leadT1ad

বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস আড়ৎ

নিষেধাজ্ঞা শেষেই ডিমওয়ালা ও নরম ইলিশে যেভাবে সয়লাব বাজার

ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পরদিন বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে আসে ৩০০ মণ ইলিশ। অবরোধ উঠে যাওয়ার প্রথম রাতেই এত পরিমাণ ইলিশ কোথা এলো, তা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে। এক আড়তদার বলছেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর্যন্ত যত মাছ বাজারে পাবেন, তা আরও আগের ধরা।

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
বরিশাল

বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে ডিমওয়ালা ও নরম ইলিশ। স্ট্রিম ছবি

প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় এবং বিপণনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয় গত শনিবার (২৫ অক্টোবর) মধ্যরাতে। তবে এর পরদিন সকালেই ৩০০ মণ ইলিশ আসে বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে। সোমবার এই পরিমাণ ছিল ২০০ মণের কাছাকাছি। অথচ গতকাল বৃহস্পতিবার এই আড়তে আসে ৮০-৯০ মণ ইলিশ।

নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরপরই এত ইলিশ কোথা এলো, তা নিয়ে সপ্তাহজুড়েই ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে চলছে আলোচনা। অভিযোগ উঠেছে, এই ইলিশের পুরোটাই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ধরা। এজন্য অধিকাংশ মাছের পেটেই রয়েছে ডিম। আর সরকারি ধড়পাকড় এড়াতে দীর্ঘদিন ফ্রিজিং করে রাখায় মাছগুলো নরম হয়ে গেছে।

বিষয়টি নিয়ে ওই আড়তেরই এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে স্ট্রিম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই আড়তদার বলেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর্যন্ত যত মাছ বাজারে পাবেন, তা আরও আগে ধরা। প্রশাসনের দুর্বলতায় হোক অথবা জেলেদের দোষে হোক এবার নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিতে চালানো অভিযানে সুবিধা করতে পারেনি প্রশাসন। এজন্য নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রচুর ইলিশ ধরা হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ইলিশ কেনার প্রস্তাব পান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ ও ভোলার চরফ্যাশন থেকে অবরোধের মধ্যেই ইলিশের চালানের প্রস্তাব দিয়েছিল। আমার মতো অনেক আড়তদারের কাছেই এমন প্রস্তাব এসেছে। আমি না করে দিয়েছি। ফ্রিজের মধ্যে রাখা নিজের জন্য ডিসক্রেডিট।’

তাঁর এই কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে ইলিশ কিনতে আসা রফিকুল ইসলামের বক্তব্যে। গত রোববার তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম টাটকা মাছ পাব। এসে দেখি বাজারের সব দোকানে খুবই নরম ইলিশ। অনেক মাছের চোখ লাল হয়ে কোটরে ঢুকে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় মাছগুলো আগে ধরা।’

বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে ইলিশ মাছ । স্ট্রিম ছবি
বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে ইলিশ মাছ । স্ট্রিম ছবি

ডিমওয়ালা ইলিশে সয়লাব বাজার

বৃহস্পতিবার বিকেলে ছোট ঝুড়িতে ৬টি ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের ডাকছিলেন রাজু। পোর্ট রোডের ভ্রাম্যমাণ এ মাছ বিক্রেতা স্ট্রিমকে বলেন, তাঁর ঝুড়িতে থাকা ‘ছয়টি মাছের মধ্যে চারটিতে ডিম আছে। ডিমওয়ালা মাছের স্বাদ কিছুটা কম। তবে শিশুদের ডিম খাওয়াতে মা-বাবারা বেশি দামে এই মাছ কেনে।’

আরেক বিক্রেতা রুবেল বলেন, ‘এখন ডিমওয়ালা মাছ কিছুটা কমেছে। নিষেধাজ্ঞা শেষের দুই দিন যে মাছগুলো এসেছে, তার প্রায় প্রতিটিতে ডিম ছিল। তবে আকারে এগুলো খুব বেশি বড় নয়।’

জেলা মৎস্য অফিস বলছে, চলতি বছরের জুলাই–সেপ্টেম্বর, এই তিন মাসে বরিশাল বিভাগে আহরিত হয়েছে ৭৯ হাজার ৩১০ টন ইলিশ। ২০২৪ সালে একই সময়ে পাওয়া ইলিশের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৬৪৭ টন। এ ছাড়া ২০২৩ সালে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৯৭ টন এবং ২০২২ সালে ১ লাখ ৫ হাজার ৫১৫ টন ইলিশ ধরা পড়েছিল।

পোর্ট রোড বাজারের একাধিক বিক্রেতা জানান, বাজারে ইলিশের সরবরাহের তারতম্যের কারণে দাম ওঠা-নামা করে। তারপরও গতকাল বৃহস্পতিবার এক কেজি ওজনের প্রতি মণ ইলিশ ৯০ হাজার টাকা, ৯০০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ৮০ হাজার, মাঝারি আকারের ইলিশ ৬০ হাজার এবং ছোট আকারের ইলিশ ৩২ হাজার টাকা মণে বিক্রি হয়।

সমুদ্রে ধরা ইলিশ এখনো বাজারে আসেনি জানিয়ে বরিশাল মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামাল শিকদার বলেন, ‘ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও সমুদ্র থেকে মাছ নিয়ে এখনো কূলে ফিরতে পারেননি জেলেরা। এ জন্য বাজারে ইলিশের দাম চড়া। এখন বাজারে যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো নদীর। নদীতে তো আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না। সাগরের জেলেরা ফিরলে চাহিদা পূরণ হবে।’

বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে ইলিশ মাছের সমাহার। স্ট্রিম ছবি
বরিশাল পোর্ট রোড পাইকারি মৎস্য আড়তে ইলিশ মাছের সমাহার। স্ট্রিম ছবি

নিষেধাজ্ঞা রক্ষা অভিযানেই হামলা

চলতি বছর ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে বিশেষ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ঘোষণা অনুযায়ী, এই সময় ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুত নিষিদ্ধ। ২৯ সেপ্টেম্বর নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়ে অভিযানকারী দল। মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরো বিভাগে দেড় থেকে দুই শতাধিক স্থানে বাধার মুখে পড়ে অভিযানিক দল। এমনকি অর্ধশতাধিক স্থানে হামলার শিকারও হয়েছেন তাঁরা। সবমিলিয়ে আহতের সংখ্যা আড়াই’শর কাছাকাছি।

এর মধ্যে ১৯ অক্টোবর হিজলার মেঘনা নদীতে হামলায় অভিযানকারী দলের ১৫ জন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আট রাউন্ড গুলি ছুড়তে হয়। এমনকি ইলিশ ধরতে যাওয়া পক্ষের মধ্যেও একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত ১৩ অক্টোবর বাবুগঞ্জ উপজেলার সুগন্ধা নদীতে ইলিশ ধরাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। একই গ্রামে মৌসুমি জেলেদের মধ্যে ওই সংঘর্ষে অন্তত চারজন আহত হন।

মৎস অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ১ হাজার ৬৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ৮৯৩ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া ৩ হাজার ৫৩১টি অভিযানে জব্দ করা হয় ৮ হাজার ৮৩৫ কেজি ইলিশ মাছ এবং ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৯৯ মিটার অবৈধ জাল। নিয়মিত মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৩টি।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাজেদুল হক বলেন, ‘এবারে নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের সঙ্গে আভিযানিক দলের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিল উদ্বেগজনক। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জেলেদের প্রণোদনা বাড়াতে হবে। জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যে, মা ইলিশ রক্ষা হলে ইলিশের উৎপাদন বাড়বে, তখন তারা বেশি পরিমাণে ইলিশ শিকার করতে পারবে।’

নিষেধাজ্ঞাকালে সরকারি সহায়তা ঠিকমতো বণ্টন না হওয়ায় জেলেরা ইলিশ ধরতে বাধ্য হয় বলে মন্তব্য করেছেন বরিশালের সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক আখতারুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘সরকারি সহায়তা সঠিক সময়ে জেলেদের কাছে না পৌঁছানো এবং সঠিক বণ্টন না হওয়ায় নিষেধাজ্ঞার সময়েও অনেক জেলে বাধ্য হয়ে নদীতে নামেন। তবে অনেক স্থানে মৌসুমি জেলেরা ইলিশ শিকারে নামেন। আমি মনে করি, আর্থিক নিরাপত্তা ও প্রেরণা দুটোই যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি আর তৈরি হবে না।’

নিষেধাজ্ঞা রক্ষায় অভিযান প্রসঙ্গে বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা চলাকালে আমাদের চেষ্টা ছিল জেলে এবং আভিযানিক দলের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অভিযান সফল করতে। যদিও শুরুতে কিছু অসাধু জেলেদের আক্রমণের শিকার হই আমরা। তারপর পর্যায়ক্রমে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।’

এই জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি মনে করি, এবার সফলভাবে অভিযান সম্পন্ন করতে পেরেছি। জেলেরা সাগর থেকে ফিরলে বাজারে ইলিশের চাহিদা পূরণ হবে।’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত