leadT1ad

মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করলেন ট্রাম্প

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে গ্যারান্টার হিসেবে স্বাক্ষর করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। সোমবার (১৩ অক্টোবর ২০২৫) মিশরের শার্ম আল-শেখ শহরে এক ঐতিহাসিক শান্তি সম্মেলনে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কাতার, মিশর ও তুরস্কের নেতারাও এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তারাও গ্যারান্টার হিসেবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। প্রায় দুই বছরব্যাপী ইসরায়েলি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এই চুক্তি কার্যকর হয়। ট্রাম্প একে আখ্যা দেন ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূচনা’ হিসেবে।

চুক্তিতে জিম্মিদের মুক্তি, বন্দি বিনিময় ও ধাপে ধাপে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে। চুক্তিটির বাস্তবায়ন পক্রিয়া শুরু হয়েছে গত ১১ অক্টোবর এবং প্রাথমিক বন্দি বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে ১৩ অক্টোবর। হোয়াইট হাউস চুক্তির পূর্ণাঙ্গ পাঠ প্রকাশ করেছে। তবে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।

এই অনুষ্ঠান ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার পরিণতি। কাতার, মিশরসহ আরব মধ্যস্থতাকারীদের সহযোগিতায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। গতকাল ট্রাম্প ইসরায়েলি সংসদেও ভাষণ দেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই চুক্তির কৃতিত্ব দাবি করেন এবং ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার কথা উল্লেখ করেন—গত দুই বছরে যা ছিল ২১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ।

চুক্তির প্রথম ধাপে যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা বিতরণ ও বন্দি বিনিময়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ধাপে পুনর্গঠন ও আঞ্চলিক স্বাভাবিকীকরণের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

হোয়াইট হাউস চু্ক্তির পূর্ণাঙ্গ নথি প্রকাশ করেছে। এতে যুদ্ধবিরতি রক্ষা, মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার নিয়মাবলি উল্লেখ রয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী নির্ধারিত সীমায় সরে যেতে শুরু করেছে। এর ফলে উত্তর গাজার ধ্বংসস্তূপে হাজারো ফিলিস্তিনি ফিরে যেতে পারছেন। হামাসও চুক্তি মেনে চলার কথা নিশ্চিত করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধ বন্ধের লিখিত নিশ্চয়তার কথা উল্লেখ করেছে।

কাতার, মিশর ও তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত।
কাতার, মিশর ও তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত।

মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের বক্তব্যের মূল দিকগুলো

ইসরায়েল ও মিশরে দেওয়া ট্রাম্পের ভাষণে তার আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়। বিশ্লেষণে পাঁচটি মূল দিক চিহ্নিত হয়েছে—

নতুন মধ্যপ্রাচ্য: ট্রাম্প এই চুক্তিকে স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বিনিয়োগের পথ খুলে দেওয়ার উদ্যোগ হিসেবে তুলে ধরেন। তবে সমালোচকেরা বলেন, এতে ইসরায়েলের দখলনীতি, পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপন ও লেবানন-সিরিয়ায় হামলার বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে।

নেতানিয়াহুর প্রতি সমর্থন: দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য ট্রাম্প ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সহায়তাকে ইসরায়েলের সামরিক সাফল্যের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরেন।

আন্তর্জাতিক চাপের প্রভাব: গাজায় ইসরায়েলি হামলার কারণে বৈশ্বিক জনমত বদলে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ট্রাম্প বলেন, এই সময়েই যুদ্ধবিরতি উদ্যোগ নেওয়া সঠিক ছিল। এতে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে ইসরায়েল পুনরায় সমর্থন পেয়েছে, যদিও অনেকে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশে বার্তা: ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের ‘সহিংসতা ত্যাগ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আসার’ আহ্বান জানান। তবে তিনি বাস্তুচ্যুতি, দখল বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তার বক্তব্যে ফিলিস্তিনিদের ভূমিকা সীমিত রাখা হয়েছে কেবল ‘শান্তি গঠনের অংশীদার’ হিসেবে।

ইরানের প্রতি মিশ্র বার্তা: ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এতে আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথ তৈরি হয়েছে। তবে তিনি বলেন, তেহরান আগ্রহ দেখালে ভবিষ্যতে আলোচনা ও নিষেধাজ্ঞা শিথিলের সুযোগ থাকবে।

জিম্মি ও বন্দি বিনিময়

চুক্তির অন্যতম প্রধান অংশ হিসেবে বন্দি ও জিম্মি বিনিময় শুরু হয় ১৩ অক্টোবর। হামাস দুই বছর ধরে আটক রাখা শেষ ২০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল দ্বৈত নাগরিক। এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দি ও আটক ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়। উভয় পক্ষের পরিবারগুলো আবেগঘন মুহূর্তে পুনর্মিলিত হয়। ইসরায়েল ‘অপারেশন রিটার্নিং হোম’ নামে একটি অভিযান চালায়, যাতে মুক্তদের ঘরে ফেরানো সহজ হয়।

১৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিনিময়ের সব ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। কোনো ধরনের লঙ্ঘনের খবর পাওয়া যায়নি।

মিশরে শান্তি সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত।
মিশরে শান্তি সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

চুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া মিশ্র হলেও সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক। ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘সংঘাতের অবসান ঘটেছে’, এবং গাজার পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এই সাফল্যের কৃতিত্ব ট্রাম্পকে দেন। বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও বলেন, বাইডেন প্রশাসনের সময়কার জানুয়ারির স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতিই এই অগ্রগতির ভিত্তি তৈরি করেছিল, তখন ১৩৫ জন জিম্মি মুক্তি পেয়েছিল।

আরব মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে কাতারের আমির বিশেষ প্রশংসা পান ট্রাম্পের কাছ থেকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (পূর্বের টুইটার) মানুষ ট্রাম্পের পুরো বক্তব্য শেয়ার করে প্রশংসা জানায়, একে ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ভোর’ বলে আখ্যা দেয়। তবে সাবেক অস্ট্রেলীয় সিনেটর ডাগ ক্যামেরনসহ সমালোচকেরা বলেন, চুক্তিতে গাজার ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে কোনও কথা বলা হয়নি বা ক্ষমাও প্রার্থনা করা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন একে ‘আমেরিকান শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ বলে বর্ণনা করেন এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়ার সম্ভাবনার আশা প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, চুক্তিতে গণহত্যার অভিযোগের জবাবদিহি অনুপস্থিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চুক্তি ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে এবং আরব–ইসরায়েল স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে। তবে ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি এখনো প্রধান দাবি।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে। ট্রাম্প আশাবাদী যে, চুক্তির নিয়ম অনুসারে এটি টিকবে। আসন্ন সম্মেলনগুলোয় গাজার পুনর্গঠন তহবিল ও দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় সৌদি আরব যুক্ত হতে পারে।

তবে স্থায়ী শান্তির জন্য দখল, বসতি স্থাপন ও মানবাধিকার ইস্যুর সমাধান অপরিহার্য। আল-জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই সাফল্য ট্রাম্পের রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু ন্যায্য সমাধান বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হবে। তাই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সূত্র: আল-জাজিরা

Ad 300x250

সম্পর্কিত