leadT1ad

ঘরে ঘরে লাশের মিছিল: ভূমিকম্পে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আফগানদের

প্রতিটি ঘরে মৃত্যু নেমে এসেছে। প্রতিটি ভেঙে পড়া ছাদের নিচে লাশ পড়ে আছে। কাদামাটির ঘরগুলো একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। মানুষ মরিয়া হয়ে সাহায্য চাইছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ০৯
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ২৬
আফগানিস্তানের কুনার ও নানগারহার প্রদেশে ভূমিকম্পে নিহত ৮০০-র বেশি মানুষ। সংগৃহীত ছবি।

গত রবিবার মধ্যরাতের কিছু আগে আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশের পিরান গ্রামে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। হামিদ জান তখন ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। তাদের ছোট ঘরটি প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠে। তিনি দেখতে পান, দেয়ালে ফাটল ধরছে।

হামিদ দ্রুত শোয়া থেকে উঠে সন্তান ও বাবা-মায়ের ঘরে ছুটে যান। দুই সন্তানকে বাইরে নিরাপদে নিতে সক্ষম হন। পরে স্ত্রী ও ছোট ভাইবোনদের বাঁচাতে আবার ঘরে ঢুকলে ছাদ ও দেয়াল তার উপর ভেঙে পড়ে। তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। নিজে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। পাঁচ ঘণ্টা পর গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে।

বের হওয়ার পর তিনি এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখেন। তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই ভাই মারা গেছেন। শক্তিশালী ভূমিকম্পে পুরো অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দরিদ্র, পাহাড়ি কুনারে ঘরগুলো ছিল কেবল কাদামাটির। ভূমিকম্পের ধাক্কায় সেসব ঘর মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে বা আকস্মিক বন্যার পানির তোড়ে ভেসে যায়।

হামিদ জান বলেন, ‘মনে হচ্ছিল পুরো পাহাড় যেন আমাদের ওপর ভেঙে পড়ছে। গ্রাম একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’ আফগান জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও জানায়, কুনার প্রদেশের কয়েকটি গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারি হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়েছে। আহত প্রায় ৩ হাজার মানুষ। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ। উদ্ধারকাজে ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো লাশ বের করা হচ্ছে। স্থানীয় সব হাসপাতাল জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।

চার বছর আগে ক্ষমতায় আসা তালেবান সরকার হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে। তবে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এখনো অনেক জায়গায় উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

কুনার প্রদেশের আরেক বাসিন্দা সানাউল্লাহ ভূমিকম্পের সময় গ্রামে ছিলেন না। সোমবার ফিরে এসে তিনি দেখেন, তার ঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভাই ও ভাইয়ের পাঁচ সন্তান নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ গল্প এখানে প্রতিটি ঘরের। আমি যাদের চিনি, সবাই অন্তত পরিবারের তিন থেকে পাঁচজনকে হারিয়েছেন।’

কুনারের এক আলেম আব্দুর রহিম জানান, মাজার উপত্যকার কবরস্থানগুলোতে মৃতদেহ উপচে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘যেদিকেই তাকাই, মানুষ কাঁদছে ও একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। গণকবর খোঁড়ার পরও জায়গা শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতি আধঘণ্টায় নতুন লাশ আসছে, তাই মানুষ আগেভাগে কবর খুঁড়তে ব্যস্ত।’

আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে ভূমিকম্পে কয়েকটি গ্রামের সব ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। সংগৃহীত ছবি।
আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে ভূমিকম্পে কয়েকটি গ্রামের সব ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। সংগৃহীত ছবি।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন মতে, অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তালেবান সরকারের উদ্ধারকাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলার মতো জনবল, সম্পদ ও অর্থ তালেবানের নেই। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে আফগানিস্তানে এনজিওগুলোর কাজ ক্রমেই কঠিন হয়ে গেছে। নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোও প্রায় সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করেছে।

তালেবান মুখপাত্র সুহেল শাহিন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এখনো অনেক গ্রামে পৌঁছানো যায়নি। আমি আশঙ্কা করছি, হতাহতের সংখ্যা ভয়াবহ।’

মাজা দারা এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘নারী ও শিশুরা সাহায্যের জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘মানুষ ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছে। আমরা চোখের সামনে তাদের মরতে দেখছি, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। জীবিতদের বের করার কেউ নেই, মৃতদের সরানোরও কেউ নেই।’

কুনারের নুর গুল জেলার শ্রমিক মুহাম্মদ আজিজ জানান, ভূমিকম্পে তার পাঁচ সন্তানসহ ১০ জন আত্মীয় নিহত হয়েছেন। এখনো গ্রামের অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।

তিনি বলেন, ‘এই এলাকার গরিব মানুষ সবকিছু হারিয়েছে। প্রতিটি ঘরে মৃত্যু নেমে এসেছে। প্রতিটি ভেঙে পড়া ছাদের নিচে লাশ পড়ে আছে। কাদামাটির ঘরগুলো একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। মানুষ মরিয়া হয়ে সাহায্য চাইছে।’

কুনার প্রদেশের এক উচ্চপদস্থ তালেবান কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, উদ্ধারকাজে এখন মূল লক্ষ্য জীবিতদের খোঁজা, মৃতদের নয়। তিনি বলেন, ভূমিধসে অধিকাংশ সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহতদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। হেলিকপ্টারের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, রোববার রাতের ভূমিকম্পে ১২ লাখেরও বেশি মানুষ প্রবলভাবে কেঁপে ওঠার অনুভূতি পেয়েছেন। রাতভর অন্তত পাঁচটি আফটারশক রেকর্ড করা হয়। রোববার মধ্যরাতে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের চারটি প্রদেশে আঘাত হানে। এর মধ্যে দুর্গম পাহাড়ি কুনার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিধস ও বন্যার সৃষ্টি হয়।

উদ্ধারকারীরা সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছাতে লড়াই করছেন। এসব এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। পাহাড়ি ঢালে ছড়ানো কাদামাটির ঘরগুলো ধসে পড়েছে। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয়ের (ইউএনওসিএইচএ) কর্মকর্তা কেট ক্যারি রয়টার্সকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের আগের ২৪-৪৮ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টি হয়েছে। তাই ভূমিধস ও পাথর ধসে পড়ার ঝুঁকি এখনো বেশি। এ কারণেই অনেক রাস্তা অচল হয়ে আছে।’

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের একটি কুনারের নুরগাল জেলার এক বাসিন্দা জানান, তাদের প্রায় পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছে। তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, ‘শিশুরা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে। বয়স্করা চাপা পড়ে আছে। তরুণরাও ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত