বিশ্ব শান্তি দিবস
সানীউজ্জামান পাভেল
জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব শান্তি দিবস (২১ সেপ্টেম্বর) কথা শুনলে মানুষের মনে এমন ক্ষোভ ও ব্যঙ্গ জাগতেই পারে যে, এসব দিবস দিয়ে আর কী আসে যায়, যেখানে যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই দেশবিদেশ নির্বিশেষে কেবল নিরন্তর যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের খবর। সঙ্গে সঙ্গে এমন হতাশাও তৈরি হয় যে বাংলাদেশেও শান্তি বলে কিছু নেই!
এসব ক্ষোভ, ব্যঙ্গ, হতাশা কোনোটিই অস্বাভাবিক নয় ঠিক ততক্ষণ, যতক্ষণ আমরা শান্তির জন্য যার যার দায়বদ্ধতা অস্বীকার করতে থাকব। আর যখনই এমন একটি আত্মোপলব্ধি এসে ভর করবে যে, যার যার প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌরে অভ্যাস থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আয়তনে শান্তির জন্য আমরা প্রত্যেকে দায়বদ্ধ তখনই কেবল ক্ষোভ-ব্যঙ্গ-হতাশাকে পাশ কাটিয়ে শান্তি নিয়ে উদযাপন-আলোচনায় আমরা নিজেদের অংশীদারত্ব অনুভব করব।
শান্তি নিয়ে কোনো আলোচনা সমাজতাত্ত্বিক জোহান গ্যাল্টুং-এর “ভায়োলেন্স, পিস অ্যাণ্ড পিস রিসার্চ” প্রবন্ধকে বাদ দিয়ে হতে পারে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কেননা এই সমাজতাত্ত্বিক ছিলেন শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রকাশের (১৯৬৯) বহু বছর পরও প্রাসঙ্গিক জোহান গ্যাল্টুং-এর প্রবন্ধটি।
‘শান্তি হলো সংঘর্ষের অনুপস্থিতি’ – এই অনুসিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে জোহান গ্যাল্টুং দেখিয়েছিলেন যে, শান্তির ভাবনা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীভেদে যতই আলাদা হোক না কেন, শান্তি আসলে সকলের সম্মতিমূলক একটি সামাজিক লক্ষ্য যা অর্জন করা অসম্ভব নয়।
যেহেতু সংঘর্ষের অনুপস্থিতিই শান্তি, তাই সংঘর্ষকে আমরা যতটা সূক্ষ্ম ও বিস্তৃতভাবে চিহ্নিত করতে পারব শান্তি প্রতিষ্ঠার আয়োজনসমূহ ততটা ব্যাপক হবে। আর সংঘর্ষকে যদি সীমিতভাবে গ্রহণ করা হয় পক্ষান্তরে তা ব্যাপক শান্তির সম্ভাবনাকেই সীমিত করবে।
সংঘর্ষের সংজ্ঞায়নে গ্যাল্টুং তাই বলেছিলেন, যেসব কারণের জন্য মানুষের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের প্রকৃত বাস্তবায়ন তাদের সম্ভাবনার চেয়ে কম হয় সেগুলোই সংঘর্ষ। অর্থাৎ মানুষের সামাজিক সম্ভাবনা ও বাস্তবতার দূরত্বই হলো সংঘর্ষ।
মনে করুন, কোনো একটি শিশু তার শৈশব কাটালো পথে-ঘাটে, রাস্তায়, বস্তিতে, কখনও স্কুল, মাদ্রাসা কিংবা মক্তবে যাওয়া হলো না তার। আরেকটি শিশু গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অভাবের তাড়নায় ঝরে পড়ল। আরেকটি শিশু ঝরে না পড়ার জন্য তার পরিবার দিনের পর দিন পাতে এক টুকরো মাছ, মাংস বা ডিম তুলতে পারল না। আরেকটি শিশু কোনোভাবে স্কুল, মাদ্রাসা, মক্তব শেষ করল ঠিকই, কিন্তু তার ভাই বা বোনটিকেও এইটুকু পড়াতে গিয়ে নিজের উচ্চতর শিক্ষা বিসর্জন দিয়ে কাজে নেমে পড়ল। আরেকটি শিশু উচ্চশিক্ষায় পৌঁছালো ঠিকই, কিন্তু শিক্ষাব্যয় মেটাতে গিয়ে সময়টা ব্যয় করল টাকা আয়ের পিছনে। আর বঞ্চিত হলো শিক্ষাচর্চার সময় ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে; কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারল না, তার ঘরে যে শিশুটি ইতিমধ্যে এসেছে তার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল, আর আটকে গেলো পূর্বপূরুষের আবর্তে।
যদি এই সব অতিচেনা ‘বাস্তবতা’ এড়ানো যেত তাহলে ধরে নিতে হবে সমাজে শিক্ষার সুযোগে সংঘর্ষ উপস্থিত, যদি এড়ানো না যেত তাহলে সংঘর্ষ নেই, এমনটাই মনে করতেন গ্যালটুং।
আমাদের বাংলাদেশে এগুলো এত পরিচিত ঘটনা যে, এগুলোকে আমরা কখনও ঠিক সংঘর্ষ হিসেবে দেখি না, বরং ‘বাস্তবতা’ হিসেবে দেখি। গাল্টুং গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে তিনি এই বাস্তবতার কারণগুলোকে – যা মানুষের সামাজিক বিকাশের সম্ভাবনাকে বিনাশ করে – সংঘর্ষ হিসেবে দেখতে বলেছেন; যে অভ্যাসটি না করলে, শান্তির বিস্তার সম্ভব নয়।
সংঘর্ষের কাঠামো তাঁর মতে, একটি বাক্যের মতো, যেখানে উপস্থিত থাকে কর্তা, কর্ম ও উদ্দেশ্য। সংঘর্ষকে তিনি ছয়টি মাত্রায় দেখেছেন : ক. দৈহিক ও মানসিক, অর্থাৎ যা মানুষের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে, খ. ঋণাত্মক ও ধনাত্মক, অর্থাৎ শুধু শাস্তি দিয়েই নয়, বরং ভোগবাদী সমাজে উপহার বা পুরস্কার দিয়েও মানুষের বিকাশকে রহিত করা যায়, গ. উদ্দেশ্যের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি, অর্থাৎ যার ক্ষতি হবে সরাসরি সে উপস্থিত না থাকলেও সংঘর্ষ হতে পারে – যেমনটা দেখা যায় রাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা পরীক্ষায় ও প্রদর্শনে, ঘ. কর্তার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে, অর্থাৎ ব্যক্তির দ্বারা সংঘর্ষের বিপরীত কাঠামোর দ্বারা সংঘটিত সংঘর্ষ যেখানে বিশেষ কোনো ব্যক্তি অনুপস্থিত, ঙ. ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সংঘর্ষ, যেখানে দোষ ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় এবং সর্বশেষ চ. অভিব্যক্ত ও অপ্রতীয়মান, অর্থাৎ যে সংঘর্ষ দেখা যায় আর যা দেখা যায় না, কিন্তু নিরন্তর ফলাফলের জন্ম দেয়।
শান্তি যেহেতু সংঘর্ষের অনুপস্থিতি, তাই সংঘর্ষের এই মাত্রাগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই শান্তির জন্য কাজ করতে হবে। গ্যাল্টুং মনে করতেন এই ছয়টি মাত্রার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তিক ও কাঠামোগত মাত্রাটি, যা অন্যান্য মাত্রাগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আর ব্যক্তি যেহেতু সমাজসৃষ্ট একটি ফলাফল তাই ব্যক্তিক ও কাঠামোগত সংঘর্ষকে আলাদা করা প্রায় দুঃসাধ্য।
মনে করুন, আপনি সরাসরি বা কোনো ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছেন একজন ব্যক্তি আরেকজনকে আঘাত করে ছিনতাই করছে তার মালপত্র ও সম্পদ, অথবা একজন গোপনে বিষ দিল আরেকজনের ফসলের ক্ষেতে বা মাছের পুকুরে; অথবা একজন পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর সদস্য গুলি করছে একজন আন্দোলনকারী নাগরিককে; অথবা একজন রাজনৈতিক কর্মী গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করছে আরেকজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়ি লক্ষ্য করে; অথবা একজন সামাজিক বা ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তি আরেকজনকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে বা করছে নিজেকে ঐশী বিধানের রক্ষাকর্তা ঘোষণা করে; অথবা কয়েকজন সাদাপোশাকের লোক কাউকে দিনে দুপুরে গাড়িতে তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে; অথবা কেউ একজন বা কয়েকজন মিলে রাস্তায়, ঘাটে, বাসে, বন্দরে আঘাত করছে আরেকজনকে – যার কারণ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা ব্যক্তিক সংঘর্ষ দেখলেও যে কাঠামো ঐ ব্যক্তিগুলো তৈরি করেছে তার প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই – যদি আমরা এসব দৃশ্য দেখা থেকে মুক্তি চাই, চাই আরেকটু সামাজিক শান্তি।
কাঠামোগত যে কারণে শান্তিপ্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়, তা হলো সামাজিক কাঠামোতে সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম বণ্টনের অভাব। কথাটা অতি পরিচিত সন্দেহ নেই, কিন্তু অতি পরিচয়ে এর আবেদনই কমেছে কেবল; কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি বহু সমাজের মত বাংলাদেশেও। একটি উদাহরণ দিলে কথাটার যুক্তিটা পরিষ্কার হতে পারে।
বাংলাদেশে জমির মালিকানা ও বণ্টনের দিকে তাকানো যাক। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশে একশ্রেণির লোককে বংশানুক্রমিকভাবে জমির ‘মালিক’ বা জমিদার করে তুলেছিল, যা মোগল ভূমিব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল। এমনটাই ধরে নিয়ে বদরুদ্দীন উমর তাঁর ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিপর্যস্ত কৃষকের বিদ্রোহই বাংলায় ও ‘মহাভারতে’ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল। তাঁর মতে, ১৯৪৭ পর্যন্ত বেশিরভাগ উপনিবেশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের মূলে এই ভূমির অসম বণ্টনকে একটি মৌলিক কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন।
মূলত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরের দুইশত বছরে এতগুলো রাজনৈতিক বিপ্লবের পরও ভূমিমালিকানার সুষ্ঠু বণ্টনের মতো একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করা যায়নি। সমাজ কাঠামোতে জমির মালিকানা একটি বিবদমান বিষয় হিসেবে বারবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর ভোক্তার সংখ্যার তুলনায় সম্পদ হিসেবে জমির পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় তা একদিকে যেমন সামাজিক সংঘর্ষের বা শান্তি বিনাশের কারণ হয়েছে, অন্যদিকে জমির মালিকানা ও দখল সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্যতম উৎস হিসেবে রয়ে গেছে আমাদের সমাজে।
আমাদের উপর্যুক্ত ভূমিবণ্টন সমস্যার উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, সামাজিক বিপ্লবের ফলে অনেক সময়ই শান্তির সম্ভাবনা থাকলেও তা বেশিরভাগ সময়ই রাজনৈতিক বিপ্লবের মতো ঘন ঘন ঘটে না।
আমাদের সমাজে গত প্রায় তিনশত বছরে যতগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেই তুলনায় সামাজিক আন্দোলন ও বিপ্লবের সংখ্যা কম। সমাজে শান্তির সংকট হয়তো এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়।
সমাজতাত্ত্বিক পিতিরিম এ সরোকিন রাশিয়ার বিপ্লবের সাপেক্ষে ১৯২৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন “দ্যা সোশিওলজি অভ রেভ্যুলুশন”, যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘর্ষ থেকেই শুধু সাধিত হয় না, তা জন্ম দেয় আরও বেশি সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘর্ষের। আমাদের সমাজ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে তেমন স্থিতিশীল হতে পারেনি। তার ফল হিসেবে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘর্ষের বিস্তার এবং সামাজিক শান্তির অভাবকে পাঠ করা যেতে পারে।
পৃথিবীতে সম্পদ সীমিত দেখেই এর বণ্টন মানুষের জন্য একটি চিরন্তন সমস্যা। সমাজশাস্ত্রে যাকে অর্থনীতি বলে, তা আসলে এই বণ্টনের নীতি ছাড়া কিছু নয়। আর সম্পদ শুধু বৈষয়িক বা বস্তুগত নয়, বরং ক্ষমতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ -- এমনটাই মনে করতেন গ্যালটুং। এদিক থেকে দেখলে তিনি প্যাহে বহদিউ’র ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত “দ্যা ফর্মস অব ক্যাপিটাল”র বহু আগেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির বিষয়টি কেবল সামনেই আনেননি, একে সামাজিক সংঘর্ষ ও শান্তির সাথে সম্পর্কিতও করেছেন।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর “পলিটিকাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া” (২০২২)-তে দেখিয়েছেন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দলের সূচনা হয়েছে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় সামরিক-বেসামরিক আমলা শ্রেণির বিকাশের একটি উপজাত হিসেবে। এই ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি ব্রিটিশের বেতন সূত্রে বিষয়-সম্পত্তি ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক পুঁজির অধিকারী ছিল। কেবল তাই নয়, পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাও এরাই কুক্ষিগত করেছিলেন। বৈষয়িক সম্পদ ও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার এই তীব্র কেন্দ্রীভবনের ঐতিহাসিক বাস্তবতাও আমাদের সমাজে শান্তির সংকটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম দেখিয়েছেন, যেসব নিয়ম-নীতি সমাজকে সুসংহত রাখে সেগুলোর অবক্ষয়ই সামাজিক সংঘর্ষ বা শান্তির সংকট। সেই সূত্রে, যদি আমাদের সমাজের অধিকাংশেরই এমনটা অনুভূত হয় যে, সামাজিক সৌহার্দ্য ভেঙে পড়ছে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সেসব নিয়ম-নীতিও অনুসন্ধান করা জরুরি। হয়তো এগুলো ব্যর্থ হয়েছে শ্রেণি, গোষ্ঠী, ধর্ম ও জাতিগত সংহতি বজায় রাখতে গিয়ে।
গ্যালটুং তাঁর আলোচনায় ‘শোষণ’ কথাটা ব্যবহার করেননি -- মার্কসবাদী রাজনীতিতে এর বিশেষ ব্যবহারের জন্য। তবু দুটি কারণে আমাদের সমাজেও সংঘর্ষ ও শান্তির আলোচনায় মার্কস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।
প্রথমত, আশির দশকে ব্যবসার উদারনীতিকরণের ফলে আমাদের সমাজে যে একটি কলকারখানাময় উৎপাদনব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে সেই বাস্তবতায় শান্তির সংকটকে মার্কসীয় দৃষ্টিতে নবভাবে দেখা জরুরি। কেননা শিল্পায়িত সমাজে বেশিরভাগ সম্পদ ও সেই সূত্রে ক্ষমতা যে সমাজের সীমিত সংখ্যকের কাছে জমা হয়, তা কেবল শ্রেণি-সংঘর্ষই জন্ম দেয় না, শিল্প সম্পর্কে শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেতন-ভাতা-সুযোগ-সুবিধা বিষয়ক সামষ্টিক দরকষাকষির গতিপ্রকৃতিও নির্ধারণ করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, শ্রেণি-সংঘর্ষকে মার্কস বঞ্চিত সমাজের জন্য একটি ‘ন্যায়-সংঘর্ষ’ হিসেবে দেখেছেন আর শান্তির জন্যও অনেক সমাজতাত্ত্বিক ‘ন্যায়-বল’ প্রয়োগকে প্রয়োজনীয় মনে করেন।
যুদ্ধতাত্ত্বিক ভন ক্লসউইটয ১৮৩২ সালে প্রকাশিত “অন ওয়ার” গ্রন্থে সংঘর্ষের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যুদ্ধকে দেখেছিলেন ‘ভিন্ন পন্থায় রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা’ হিসেবে। আর দার্শনিক মিখাইল ওয়ালজার ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত “জাস্ট ওয়ার” গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন সংঘর্ষের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কোনো যুদ্ধই সম্ভব নয়, যতক্ষণ না তা একটি ‘ন্যায়-যুদ্ধ’ হয়ে ওঠে। তাঁর উদাহরণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধও ছিল। এরই ধারাবাহিকতাতেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ন্যায়-বল’ প্রয়োগের আলোচনা সংঘর্ষ ও শান্তি অধ্যয়নে বিস্তৃত হয়েছে।
গ্যালটুং কাঠামোগত সংঘর্ষকে ‘সামাজিক অবিচার’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন সেই ১৯৬৯ সালে। অনেক পরে ২০০৬ সালে পিয়েরে এলান ও এলেক্সিস কেলারের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় শান্তি অধ্যয়নে নতুন মাত্রা যোগকারী গ্রন্থ “হোয়াট ইজ আ জাস্ট পিস”। এই গ্রন্থই শান্তি ও সুবিচারের সম্পর্ককে বহুমাত্রায় বিশ্লেষণ করে ‘ন্যায়-শান্তির’ ধারণা সামাজিক চিন্তায় স্থায়ী করেছিল।
এডওয়ার্ড সাইদ এই বইতে “এ মেথড ফর থিংকিং এবাউট জাস্ট পিস” শিরোনামের এক সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ে সংঘর্ষ ও শান্তির দ্বিমেরুকরণের বদলে ‘ন্যায়-শান্তি’কে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে চর্চা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁর মতে যেখানেই দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ উপস্থিত সেখানেই বিরোধের ভেতর সেসব উপাদানে মনোযোগ দেয়া জরুরি যা মৌলিক, সমাধান ও মিলন-অযোগ্য। তাহলেই আমরা পারব সংঘর্ষের কারণ হিসেবে যেসব জ্ঞান ও সংস্কৃতি ক্রিয়াশীল তাদের চিহ্নিত করতে। আর এটাও উপলব্ধি করতে পারব যে, শান্তি ও ন্যায়কে আলাদাভাবে ভাবার সুযোগ নেই। ন্যায়কে বাদ দিয়ে যে শান্তি, তা স্থায়ী তো হতে পারেই না, তা আদৌ শান্তি কিনা সেবিষয়ে সাবধান হওয়া জরুরি।
এরই ধারাবাহিকতায় আমরা শুধু এটুকু বলে ক্ষান্ত হতে পারি যে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় শান্তির সংকট আসলে একটি ন্যায়ের সংকট। যার মূলে রয়েছে অসম বণ্টনের অবিচার। আর ন্যায় ও শান্তি মূলত মানুষ হিসেবে আমাদের সবার সামাজিক অধিকার। তাই যেকোনো সমাজেই শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা – যা এ বছর জাতিসংঘ বিশ্ব শান্তি দিবসের প্রতিপাদ্য। আসলে সম্পদ ও ক্ষমতার সুষম বণ্টনের জন্য এক ন্যায়-যুদ্ধে জড়িত হওয়া, বাংলাদেশও তার বিপরীত কিছু নয় বলেই মনে হয়।
জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব শান্তি দিবস (২১ সেপ্টেম্বর) কথা শুনলে মানুষের মনে এমন ক্ষোভ ও ব্যঙ্গ জাগতেই পারে যে, এসব দিবস দিয়ে আর কী আসে যায়, যেখানে যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই দেশবিদেশ নির্বিশেষে কেবল নিরন্তর যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের খবর। সঙ্গে সঙ্গে এমন হতাশাও তৈরি হয় যে বাংলাদেশেও শান্তি বলে কিছু নেই!
এসব ক্ষোভ, ব্যঙ্গ, হতাশা কোনোটিই অস্বাভাবিক নয় ঠিক ততক্ষণ, যতক্ষণ আমরা শান্তির জন্য যার যার দায়বদ্ধতা অস্বীকার করতে থাকব। আর যখনই এমন একটি আত্মোপলব্ধি এসে ভর করবে যে, যার যার প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌরে অভ্যাস থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আয়তনে শান্তির জন্য আমরা প্রত্যেকে দায়বদ্ধ তখনই কেবল ক্ষোভ-ব্যঙ্গ-হতাশাকে পাশ কাটিয়ে শান্তি নিয়ে উদযাপন-আলোচনায় আমরা নিজেদের অংশীদারত্ব অনুভব করব।
শান্তি নিয়ে কোনো আলোচনা সমাজতাত্ত্বিক জোহান গ্যাল্টুং-এর “ভায়োলেন্স, পিস অ্যাণ্ড পিস রিসার্চ” প্রবন্ধকে বাদ দিয়ে হতে পারে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কেননা এই সমাজতাত্ত্বিক ছিলেন শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রকাশের (১৯৬৯) বহু বছর পরও প্রাসঙ্গিক জোহান গ্যাল্টুং-এর প্রবন্ধটি।
‘শান্তি হলো সংঘর্ষের অনুপস্থিতি’ – এই অনুসিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে জোহান গ্যাল্টুং দেখিয়েছিলেন যে, শান্তির ভাবনা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীভেদে যতই আলাদা হোক না কেন, শান্তি আসলে সকলের সম্মতিমূলক একটি সামাজিক লক্ষ্য যা অর্জন করা অসম্ভব নয়।
যেহেতু সংঘর্ষের অনুপস্থিতিই শান্তি, তাই সংঘর্ষকে আমরা যতটা সূক্ষ্ম ও বিস্তৃতভাবে চিহ্নিত করতে পারব শান্তি প্রতিষ্ঠার আয়োজনসমূহ ততটা ব্যাপক হবে। আর সংঘর্ষকে যদি সীমিতভাবে গ্রহণ করা হয় পক্ষান্তরে তা ব্যাপক শান্তির সম্ভাবনাকেই সীমিত করবে।
সংঘর্ষের সংজ্ঞায়নে গ্যাল্টুং তাই বলেছিলেন, যেসব কারণের জন্য মানুষের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের প্রকৃত বাস্তবায়ন তাদের সম্ভাবনার চেয়ে কম হয় সেগুলোই সংঘর্ষ। অর্থাৎ মানুষের সামাজিক সম্ভাবনা ও বাস্তবতার দূরত্বই হলো সংঘর্ষ।
মনে করুন, কোনো একটি শিশু তার শৈশব কাটালো পথে-ঘাটে, রাস্তায়, বস্তিতে, কখনও স্কুল, মাদ্রাসা কিংবা মক্তবে যাওয়া হলো না তার। আরেকটি শিশু গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অভাবের তাড়নায় ঝরে পড়ল। আরেকটি শিশু ঝরে না পড়ার জন্য তার পরিবার দিনের পর দিন পাতে এক টুকরো মাছ, মাংস বা ডিম তুলতে পারল না। আরেকটি শিশু কোনোভাবে স্কুল, মাদ্রাসা, মক্তব শেষ করল ঠিকই, কিন্তু তার ভাই বা বোনটিকেও এইটুকু পড়াতে গিয়ে নিজের উচ্চতর শিক্ষা বিসর্জন দিয়ে কাজে নেমে পড়ল। আরেকটি শিশু উচ্চশিক্ষায় পৌঁছালো ঠিকই, কিন্তু শিক্ষাব্যয় মেটাতে গিয়ে সময়টা ব্যয় করল টাকা আয়ের পিছনে। আর বঞ্চিত হলো শিক্ষাচর্চার সময় ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে; কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারল না, তার ঘরে যে শিশুটি ইতিমধ্যে এসেছে তার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল, আর আটকে গেলো পূর্বপূরুষের আবর্তে।
যদি এই সব অতিচেনা ‘বাস্তবতা’ এড়ানো যেত তাহলে ধরে নিতে হবে সমাজে শিক্ষার সুযোগে সংঘর্ষ উপস্থিত, যদি এড়ানো না যেত তাহলে সংঘর্ষ নেই, এমনটাই মনে করতেন গ্যালটুং।
আমাদের বাংলাদেশে এগুলো এত পরিচিত ঘটনা যে, এগুলোকে আমরা কখনও ঠিক সংঘর্ষ হিসেবে দেখি না, বরং ‘বাস্তবতা’ হিসেবে দেখি। গাল্টুং গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে তিনি এই বাস্তবতার কারণগুলোকে – যা মানুষের সামাজিক বিকাশের সম্ভাবনাকে বিনাশ করে – সংঘর্ষ হিসেবে দেখতে বলেছেন; যে অভ্যাসটি না করলে, শান্তির বিস্তার সম্ভব নয়।
সংঘর্ষের কাঠামো তাঁর মতে, একটি বাক্যের মতো, যেখানে উপস্থিত থাকে কর্তা, কর্ম ও উদ্দেশ্য। সংঘর্ষকে তিনি ছয়টি মাত্রায় দেখেছেন : ক. দৈহিক ও মানসিক, অর্থাৎ যা মানুষের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে, খ. ঋণাত্মক ও ধনাত্মক, অর্থাৎ শুধু শাস্তি দিয়েই নয়, বরং ভোগবাদী সমাজে উপহার বা পুরস্কার দিয়েও মানুষের বিকাশকে রহিত করা যায়, গ. উদ্দেশ্যের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি, অর্থাৎ যার ক্ষতি হবে সরাসরি সে উপস্থিত না থাকলেও সংঘর্ষ হতে পারে – যেমনটা দেখা যায় রাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা পরীক্ষায় ও প্রদর্শনে, ঘ. কর্তার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে, অর্থাৎ ব্যক্তির দ্বারা সংঘর্ষের বিপরীত কাঠামোর দ্বারা সংঘটিত সংঘর্ষ যেখানে বিশেষ কোনো ব্যক্তি অনুপস্থিত, ঙ. ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সংঘর্ষ, যেখানে দোষ ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় এবং সর্বশেষ চ. অভিব্যক্ত ও অপ্রতীয়মান, অর্থাৎ যে সংঘর্ষ দেখা যায় আর যা দেখা যায় না, কিন্তু নিরন্তর ফলাফলের জন্ম দেয়।
শান্তি যেহেতু সংঘর্ষের অনুপস্থিতি, তাই সংঘর্ষের এই মাত্রাগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই শান্তির জন্য কাজ করতে হবে। গ্যাল্টুং মনে করতেন এই ছয়টি মাত্রার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তিক ও কাঠামোগত মাত্রাটি, যা অন্যান্য মাত্রাগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আর ব্যক্তি যেহেতু সমাজসৃষ্ট একটি ফলাফল তাই ব্যক্তিক ও কাঠামোগত সংঘর্ষকে আলাদা করা প্রায় দুঃসাধ্য।
মনে করুন, আপনি সরাসরি বা কোনো ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছেন একজন ব্যক্তি আরেকজনকে আঘাত করে ছিনতাই করছে তার মালপত্র ও সম্পদ, অথবা একজন গোপনে বিষ দিল আরেকজনের ফসলের ক্ষেতে বা মাছের পুকুরে; অথবা একজন পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর সদস্য গুলি করছে একজন আন্দোলনকারী নাগরিককে; অথবা একজন রাজনৈতিক কর্মী গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করছে আরেকজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়ি লক্ষ্য করে; অথবা একজন সামাজিক বা ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তি আরেকজনকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে বা করছে নিজেকে ঐশী বিধানের রক্ষাকর্তা ঘোষণা করে; অথবা কয়েকজন সাদাপোশাকের লোক কাউকে দিনে দুপুরে গাড়িতে তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে; অথবা কেউ একজন বা কয়েকজন মিলে রাস্তায়, ঘাটে, বাসে, বন্দরে আঘাত করছে আরেকজনকে – যার কারণ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা ব্যক্তিক সংঘর্ষ দেখলেও যে কাঠামো ঐ ব্যক্তিগুলো তৈরি করেছে তার প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই – যদি আমরা এসব দৃশ্য দেখা থেকে মুক্তি চাই, চাই আরেকটু সামাজিক শান্তি।
কাঠামোগত যে কারণে শান্তিপ্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়, তা হলো সামাজিক কাঠামোতে সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম বণ্টনের অভাব। কথাটা অতি পরিচিত সন্দেহ নেই, কিন্তু অতি পরিচয়ে এর আবেদনই কমেছে কেবল; কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি বহু সমাজের মত বাংলাদেশেও। একটি উদাহরণ দিলে কথাটার যুক্তিটা পরিষ্কার হতে পারে।
বাংলাদেশে জমির মালিকানা ও বণ্টনের দিকে তাকানো যাক। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশে একশ্রেণির লোককে বংশানুক্রমিকভাবে জমির ‘মালিক’ বা জমিদার করে তুলেছিল, যা মোগল ভূমিব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল। এমনটাই ধরে নিয়ে বদরুদ্দীন উমর তাঁর ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিপর্যস্ত কৃষকের বিদ্রোহই বাংলায় ও ‘মহাভারতে’ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল। তাঁর মতে, ১৯৪৭ পর্যন্ত বেশিরভাগ উপনিবেশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের মূলে এই ভূমির অসম বণ্টনকে একটি মৌলিক কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন।
মূলত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরের দুইশত বছরে এতগুলো রাজনৈতিক বিপ্লবের পরও ভূমিমালিকানার সুষ্ঠু বণ্টনের মতো একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করা যায়নি। সমাজ কাঠামোতে জমির মালিকানা একটি বিবদমান বিষয় হিসেবে বারবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর ভোক্তার সংখ্যার তুলনায় সম্পদ হিসেবে জমির পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় তা একদিকে যেমন সামাজিক সংঘর্ষের বা শান্তি বিনাশের কারণ হয়েছে, অন্যদিকে জমির মালিকানা ও দখল সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্যতম উৎস হিসেবে রয়ে গেছে আমাদের সমাজে।
আমাদের উপর্যুক্ত ভূমিবণ্টন সমস্যার উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, সামাজিক বিপ্লবের ফলে অনেক সময়ই শান্তির সম্ভাবনা থাকলেও তা বেশিরভাগ সময়ই রাজনৈতিক বিপ্লবের মতো ঘন ঘন ঘটে না।
আমাদের সমাজে গত প্রায় তিনশত বছরে যতগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেই তুলনায় সামাজিক আন্দোলন ও বিপ্লবের সংখ্যা কম। সমাজে শান্তির সংকট হয়তো এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়।
সমাজতাত্ত্বিক পিতিরিম এ সরোকিন রাশিয়ার বিপ্লবের সাপেক্ষে ১৯২৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন “দ্যা সোশিওলজি অভ রেভ্যুলুশন”, যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘর্ষ থেকেই শুধু সাধিত হয় না, তা জন্ম দেয় আরও বেশি সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘর্ষের। আমাদের সমাজ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে তেমন স্থিতিশীল হতে পারেনি। তার ফল হিসেবে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘর্ষের বিস্তার এবং সামাজিক শান্তির অভাবকে পাঠ করা যেতে পারে।
পৃথিবীতে সম্পদ সীমিত দেখেই এর বণ্টন মানুষের জন্য একটি চিরন্তন সমস্যা। সমাজশাস্ত্রে যাকে অর্থনীতি বলে, তা আসলে এই বণ্টনের নীতি ছাড়া কিছু নয়। আর সম্পদ শুধু বৈষয়িক বা বস্তুগত নয়, বরং ক্ষমতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ -- এমনটাই মনে করতেন গ্যালটুং। এদিক থেকে দেখলে তিনি প্যাহে বহদিউ’র ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত “দ্যা ফর্মস অব ক্যাপিটাল”র বহু আগেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির বিষয়টি কেবল সামনেই আনেননি, একে সামাজিক সংঘর্ষ ও শান্তির সাথে সম্পর্কিতও করেছেন।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর “পলিটিকাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া” (২০২২)-তে দেখিয়েছেন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দলের সূচনা হয়েছে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় সামরিক-বেসামরিক আমলা শ্রেণির বিকাশের একটি উপজাত হিসেবে। এই ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি ব্রিটিশের বেতন সূত্রে বিষয়-সম্পত্তি ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক পুঁজির অধিকারী ছিল। কেবল তাই নয়, পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাও এরাই কুক্ষিগত করেছিলেন। বৈষয়িক সম্পদ ও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার এই তীব্র কেন্দ্রীভবনের ঐতিহাসিক বাস্তবতাও আমাদের সমাজে শান্তির সংকটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইম দেখিয়েছেন, যেসব নিয়ম-নীতি সমাজকে সুসংহত রাখে সেগুলোর অবক্ষয়ই সামাজিক সংঘর্ষ বা শান্তির সংকট। সেই সূত্রে, যদি আমাদের সমাজের অধিকাংশেরই এমনটা অনুভূত হয় যে, সামাজিক সৌহার্দ্য ভেঙে পড়ছে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সেসব নিয়ম-নীতিও অনুসন্ধান করা জরুরি। হয়তো এগুলো ব্যর্থ হয়েছে শ্রেণি, গোষ্ঠী, ধর্ম ও জাতিগত সংহতি বজায় রাখতে গিয়ে।
গ্যালটুং তাঁর আলোচনায় ‘শোষণ’ কথাটা ব্যবহার করেননি -- মার্কসবাদী রাজনীতিতে এর বিশেষ ব্যবহারের জন্য। তবু দুটি কারণে আমাদের সমাজেও সংঘর্ষ ও শান্তির আলোচনায় মার্কস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।
প্রথমত, আশির দশকে ব্যবসার উদারনীতিকরণের ফলে আমাদের সমাজে যে একটি কলকারখানাময় উৎপাদনব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে সেই বাস্তবতায় শান্তির সংকটকে মার্কসীয় দৃষ্টিতে নবভাবে দেখা জরুরি। কেননা শিল্পায়িত সমাজে বেশিরভাগ সম্পদ ও সেই সূত্রে ক্ষমতা যে সমাজের সীমিত সংখ্যকের কাছে জমা হয়, তা কেবল শ্রেণি-সংঘর্ষই জন্ম দেয় না, শিল্প সম্পর্কে শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেতন-ভাতা-সুযোগ-সুবিধা বিষয়ক সামষ্টিক দরকষাকষির গতিপ্রকৃতিও নির্ধারণ করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, শ্রেণি-সংঘর্ষকে মার্কস বঞ্চিত সমাজের জন্য একটি ‘ন্যায়-সংঘর্ষ’ হিসেবে দেখেছেন আর শান্তির জন্যও অনেক সমাজতাত্ত্বিক ‘ন্যায়-বল’ প্রয়োগকে প্রয়োজনীয় মনে করেন।
যুদ্ধতাত্ত্বিক ভন ক্লসউইটয ১৮৩২ সালে প্রকাশিত “অন ওয়ার” গ্রন্থে সংঘর্ষের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যুদ্ধকে দেখেছিলেন ‘ভিন্ন পন্থায় রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা’ হিসেবে। আর দার্শনিক মিখাইল ওয়ালজার ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত “জাস্ট ওয়ার” গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন সংঘর্ষের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কোনো যুদ্ধই সম্ভব নয়, যতক্ষণ না তা একটি ‘ন্যায়-যুদ্ধ’ হয়ে ওঠে। তাঁর উদাহরণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধও ছিল। এরই ধারাবাহিকতাতেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ন্যায়-বল’ প্রয়োগের আলোচনা সংঘর্ষ ও শান্তি অধ্যয়নে বিস্তৃত হয়েছে।
গ্যালটুং কাঠামোগত সংঘর্ষকে ‘সামাজিক অবিচার’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন সেই ১৯৬৯ সালে। অনেক পরে ২০০৬ সালে পিয়েরে এলান ও এলেক্সিস কেলারের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় শান্তি অধ্যয়নে নতুন মাত্রা যোগকারী গ্রন্থ “হোয়াট ইজ আ জাস্ট পিস”। এই গ্রন্থই শান্তি ও সুবিচারের সম্পর্ককে বহুমাত্রায় বিশ্লেষণ করে ‘ন্যায়-শান্তির’ ধারণা সামাজিক চিন্তায় স্থায়ী করেছিল।
এডওয়ার্ড সাইদ এই বইতে “এ মেথড ফর থিংকিং এবাউট জাস্ট পিস” শিরোনামের এক সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ে সংঘর্ষ ও শান্তির দ্বিমেরুকরণের বদলে ‘ন্যায়-শান্তি’কে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে চর্চা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁর মতে যেখানেই দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ উপস্থিত সেখানেই বিরোধের ভেতর সেসব উপাদানে মনোযোগ দেয়া জরুরি যা মৌলিক, সমাধান ও মিলন-অযোগ্য। তাহলেই আমরা পারব সংঘর্ষের কারণ হিসেবে যেসব জ্ঞান ও সংস্কৃতি ক্রিয়াশীল তাদের চিহ্নিত করতে। আর এটাও উপলব্ধি করতে পারব যে, শান্তি ও ন্যায়কে আলাদাভাবে ভাবার সুযোগ নেই। ন্যায়কে বাদ দিয়ে যে শান্তি, তা স্থায়ী তো হতে পারেই না, তা আদৌ শান্তি কিনা সেবিষয়ে সাবধান হওয়া জরুরি।
এরই ধারাবাহিকতায় আমরা শুধু এটুকু বলে ক্ষান্ত হতে পারি যে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় শান্তির সংকট আসলে একটি ন্যায়ের সংকট। যার মূলে রয়েছে অসম বণ্টনের অবিচার। আর ন্যায় ও শান্তি মূলত মানুষ হিসেবে আমাদের সবার সামাজিক অধিকার। তাই যেকোনো সমাজেই শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা – যা এ বছর জাতিসংঘ বিশ্ব শান্তি দিবসের প্রতিপাদ্য। আসলে সম্পদ ও ক্ষমতার সুষম বণ্টনের জন্য এক ন্যায়-যুদ্ধে জড়িত হওয়া, বাংলাদেশও তার বিপরীত কিছু নয় বলেই মনে হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব শিক্ষাঙ্গনকে কীভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এখনই যুক্তিনিষ্ঠ ও সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নয়, অরাজকতার দুর্গে পরিণত হবে।
৬ ঘণ্টা আগেভবিষ্যতের দিকে তাকালে বৈশ্বিক গতিপথ দ্বিমুখী অথচ আন্তঃনির্ভরশীল ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সামরিক ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকবে, কিন্তু তাদের প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে একাধিক উন্নয়নশীল দেশের ঐক্য। বিশ্বের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার কারণে এই বৈধতা অর্জন
৯ ঘণ্টা আগেরাহুলের অভিযোগ, ভিন্ন রাজ্যে বসে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত উপায়ে কংগ্রেসপন্থী, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। কর্ণাটকের আলন্দ কেন্দ্রে ছয় হাজারেরও বেশি নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জমা পড়েছিল বলে অভিযোগ। রাহুল গান্ধীর মতে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া আসলে নিতান্তই এ
২ দিন আগেবাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি প্রধানত মন্ত্রণালয়নির্ভর এবং তা সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বড় ব্যবসায়ী সংগঠন ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা প্রভাব বিস্তার করলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, সাধারণ নাগরিক, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত প্রায় অনুপস্থিত থাকে।
২ দিন আগে