ভারতের জন্য খুব কম বন্ধুত্বই কৌশলগতভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একই সঙ্গে খুব কম সম্পর্কেই রাজনৈতিকভাবে এতো মাশুলও গুনতে হয়েছে, যতটা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে হয়েছে।
১৫ বছরের ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা দিল্লিকে তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি দিয়েছেন—স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক যোগাযোগের উন্নয়ন এবং ভারতের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে আগ্রহী এক প্রতিবেশী। ভারতও এসব বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর হাসিনা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
এই পরিস্থিতি এখন এক জটিল কূটনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করেছে। ঢাকা তাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু দিল্লি সে পথে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
যাকে ভারত মানবিক আশ্রয় হিসেবে ভেবেছিল, তা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক দীর্ঘ ও অস্বস্তিকর পরীক্ষায়। প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কতদূর পুরনো মিত্রের পাশে দাঁড়াবে এবং এর জন্য কতটুকু কূটনৈতিক মূলধন ব্যয় করতে প্রস্তুত।
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ভারতের সামনে চারটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিকল্প রয়েছে। প্রথমত, হাসিনাকে ফেরত দেওয়া—যা ভারত মোটেই করতে চায় না। দ্বিতীয়ত, বর্তমান অবস্থা বজায় রাখা—কিন্তু নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি দিল্লির জন্য ‘ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ’হয়ে উঠতে পারে।
তৃতীয়ত, হাসিনাকে নীরব থাকতে চাপ দেওয়া—তবে তিনি এখনও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে এটি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, আর দিল্লিও এমন চাপ প্রয়োগ করতে অনিচ্ছুক। চতুর্থ ও শেষ বিকল্প হলো তাকে কোনো তৃতীয় দেশে পাঠানো—কিন্তু গুরুতর আইনি জটিলতা ও নিরাপত্তা চাহিদা থাকা এক ‘ব্যয়বহুল অতিথিকে’ গ্রহণ করতে চাইবে এমন দেশ খুব কমই আছে।
হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করা ভারতের জন্য অকল্পনীয়। কারণ ক্ষমতাসীন দল হোক বা বিরোধী, সবাই তাকে ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করে। কুগেলম্যানের ভাষায়, ‘ভারত তার বন্ধুদের বিপক্ষে দাঁড়ায় না।’
এই মুহূর্তটি দিল্লির জন্য আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গভীরতা এবং তার অসামঞ্জস্যের কারণে। এই সম্পর্টক বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ভারতের ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। আর ভারত এখন বাংলাদেশের জন্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। গত বছর দুই দেশের মোট বাণিজ্য ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশ বড় ঘাটতিতে ছিল এবং ভারতীয় কাঁচামাল, জ্বালানি ও ট্রানজিট ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
গত এক দশকে ভারত ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত স্বল্পসুদে ঋণ দিয়েছে। পাশাপাশি শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, সীমান্তপার রেলসংযোগ এবং ভারতীয় গ্রিড ও বন্দর থেকে বিদ্যুৎ, তেল ও এলএনজি সরবরাহ করে আসছে। এই সম্পর্ক সহজে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ কারও নেই।
গণঅভ্যুত্থানের পর হাসিনার ম্যুরাল নষ্ট করে ছাত্র-জনতা। ছবি: সংগৃহীত।জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ পারস্পরিক নির্ভরতার জটিল সম্পর্কে আবদ্ধ। পানি, বিদ্যুৎসহ নানা ক্ষেত্রে একে অপরের ওপর নির্ভরতা গভীর। ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো কঠিন।’
তবু অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস এখন দ্রুত বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক পুনর্গঠনে মনোযোগী। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রকাশিত বিআন সাইয়ের গবেষণা-পত্রে বলা হয়েছে, তার প্রথম কয়েক মাসের পদক্ষেপ ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ভারত-নির্ভরতা থেকে সরিয়ে নেওয়ার’ সংকেত দিচ্ছে।
যে সরকার একসময় আঞ্চলিক সব মঞ্চে ভারতের পাশে দাঁড়াত, এখন তারা বিচারিক আদান-প্রদান বাতিল করছে, ভারতীয় জ্বালানি চুক্তি নতুন করে বিবেচনা করছে, ভারত-নেতৃত্বাধীন সংযোগ প্রকল্পগুলো মন্থর করছে এবং প্রকাশ্যে চীন, পাকিস্তান ও এমনকি তুরস্কের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করছে। অনেকের মতে, বার্তাটি স্পষ্ট—ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী বাংলাদেশ এখন দৃঢ়ভাবে ভারসাম্য বদলাচ্ছে।
জনমতেও অবনতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঢাকাভিত্তিক সেন্টার ফর অল্টারনেটিভস-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখেন। বিপরীতে দিল্লির ক্ষেত্রে তা মাত্র ১১ শতাংশ। গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর এ মনোভাব আরও তীব্র হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ভারতের সমর্থনেই শেষ কয়েক বছরে হাসিনা ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। ভারতের অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারের মনোভাব আছে বলেও সাধারণ মানুষের বিশ্বাস।
অধ্যাপক ভরদ্বাজ বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সাধারণত রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে থাকে। তথ্য-উপাত্তেও দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাণিজ্য বেড়েছিল, যদিও তখন ক্ষমতায় ছিল তুলনামূলকভাবে ‘কম বন্ধুত্বপূর্ণ’ বিএনপি-জামায়াত জোট।
তিনি বলেন, সরকার বদলালে কূটনৈতিক সম্পর্ক ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া-সম্পর্কিত যোগাযোগ সাধারণত স্থিতিশীলই থাকে। নতুন সরকার ভারতের প্রতি কম সদয় হলেও তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাণিজ্য বা বিস্তৃত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভেঙে দেয় না।
দিল্লির জন্য এখনকার চ্যালেঞ্জ শুধু নির্বাসনে থাকা এক পুরনো মিত্রকে সামলানো নয়। বরং তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এমন এক প্রতিবেশীকে ধরে রাখা, যা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু—সন্ত্রাস দমন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-বাংলাদেশের ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের বড় অংশই ঝুঁকিপূর্ণ ও নদীনির্ভর। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা যেকোনো সময় বাস্তুচ্যুতি বা উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ছাত্র-জনতার উল্লাস। ছবি: সংগৃহীত।লন্ডনের সোয়াস (এসওএএস) বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ অরবিন্দ পালিওয়াল বলেন, ‘ভারতের এখন তাড়া করার দরকার নেই।’ তার মতে, সামনে এগোতে হলে দরকার নীরব ও ধৈর্যশীল যোগাযোগ—ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে, এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গেও।
ড. পালিওয়াল মনে করেন, আগামী ১২ থেকে ১৮ মাস সম্পর্ক অস্থিরই থাকবে। পরিস্থিতির তীব্রতা নির্ভর করবে আগামী বছরের নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর। তিনি বলেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারে এবং নতুন নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেয়, তাহলে দুই দেশের জন্য সম্পর্ক পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি হতে পারে। তাতে ক্ষতি সীমিত রাখা সম্ভব।
বর্তমান অনিশ্চয়তায় দিল্লিকে শুধু তাৎক্ষণিক কৌশলগত সিদ্ধান্তই নয়, বরং নীতিগত প্রশ্নও বিবেচনা করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো—বন্ধুপ্রতিম সরকারগুলোকে ভারত কীভাবে আশ্বাস দেবে যে সংকটেও তাদের পাশে থাকবে, অথচ আবার এমন অভিযোগও আসবে না যে ভারত মানবাধিকার প্রশ্নে সমস্যাযুক্ত নেতাদের রক্ষা করছে?
পালিওয়ালের মতে, এর কোনো সহজ সমাধান নেই। বরং গভীরতর প্রশ্ন হলো—ভারত কী এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে এক নেতার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা গড়ে উঠেছিল? অর্থাৎ, দিল্লি কি খুব বেশি ‘এক ঝুড়িতে সব ডিম রেখেছিল’?
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, বন্ধুসুলভ এবং কাজ এগোতে সহায়তা করে—তার সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখা হয়। এতে পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। পররাষ্ট্রনীতি জনমত বা নৈতিকতার ওপর চলে না—রাষ্ট্রের সম্পর্ক সাধারণত তেমন হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সেখানে বিভাজন গভীর, দলীয় দ্বন্দ্ব তীব্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল।’
ভারত এই গভীর রাজনৈতিক ফাটল মেরামত করতে পারবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। একই সঙ্গে এই সমীকরণের বড় অংশ নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামী সরকারের ওপর। কুগেলম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন সরকার হাসিনা ফ্যাক্টরকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পরিচালনা করবে, সেটাই আসল। যদি এই ইস্যুকেই সম্পর্কের নিয়ন্ত্রক করে তোলে, তাহলে এগোনো কঠিন হবে।’
অবশেষে, নতুন নির্বাচিত সরকারকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। একদিকে বাংলাদেশের মূল স্বার্থ রক্ষা করতে হবে, যেমন সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ। অন্যদিকে দেশীয় রাজনীতি এবং জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাবও সামলাতে হবে। কুগেলম্যানের মূল্যায়ন হলো, বড় কোনো সংকট নাও দেখা দিতে পারে, তবে সম্পর্ক নাজুকই থাকবে।
(বিবিসির ভারত সংবাদদাতা সৌতিক বিশ্বাসের নিবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ)