আসিফ রেজা
কদিন আগেই ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসাবে সের্জিও গরের নাম ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প; যিনি শিগগিরই নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর ডিপ্লোম্যাটিক ক্রিডেনশিয়াল পেশ করতে যাচ্ছেন। এমনটা তো হতেই পারত যে, এই নিয়োগে নয়াদিল্লির সাউথ ব্লক যারপরনাই আনন্দিত হয়েছে। তা কিন্তু হয়নি! অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য একজন অপরিহার্য ব্যক্তি। তাই এটাই সবচেয়ে ভাল হত যদি এই সদ্যঘোষিত নিয়োগে নয়াদিল্লি খুশি হওয়ার মতো কোনো কারণ খুঁজে পেত।
ভারতীয় ক্ষমতাসীন সরকার বরং নিয়োগটিকে ঘিরে তাদের অস্বস্তি ও বিরক্তি প্রকাশ করছে। তারা অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের আপত্তি প্রকাশ করে নি। তবুও তাদের অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ যে ঘটেছে এটা তাদের অন্যান্য চ্যানেলে (গোদি মিডিয়া) প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এর কারণ হলো সের্জিও গর কেবল নয়াদিল্লি নয়, তাঁকে একই সঙ্গে ১৩টি দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর করা হয়েছে, যার অন্যতম হল ভারত। অর্থাৎ, ভারতের দীর্ঘদিনের স্থায়ী আপত্তি সত্ত্বেও সের্জিও গর একাধারে ভারত ও পাকিস্তান -- উভয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন।
এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দ্য ওয়ার গত ২৩শে অগাস্ট ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছিল যে, `ট্রাম্প ভারতের রাষ্ট্রদূত ও একই সঙ্গে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার জন্য সের্জিও গর-এর নাম ঘোষণা করেছেন।’
প্রথমবারের মত এমন একটি চমক সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটল, যার ফলে মার্কিন ফরেন পলিসিতে নয়াদিল্লির একক কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে একপ্রকার অবনমন হয়েছে বলে আন্তর্জার্তিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। অন্য কথায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চশমা পড়ে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখার অনেক বছরের নীতি পরিত্যাগ করেছে। ফলে এই অঞ্চলে ভারতীয় কট্টর জাতীয়তাবাদীরা ভারতের একক আধিপত্যের যে স্বপ্ন দেখছিলেন, তা রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বেশ কিছু ভারতীয় ভূরাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ও ক্ষুব্ধ সাংসদ ইতিমধ্যে পার্লামেন্টের লোকসভায় এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাঁদের উষ্মা প্রকাশ করে ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, তারা যেন এই নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতমাতা কি এতই তুচ্ছ হয়ে গেল যে নয়াদিল্লিতে একজন পার্ট টাইম দূত পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাকে অপমান করবে? তাঁরা প্রশ্ন করছেন, একই সঙ্গে ১৩টি দেশের মধ্যে দূতিয়ালি করলে পার্ট টাইমে ভারতের কোন কাজে আসবেন সের্জিও গর?
তবে ভারতের স্বঘোষিত বিশ্বগুরু মোদি সরকারের তরফে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ কিংবা অনুযোগ প্রকাশ শোনা যায় নি। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের চলমান দুরবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রদূত প্রশ্নে নতুন কোনো মাথাব্যাথা নেওয়ার উৎসাহ পাচ্ছে না সাউথ ব্লক।
এদিকে সের্জিও গর দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভারত সফর করলেন না, বরং তাঁর দায়িত্বে থাকা অন্যান্য রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করাকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনুস -- যিনি ভারতীয় স্টাবলিশমেন্ট ও ডিপ স্টেটের চক্ষুশূল। সের্জিও গোর তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন।
এমনকি শ্রীলংকার বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছেন সের্জিও গর। শুধু তাই নয়, ভুটানকে তিনি ভারতের চেয়ে অগ্রগণ্য মনে করেছেন। ওদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সেক্রেটারি অব স্টেটসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাই স্টেক মিটিং করেছেন। সারা দুনিয়া এখন তা জানে। সেখানেও সের্জিও গর ছিলেন। তবে ভারত সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই ভুটান সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় ভারতীয় ডিপ স্টেট যে অত্যন্ত অসুখী সেটা ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) পত্রিকায় প্রকশিত একটি লেখায় স্পষ্ট। শুভজিৎ রায়ের সে লেখায় পাওয়া যাচ্ছে হতাশামিশ্রিত মন্তব্য।
ওই লেখায় মন্তব্য করা হয়েছে, ‘‘সেপ্টেম্বর এর ২২ তারিখ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ‘অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনা’ করেন”। পাঠক, লক্ষ করুন, প্রফেসর ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অত্যন্ত খারাপ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গর আর ইউনুস ‘অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনা’ করছেন; আর তা দেখে হতভম্ব ভারতীয় ডিপ স্টেট হতাশাগ্রস্ত প্রেমিকের মতোই ভাবছে, ‘সুরঞ্জনা!.. কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’
সে যাই হোক, ওই ‘অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনা’য় অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনুস ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন বটে। বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। এ সম্পর্কে কিছু বলার আগে আসুন দেখে নেই এই বিষয়ে ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ কি লিখেছে। পত্রিকাটি রিপোর্ট করছে যে, “ভারতে মার্কিন দূতাবাস মনোনীত, সার্জিও গর, যিনি দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের বিশেষ দূতও হবেন, তিনি দ্রুত তাঁর দ্বিতীয় ভূমিকায় নেমে পড়েছেন, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন”।
বোঝাই যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও ভুটান যে এখন ভারতের চেয়ে বেশি গুরুত্ববহ সেটা নয়াদিল্লির প্রধানদের চোখে পড়েছে। এজন্যই লেখাটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সূত্র জানায়, দিল্লিতেও বিষয়টি নজর এড়ায়নি। তারা তাঁর বৈঠকগুলো খুব কাছ থেকে দেখছে, বিশেষ করে তিনি কখন, পাকিস্তানের কোন কোন নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন তা জানতে তাঁরা বিশেষভাবে আগ্রহী। তাঁরা আরও বুঝতে আগ্রহী, তিনি কি দিল্লির ওপর অচল হয়ে পড়া সার্ক সম্পর্কে দেশটির ঘোষিত দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে চাপ দিতে, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় ভেঙে যাওয়ার কারণে অচলাবস্থায় রয়েছে।’
প্রকৃতপক্ষে, প্রফেসর ইউনুসের সঙ্গে সের্জিও গরের সাম্প্রতিক আলোচনাটি এই সার্ক প্রশ্নেই বিশেষ গুরুত্ববহ বলে বিবেচিত হচ্ছে। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হলো, ড. ইউনুস সের্জিও গরকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বিশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত হওয়ার গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সার্কের অচলাবস্থার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক সহযোগিতা যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশ আশা করে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা আবার চালু করার স্বার্থে গর যেন সার্কের পুনরুজ্জীবনে ভারতের ওপর যথাযথ ইতিবাচক চাপ প্রদান করেন।
অথচ কে না জানে, সার্ক-এর পুনরুজ্জীবনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভারতের স্বার্থপর দাদাগিরি! ভারত বলছে তারা সার্ককে পুনরায় চালু করতে অনাগ্রহী। কারণ সার্কে পাকিস্তানের মুখ দেখতে হবে। এই নীতির দ্বিচারিতা এই যে, ভারত সাংহাই কোঅপারেশনের মতো ফোরামগুলোতে কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গেই নিয়মিত বসছে!
আসল কথা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার ছোট প্রতিবেশীগুলোর ওপর একচ্ছত্র ছড়ি ঘুরানোর লাইসেন্স পেতে চায় ভারত, যা সার্কের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরামে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন পাকিস্তানের উপস্থিতিতে সম্ভব নয়।
ভারত বরাবরই এই অঞ্চলের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোকে তাদের স্বাভাবিক প্রভাববলয় হিসাবে দেখতে চায়, একদিন যার আদর্শিক রূপ হবে ‘অখণ্ড ভারত’। সেই কারণে সের্জিও গরের কাছে প্রফেসর ইউনুসের সার্ক পুনরুজ্জীবনের ঘোষিত ইচ্ছাটি কথিত ‘বিশ্বগুরু’ ভারতের ইচ্ছার সঙ্গে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশ যে ভারতের ‘নির্দেশে’ বিমসটেক-কে সার্ক-এর বিকল্প হিসাবে মানতে নারাজ তা এখন খুবই স্পষ্ট। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার আলোচ্য প্রবন্ধে ইউনুস-গর আলোচনা সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির উল্লেখ আছে। এ সূত্রে এক্সপ্রেস লিখেছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে, যেখানে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কোনো শীর্ষ সম্মেলন হয়নি। তিনি (ড. ইউনুস) আসিয়ানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অর্থনীতির সঙ্গে একীভূতকরণ দেশের উন্নয়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে’।
এ পরিস্থিতিতে ভারতের আঞ্চলিক সম্প্রসারণবাদী এস্টাবলিশমেন্ট ভীত হয়ে পড়েছে; তারা ভাবছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর চাপে সার্ক পুনরুজ্জীবনের বিষয়টিকে অনিচ্ছুক ভারতের সঙ্গে তাদের সকল ভবিষ্যৎ আলোচনার অংশ করে না ফেলে।
বিশেষত, আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা ও পারস্পরিক যোগাযোগ তাদের এই ভয়কে আরও গভীর করেছে। তাছাড়া সের্জিও গরকে এককভাবে ভারতে রাষ্ট্রদূত না করে দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের জন্য বিশেষ দূত করায় ভারতকে এটাও ভাবতে হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতকেন্দ্রিক চিন্তা নয়, বরং গোটা অঞ্চলের সব দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিও সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে। আর তাই এ সিদ্ধান্ত করাই যায় যে, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে ভারত চিন্তিত হয়ে পড়েছে। শাসকগোষ্ঠীর চিন্তার ছাপ পড়ছে নানা সাংস্কৃতিক রূপায়ণেও; শারদীয় দুর্গাপূজায় ড. মুহম্মদ ইউনুসের আদলে অসুরবধের মূর্তি নির্মাণ তাই হয়ে ওঠে ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের অসন্তোষ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ভূরাজনীতি পর্যবেক্ষক
কদিন আগেই ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসাবে সের্জিও গরের নাম ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প; যিনি শিগগিরই নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর ডিপ্লোম্যাটিক ক্রিডেনশিয়াল পেশ করতে যাচ্ছেন। এমনটা তো হতেই পারত যে, এই নিয়োগে নয়াদিল্লির সাউথ ব্লক যারপরনাই আনন্দিত হয়েছে। তা কিন্তু হয়নি! অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য একজন অপরিহার্য ব্যক্তি। তাই এটাই সবচেয়ে ভাল হত যদি এই সদ্যঘোষিত নিয়োগে নয়াদিল্লি খুশি হওয়ার মতো কোনো কারণ খুঁজে পেত।
ভারতীয় ক্ষমতাসীন সরকার বরং নিয়োগটিকে ঘিরে তাদের অস্বস্তি ও বিরক্তি প্রকাশ করছে। তারা অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের আপত্তি প্রকাশ করে নি। তবুও তাদের অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ যে ঘটেছে এটা তাদের অন্যান্য চ্যানেলে (গোদি মিডিয়া) প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এর কারণ হলো সের্জিও গর কেবল নয়াদিল্লি নয়, তাঁকে একই সঙ্গে ১৩টি দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর করা হয়েছে, যার অন্যতম হল ভারত। অর্থাৎ, ভারতের দীর্ঘদিনের স্থায়ী আপত্তি সত্ত্বেও সের্জিও গর একাধারে ভারত ও পাকিস্তান -- উভয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন।
এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দ্য ওয়ার গত ২৩শে অগাস্ট ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছিল যে, `ট্রাম্প ভারতের রাষ্ট্রদূত ও একই সঙ্গে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার জন্য সের্জিও গর-এর নাম ঘোষণা করেছেন।’
প্রথমবারের মত এমন একটি চমক সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটল, যার ফলে মার্কিন ফরেন পলিসিতে নয়াদিল্লির একক কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে একপ্রকার অবনমন হয়েছে বলে আন্তর্জার্তিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। অন্য কথায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চশমা পড়ে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখার অনেক বছরের নীতি পরিত্যাগ করেছে। ফলে এই অঞ্চলে ভারতীয় কট্টর জাতীয়তাবাদীরা ভারতের একক আধিপত্যের যে স্বপ্ন দেখছিলেন, তা রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বেশ কিছু ভারতীয় ভূরাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ও ক্ষুব্ধ সাংসদ ইতিমধ্যে পার্লামেন্টের লোকসভায় এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাঁদের উষ্মা প্রকাশ করে ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, তারা যেন এই নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতমাতা কি এতই তুচ্ছ হয়ে গেল যে নয়াদিল্লিতে একজন পার্ট টাইম দূত পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাকে অপমান করবে? তাঁরা প্রশ্ন করছেন, একই সঙ্গে ১৩টি দেশের মধ্যে দূতিয়ালি করলে পার্ট টাইমে ভারতের কোন কাজে আসবেন সের্জিও গর?
তবে ভারতের স্বঘোষিত বিশ্বগুরু মোদি সরকারের তরফে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ কিংবা অনুযোগ প্রকাশ শোনা যায় নি। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের চলমান দুরবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রদূত প্রশ্নে নতুন কোনো মাথাব্যাথা নেওয়ার উৎসাহ পাচ্ছে না সাউথ ব্লক।
এদিকে সের্জিও গর দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভারত সফর করলেন না, বরং তাঁর দায়িত্বে থাকা অন্যান্য রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করাকেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনুস -- যিনি ভারতীয় স্টাবলিশমেন্ট ও ডিপ স্টেটের চক্ষুশূল। সের্জিও গোর তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন।
এমনকি শ্রীলংকার বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছেন সের্জিও গর। শুধু তাই নয়, ভুটানকে তিনি ভারতের চেয়ে অগ্রগণ্য মনে করেছেন। ওদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সেক্রেটারি অব স্টেটসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাই স্টেক মিটিং করেছেন। সারা দুনিয়া এখন তা জানে। সেখানেও সের্জিও গর ছিলেন। তবে ভারত সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই ভুটান সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় ভারতীয় ডিপ স্টেট যে অত্যন্ত অসুখী সেটা ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) পত্রিকায় প্রকশিত একটি লেখায় স্পষ্ট। শুভজিৎ রায়ের সে লেখায় পাওয়া যাচ্ছে হতাশামিশ্রিত মন্তব্য।
ওই লেখায় মন্তব্য করা হয়েছে, ‘‘সেপ্টেম্বর এর ২২ তারিখ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ‘অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনা’ করেন”। পাঠক, লক্ষ করুন, প্রফেসর ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অত্যন্ত খারাপ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গর আর ইউনুস ‘অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনা’ করছেন; আর তা দেখে হতভম্ব ভারতীয় ডিপ স্টেট হতাশাগ্রস্ত প্রেমিকের মতোই ভাবছে, ‘সুরঞ্জনা!.. কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’
সে যাই হোক, ওই ‘অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনা’য় অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনুস ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছেন বটে। বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। এ সম্পর্কে কিছু বলার আগে আসুন দেখে নেই এই বিষয়ে ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ কি লিখেছে। পত্রিকাটি রিপোর্ট করছে যে, “ভারতে মার্কিন দূতাবাস মনোনীত, সার্জিও গর, যিনি দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের বিশেষ দূতও হবেন, তিনি দ্রুত তাঁর দ্বিতীয় ভূমিকায় নেমে পড়েছেন, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন”।
বোঝাই যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও ভুটান যে এখন ভারতের চেয়ে বেশি গুরুত্ববহ সেটা নয়াদিল্লির প্রধানদের চোখে পড়েছে। এজন্যই লেখাটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সূত্র জানায়, দিল্লিতেও বিষয়টি নজর এড়ায়নি। তারা তাঁর বৈঠকগুলো খুব কাছ থেকে দেখছে, বিশেষ করে তিনি কখন, পাকিস্তানের কোন কোন নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন তা জানতে তাঁরা বিশেষভাবে আগ্রহী। তাঁরা আরও বুঝতে আগ্রহী, তিনি কি দিল্লির ওপর অচল হয়ে পড়া সার্ক সম্পর্কে দেশটির ঘোষিত দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে চাপ দিতে, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় ভেঙে যাওয়ার কারণে অচলাবস্থায় রয়েছে।’
প্রকৃতপক্ষে, প্রফেসর ইউনুসের সঙ্গে সের্জিও গরের সাম্প্রতিক আলোচনাটি এই সার্ক প্রশ্নেই বিশেষ গুরুত্ববহ বলে বিবেচিত হচ্ছে। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হলো, ড. ইউনুস সের্জিও গরকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বিশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত হওয়ার গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সার্কের অচলাবস্থার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক সহযোগিতা যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশ আশা করে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা আবার চালু করার স্বার্থে গর যেন সার্কের পুনরুজ্জীবনে ভারতের ওপর যথাযথ ইতিবাচক চাপ প্রদান করেন।
অথচ কে না জানে, সার্ক-এর পুনরুজ্জীবনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভারতের স্বার্থপর দাদাগিরি! ভারত বলছে তারা সার্ককে পুনরায় চালু করতে অনাগ্রহী। কারণ সার্কে পাকিস্তানের মুখ দেখতে হবে। এই নীতির দ্বিচারিতা এই যে, ভারত সাংহাই কোঅপারেশনের মতো ফোরামগুলোতে কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গেই নিয়মিত বসছে!
আসল কথা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার ছোট প্রতিবেশীগুলোর ওপর একচ্ছত্র ছড়ি ঘুরানোর লাইসেন্স পেতে চায় ভারত, যা সার্কের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরামে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন পাকিস্তানের উপস্থিতিতে সম্ভব নয়।
ভারত বরাবরই এই অঞ্চলের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোকে তাদের স্বাভাবিক প্রভাববলয় হিসাবে দেখতে চায়, একদিন যার আদর্শিক রূপ হবে ‘অখণ্ড ভারত’। সেই কারণে সের্জিও গরের কাছে প্রফেসর ইউনুসের সার্ক পুনরুজ্জীবনের ঘোষিত ইচ্ছাটি কথিত ‘বিশ্বগুরু’ ভারতের ইচ্ছার সঙ্গে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশ যে ভারতের ‘নির্দেশে’ বিমসটেক-কে সার্ক-এর বিকল্প হিসাবে মানতে নারাজ তা এখন খুবই স্পষ্ট। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার আলোচ্য প্রবন্ধে ইউনুস-গর আলোচনা সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির উল্লেখ আছে। এ সূত্রে এক্সপ্রেস লিখেছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে, যেখানে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কোনো শীর্ষ সম্মেলন হয়নি। তিনি (ড. ইউনুস) আসিয়ানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অর্থনীতির সঙ্গে একীভূতকরণ দেশের উন্নয়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে’।
এ পরিস্থিতিতে ভারতের আঞ্চলিক সম্প্রসারণবাদী এস্টাবলিশমেন্ট ভীত হয়ে পড়েছে; তারা ভাবছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর চাপে সার্ক পুনরুজ্জীবনের বিষয়টিকে অনিচ্ছুক ভারতের সঙ্গে তাদের সকল ভবিষ্যৎ আলোচনার অংশ করে না ফেলে।
বিশেষত, আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা ও পারস্পরিক যোগাযোগ তাদের এই ভয়কে আরও গভীর করেছে। তাছাড়া সের্জিও গরকে এককভাবে ভারতে রাষ্ট্রদূত না করে দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের জন্য বিশেষ দূত করায় ভারতকে এটাও ভাবতে হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতকেন্দ্রিক চিন্তা নয়, বরং গোটা অঞ্চলের সব দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিও সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে। আর তাই এ সিদ্ধান্ত করাই যায় যে, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে ভারত চিন্তিত হয়ে পড়েছে। শাসকগোষ্ঠীর চিন্তার ছাপ পড়ছে নানা সাংস্কৃতিক রূপায়ণেও; শারদীয় দুর্গাপূজায় ড. মুহম্মদ ইউনুসের আদলে অসুরবধের মূর্তি নির্মাণ তাই হয়ে ওঠে ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের অসন্তোষ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ভূরাজনীতি পর্যবেক্ষক
একটা রাষ্ট্রে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকেরা ক্ষমতায় থাকার সময় কী করে? তারা যে সব সময় টাকাপয়সার জোরে কিম্বা অস্ত্রপাতি আর বাহিনীর জোরে টিকে থাকে এমন নয়। বরং তারা শিল্প-সাহিত্য, কবিতা, আর্ট-কালচার, থিয়েটার, সিনেমা, মিডিয়া, ক্রীড়া-বিনোদন ইত্যাদি যত সফট পাওয়ার আছে—তার সব কিছু দিয়ে জনগণ তথা শাসিতদের মনে নিজেদের
১ দিন আগেইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহিদুল আলম। এ সংবাদে তাঁর সহকর্মীরাই শুধু নন, উদ্বিগ্ন সমগ্র বাংলাদেশ। শহিদুলের কাজ ও ব্যক্তিত্বের ধরন প্রসঙ্গে লিখেছেন তাঁর সহকর্মী তানভীর মুরাদ তপু।
১ দিন আগেদীর্ঘদিন পর গণমাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিয়ে কথা বলার শুরুতেই যেটি বলতে হবে তা হলো, সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিশেষ তাৎপর্য তৈরি করেছে। এই সাক্ষাৎকারকে যদি আমরা সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করি, তাহলে একে
১ দিন আগেআমি সবসময়ই একজন আশাবাদী মানুষ। তাই ভেবেছিলাম, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলা ও গাজার অবরোধ ভাঙার ঘটনাটি হয়তো ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন নীতির পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করবে।
২ দিন আগে