leadT1ad

ডাকসুর উচ্ছেদ অভিযান, এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৩৯
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উচ্ছেদ অভিযান চলাকালীন একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলমান উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এই অভিযানের নেতৃত্বে থাকলেও তাদের এখতিয়ার বা ক্ষমতা এবং অভিযানের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

কী ঘটেছে

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন এলাকা এবং মেট্রোরেল স্টেশনের নিচের অংশে ভাসমান দোকান, হকার ও ‘ভবঘুরেদের’ উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এবি জুবায়ের এবং সদস্য সর্বমিত্র চাকমার নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালিত হতে দেখা গেছে।

অভিযান পরিচালনার সময় কিছু ক্ষেত্রে দোকান ভাঙচুর ও দোকানিদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, উচ্ছেদের সময় দোকানিরা তাঁদের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাননি। তা ছাড়া তাঁদের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করা হয়েছে। এ সময় শারীরিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন কয়েকজন দোকানি। তাঁদের অভিযোগ, অভিযানের পূর্বে তাঁদের কোনো নোটিস দেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে ডাকসু নেতারা দাবি করেন, অভিযানকালে কয়েকজনের কাছ থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে।

কয়েকটি উচ্ছেদ কার্যক্রমে ডাকসুর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষও অংশ নিয়েছে। তবে এর বাইরে শুধু ডাকসু নেতাদেরও উচ্ছেদ কাজে অংশ নিতে দেখা গেছে।

শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ

টিএসসি মেট্রো স্টেশনের কাছেই একটি ভাজাপোড়ার দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন তানভীর হোসেন (২৬)। তিনি জানান, ১৫ বছর ধরে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকানে কাজ করছেন। গত ১৫ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উচ্ছেদ অভিযানে তাঁর নিজের দোকান ভেঙে যাওয়ার পর থেকে তিনি অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন।

ডাকসু ও প্রক্টরিয়াল টিমের অভিযানে তাঁর দোকানের গাড়ি ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ তানভীরের। সেইসঙ্গে তাঁকে শিক্ষার্থী ও প্রক্টরিয়াল টিমের লোকেরা মারধর করে বলেও জানান। এতে তাঁর কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নেন তিনি।

গত শনিবার রাতের অভিযানের সময় মারধোরের অভিযোগ করেন মোমো বিক্রেতা মো. মহীনুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমার এই দোকান ছাড়া কোনো সহায়-সম্বল নেই। তাঁরা যখন আসছিলেন, আমরা অনেকে সরে যাচ্ছিলাম। তারপরও আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়েছে। আমি দোকান নিয়ে সরে যাচ্ছিলাম, তবুও আমার দোকানটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এত দিন ব্যবসা করেছি, কখনো কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করিনি। অথচ তাঁরা আমাদের গায়ে হাত তুললেন, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন, এমনকি নারী ফুল বিক্রেতা ও পথশিশুদেরও ছাড় দেননি।’

ডাকসু ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য

ডাকসু নেতাদের মতে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে অবস্থানরত অনেক হকার ও ভবঘুরে মাদক ব্যবসা এবং ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এবি জুবায়ের স্ট্রিমকে বলেন, ‘ডাকসুর কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষা করা। আমাদের শিক্ষার্থীদের অন্যতম একটা অধিকার হচ্ছে, আমরা সেইফ ক্যাম্পাস ডিজার্ভ করি। ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের অবৈধ স্থাপনা থাকবে না, মাদক থাকবে না। তো সেইটা এনশিওর করার জন্য ডাকসু কাজ করতেই পারে। এটা ডাকসুর এখতিয়ার।’

শিক্ষার্থীরা দোকানিদের গায়ে হাত তুলেছে, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন জুবায়ের। সেইসঙ্গে বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের আগে দোকানিদের বারবার সতর্ক করা হয়েছিল।

ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এস এম ফরহাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ক্যাম্পাসের অংশীজন হলেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী; কোনো মাদক ব্যবসায়ী বা অনিবন্ধিত দোকানদার নয়।

তিনি আরও বলেন, ‘হয় ডাকসু থাকবে, নতুবা অবৈধ ব্যবসা-মাদক সিন্ডিকেট থাকবে; দুটো একসাথে চলতে দেব না।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এই অভিযানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে তাঁরা প্রস্তুত।

কারা প্রতিবাদ করছে এবং কেন

এই উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে ক্যাম্পাসে সক্রিয় কয়েকটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এবং উচ্ছেদের শিকার হওয়া হকাররা। শনিবার রাতে অভিযানের পরপরই হকাররা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কোনো ধরনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ উচ্ছেদ করায় তাঁরা অসহায় অবস্থায় পড়েছেন।

ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা এক ফেসবুক পোস্টে এ ধরনের কার্যক্রমকে গুণ্ডামি আখ্যা দিয়ে লেখেন, ‘ডাকসুর গঠনতন্ত্রটা তো কোথাও দেখি না। কেউ শেয়ার করবেন, দেখি কোথায় লেখা আছে যে ডাকসুর নামে গুণ্ডামি জায়েজ!’

গত মঙ্গলবার গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, ২৫ অক্টোবর থেকে ডাকসুর উদ্যোগে চালানো অভিযানে হকারদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, দোকান ভাঙচুর, মালামাল জব্দ ও নারী হকারদের লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে, যা ডাকসু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ারবহির্ভূত এবং ফৌজদারি অপরাধের শামিল।

এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন

এই উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হলো—ডাকসুর এ ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার এখতিয়ার আছে কি না। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এর মূল কাজ হলো শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রম আয়োজন করা এবং সিনেটে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করা। গঠনতন্ত্রে সরাসরি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার মতো প্রশাসনিক ক্ষমতা ডাকসুকে দেওয়া হয়নি।

এবি জুবায়ের বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার খাতিরে ডাকসু এমন পদক্ষেপ নিতে পারে।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান স্ট্রিমকে জানাচ্ছেন, স্ব-উদ্যোগী হয়ে এমন অভিযানে এককভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার এখতিয়ার ডাকসুর নেই।

তিনি বলেন, ‘তারা কনসার্ন জানাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। চাপ দিতে পারে, যদি তাদের কাছে যৌক্তিক কিছু মনে হয় যে এই জায়গাগুলোতে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বা অবৈধ স্থাপনার কারণে পরিবেশ বা কোনো নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে। কিংবা, মাদক বা অন্যান্য বিষয়ে তারা কনসার্ন জানাতে পারে।’

তবে প্রক্টরিয়াল বডি ও সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে বলে জানান শিহাব উদ্দিন। তবে সেক্ষেত্রেও দোকানিদের যথাযথ সময় দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত দেন তিনি।

শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘তাদেরকে একটা রিজনেবল নোটিস দিয়ে বিদায় দিতে হয়। কারণ, ওইটা দিয়ে হয়তো বা তাঁর জীবন চলছে বা সংসার চলছে। তো এটাকে আমরা বলি ন্যাচারাল জাস্টিস।’

সেইসঙ্গে উচ্ছেদ অভিযানকালে কাউকে মারধর করার সুযোগ নেই বলেও তিনি জানান।

সমাধান কী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক স্ট্রিমকে বলেন, লোক দেখানো বা বাহবা পাওয়ার জন্য যাতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা না হয়। এতে অভিযান টেকসই হবে না।

তৌহিদুল হকের মতে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই অভিযানের বিষয়ে প্রশাসনের দৃঢ় অবস্থানে থাকাটা বেশ কঠিন। তিনি বরং একে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন।

তৌহিদুল হক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় যদি তার ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, সেক্ষেত্রে এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারে। অর্থাৎ কে কে দোকান করতে পারবে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার অনুমতি দেওয়া, ক্যাম্পাসের যাতে ভাবমূর্তি অথবা নিরাপত্তার জায়গাতে কোনো ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়, এই প্রসঙ্গটা চিন্তা করে পরিচালনা করলে আমার কাছে মনে হয় যে এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা যাবে।’

তবে এই কাজ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ মানবিকতা দেখাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। কাউকে মারধর বা কারো ব্যবসার উপকরণ ভেঙে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিকতার মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মত তাঁর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যকে অনেকে স্বাগত জানালেও, সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একটি নির্বাচিত ছাত্র সংসদের সরাসরি প্রশাসনিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এবং বলপ্রয়োগের অভিযোগ তাদের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করেছে, যা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত