কৃষি মানে আগের দিনের মতো শুধু চিরাচরিত ফসল উৎপাদন নয়। সাহস, জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে কৃষিতে যে পরিবর্তন সম্ভব, তারই উদাহরণ মানিকগঞ্জের ড্রাগন ফলচাষী নূর মোহাম্মদ।
সম্প্রতি কৃষ্ণপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের সূর্যের আলো পড়ছে সবুজ লতায় ঘেরা বাগানে, এক অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে। স্বপ্ন দেখলেই সব সময় তা বাস্তবে রূপ নেয় না, কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন নূর মোহাম্মদ। মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের রাজিবপুর এলাকার এই কৃষক ২০২০ সালে প্রচলিত চাষের ধারা ভেঙে প্রতিকূলতার মধ্যেও ড্রাগন ফলের আবাদ শুরু করেন।
শুরুর দিকে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে তিনি একশত শতাংশ জমিতে বাগান গড়ে তোলেন। বাগানে সারি সারি লতায় ঝুলছে কাঁচা–পাকা অসংখ্য ড্রাগন ফল। শুরুতে এলাকার মানুষ তাঁকে ‘পাগল’ বললেও এখন তিনি একাধিক ড্রাগন বাগানের মালিক। বাজারের ড্রাগনের তুলনায় তাঁর ফল বেশি মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদাও অনেক।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘বাগান শুরুতে পরিবার ও প্রতিবেশীরা উপহাস করত। কেউ মূলধন দেয়নি। ব্যাংক ও আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার নিয়ে শুরু করি। প্রথম মৌসুমেই মূলধন উঠে আসে। তখন সবাই প্রশংসা করতে শুরু করে।’
ফুল এসেছে ড্রাগনে। স্ট্রিম ছবিতিনি আরও জানান, বাগানে কেবল জৈব সার ব্যবহার করেন, রাসায়নিক সার নয়। প্রতি বছর খরচ বাদে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আয় হয় তাঁর। চলতি মৌসুমে বৃষ্টি কিছুটা ক্ষতি করলেও ২০ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হবে বলে আশা করছেন। তিন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে চারটি ড্রাগন বাগান করেছেন তিনি, যেন তাঁদের চাকরির পেছনে দৌড়াতে না হয়।
ঢাকা জেলার ধামরাই থেকে আসা ক্রেতা সুমন মাহমুদ বলেন, ‘ফেসবুকে পোস্ট দেখে বাগানে এসেছি। বাজারের চেয়ে দাম বেশি, কিন্তু বিষমুক্ত ও খুব মিষ্টি। কয়েকটা ফল বাগানেই খেয়েছি, দারুণ স্বাদ।’
সদর উপজেলার বারাহিচর এলাকার আফজাল হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন যাতায়াতের পথে এই বাগান দেখি। মাঝেমধ্যে ফল কিনি। বাজারের চেয়ে দাম একটু বেশি, কিন্তু স্বাদ ও ঘ্রাণ অনেক ভালো।’
কৃষি বিভাগের উপসহকারী ব্লক সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নূর মোহাম্মদ বাগানে কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফল হওয়ায় এগুলো মিষ্টি ও সুস্বাদু। ২০২০ সালে বাগানের যাত্রা শুরু হয়, ২০২২ সাল থেকে বাজারজাত শুরু। শুরু থেকেই কৃষি বিভাগ পরামর্শ ও সহায়তা দিচ্ছে।’
ড্রাগন থেকে খরচ বাদে বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আয় হয় নূর মোহাম্মদের। স্ট্রিম ছবিমানিকগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মাসুম ভূঁইয়া বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ ও কৃষি অফিস উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছে। ড্রাগন বাগানের জন্য খামারবাড়িতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নূর মোহাম্মদের মতো উদ্যমীরা রাসায়নিক সার ছাড়াই বিষমুক্ত ফল উৎপাদন করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন।’
নূর মোহাম্মদের এই সাফল্য শুধু তাঁর ভাগ্যই বদলায়নি, আশপাশের অনেক বেকার যুবককেও নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় দেশি–বিদেশি ফলের বাগান গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আগামী দিনের অর্থনীতিকে বদলে দেবে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা—এমনটাই বিশ্বাস স্থানীয়দের।