leadT1ad

আজ চে গুয়েভারার মৃত্যুদিন

চে গুয়েভারার সমাধিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল

আজ ৯ অক্টোবর চে গুয়েভারার মৃত্যুদিন। ১৯৬৭ সালের এই দিনে বলিভিয়ার একটি গ্রামে চে গুয়েভারা নিহত হন। ২০১৯ সালে ভূ-পর্যটক তানভীর অপু কিউবার সান্তা ক্লারা শহরে চে গুয়েভারার সমাধিতে গিয়েছিলেন। এই বিপ্লবীর সমাধিতে গিয়ে কেমন অনুভূতি হয়েছিল, তা জানা যাবে এ লেখায়।

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ২১: ১৯
চে গুয়েভারার সমাধিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। স্ট্রিম ছবি

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের মৃত্যু তাঁদের অস্তিত্বকে মুছে দেয় না, বরং আরও জীবন্ত করে তোলে, আরও প্রেরণার উৎসে পরিণত করে। চে গুয়েভারা ঠিক তেমনই এক নাম।

চে গুয়েভারা আমার অন্তরে আছেন সেই শৈশব থেকে। তাই ২০১৯ সালে যখন কিউবায় গেলাম, তখন গিয়েছিলাম সান্তা ক্লারা শহরে—চে গেয়াভারার সমাধিতে। এখানেই সমাহিত হয়েছেন আমার স্বপ্নের নায়ক।

চে গুয়েভারার সমাধিতে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
চে গুয়েভারার সমাধিতে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বলা দরকার, এই সান্তা ক্লারা শহর ছিল চে গুয়েভারার বিপ্লবী জীবনের কেন্দ্রস্থল। এখানেই তিনি প্রথম গেরিলা বাহিনী সংগঠিত করেছিলেন। এই সমাধিস্থল তাই কেবল একটি কবর নয়, এটি একটি ইতিহাসের স্মারক।

মনে পড়ে, সান্তা ক্লারারার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি ইতিহাসের গভীর ছোঁয়া অনুভব করেছিলাম। কেননা, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম চে গুয়েভারার বিশাল এক ভাস্কর্যের সামনে। এ ভাষ্কর্য যেন বলে দিচ্ছে তাঁর দৃপ্ত দৃষ্টি আর দৃঢ় পদক্ষেপের ইতিহাস। চে এখনো আমাদের বিপ্লবের পথে উদ্বুদ্ধ করে।

চে গুয়েভারার সমাধি। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
চে গুয়েভারার সমাধি। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আদতে চে গুয়েভারার সঙ্গে কিউবার সান্তা ক্লারা শহরে একাকার হয়ে আছে। আগেই বলেছি, এ শহরেই তিনি প্রথম গেরিলা বাহিনী সংগঠিত করেছিলেন। সৈন্যবাহী ট্রেন থামিয়ে দখল করেছিলেন অস্ত্র। আর এ ঘটনার মধ্য দিয়েই বিপ্লবীযাত্রার সূচনা ঘটেছিল চে গুয়েভারার।

ইতিহাসের সত্য এই যে, সান্তা ক্লারার ওই ট্রেন যুদ্ধই কিউবান বিপ্লবের ভাগ্য পাল্টে দেয়। আর বিপ্লবী হিসেবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে চে গুয়েভারার নাম।

চে গুয়েভারার সমাধির দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে তাঁর জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
চে গুয়েভারার সমাধির দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে তাঁর জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

যখন আমি এই মহান মানুষটির সমাধিস্থলে গিয়েছিলাম, আমার মধ্যে গভীর এক বিষণ্নতা কাজ করছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বারবার মনে পড়ছিল তাঁর জীবনকাহিনি। কীভাবে এক তরুণ ডাক্তার থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ববিপ্লবী।

আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া চে গুয়েভারা এক সময় ছিলেন সাধারণ এক ভ্রমণপিপাসু যুবক। এক বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেল নিয়ে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই ভ্রমণই তাঁর জীবন পুরো বদলে দিয়েছিল।

কিউবার সান্তা ক্লারার হোটেল সান্তা ক্লারা লিব্রের সামনের দেয়ালে ১৯৫৮ সালের গোলাগুলির চিহ্ন। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
কিউবার সান্তা ক্লারার হোটেল সান্তা ক্লারা লিব্রের সামনের দেয়ালে ১৯৫৮ সালের গোলাগুলির চিহ্ন। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

চলার পথে তিনি দেখেছিলেন মানুষের দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর শোষণ। দেখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আর স্থানীয় শাসকদের দমননীতি কীভাবে পিষ্ট করছে সাধারণ মানুষকে। বলা যায়, এই মোটরসাইকেল ভ্রমণই চে গুয়েভারার জীবনের দিশা ঠিক করে দেয়। তাঁর হৃদয়ে জ্বেলে দেয় বিপ্লবের শিখা।

আমি যখন চে গুয়েভারার ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন দেখলাম দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে তাঁর জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি। কোথাও তিনি ঘোড়ার পিঠে বিপ্লবের প্রস্তুতিতে, কোথাও আবার সেনার পোশাকে যুদ্ধের ময়দানে। আবার কোনো এক ছবিতে দেখা গেল, জাতিসংঘের মঞ্চে দৃপ্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ করছেন।

চে গুয়েভারা ও তাঁর সঙ্গীরা যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন এই বুলডোজার। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
চে গুয়েভারা ও তাঁর সঙ্গীরা যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন এই বুলডোজার। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কিউবার বিপ্লবের পর চে গুয়েভারা হয়েছিলেন দেশটির অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তিনি বিপ্লবকেই সবচেয়ে বড় ধ্যানজ্ঞান মনে করতেন। তাই কিউবার বিপ্লবে সফল হওয়ার পর মন্ত্রীত্ব ছেড়ে তিনি চলে যান আফ্রিকার কঙ্গোতে, সেখানে নতুন করে বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর আশা নিয়ে।

কঙ্গোতে ব্যর্থ হয়ে তিনি যাত্রা করেন বলিভিয়ায়, যেখানে শেষ পর্যন্ত মার্কিন গুপ্তচরদের সহায়তায় তাঁকে হত্যা করা হয়। চে গুয়েভারাকে হত্যা করা হয়েছিল ঘটেছিল খুবই নিষ্ঠুরভাবে। প্রথমে তাঁর দুই হাত কেটে ফেলা হয় এবং সেই হাত দুটি পাঠানো হয় ভিন্ন ভিন্ন দেশে। কিন্তু মৃত্যু কি থামাতে পেরেছে এই বিশ্ববিপ্লবীর দর্শনকে? না, তাঁর চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশে।

চে গুয়েভারা ও তাঁর সহযোদ্ধারা বুলডোজার দিয়ে রেললাইন উপড়ে লড়াই শেষে এই ট্রেনটি দখল করেন। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
চে গুয়েভারা ও তাঁর সহযোদ্ধারা বুলডোজার দিয়ে রেললাইন উপড়ে লড়াই শেষে এই ট্রেনটি দখল করেন। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া—যেখানেই তরুণরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সেখানে চে নতুন করে জন্ম নেন।

চে গুয়েভারার মৃত্যুর ২০ বছর পূর্তিতে কিউবার সরকার সান্তা ক্লারায় তাঁর স্মৃতিতে তৈরি করে বিশাল এক ভাস্কর্য। এর আরও ১০ বছর পর বলিভিয়া থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁর দেহাবশেষ, যা এনে সান্তা ক্লারাতেই সমাহিত করা হয়।

কিউবার রাস্তা। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
কিউবার রাস্তা। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

২০১৯ সালে চে গুয়েভারার সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন এক অপরাধবোধ জেঁকে বসেছিল আমার ভেতরে। শুধু মনে হচ্ছিল, আমরা যারা আজ নিজেদের ছোট ছোট জগতে সীমাবদ্ধ, তারা চে’কে ঠিকভাবে ধারণ করতে পারিনি। তাই নিঃশব্দে মনে মনে উচ্চারণ করেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই অবিস্মরণীয় চরণ, ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত