leadT1ad

আনু মুহাম্মদের বিশ্লেষণ

জুলাই সনদ ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

আনু মুহাম্মদ
আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ৩৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

আজ জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দিন। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই সনদে সাক্ষর করে একে গণতন্ত্রের পুনর্গঠনের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু সনদটি আমি যেভাবে দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, এটি ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে দেখার প্রচেষ্টা মাত্র। ইতিহাসকে তার পূর্ণ প্রেক্ষাপটে, বিবর্তনে ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনায় বোঝার চেষ্টা এখানে অনুপস্থিত।

জুলাই সনদের গঠন ও ভাষা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এটি একধরনের আংশিক সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সনদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সংবিধানের কিছু ধারার সংস্কারের কথা বলা হলেও অর্থনীতি, প্রশাসন, মানবাধিকার, শিক্ষা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা পরিবেশ—এসব মৌলিক ক্ষেত্র একেবারেই অনুল্লেখিত। ফলে এটি শুধু আইনি কাঠামোর সংস্কারে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের কোনো পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারেনি।

এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো, সনদে এমন একটি ধারা রাখা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে এই সনদ নিয়ে কেউ আদালতে যেতে পারবে না কিংবা এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা প্রশ্ন তোলা যাবে না। এমনকি বলা হয়েছে, স্বাক্ষরকারী দল বা ব্যক্তি একটি বন্ডে সই করবে, যাতে তারা সনদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিতে না পারে। এ ধরনের শর্ত গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

এই নিষেধাজ্ঞামূলক ধারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতের দমনমূলক রাজনীতির কথা। শেখ হাসিনার শাসনামলে সংবিধান বা তার কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনা করা ছিল প্রায় নিষিদ্ধ; কেউ সমালোচনা করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহে শাস্তির মুখে পড়তে হতো। এখন জুলাই সনদের ক্ষেত্রেও একই মানসিকতা ফিরে আসছে বলে আমার মনে হচ্ছে।

সংবিধান নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা যায়, সংশোধনের দাবি তোলা যায়; তেমনি জুলাই সনদ নিয়েও তা করা উচিত। কোনো কিছুই প্রশ্নাতীত নয়। জোর করে বা জোড়াতালি দিয়ে পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা কখনো টেকসই গণতান্ত্রিক রূপান্তরে রূপ নেবে না।

প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দল কোনো না কোনোভাবে জুলাই সনদ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। কেউ সরাসরি স্বাক্ষর করেছে, কেউ করেনি। তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে এতে ভূমিকা রেখেছে। অথচ একই দলগুলো যখন সরকার কর্তৃক জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি বা নীতির বাস্তবায়ন দেখে, তখন নীরব থাকে।

এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা দরকার—প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দল কোনো না কোনোভাবে জুলাই সনদ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। কেউ সরাসরি স্বাক্ষর করেছে, কেউ করেনি। তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে এতে ভূমিকা রেখেছে। অথচ একই দলগুলো যখন সরকার কর্তৃক জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি বা নীতির বাস্তবায়ন দেখে, তখন নীরব থাকে। আর এমন দ্বিচারিতামূলক প্রশ্ন তোলে, ফলে মনে হয়, দলগুলো কি সত্যিই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নেতৃত্ব দিতে পারবে, যদি তারা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নীরব থাকে? শুধু একটি সনদে স্বাক্ষর করলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে—এমন ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

ছাত্ররাজনীতির নতুন বার্তা

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী ছাত্রশিবির বা তাদের ভিন্ন পরিচয়ের সংগঠনগুলোর নির্বাচনী সাফল্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সরাসরি বা আড়াল করা নামে জিতেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে?

আমার মতে, ছাত্র নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তারা শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ ও ক্লান্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পুনর্গঠিত করেছে—সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কর্মসূচির আড়ালে তারা বিকল্প ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। তবে এই সাফল্য জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি প্রতিফলিত হবে না।

তবুও এই ফলাফল আমাদের একটি বাস্তব বার্তা দিচ্ছে। বার্তাটি হলো, বিএনপি এখন সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত। তাদের কাঠামো দুর্বল, নেতৃত্ব বিভক্ত, মাঠ পর্যায়ে কর্মীরা নেতৃত্বহীন। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো দীর্ঘদিনের নিপীড়ন সত্ত্বেও সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

জামায়াতের কৌশল ও পুনর্গঠন

জামায়াতে ইসলামী গত এক দশকে অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের অবস্থান পুনর্গঠিত করেছে। একদিকে তারা সরকারি দল ও প্রশাসনের ভেতরে ভিন্ন পরিচয়ে জায়গা তৈরি করেছে, অন্যদিকে নিপীড়নের রাজনীতি থেকে জনসমর্থন ও সহানুভূতি অর্জন করেছে।

২৮ অক্টোবরের ঘটনার সময় যখন বিএনপি হামলার মুখে ছত্রভঙ্গ হয়, তখন জামায়াত নির্বিঘ্নে বিশাল সমাবেশ করেছে—এটি কোনো না কোনো পর্যায়ে সরকারের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়ার ইঙ্গিত দেয়।

সব মিলিয়ে জুলাই সনদ, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তিত ধারা এবং জামায়াতের কৌশলগত পুনর্গঠন—এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক গভীর রূপান্তরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ, জামায়াত এখন আর্থিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের ব্যাংক, ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এনজিও—সব মিলিয়ে তারা একটি সুসংগঠিত আর্থিক ও সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তারা বিএনপির তুলনায় কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করেছে—শত কোটি টাকার বেশি। এই আর্থিক ও সাংগঠনিক শক্তিই এখন ছাত্ররাজনীতি ও সামাজিক কাঠামোয় প্রতিফলিত হচ্ছে।

পরিবর্তনের বাস্তব শর্ত

এখন প্রশ্ন হলো, আগামী বাংলাদেশের চেহারা কেমন হবে? পরিবর্তন কোনোভাবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসবে না। পরিবর্তনের জন্য যারা পরিবর্তন চায়—তরুণ প্রজন্ম, শ্রমজীবী মানুষ ও সাধারণ নাগরিকদের সচেতন, সংগঠিত ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে হবে।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে তরুণেরা রক্ত দিয়েছে, শ্রমজীবী মানুষও অংশ নিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, রক্তদান শুধু সূচনা, পরিবর্তনের নয়। যেমন ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও সেই মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, মতাদর্শিক সংগঠন ও রাজনৈতিক শক্তির অভাব ছিল।

প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সংগঠিত মতাদর্শিক আন্দোলন, যা জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রের কাঠামো পুনর্গঠন করতে পারে। না হলে রক্ত ও ত্যাগের ফল জনগণের হাতে না গিয়ে অন্য শক্তির হাতে চলে যাবে।

সব মিলিয়ে জুলাই সনদ, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তিত ধারা এবং জামায়াতের কৌশলগত পুনর্গঠন—এসবই ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক গভীর রূপান্তরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

এই রূপান্তর কোন পথে যাবে—তা নির্ভর করছে তরুণ সমাজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংগঠিত চেতনা এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর। যদি তারা নিজেদের মতাদর্শিকভাবে প্রস্তুত করে সংগঠিত হয়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র, ন্যায় ও মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে। অন্যথায়, পুরোনো অন্ধকারই নতুন আকারে ফিরে আসবে।

(অনুলিখিত)

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত