেন, এই ধর্মভিত্তিক ঝোঁকটি জাতীয়তাবাদের মূল আদর্শের পরিপন্থী এবং এই বিষয়টি নিয়ে তিনি বিরক্ত ছিলেন। তিনি সরকারের এই দক্ষিণপন্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করতেন।
বদরুদ্দীন উমর বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, যখন ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং ব্যয়বহুল ইফতার পার্টির আয়োজন করে, তখন তাদের মধ্যে শ্রমিক-কৃষকের কোনো আওয়াজ ছিল না। যখন তারা নিজেদেরকে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে ঘোষণা করে, তখন তিনি বলেন, ‘মধ্যপন্থী বলে তো কিছু হয় না।’ তাঁর এই মন্তব্যটি তাঁর স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান এবং আদর্শের প্রতি তাঁর অবিচল প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। বদরুদ্দীন উমরের এই পর্যবেক্ষণগুলো ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’ নামের একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক: বদরুদ্দীর উমরের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী ও সুহৃদ
উজ্জ্বল নক্ষত্র বদরুদ্দীন উমর (১৯৩১) আর নেই। তিনি কেবল উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলাদেশের একজন মার্কসবাদী ইতিহাসবিদই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী তাত্ত্বিক এবং রাজনীতিবিদও। লেখালেখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে শ্রেণিসংগ্রাম, জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রগঠনের প্রচলিত ধারণাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। নিজের
১ ঘণ্টা আগেবদরুদ্দীন উমরের কাজগুলো কেউ মুছে দিতে পারবে না। তিনি ১১৫টি বই লিখেছেন। বেশির ভাগ মানুষ তাঁর এতগুলো বই পড়েননি। কিছু কিছু সাক্ষাৎকার হয়তো পড়েছে। কিন্তু তারা সমালোচনা করার ব্যাপারে খুব তৎপর। যাইহোক, আমি তাঁর প্রধান প্রধান বইগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। ফলে আমি তার সমগ্র কাজকে বিবেচনায় নিয়ে বলতে পারি, বাংলা
৪ ঘণ্টা আগেজুলাই অভ্যুত্থানের পর নয় মাস গত হয়েছে। এই সময়ে বাঙলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একটানা পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের যে পরিচয় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ প
৬ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রগতিশীল চিন্তার ‘বাতিঘর’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ সেখানেই সম্প্রতি এক ছাত্রীকে দলবদ্ধধ র্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এক তিক্ত সত্যকে সামনে এনেছে।
৩ দিন আগে