রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫ চিনিকলের ছয়টিতে প্রায় পাঁচ বছর উৎপাদন বন্ধ। অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ চিনিকল চালুর জন্য টাস্কফোর্স কমিটি করলেও মেলেনি অর্থ। এতে ছয় চিনিকল সংশ্লিষ্টদের হতাশা দীর্ঘ হচ্ছে। তবে বাকি ৯টিতে ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে চলতি মৌসুমের আখমাড়াই।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্র জানায়, ৭ নভেম্বর নাটোরের নর্থবেঙ্গল চিনিকল, ২১ নভেম্বর নাটোর চিনিকল, ২৮ নভেম্বর রাজশাহী চিনিকল ও জামালপুরের জিলবাংলা চিনিকল, ৫ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড ও ফরিদপুর চিনিকল, ১২ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও চিনিকল ও ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকল এবং ২৬ ডিসেম্বর জয়পুরহাট চিনিকলে মাড়াই শুরু হবে।
২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় শেখ হাসিনা সরকার হঠাৎ ছয়টি চিনিকলে আখমাড়াই বন্ধের ঘোষণা দেয়। খেতে তখন দণ্ডায়মান আখ, কাটার অপেক্ষায় ছিল। আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে কর্মী ও কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামলেও লাভ হয়নি।
এরপর থেকে বন্ধই রয়েছে রংপুরের শ্যামপুর চিনিকল, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকল, গাইবান্ধার রংপুর চিনিকল, পঞ্চগড় চিনিকল, পাবনা চিনিকল ও কুষ্টিয়া চিনিকল।
এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (বিএসএফআইসি) মনোয়ার হাসান খান বলেন, চিনিকলগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করার পরিকল্পনা ছিল। সেতাবগঞ্জ ও শ্যামপুরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজি হয়নি। আমরা আবার চেষ্টা করব। টাকা পেলে কার্যক্রম শুরু হবে।
আশার জোয়ারে বিষাদ
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ ছয় চিনিকল চালুর জন্য টাস্কফোর্স গঠন করে। ছয় চিনিকল সংশ্লিষ্টদের নিয়ে টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক করা হয় বিএসএফআইসির চেয়ারম্যানকে। প্রথমে কমিটিতে ১৩ সদস্য থাকলেও, পরে আরও পাঁচজন অন্তর্ভুক্ত হয়।
টাস্কফোর্সের সুপারিশে জেগে ওঠে আশা। চাষিরা নতুন করে বিঘার পর বিঘা আখ রোপণ করেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকলের প্রবেশপথে গজিয়ে ওঠা আগাছা কেটে ফেলা হয়। জীর্ণ দেয়াল-মেঝে ধুয়ে করা হয় ঝকঝকে।
নতুন করে উদ্বোধনের আনন্দে চিনিকলের কিছু কর্মী পিঠা উৎসব আয়োজন করেন। আশপাশের কৃষক পরিবার ও কর্মীদের স্ত্রী-সন্তানরাও উৎসবে মেতে ওঠেন। সবার হাসি-ঠাট্টায় পাঁচ বছর পর স্যাঁতসেঁতে ভবন যেন ফিরে পায় প্রাণ। মানুষের চোখে-মুখে ঝলমলিয়ে ওঠে পুরোনো দিনের স্মৃতি।
কিন্তু কৃষক পরিবার ও কর্মীদের এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গত ৩০ জুলাই চিঠি দিয়ে অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে অসম্মতি জানায় অর্থ বিভাগ। কারণ হিসেবে বলা হয়, বিগত দুই দশকে পরিচালনা ঋণ বাবদ বিএসএফআইসিকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। বিএসএফআইসি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। বিপুল ভর্তুকি কমানোর উদ্দেশ্যে চিনিকলগুলো বন্ধ করা হয়েছিল। নতুন করে অর্থ ছাড় সম্ভব নয়।
অর্থ বিভাগের এমন অবস্থানে বিপাকে পড়েছেন অন্তত ২৯১ হেক্টর জমিতে আখ চাষ করা স্থানীয় হাজার হাজার চাষি। রংপুরের পালিচড়া গ্রামের কৃষক মিলন মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, আখ আমাদের এলাকার অর্থকরী ফসল। আগে আখ চাষ করে বছর শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পেতাম। এবার অনেক আশা নিয়ে চাষ করেছিলাম। কিন্তু লোকসান গুণতে হবে মনে হচ্ছে। শ্যামপুর চিনিকল চালু হলে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে লোকজনের কর্মসংস্থান বাড়ত।
বালাচওড়ারহাট এলাকার কৃষক মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শ্যামপুর চালু হইলে এটে আঁখ বেচার পাইনো হয়। এটা নাকি আর চালু হবার নেয়। ওই জন্য জয়পুরহাটের চিনিকলে বিক্রি করা লাগবে। এতে ঝক্কি-ঝামেলা বেশি। খরচ বেশি। শ্যামপুর মিল চালু হইলে হামরা লাভবান হইনো হয়।’
শ্যামপুর গ্রামের আখচাষি ফজলুল হক বলেন, বিভিন্ন সময় চিনিকল চালুর জন্য আন্দোলন করেছি। অন্তর্বর্তী সরকার আশা দেখিয়ে এখন শুনছি চালু করবে না।
শ্যামপুর চিনিকলের অস্থায়ী শ্রমিক সুজন মিয়া বলেন, চিনিকলে কাজ করে ভালো ছিলাম। শেখ হাসিনার পতনের পর শুনলাম চিনিকল চালু হবে। আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আবারও কাজ করে দুই টাকা রোজগার করতে পারব। কিন্তু এখন শুনছি বন্ধই থাকবে। আশা দেখানোর তো দরকার ছিল না।
শ্যামপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর চিনিকল চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে অর্থছাড় হয়নি। চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টর যোগাযোগ করছেন। আমাদের বেতন-ভাতা ঠিক আছে। আমরা চাই মিল দ্রুত চালু হোক।
বন্ধ চিনিকল টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য আলতাফ হোসেন বলেন, এটি খুবই হতাশার। কীভাবে চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে লাভজনক করা যায়, তার বিস্তারিত সুপারিশ দিয়েছিল কমিটি। অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় আবারও কলগুলোর কার্যক্রমে অনিশ্চয়তা দেখা দিল।
তিনি বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকার এসব সম্পদ কাজে লাগানো গেলে লোকসান নয়, লাভের মুখ দেখবে বিএসএফআইসি। চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পযুক্ত করলে ব্যবসার পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে।
পঞ্চগড় চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম জানান, সরকার আশা দেখিয়ে আবারও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যোগাযোগ করছি, চালু না করলে আখচাষি, শ্রমিকসহ সবাইকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার জানান, অর্থ বরাদ্দ পেলে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নেবেন তাঁরা।
টাস্কফোর্সের সুপারিশে কী ছিল
টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল চালুর জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আখচাষ উন্নয়ন ও রোপণ-সংক্রান্ত সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়। একই সঙ্গে ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রক্ষেপণ করা হয় কল দুটির। শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল চালুর জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যথাক্রমে ৫৩৭ ও ৮২৩ কোটি টাকা দেওয়া সিদ্ধান্ত জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ ছাড়ে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ বিভাগে চিঠি দেয় বিএসএফআইসি। পরে ১৩ জুলাই টাকার অঙ্ক আরও বাড়িয়ে ছাড়করণে চিঠি দেওয়া হয়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, স্থানীয় অর্থনীতির বড় চালিকা শক্তি চিনিকলের মতো ভারী শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। চিনিকল বন্ধ কোনো সমাধান নয়, আধুনিকায়নের মধ্যদিয়ে একটি টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগুলো চালু করা উচিত।
বিএসএফআইসির যুগ্মসচিব এবং ইক্ষু উন্নয়ন ও গবেষণা কার্যালয়ের পরিচালক আবদুল আলীম খান স্ট্রিমকে বলেন, আমরা চালু জন্য চেষ্টা করেছি। এখন কী হচ্ছে, তা শিল্প মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।