leadT1ad

প্রকাশ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যৌন কেলেঙ্কারির নথি

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

এপস্টেইন একবার দাবি করেন, তার কাছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য তথ্য আছে এবং তিনি চাইলে ‘তাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন।’ ছবি: সংগৃহীত।

রাজনৈতিক চাপে নতি স্বীকার করে জেফ্রি এপস্টেইন সংশ্লিষ্ট সব নথি প্রকাশের নির্দেশনা দেওয়া একটি বিলে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিলটির নাম ‘এপস্টেইন ফাইলস ট্রান্সপারেন্সি অ্যাক্ট’। এই আইনে বলা হয়েছে, মার্কিন বিচার বিভাগকে দোষী সাব্যস্ত যৌন অপরাধী জেফ্রি এপস্টেইন মামলার তদন্ত সংক্রান্ত সব তথ্য ৩০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। কয়েক মাস ধরে কংগ্রেসে বিতর্ক, রাজনৈতিক চাপ এবং রিপাবলিকান দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের পর এই সিদ্ধান্ত আসে।

ট্রাম্প কয়েক মাস ধরে এই নথি প্রকাশের বিরোধিতা করছিলেন। কিন্তু এপস্টেইনের ভুক্তভোগী নারীরা এবং রিপাবলিকান দলের কিছু সদস্যের চাপের মুখে তিনি গত সপ্তাহে অবস্থান পরিবর্তন করেন। তবে সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় তিনি অভিযোগ তোলেন যে ডেমোক্র্যাটরা এই ইস্যুকে ব্যবহার করছে তাঁর প্রশাসনের সাফল্যগুলো আড়াল করার জন্য।

এসব নথি প্রকাশের ফলে বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত যৌন পাচার কেলেঙ্কারির অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আইন অনুযায়ী সব নথি ডিজিটাল, অনুসন্ধানযোগ্য ফরম্যাটে প্রকাশ করতে হবে। তবে ভুক্তভোগীর পরিচয় রক্ষার জন্য কিছু তথ্য গোপন করা যাবে। ট্রাম্প দাবি করেন, এই নথি প্রকাশ ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে আঘাত হানবে। কিন্তু সমালোচকেরা মনে করেন, এই নথিতে উভয় দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামই উঠে আসতে পারে। এতে এপস্টেইনের নেটওয়ার্ক নিয়ে বৈশ্বিক নজরদারি আবারও তীব্র হতে পারে।

ওয়াশিংটনকে অবাক করে দিয়ে ট্রাম্প তাঁর দীর্ঘস্থায়ী আপত্তি তুলে নেন। এর ফলে বিলটি বিরলভাবে দ্বিদলীয় সমর্থন লাভ করে কংগ্রেসে পাস হয়। মঙ্গলবার প্রতিনিধি পরিষদে ৪২৭–১ ভোটে বিল অনুমোদিত হয়। পরে সিনেট সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস করে।

এখন বিচার বিভাগকে এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব নথি, যোগাযোগ ও ২০১৯ সালে ফেডারেল কারাগারে তার মৃত্যুর তদন্ত–সংক্রান্ত তথ্য ৩০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। ভুক্তভোগীদের রক্ষা বা চলমান তদন্তের প্রয়োজনে কিছু অংশ কালো করা যেতে পারে। তবে ‘লজ্জা, সুনামহানি বা রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা’— এই কারণ দেখিয়ে কোনো তথ্য গোপন করা যাবে না।

এর আগে গত সপ্তাহে এপস্টেইনের এস্টেট থেকে প্রায় ২০ হাজার পৃষ্ঠার নথি প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাম্পকে সরাসরি উল্লেখ করা অংশও আছে। প্রকাশিত বার্তাগুলোতে ২০১৮ সালে এপস্টেইন লিখেছিলেন— ‘আমি-ই একমাত্র মানুষ যে তাকে ধ্বংস করতে পার এবং আমি জানি ডোনাল্ড কতটা নোংরা।’

জেফ্রি এপস্টেইন ও তার যৌন কেলেঙ্কারি

জেফ্রি এপস্টেইন ছিলেন একজন ধনী মার্কিন ব্যবসায়ী ও দোষী সাব্যস্ত যৌন অপরাধী। ২০১৯ সালে নাবালিকাদের যৌন পাচারের অভিযোগে বিচারাধীন অবস্থায় তিনি ফেডারেল কারাগারে মারা যান। তার মামলাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় যৌন কেলেঙ্কারি’ বলা হয়। কারণ এতে রাজনীতি, ব্যবসা ও বিনোদন অঙ্গনের বহু পরিচিত ব্যক্তির নাম জড়িত ছিল। এপস্টেইনের ব্যক্তিগত দ্বীপ এবং অন্যান্য সম্পত্তিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের যৌন শোষণের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তার সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং আরও বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগাযোগ ছিল। তাদের অনেকেই এপস্টেইনের ব্যক্তিগত বিমান ‘লোলিটা এক্সপ্রেস’–এ ভ্রমণ করেছিলেন।

২০২১ সালে এপস্টেইনের সহযোগী গিসলেইন ম্যাক্সওয়েল নাবালিকাদের যৌন পাচারে দোষী সাব্যস্ত হন। আগের বছরগুলোতে যে ফ্লাইট লগ ও সাক্ষ্যের নথি প্রকাশ পেয়েছিল, তা সত্ত্বেও বিচার বিভাগের বহু নথি গোপন ছিল। রয়টার্স উল্লেখ করেছে যে এপস্টেইনের নেটওয়ার্কে ‘শক্তিশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা’ ছিল। পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ না হওয়ায় নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও স্বচ্ছতার দাবি আরও জোরালো হয়।

ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসন ২০১৯ সালে এপস্টেইনকে অভিযুক্ত করেছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের সময় কোনো উল্লেখযোগ্য নথি প্রকাশ হয়নি। এতে উভয় দলের মধ্যেই অসন্তোষ তৈরি হয়। এই কেলেঙ্কারি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনার জন্ম দেয়, কারণ অভিযোগ অনুযায়ী এতে একাধিক দেশের ভুক্তভোগী জড়িত ছিলেন।

কী আছে এপস্টেইন ফাইলস ট্রান্সপারেন্সি অ্যাক্ট বিলে

২০২৫ সালের শুরুর দিকে কংগ্রেসে বিলটি উত্থাপন করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল বিচার বিভাগকে এপস্টেইন–সম্পর্কিত তদন্ত, মামলা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নথি—যেগুলো সংবেদনশীল নয়—ডিক্লাসিফাই করে প্রকাশ করতে বাধ্য করা। গত মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর ২০২৫) প্রতিনিধি পরিষদে বিলটি পাস হয়। পরদিন সিনেট সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন দেয়। এরপর এটি দ্রুত ট্রাম্পের টেবিলে পৌঁছে।

আইনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হলো—

নথি স্বাক্ষরের ৩০ দিনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে (২০ ডিসেম্বর ২০২৫–এর মধ্যে)।

সব নথি ডিজিটাল ও অনুসন্ধানযোগ্য আকারে অনলাইনে প্রকাশ করতে হবে।

শুধু ভুক্তভোগীর পরিচয়, চলমান তদন্ত বা জাতীয় নিরাপত্তার কারণে কিছু অংশ গোপন করা যাবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি নথি প্রকাশ প্রক্রিয়ার তদারকি করবেন। বন্ডি বলেছেন, বিচার বিভাগ আইন মেনে চলবে, তবে ভুক্তভোগীদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

শুরুর দিকে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আইনপ্রণেতা এই বিল আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, নথি প্রকাশ রাজনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। পলিটিকো এটিকে ‘কয়েক মাসের তীব্র রিপাবলিকান দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত ফল’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। কয়েকজন রিপাবলিকান শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিলটির পক্ষে ভোট দেন। সব চাপের পর ট্রাম্প বিলটিতে স্বাক্ষর করেন এবং জানান এটি কংগ্রেস ও জনগণের দাবির প্রতিফলন।

১৯৯৭ সালে মার-এ-লাগোতে জেফ্রি এপস্টেইনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প।
১৯৯৭ সালে মার-এ-লাগোতে জেফ্রি এপস্টেইনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্পের স্বাক্ষর ও প্রকাশ্য বক্তব্য

বুধবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল–এ এক বার্তায় জানান যে তিনি বিলটিতে স্বাক্ষর করেছেন। কোনো আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়নি। দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, জেফ্রি এপস্টেইন আজীবন ডেমোক্র্যাট সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘জেফ্রি এপস্টেইন আজীবন ডেমোক্র্যাট ছিলেন। তিনি ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদদের হাজার হাজার ডলার দান করেছিলেন। তিনি বিল ক্লিনটন (যিনি তার বিমানে ২৬ বার ভ্রমণ করেছেন), ল্যারি সামার্স, রেইড হফম্যান, সংখ্যালঘু নেতা হাকিম জেফ্রিজ, ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসউইম্যান স্টেসি প্লাস্কেটসহ আরও বহু পরিচিত ডেমোক্র্যাট ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন।’

ট্রাম্প দাবি করেন, এপস্টেইন–সম্পর্কিত বিষয় ‘ডেমোক্র্যাটদের জন্য রিপাবলিকানদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর।’ তিনি অভিযোগ করেন, তার প্রশাসনের সাফল্য ঢেকে দিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এই ইস্যুকে ব্যবহার করছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে তার প্রথম প্রশাসনই ২০১৯ সালে এপস্টেইনকে অভিযুক্ত করেছিল। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ ইতোমধ্যে কংগ্রেসকে প্রায় ৫০ হাজার পৃষ্ঠার নথি দিয়েছে। তবে সমালোচকেরা, সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডির ‘ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার’ ওপর জোর দেওয়ায় বাছাই করা নথি প্রকাশ হতে পারে।

নথি থেকে কী প্রত্যাশা করা হচ্ছে

বিচার বিভাগের এপস্টেইন ফাইলগুলোতে তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য, আর্থিক নথি এবং ২০০০ সালের শুরুর দিক থেকে বিভিন্ন তদন্ত–সম্পর্কিত যোগাযোগ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। পূর্বে প্রকাশিত নথিগুলোতে ফ্লোরিডায় এপস্টেইনের প্লি ডিল এবং ম্যাক্সওয়েলের বিচারের তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু নতুন নথিগুলো আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র উন্মোচন করতে পারে—

প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা:

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সেলিব্রিটি—যারা এপস্টেইনের সঙ্গে উড়োজাহাজে ভ্রমণ করেছেন, দেখা করেছেন বা অর্থসাহায্য পেয়েছেন—তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য।

পাচার চক্রের কার্যক্রম:

কীভাবে মেয়েদের সংগ্রহ করা হতো, কোথায় নিয়ে যাওয়া হতো এবং এতে আন্তর্জাতিক সংযোগ কীভাবে কাজ করত—এসব বিষয়ে নতুন তথ্য।

সরকারের ভূমিকা:

২০০৮ সালে অত্যন্ত বিতর্কিত নন-প্রসিকিউশন এগ্রিমেন্ট কেন হয়েছিল এবং কোন তদন্তগুলো স্থগিত করা হয়েছিল—তার কারণ ব্যাখ্যা।

দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ‘৩০ দিনের কাউন্টডাউন’ শুরু হয়ে গেছে। তবে কিছু অংশ কালো করে দেওয়া হতে পারে, তাই সব তথ্য হয়তো বড় ধরনের চমক সৃষ্টি নাও করতে পারে। সিএনবিসি সতর্ক করেছে যে বিলটি প্রকাশের জন্য ‘টাইমার’ চালু করলেও, কোন নথি কতটা প্রকাশ করা হবে তা অনেকটাই বন্ডির বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে।

সম্ভাব্য প্রভাব ও পরিণতি

নথি প্রকাশের সম্ভাব্য প্রভাব বহুস্তরীয় হতে পারে—

রাজনৈতিক প্রভাব:

উভয় দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ট্রাম্প যদিও বিষয়টিকে ডেমোক্র্যাটদের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন, তবে এপস্টেইনের সঙ্গে তার পুরোনো সামাজিক সম্পর্কও আবার আলোচনায় আসতে পারে—যদিও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই।

আইনি পরিণতি:

নতুন প্রমাণ প্রকাশ পেলে মামলা পুনরায় চালু হতে পারে। ভুক্তভোগীরা নতুন করে বিচার দাবি করতে পারেন।

আন্তর্জাতিক প্রভাব:

ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অ্যান্ড্রুর মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব নতুন চাপের মুখে পড়তে পারেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কও প্রভাবিত হতে পারে।

জনগণের আস্থা:

পূর্ণ স্বচ্ছতা বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু যদি অতিরিক্ত কালো দাগ দেওয়া হয়, তাহলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আরও বেড়ে যেতে পারে।

আল জাজিরা জানিয়েছে, আইনটি ‘অশ্রেণিভুক্ত নথি প্রকাশ বাধ্যতামূলক করলেও’ ব্যতিক্রমের সুযোগ থাকায় এর প্রভাব সীমিত হতে পারে। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন যে যদি নথিতে ট্রাম্পপন্থী ব্যক্তিদের নাম উঠে আসে, তবে এটি ‘উল্টো ফল’ বয়ে আনতে পারে—একই সতর্কবার্তা ট্রাম্প নিজেও দিয়েছেন।

৩০ দিনের সময়সীমা শুরু হয়ে গেছে। এখন বিশ্বের অপেক্ষা—এই নথিগুলো কি পুরো এপস্টেইন নেটওয়ার্ক উন্মোচন করবে, নাকি আরও প্রশ্ন সৃষ্টি করবে।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, এপি, সিএনবিসি নিউজ

Ad 300x250

সম্পর্কিত