leadT1ad

বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হোক বাংলাদেশে আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে: মাহমুদুর রহমান

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪১
বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হোক বাংলাদেশে আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে: মাহমুদুর রহমান। স্ট্রিম গ্রাফিক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, এই বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হোক বাংলাদেশে আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে। গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এ দ্বিতীয় দিনের মতো দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি এ কথা বলেন। গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জবানবন্দিতে প্রসিকিউশনের ৪৬তম সাক্ষী তিনি।

পরে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন তাঁকে জেরা করেন। গতকাল সোমবার তিনি প্রথম দিনের মতো জবানবন্দি দেন।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলের অন্যায়, অবিচার ও অনিয়মের ঘটনায় ন্যায়বিচার করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকারগুলো সতর্ক হবে উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেভাবে ‘নেভার অ্যাগেইন’ বলা হয়েছিল—বাংলাদেশেও এই বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হোক যেন গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি আর না হয়।

তিনি বলেন, হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার মহান জুলাই বিপ্লবের সময় যে গণহত্যা চালিয়েছে এবং যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সে সম্পর্কে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণহত্যা চালাতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল প্রতি রাতে তাঁর বাড়িতে কোর কমিটির সভা করতেন। সেখানে পুলিশ, র‍্যাব এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ থাকতেন। সেই সভায় তাঁরা বিক্ষোভকারী এবং আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্রদের ওপরে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের উপায় নিয়ে আলোচনা করতেন।

আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আরব রেভ্যুলুশনের সময় মিসর এবং তিউনিশিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন দেখেছি। বাংলাদেশেও ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইটালি এবং জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি এবং হিটলারের পতন হয়েছিল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর।

তিনি জানান, সেই সভায় তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর বরাতে জানিয়েছেন যেন আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে মিডিয়াতে ঘোষণা করেছিলেন, আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের হত্যা করে লাশ গুমের নির্দেশ দিয়েছেন।

জাতিসংঘের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে উল্লেখ করে জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান বলেন, এ কারণে তাদের প্রত্যেকের ওপর কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় পড়ে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর যে হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট প্রকাশ করে, সেগুলোতেও হাসিনার শাসন আমলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে যে তিনটি ভুয়া নির্বাচন হয়েছিল, সে সম্পর্কেও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংসদেও উক্ত ৩টি নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।

‘আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মধ্যে আল-জাজিরা “অল দ্যা প্রাইম মিনির্স্টার্স মেন” শিরোনামে প্রচারিত প্রতিবেদন সারাবিশ্বে সাড়া ফেলেছিল, সেখানে হাসিনা, তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা এবং সামরিক উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকীর দুর্নীতি এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা রয়েছে।’

সাক্ষী জানান, পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি, কোনো ফ্যাসিস্ট রেজিম কিংবা অটোক্রেটিক রেজিম গণতান্ত্রিক উপায়ে অপসারিত করা যায়নি।

আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আরব রেভ্যুলুশনের সময় মিসর এবং তিউনিশিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন দেখেছি। বাংলাদেশেও ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইটালি এবং জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি এবং হিটলারের পতন হয়েছিল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর। জার্মানিতে সেই সময় জনগণ, বিশেষ করে ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপরে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বে আওয়াজ উঠেছিলো 'নেভার অ্যাগেইন'। অর্থাৎ, আর যেন কখনো হিটলারের মতো নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট শাসকের আগমন না ঘটে।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর যে হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট প্রকাশ করে, সেগুলোতেও হাসিনার শাসন আমলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে যে তিনটি ভুয়া নির্বাচন হয়েছিল, সে সম্পর্কেও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

মাহমুদুর রহমান জানান, কয়েকদিন আগে জুলাই বিপ্লবের শহীদ ফাইয়াজের পিতা আমাকে ফোন করেছিলেন। একদিন পরে তাঁর ছেলের ১৮ বছর হওয়ার কথা ছিল। ফাইয়াজ ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রিকশা করে বাড়িতে ফিরছিল। সেই রিকশার মধ্যেই ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছিল। শহীদ ফাইয়াজের পিতা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর শহীদ ছেলের জন্মদিনে আমি যেন আমার দেশ পত্রিকায় একটা সংবাদ ছাপাই। ‘আমি সেই পিতার অনুরোধ রক্ষা করেছি। শহীদ ফাইয়াজের পিতার মতো এমন অন্তত ১৪০০ শহীদের পিতা এবং মাতা সন্তানের শোক নিয়ে বেঁচে আছেন। এই শহীদ পরিবারগুলো একটি ন্যায়বিচার দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। এর সঙ্গে আরো যে অন্তত ২০ হাজার আহত জুলাইযোদ্ধা চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, তারাও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কমান্ড রেসপনসিবিলিটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বিচার দেখতে চান।’

ট্রাইব্যুনালে মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, এই আসামিদের মধ্যে যাঁরা সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যাঁরা উক্ত হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি, তাঁরা সকলেই কমান্ড রেসপনসিবিলিটির আওতাভুক্ত। আমি বিগত ১৬ বছর ধরে এই ফ্যাসিবাদের উত্থান, বিকাশ এবং পতন দেখেছি। এই বিষয়ে অনবরত লেখালেখি করেছি এবং বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়ে জনগণকে অবহিত করার চেষ্টা করেছি। জুলাই গণহত্যার পর যখন এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়েছে, আমি মনে করেছি—রাষ্ট্রের একজন বর্ষীয়ান নাগরিক হিসেবে আমার কর্তব্য ট্রাইব্যুনালকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। এর অংশ হিসেবে আমি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিচ্ছি। আমি চাই অপরাধীরা যেন সাজা পায়, শহীদ পরিবার, আহত জুলাইযোদ্ধা এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তাঁদের পরিবারের শোক কিছুটা হলেও যেন লাঘব হয়।

জেরায় মাহমুদুর রহমান বলেন, এটা সত্য নয় যে, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা শহরে বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং গাছ কেটে ধ্বংস করেছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী মত দেন, ওই দিন সরকার জনগণের জানমাল রক্ষার্থে শান্তিপূর্ণ উপায়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিয়েছে। এবং শাপলা চত্ত্বরে কোনো গণহত্যা হয়নি। সাক্ষী জবাব দেন, সত্য নয়।

পরে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় শুনানি আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত