leadT1ad

শোকাঞ্জলি

কেমন ছিল বদরুদ্দীন উমরের শেষ দিনগুলো

বদরুদ্দীন উমরের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী ওমর তারেক চৌধুরী। তিনি খুব কাছে থেকে বদরুদ্দীন উমরের চিন্তা, দর্শন ও লেখালেখির জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখেছেন উমরের শেষ দিনগুলোও।

বদরুদ্দীর উমর। সংগৃহীত ছবি

কমরেড বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সখ্য। তাঁর শেষ দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অসম্ভব রসবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। বাইরে থেকে তাঁকে কিছুটা কাঠখোট্টা মনে হলেও, তাঁর ভেতরের সূক্ষ্ম রসবোধ ছিল অসাধারণ। নিজেকে নিয়ে রসিকতা করে তিনি বলতেন, ‘আমি তো চলে যাবার জন্য দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি, আমার জন্য তো দরজা খুলছে না।’ অর্থাৎ, তাঁর বয়স হয়েছে, যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু ডাক আসছে না।

গত জুলাই মাসের ২১ তারিখ রাতে তাঁর জ্বর আসে। জ্বরটা বেশ উদ্বেগজনক হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় পরের দিন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, তাঁর ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে, নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। উরেনারি ব্লাডারে পাথরের সমস্যাও ধরা পড়েছিল। হাসপাতালে তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে, ৩১ জুলাই তাঁকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হয়। বাসায় ফিরে তিনি সাময়িকভাবে কিছুটা ভালো এবং মূলত অসুস্থতার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিলেন।

জুলাইয়ের ২৭ তারিখে আমি তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখন তাঁর বেশ কাশি ছিল, বুকে শব্দ হচ্ছিল। তখন আবার কোভিডের একটি মৃদু ধাক্কা এসেছিল; কাজেই আমার ভেতরে একটি উদ্বেগও কাজ করছিল। তাঁর বয়স এবং নিউমোনিয়ার কারণে কিছুটা বিধিনিষেধ মেনে চলতে হচ্ছিল। আমি দূরে দূরেই ছিলাম হাসপাতালে। খুব একটা কথা বলিনি। ঘণ্টাখানেক পর চলে আসার সময়, আমি দূর থেকে হাত নাড়তেই তিনি আমাকে জোরে ডেকে বললেন, ‘তারেক।’ আমি ফিরে তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়ালে তিনি বলেন, ‘ভালো থেকো, আবার এসো। তাঁর এই ডেকে কথা বলাটা আমাকে ভীষণ আপ্লুত করেছিল। আমি তাঁর পায়ে হাত বুলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসি।

আমার মনে হয়, বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তাঁর কথাগুলো ঠিকমতোই রেখে গেছেন। তিনি তাঁর জীবনের চাওয়া, একটি সাধারণ, সম্মানজনক এবং কর্মময় জীবনের কথা বলতেন। তাঁর এই কথাগুলো তাঁর জীবনবোধের প্রতিফলন।

বাসায় ফেরার পর ৯ অগাস্ট তাকে চেকআপ ও ক্যাথেটার খোলার জন্য আবারও হাসপাতালে যেতে হয়।

এরপর আগস্টের ২২ তারিখে আমি এবং আমার বন্ধু চৌধুরী মুফাদ আহমদ তাঁকে দেখতে বাসায় যাই। তখন তিনি প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আমরা যখন যাই, তখন তাঁকে বিকেলের নাশতা খাওয়ানো হচ্ছিল। তাঁর মেয়ে সারা বানু খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি আমাদের দেখে আক্ষেপ করে বলেন, ‘কিছু তো করতে পারছি না।’ কথাগুলো বলার সময় তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। এরপর তিনি শুয়ে পড়লেন।

কিছুক্ষণ পর বদরুদ্দীন উমর ভাইয়ের ছেলে সোহেল আবদুল্লাহ তাঁকে গিয়ে বললেন, ‘আব্বা, তারেক ভাই এসছে, মুফাদ ভাই এসেছে।’ তিনি বললেন, ‘ওদেরকে ডাকো এ ঘরে। ’আমরা গিয়ে দূরে বসলে তিনি বলেন, ‘আমাকে ঘুরিয়ে দাও। ’আমাদের দিকে মুখ করে বিছানায় তাঁকে ঘোরানো হলো, কিন্তু ততক্ষণে তিনি আবার ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, দম ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমরাও আর দেরি না করে সোহেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে চলে আসি। সোহেলের কাছে শুনেছিলাম, ওই সময়ে তিনি নিজের সম্পর্কে এক গভীর হতাশার মধ্যে ছিলেন।

তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘এইভাবে আর কতদিন থাকতে হবে আমাকে?’ এই প্রশ্নটি তাঁর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার আকুতি প্রকাশ করত। তিনি সব সময় চিন্তায় ও লেখায় সক্রিয় থাকতে চেয়েছিলেন, আর শারীরিক অক্ষমতা তাঁর কাছে জীবনের অর্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। শেষ দিকে তিনি আক্ষরিক অর্থেই শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে এ অবস্থায় দেখাটা ছিল খুবই দুঃখজনক।

বদরুদ্দীন উমর ছাত্রদের তৈরি রাজনৈতিক দলের কিছু কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলে আলাপে ও তাঁর মে মাসের সর্বশেষ লেখায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং ব্যয়বহুল ইফতার পার্টির আয়োজন করার বিপরীতে তাঁদের মধ্যে শ্রমিক-কৃষকের কোনো আওয়াজ ছিল না।

একটি বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সোহেল আমাকে বলেছিলেন, হাসপাতাল থেকে আসার পর হঠাৎ একদিন উমর ভাই সোহেলকে ডেকে বলেন, ‘তারেক কোথায়? তারেকের খোঁজ নাও।’ সোহেল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’ তিনি বলেন,, ‘ও একটা বিপদের মধ্যে আছে, ওর খোঁজ নাও।’ সোহেল কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যান। সোহেল ভাবছিলেন, আব্বার সঙ্গে যোগাযোগ নেই তারেক ভাইয়ের। আব্বা কোত্থেকে এটা জানছে? তখন বোঝা যায়, তিনি কোনো ঘোরের মধ্যে বা স্মৃতিভ্রংশের কারণে আমার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর কথার মধ্যে ছিল খুব দৃঢ়তা, যা সোহেলকে কিছুটা বিভ্রান্ত করে তোলে।

এরপর আমার আর যাওয়া হয়নি। মাঝে তিনি স্পেশালাইজড হাসপাতালে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। টেস্ট, ডায়েটের পরামর্শ নেওয়া ইত্যাদি করে আবার ফিরে আসেন। তাঁর খাওয়াদাওয়া অত্যন্ত কমে গিয়েছিল। ফোনে খোঁজখবর নিতাম। গত পরশু রাতে তাঁর আবার বেশ জ্বর আসে।

গতকাল সন্ধ্যায় সোহেলের সঙ্গে কথা বললে সে জানায়, জ্বর কমে এলেও, উমর ভাইকে আজ সকালে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। আজ সকালে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতির মধ্যে সকালের নাশতা খাওয়ার সময় এলিয়ে পড়েন। হাসপাতালে তাঁর যাওয়া হয় কিন্তু ততক্ষণে তিনি তাঁর জীবনের শেষ যাত্রা শুরু করেছেন।

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করে তিনি বলতেন, ‘আমি তো চলে যাবার জন্য দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি, আমার জন্য তো দরজা খুলছে না।’ অর্থাৎ, তাঁর বয়স হয়েছে, যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু ডাক আসছে না।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে উমর যা বলেছিলেন

আমার মনে হয়, বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তাঁর কথাগুলো ঠিকমতোই রেখেছেন। তিনি তাঁর জীবনের চাওয়া হিসেবে—একটি সাধারণ অনাড়ম্বর, সম্মানজনক এবং কর্মময় জীবনের কথা বলতেন। তিনি সেটাই পেয়েছিলেন বা সেভাবে জীবনযাপন করেছেন। তাঁর এই কথাগুলো তাঁর জীবনবোধের প্রতিফলন।

বদরুদ্দীন উমর তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যবোধের প্রতি অবিচল ছিলেন। এই বছর যখন তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তিনি খুশি হয়েছিলেন, সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কখনো পুরস্কার নিইনি এবং আমি কখনো কোনো পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। আমি আমার নিজের জন্য কাজ করেছি। আপনারা পুরস্কার দিয়েছেন, সে জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এটা আমার পক্ষে অন্যান্য পুরস্কারের মতোই নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’এটি ছিল তাঁর কমিটমেন্ট ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বদরুদ্দীন উমর একধরনের সৌভাগ্যের কথা বলতে হবে, আর কিছুদিন আগে মারা গেলে তিনি ২০২৪-এর জুলই অভ্যুত্থানের মতো জাতীয় ঘটনার সাক্ষী হতে পারতেন না। তিনি ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন সেই বিশাল ঘটনার ইতিহাস থাকা দরকার এবং সেই লক্ষ্যে তিনি ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইটির খণ্ড তিনটি রচনা করেন, যা ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানের রাজনীতিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে হাজির করেছে। তাঁর গবেষণার পদ্ধতি ছিল অতুলনীয়, যেখানে তিনি শতাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়ে সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করছেন তাঁদের জীবদ্দশায়। এই ঐতিহাসিক কাজটি ছিল তাঁর প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠার পরিচায়ক। তিনি এই বইটি বাংলাদেশের জনগণকে উৎসর্গ করেছিলেন। কারণ, তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণ।

অভ্যুত্থানের পরপরই নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিল। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বেশ খুশি হয়েছিলেন। তাদের চেষ্টা ও পড়াশোনার চর্চার প্রশংসা করেছিলেন আমার কাছে। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি লক্ষ করেন যে এই ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে একটি দক্ষিণপন্থী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করতে পারলেন। তিনি এটিকে বাংলাদেশের অন্য যেকোনো গণ-অভ্যুত্থানের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক এবং আক্রমণাত্মক বলে অভিমত দিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই অভ্যুত্থানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল জনগণের মারমুখী প্রকৃতি। তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিও তুলেছিলেন বেশ আগেই।

অভ্যুত্থানের পরপরই নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিল। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বেশ খুশি হয়েছিলেন। তাদের চেষ্টা ও পড়াশোনার চর্চার প্রশংসা করেছিলেন আমার কাছে। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি লক্ষ করেন যে এই ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে একটি দক্ষিণপন্থী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিনি লক্ষ করেছেন তাঁদের মধ্যে একটি ধর্মভিত্তিক ঝোঁক আছে। এই বিষয়টি নিয়ে তিনি বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। বর্তমান সরকারের দিক থেকে দক্ষিণপন্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার বিষয়েও তিনি আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলে অসুস্থ হবার আগে শেষ একটি আলাপচারিতায়।

বদরুদ্দীন উমর ছাত্রদের তৈরি রাজনৈতিক দলের কিছু কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলে আলাপে ও তাঁর মে মাসের সর্বশেষ লেখায়। তিনি উল্লেখ করেন যে ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং ব্যয়বহুল ইফতার পার্টির আয়োজন করার বিপরীতে তাঁদের মধ্যে শ্রমিক-কৃষকের কোনো আওয়াজ ছিল না। যখন তারা নিজেদেরকে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে ঘোষণা করে, তখন তিনি বলেন, ‘মধ্যপন্থা ‘ বলে তো কিছু হয় না।’ তাঁর এই মন্তব্যটি তাঁর স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান এবং আদর্শের প্রতি তাঁর অবিচল প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। বদরুদ্দীন উমরের এই পর্যবেক্ষণগুলো ‘বাঙলাদেশে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান’ নামের সাক্ষাতকার ও কয়েকটি নিবন্ধের সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে।

লেখক: বদরুদ্দীর উমরের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী ও সুহৃদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত